ইসলামের সত্যতা ও কুরআনের চ্যালেঞ্জ

মাওলানা লিয়াকত আলী | Mar 22, 2021 01:27 pm
ইসলামের সত্যতা ও কুরআনের চ্যালেঞ্জ

ইসলামের সত্যতা ও কুরআনের চ্যালেঞ্জ - ছবি সংগৃহীত

 

আল্লাহ তায়ালা যে নবী বা রাসূলকেই শরিয়ত ও কিতাব দিয়ে মানবজাতিকে সুপথ প্রদর্শনের জন্য পাঠিয়েছেন, তাকে এমন কিছু উপাদান দিয়ে সহায়তা করেছেন, যা তার নবী-রাসূল হওয়ার ও তার প্রচারিত শরিয়ত আল্লাহপ্রদত্ত হওয়ার দাবির সত্যতা ও প্রমাণ বহন করে। ইতঃপূর্বেকার নবী-রাসূলগণের নবুওয়াত ও রিসালাতের পক্ষে যেসব প্রমাণ ছিল, তার সবগুলোই এবং আরো বেশি বিদ্যমান ছিল শেষনবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের নবুওয়াত ও তার প্রচারিত শরিয়ত আল্লাহপ্রদত্ত হওয়ার দাবির সত্যতা প্রমাণের পক্ষে। এ জন্য যদি কেউ হজরত ইবরাহিম, হজরত মূসা, হজরত ঈসা আলায়হিমুস সালামের বা অন্য কোনো নবীর নবুওয়াতে বিশ্বাস করে অথচ মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের নবুওয়াতে অবিশ্বাস করে, তাহলে সে হবে স্ববিরোধী। বস্তুত তার এই বিশ্বাস ও অবিশ্বাসের পেছনে রয়েছে অজ্ঞতা, গোঁড়ামি ও অন্ধ অনুকরণ। কেননা অন্য কোনো নবীর নবুওয়াতে বা কোনো রাসূলের রিসালাতে তার বিশ্বাসের পেছনে যেসব যুক্তি ও প্রমাণ ছিল, তার সবই এবং আরো যুক্তি ও প্রমাণ রয়েছে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের নবুওয়াতের পক্ষে। এই সাধারণ বক্তব্যের পরেও হজরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের নবী হওয়ার ও তার ওপর নাজিল হওয়া কুরআন মাজিদ আল্লাহর কিতাব হওয়ার পক্ষে কয়েকটি প্রমাণ উল্লেখ করা আরো সহায়ক হবে বলে মনে করছি।

প্রথমত নবী করীম সা:-এর জীবনচরিত। শৈশব থেকে মৃত্যু পর্যন্ত তিনি ছিলেন উৎকৃষ্ট মানবিক গুণাবলির সর্বোচ্চ স্তরের অধিকারী, যা তার ঘোরতর শত্রুরাও অকপটে স্বীকার করত। এমন নিষ্কলুষ চরিত্রের একজন ব্যক্তির পক্ষে আল্লাহ তায়ালা সম্পর্কে মিথ্যা দাবি করা কিভাবে সম্ভব হতে পারে? সুস্থ বিবেক বুদ্ধির মানুষদের জন্য শুধু এতটুকুই যথেষ্ট। প্রথম দিন হজরত জিবরাইলের মাধ্যমে ওয়াহি লাভের পর তিনি যখন হজরত খাদিজার কাছে এসে ঘটনা বর্ণনা করেছিলেন, তখন হজরত খাদিজা রা. তাঁকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে এই যুক্তিই দিয়েছিলেন যে, এমন উন্নত চরিত্রের কোনো মানুষকে আল্লাহ তায়ালা কখনো অপদস্থ করেন না। হজরত খাদিজা রা. বলেছিলেন, আপনি সুসংবাদ নিন। নিশ্চয়ই আল্লাহ আপনাকে কখনোই অপদস্থ করবেন না। কেননা আপনি অসহায়ের দায় বহন করেন, দুর্বলকে সহায়তা করেন... এভাবে তিনি তাঁর উন্নত চরিত্র বৈশিষ্ট্য ও মাধুর্যপূর্ণ জীবনাদর্শ তুলে ধরেছিলেন।

দ্বিতীয় প্রমাণ স্বয়ং এই মহান শরিয়ত। এমন সংহত সামগ্রিক সার্বজনীন চিরন্তন শরিয়ত এমন একজন ব্যক্তির পক্ষে উপস্থাপন করা কিভাবে সম্ভব যিনি লালিত পালিত হয়েছেন জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা থেকে মুক্ত আরব সমাজে? আবার তিনি অক্ষরজ্ঞানেরও অধিকারী ছিলেন না। এই শরিয়ত যদি সৃষ্টিকর্তার প্রত্যাদেশ না হতো, তাহলে এমন একজন ব্যক্তির বুদ্ধিবৃত্তির পরিপক্বতা ও চিন্তার প্রসারতা যতই হোক না কেন, তার পক্ষে এমন শরিয়ত উপস্থাপন করা সম্ভব হতো না। আইনশাস্ত্র, সমাজবিজ্ঞান ও অন্যন্য বিদ্যার বিশেষজ্ঞরা এই প্রমাণটি অনুধাবন ও মূল্যায়ন করতে পারেন।
তৃতীয়ত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম যে সত্যিই একজন নবী ছিলেন এবং তার প্রচারিত ধর্ম আল্লাহর প্রত্যাদেশ, তার সবচেয়ে বড় যে প্রমাণ আমাদের সামনে বিদ্যমান রয়েছে এবং চিরকাল বিদ্যমান থাকবে তা হলো কুরআন মাজিদ। এই কিতাবের অলৌকিকতা স্থির প্রমাণিত। বিষয়টি নিয়ে একটু বিস্তারিত আলোচনা করা প্রয়োজন বোধ হচ্ছে।

ইসলামের ইতিহাস যারা অবগত, এমন সবার কাছে পরিষ্কার যে, মক্কার বাসিন্দারা ও স্বয়ং কুরাইশরা প্রথমে ইসলামের দাওয়াতের বিরোধিতা করেছিল। তারা প্রথমে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের নবুওয়াত মেনে নেয়নি। তারা বিশ্বাস করতে চায়নি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর নবী এবং কুরআন মাজিদ আল্লাহর কিতাব। তাই প্রথমেই মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের সাথে কুরাইশ এবং অন্য সব বিরোধী-অস্বীকারকারী-বিদ্বেষীর যেসব ঘটনা ঘটেছিল, সেগুলোর মধ্যে একটি ছিল এই যে, তিনি আল্লাহর প্রত্যাদেশ অনুযায়ী তাদেরকে কুরআন নিয়ে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিলেন। ইরশাদ করা হয়- বলুন, যদি মানুষ ও জিনেরা একত্র হয় এ জন্য যে, তারা এই কুরআনের অনুরূপ উপস্থাপন করবে, তাহলে তারা তা উপস্থাপন করতে পারবে না- যদিও তারা পরস্পরের সহায়ক হয়। (সূরা বনি ইসরাইল, আয়াত ৮৮)

এই চ্যালেঞ্জে বিরোধীরা নীরব হয়ে যায়। তারা এই চ্যালেঞ্জ নাকচ করতে বা এর জবাব দিতে অপারগ হয়ে যায়। তারপর আল্লাহর রাসূল তাদেরকে আবার চ্যালেঞ্জ জানালেন এবং তাদেরকে সেই কথা বললেন যা আল্লাহ তার কাছে ওয়াহি পাঠালেন। ইরশাদ হলো- তারা কি বলছে যে তিনি এটিকে রচনা করেছেন? বলুন তাহলে তোমরা অনুরূপ দশটি সূরা রচনা করে উপস্থাপন করো এবং আল্লাহ ব্যতীত যাকে পার আহ্বান জানাও- যদি তোমরা সত্যবাদী হও। (সূরা হুদ, আয়াত ১৩)

তখনো তারা নীরব রইল এবং অপারগ হয়ে গেল। তারপর আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম আবার তাদেরকে চ্যালেঞ্জ জানালেন এবং তাদেরকে বললেন যা তাকে বলার আদেশ করা হলো। ইরশাদ হলো- এই কুরআন আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো পক্ষ থেকে রচিত হওয়ার মতো নয়। বরং তা ইতঃপূর্বে যা রয়েছে তার প্রত্যয়নকারী ও গ্রন্থের বিস্তৃতি। এতে কোনো সন্দেহ নেই, এটি জগৎগুলোর প্রতিপালকের পক্ষ থেকে। তারা কি বলে যে, তিনি তা রচনা করেছেন? বলুন, তাহলে তোমরা অনুরূপ একটি সূরা উপস্থাপন করো এবং আল্লাহ ব্যতীত যাকে পার আহ্বান জানাও যদি তোমরা সত্যবাদী হও। (সূরা ইউনুস, আয়াত ৩৭-৩৮)

আরো ইরশাদ হয়েছে আমরা আমাদের বান্দার প্রতি যা অবতীর্ণ করেছি, তাতে তোমরা সন্দিহান হলে অনুরূপ একটি সূরা উপস্থাপন করো এবং আল্লাহ ব্যতীত তোমাদের সাক্ষীদের আহ্বান জানাও যদি তোমরা সত্যবাদী হও। যদি তোমরা তা না কর এবং কখনো করবেও না, তাহলে সেই আগুনের ভয় করো যার ইন্ধন হবে মানুষ ও পাথর, যা প্রস্তুত রাখা হয়েছে অবিশ্বাসীদের জন্য। (সূরা বাকারা , আয়াত ২৩-২৪)

মহানবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের পক্ষ থেকে কুরাইশ ও অন্যসব বিরোধীর প্রতি ছুড়ে দেয়া চ্যালেঞ্জের পরিণতি দাঁড়িয়েছিল এই যে, তারা এই চ্যালেঞ্জের জবাব দিতে এমনকি জবাব দেয়ার চেষ্টা করতেও সক্ষম হয়নি। তারা নীরব হয়ে যায় এবং বিরোধিতার অন্য উপায় অবলম্বন করে। তা হলো মিথ্যা ও অপপ্রচার, শক্তিপ্রয়োগ ও ভীতি সঞ্চারের মাধ্যমে আল্লাহর পথ থেকে লোকদের বাধা দেয়া এবং নিজেদের লোকদের প্রতি এ মর্মে উপদেশ দেয়া যে, তারা যেন কুরআনের পাঠ না শোনে। কেননা এতে তারা প্রভাবিত হতে পারে। তাদের এ পদ্ধতির কথা আল্লাহ তায়ালা জানিয়ে দিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে- অবিশ্বাসীরা বলে তোমরা এই কুরআন শুনবে না এবং এর আবৃত্তিতে হট্টগোল সৃষ্টি কর, হয়তো তোমরা জয়ী হবে। ( সূরা হা-মীম সিজদা, আয়াত ২৬)

যাকে বা যাদেরকে চ্যালেঞ্জ জানানো হয়, সে বা তারা যদি সেই চ্যালেঞ্জের জবাব দিতে অক্ষম হয়, তাহলে চ্যালেঞ্জকারীর ও তার দাবির সত্যতা প্রমাণিত হয়। তেমনি যারা এ চ্যালেঞ্জের জবাব দিতে অক্ষম হয়, তাদের মিথ্যা ও অসারতা প্রমাণিত হয়। তবে এই প্রমাণ তখন হয়, তখন চ্যালেঞ্জটিতে অপরিহার্য শর্তগুলো পাওয়া যায়। তাহলেই এই চ্যালেঞ্জ যথার্থ হয় এবং তা থেকে এই প্রমাণ ও ফল পাওয়া যায়। প্রশ্ন হলো চ্যালেঞ্জ যথার্থ হওয়ার জন্য শর্তগুলো কী এবং এসব শর্ত এ ক্ষেত্রে পূরণ হয়েছিল কি না।

যথার্থ চ্যালেঞ্জের শর্ত

প্রথমত যাদের প্রতি চ্যালেঞ্জ জানানো হবে, চ্যালেঞ্জের বিষয়বস্তুটি তাদের সক্ষমতার আওতায় থাকতে হবে। বরং তা তাদের বৈশিষ্ট্যাবলির অন্তর্গত হতে হবে এবং তারা যেন সেই বিষয়ে অসাধারণ, অগ্রগামী ও প্রসিদ্ধ হয়। যেমন একজন কুস্তিগির যদি অন্য কুস্তিগিরদের প্রতি চ্যালেঞ্জ জানায় যে, সে-ই সেরা কুস্তিগির, তাকে হারানোর মতো কেউ নেই। এতে কারো সন্দেহ থাকলে সে যেন তার সাথে প্রতিযোগিতায় এগিয়ে আসে। এখানে চ্যালেঞ্জের বিষয়বস্তু হলো কুস্তি। আর যাদের প্রতি চ্যালেঞ্জ জানানো হয়েছে, তাদের বিশেষত্বই হলো কুস্তিগিরি।

যথার্থ চ্যালেঞ্জের দ্বিতীয় শর্ত যাদের প্রতি চ্যালেঞ্জ জানানো হবে, তাদের আগ্রহ থাকতে হবে চ্যালেঞ্জকারীর জবাব দেয়ার ও তার দাবিকে মিথ্যা প্রমাণিত করার। অতএব চ্যালেঞ্জ থেকে সঠিক প্রমাণ পাওয়া ও চ্যালেঞ্জের যথার্থতার জন্য শুধু প্রথম শর্তটি যথেষ্ট নয়। কেননা যাকে বা যাদেরকে চ্যালেঞ্জ জানানো হয়, সে বা তারা অনেক সময় চ্যালেঞ্জকারীর দাবি মিথ্যা প্রমাণে আগ্রহী বা উৎসাহী হয় না। ফলে সে বা তারা চুপ থাকে এবং জবাব দেয় না। সুতরাং এই চুপ থাকা তার বা তাদের অক্ষমতা বোঝায় না। আর এতে চ্যালেঞ্জকারীর দাবির সত্যতা প্রমাণিত হয় না। যেমন দু’জন কুস্তিগিরের একজন চ্যালেঞ্জ জানাল যে, তাকে পরাস্ত করার মতো কেউ থাকলে যেন এগিয়ে আসে। কিন্তু অপর কুস্তিগির আপনজন ও পরিচিত হওয়ায় এই চ্যালেঞ্জের জবাব দিতে আগ্রহ বা উৎসাহ রাখে না। অথবা চ্যালেঞ্জকারীকে হেয় দৃষ্টিতে দেখার কারণে এই চ্যালেঞ্জকে গুরুত্বের সাথে নেয় না। এ জন্য তার জবাব দেয়া প্রয়োজন মনে করে না।

তৃতীয়ত যাকে বা যাদেরকে চ্যালেঞ্জ জানানো হবে, তার বা তাদের যদি এই চ্যালেঞ্জের জবাব দেয়ার ক্ষেত্রে কোনো বাধার মুখে পড়তে হয় এবং এ জন্য সে বা তারা সেই চ্যালেঞ্জের জবাব না দেয়, তাহলেও চ্যালেঞ্জকারীর দাবির সত্যতা প্রমাণিত হয় না। বাধা বলতে চ্যালেঞ্জকারীর ভয়। তার প্রভাব, কর্তৃত্ব ও প্রতিশোধের ক্ষমতা থাকলে এই চ্যালেঞ্জের জবাব দিতে কেউ অগ্রসর হবে না। এ জন্য তৃতীয় এই শর্তটি পাওয়া না গেলে প্রথম দুই শর্তের ভিত্তিতে চ্যালেঞ্জের যথার্থতা প্রমাণিত হবে না। একজন রাষ্ট্রপ্রধান ঘোষণা করলেন, তিনিই জনগণের পছন্দের নেতা। অন্য কাউকে জনগণ পছন্দ করে না। কেউ মানতে না চাইলে সামনের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমে দেখুক জনগণ কাকে ভোট দেয়। কিন্তু তার প্রতিপক্ষরা জানে, নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চাইলে রাষ্ট্রযন্ত্রের সব শক্তি ব্যবহার করে তাকে শায়েস্তা করা হবে। এ জন্য কেউ প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামে না বা নামতে সাহস পায় না। তারা নীরবে এই চ্যালেঞ্জ শুনতে থাকে। কিন্তু তাদের এই নীরবতা ক্ষমতাসীন রাষ্ট্রপ্রধানের দাবির যথার্থতা প্রমাণ করে না।

কোনো চ্যালেঞ্জ যথার্থ ও ফলপ্রসূ বলে বিবেচিত হওয়ার জন্য এই শর্তগুলো পূরণ হওয়া প্রয়োজন। এখন আমরা দেখতে চাই আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের ভাষায় কুরআন মাজিদ সম্পর্কে যে চ্যালেঞ্জ জানানো হয়েছিল, তাতে এই সব শর্ত পূরণ হয়েছিল কি না। বস্তুত যেসব শর্তের কথা উল্লেখ করা হলো, তার সবই পূর্ণরূপে বিদ্যমান ছিল বিরোধীদের প্রতি কুরআন মাজিদের চ্যালেঞ্জের ক্ষেত্রে। প্রথম শর্তটির প্রসঙ্গই আগে আলোচনা করা যায়। তা হলো- যাদের প্রতি চ্যালেঞ্জ জানানো হয়, চ্যালেঞ্জের বিষয়বস্তু তাদের বৈশিষ্ট্যের অন্তর্গত হওয়া। সবাই জানে যে, সাধারণভাবে আরবরা ও বিশেষভাবে কুরাইশরা আরবি ভাষা ও সাহিত্যের শৈলী ও অলঙ্কারে বিশেষ দূরদর্শী হিসেবে প্রসিদ্ধ ছিল। তাদের দৈনন্দিন সংলাপ, বক্তৃতা, গদ্য, পদ্য সব কিছুতে তাদের এই বিশেষ রুচি ও প্রতিভার প্রকাশ পেত। এমনকি সেরা কবিতা নির্বাচনের জন্য তাদের নিয়মিত মেলা ও আসর বসত।

এদিকে কুরআন মাজিদ নাযিল হয়েছে আরবদের ভাষায়। তারপর তাদেরকে চ্যালেঞ্জ জানানো হলো যে, এই কুরআন আল্লাহর বাণী, যা রাসূল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের প্রতি নাজিল করা হয়েছে। তোমাদের যদি এ ব্যাপারে সন্দেহ থাকে, তাহলে তোমরা উপস্থিত করো এটির অনুরূপ অথবা এটির অনুরূপ দশটি সূরা অথবা এটির অনুরূপ একটি সূরা। তাদেরকে চ্যালেঞ্জ জানানো হলো এমন একটি বিষয়বস্তুতে, যা তাদের বৈশিষ্ট্যের অন্তর্গত এবং তারা এতে পারদর্শী। অতএব বিরোধীদের প্রতি কুরআন মাজিদের চ্যালেঞ্জের এই শর্তটি বিদ্যমান ছিল। দ্বিতীয় শর্ত ছিল চ্যালেঞ্জ গ্রহণে আগ্রহ। এটিও এখানে বিদ্যমান। কেননা ইসলামের ইতিহাসের প্রাথমিক জ্ঞান আছে, এমন যে কেউ জানে কুরাইশরা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের নবুওয়াতের দাবিকে মিথ্যা প্রমাণের জন্য এবং তিনি নবী নন বলে প্রমাণের জন্য সদা তৎপর ছিল। তারা কিছুতেই মানতে রাজি ছিল না যে, মুহাম্মাদ সা: আল্লাহর রাসূল। আবদুল্লাহর পুত্র মুহাম্মাদের নবী হওয়ার দাবি মিথ্যা প্রমাণের জন্য তারা চেষ্টার ত্রুটি করেনি। প্রথমে তারা অবলম্বন করে প্রণোদনার পথ। তারা আবু তালেবের কাছে প্রস্তাব দেয় তিনি যেন তার ভাতিজাকে ইসলাম প্রচারে নিবৃত্ত করেন। বিনিময়ে তারা তাকে এই পরিমাণে অর্থ সম্পদ দেবে, যাতে তিনি হয়ে যাবেন সেরা ধনী এবং তাকে বানানো হবে তাদের নেতা। এতে তিনি হবেন সবচেয়ে ক্ষমতাবান। অথবা তার যে অবস্থা হয়েছে, এ জন্য যদি চিকিৎসার প্রয়োজন পড়ে, তাহলে তারা তাকে নিয়ে যাবে কোনো মানসিক ব্যাধি বিশেষজ্ঞের কাছে। আবু তালেব কুরাইশদের এই প্রস্তাব আল্লাহর রাসূল সা: এর কাছে পেশ করলে, তিনি বলেছিলেন, চাচাজি, আল্লাহর শপথ, তারা যদি এটি পরিত্যাগের বিনিময়ে আমার ডান হাতে সূর্য ও বাম হাতে চন্দ্র এতে দেয়, তবুও আমি তা ছাড়বো না- যতক্ষণ না আল্লাহ এটিকে বিজয়ী করেন কিংবা এ জন্য আমার জীবন চলে যায়।

এরপর তারা অবলম্বন করে হুমকি দেয়া, কষ্ট দেয়া, আল্লাহর রাসূল ও তার অনুসারীদের সাথে অর্থনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করা এবং রাসূলের ওপর এমন বিশেষণ আরোপের পথ যা থেকে তিনি সম্পূর্ণ পবিত্র ছিলেন। যেমন তারা বলল তিনি অপ্রকৃতিস্থ, তিনি জাদুকর, তিনি বানোয়াট কথা বলছেন ইত্যাদি। তারা তাকে ও তার অনুসারীদের নির্যাতনের মাত্রা এতই বাড়িয়ে দেয় যে, কয়েকজন মুসলিম এতে জীবন হারান। তেমনি তাদের এই নির্যাতন থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য কিছু সংখ্যক মুসলমান পার্শ্ববর্তী দেশ আবিসিনিয়া বা ইথিওপিয়ায় দুইবার হিজরত করেন। কুরাইশরা যে আল্লাহর রাসূলের নবুওয়াতের দাবিকে মিথ্যা প্রমাণিত করা ও তার চ্যালেঞ্জের জবাব দিতে পূর্ণ মাত্রায় আগ্রহী ছিল, এ থেকেই স্পষ্ট হয়।

এবার আসা যাক তৃতীয় শর্ত প্রসঙ্গে। তা হলো চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করা ও জবাব দেয়ার ক্ষেত্রে বাধা না থাকা। কুরআন মাজিদের চ্যালেঞ্জের ক্ষেত্রে এই শর্তটিও বিদ্যমান ছিল। কেননা ইসলামের ইতিহাসের একজন নগণ্য ছাত্রও জানে, মক্কায় ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব পুরোপুরি ছিল কুরাইশদের হাতে। অন্য দিকে আল্লাহর রাসূল সা:ও মুসলমানরা ছিলেন দুর্বল ও অসহায়। তাদের কোনোই ক্ষমতা কিংবা কর্তৃত্ব ছিল না। এ জন্যই তো অসহনীয়তার এক পর্যায়ে তাদের একটি দল আবিসিনিয়ায় হিজরত করে। তারপর শেষ পর্যন্ত আল্লাহর রাসূল সা: ও মুসলমানরা হিজরত করে মক্কায় চলে যান। সুতরাং কুরআনের চ্যালেঞ্জের জবাব দিতে কুরাইশদের সামনে কোনোই বাধা ছিল না। তারা সক্ষম হলে অবশ্যই প্রমাণ করে ছাড়ত যে, কুরআন মাজিদ আল্লাহর বাণী নয় এবং মুহাম্মাদ সা: আল্লাহর রাসূল নন।

মোটকথা মুশরিকদের প্রতি কুরআনের ছুড়ে দেয়া চ্যালেঞ্জের পরিণতি দাঁড়িয়েছিল এই যে, তারা এই চ্যালেঞ্জের জবাব দিতে সক্ষম হয়নি। সব শর্ত বিদ্যমান থাকার পরও তাদের এই অক্ষমতা থেকে আল্লাহর রাসূলের দাবির সত্যতা প্রমাণিত হয়। প্রমাণিত হয় যে, তিনি আল্লাহর রাসূল এবং কুরআন মাজিদ আল্লাহর বাণী। যখন এটি প্রমাণিত হলো, তখন মানবজাতির ওপর অবশ্যকর্তব্য হয়ে দাঁড়ায় তাকে নবী হিসেবে বিশ্বাস করা, তার অনুসরণ করা, তিনি যে শরিয়ত উপস্থাপন করেছেন তা মেনে নেয়া এবং কুরআন-সুন্নাহের সব বিষয়ে বিশ্বাস স্থাপন করা। সুতরাং মানবজাতির অবশ্য কর্তব্য তাকে নবী হিসেবে বিশ্বাস করা, তাকে অনুসরণ করা, তিনি আল্লাহর পক্ষ থেকে যে মানবজাতির কাছে এটাই কাম্য আল্লাহ তায়ালার।

কুরআন মাজিদের এই চ্যালেঞ্জ স্থায়ী। এই চ্যালেঞ্জ এখনো বহাল এবং কেয়ামত পর্যন্ত যে-ই বা যারাই মুহাম্মাদ সা:কে নবী হিসেবে ও কুরআন মাজিদকে আল্লাহর বাণী হিসেবে বিশ্বাস করতে চাইবে না, তার ও তাদের জন্য এ চ্যালেঞ্জ প্রযোজ্য থাকবে। ইতিহাসের অনেক যুগ পার হয়ে গেল। ইসলাম ও কুরআনের বিরোধিতাকারী সব যুগেই ছিল। ইসলামের ব্যাপারে সন্দেহ সৃষ্টি করতে এবং ইসলামের অনেক বিধান সম্পর্কে আপত্তি জানাতে তাদের ক্লান্ত হতে দেখা যায়নি। কত তথাকথিত বুদ্ধিজীবী, দার্শনিক ও বিশেষজ্ঞের আবির্ভাব হলো। জ্ঞান ও মনীষার দম্ভ দেখাতে তারা কার্পণ্য করলেন না। কিন্তু কুরআন মাজিদের এই চ্যালেঞ্জের জবাব এ পর্যন্ত কেউ দিতে পারেনি, পারবেও না।

সুতরাং কুরআন মাজিদের অলৌকিকতা ও মুহাম্মাদ সা:- এর নবুওয়াতের সত্যতা প্রমাণিত হয়, যা অস্বীকার করার সুযোগ নেই।

 


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us