নানা ধর্মে নারীর মর্যাদা

মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান | Mar 30, 2021 02:29 pm
নানা ধর্মে নারীর মর্যাদা

নানা ধর্মে নারীর মর্যাদা - ছবি : অন্য এক দিগন্ত

 

মানবশিশু স্বাধীন সত্তা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। ছেলে ও মেয়ে একই উৎস থেকে সৃষ্ট। সৃষ্টিগতভাবে মেয়ে বা ছেলে প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্যগত কারণে একে অন্যের ওপর কোনো প্রাধান্য রাখে না। লৈঙ্গিক ভিন্নতার কারণে নারী ও পুরুষ যখন একে অন্যের ওপর অনধিকার চর্চা, বৈষম্য ও প্রাধান্য বিস্তার করতে চায় তখনই অধিকার ক্ষুণœ হয়।

মানব ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ইসলাম ছাড়া পৃথিবীর অন্য কোনো ধর্ম বা সমাজে কন্যা শিশুর উপযুক্ত মর্যাদা স্বীকৃত হয়নি। সর্বত্রই সে ছিল পুরুষের দাসী ও বিলাসিতার সামগ্রী। সব প্রাচীন ধর্ম ও আইনে নারীরা পুরোহিত, স্বামী ও অভিভাবকের অধীন স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যহীন বলে বিবেচিত হয়েছে। বিশ্বের প্রচলিত ধর্মসমূহের বর্ণনার দিকে তাকালে তা সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে।

ইহুদি ধর্মে

ইহুদি ধর্ম কন্যা না নারী সম্বন্ধে যে ধারণা পেশ করে তার সারমর্ম হচ্ছে এই, ‘পুরুষ সৎকর্মশীল ও সৎস্বভাব বিশিষ্ট, আর নারী ভণ্ড ও বদস্বভাবের। পৃথিবীর প্রথম মানব আদি পিতা আদম আলাইহিস্ সালাম চির সুখের স্থান জান্নাতে স্বচ্ছন্দে বসবাস করছিলেন। তাঁর স্ত্রী হাওয়া তাঁকে নিষিদ্ধ গাছের ফল খেতে প্ররোচিত করেন।’’ (‘আফিফী, মুহাম্মদ সাদিক আল-মারতুওয়া, আল-মারআহ ওয়া হুকুকুহা ফিল ইসলাম, বৈরুত: দারুল ইহইয়াইতু তুরাসিল আরাবী, তা. বি, পৃ. ১৩; হুসায়ন, সাদিক, তালীমুল মারআতি ফিল ইসলাম, আল-বাছুল ইসলামী, লক্ষ্মৌ: মুয়াসসাসাতুস সাহাফা ওয়ান নাশর, ১৪২০ হি:, সংখ্যা, ৬. পৃ. ৩৬।’)

ইহুদি ধর্মমতে, নারীর ওপর সৃষ্টিকর্তার চিরন্তন অভিশাপ রয়েছে। নারীর কারণে সবার ধ্বংস অনিবার্য। (ইবঃঃধহু, ঞযব ঊহপুপষড়ঢ়ধবফরধ ইৎরঃধহরপধ, ইড়ধৎফ ড়ভ ঊফরঃড়ৎং, ঈযরপধমড়: গধপৎড়ঢ়ধবফরধ, ১৯৯৫, ১৫ঃয াড়ষ. ঠ, ঢ়. ৭৩২.) এ ধর্মে সামাজিক প্রার্থনায় দশজন পুরুষের উপস্থিতি জরুরি ছিল। কিন্তু নয়জন পুরুষ এবং বহু নারী উপস্থিত থাকলেও প্রার্থনা অনুষ্ঠিত হতো না। কারণ নারী মানুষরূপে গণ্য হতো না। নারী ছিল উপেক্ষার পাত্র। (ঝযধহবৎ, উড়হধষফ ড: অ ঈযৎরংঃরধহ ারবি ড়ভ উরাড়ৎপব, খবরফবহ: ১৯৬৯, ঢ়. ৩১.)

খ্রিষ্টধর্মে

পৃথিবীর অন্যতম ধর্ম হচ্ছে খ্রিষ্টধর্ম। তাদের ধর্মগ্রন্থ বাইবেল। এ ধর্মে নারীরা ছিল চরম অবহেলিত ও নিগৃহীত। খ্রিষ্টানরা নারীকে পাপের প্রতীক বলে বিশ্বাস করতো। তারা মনে করতো, আদম আলাইহিস্ সালামের স্ত্রী হাওয়ার ভুলের কারণে সকল নারীর রক্তে পাপের সঞ্চালন ঘটেছে। খ্রিষ্টান পাদ্রিরা নারীকে নরকের দ্বার (ডড়সধহ রং ফড়ড়ৎ ঃড় যবষষ) এবং মানবের সমস্ত দুঃখ-দুর্দশার কারণ মনে করতো। তারা নারীকে সর্বাপেক্ষা জঘন্যরূপে চিত্রিত ও নিকৃষ্ট বিশেষণে ভূষিত করতো। (কাদের, ড. এম. আব্দুল, নানা ধর্মে নারী, চট্টগ্রাম: ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ১৯৯০, পৃ. ৩৫।)

খ্রিষ্টসমাজ নারীকে আত্মাহীন প্রাণী ও সন্তান উৎপাদনের একটি প্রাকৃতিক যন্ত্ররূপে আখ্যায়িত করেছে। (জাফর, আবু, নারী স্বাধীনতা: ইসলাম ও পাশ্চাত্য বিশ্ব, ঢাকা: পালাবদল পাবলিকেশন্স লি:, ২০০১, পৃ. ৭৩।) তাদের ধারণা, ঈসা আলাইহিস্ সালামকে শুলবরণ করতে হয়েছে নারীর পাপের প্রায়শ্চিত্তের জন্যই। খ্রিষ্টান পাদ্রিদের মতে, “নারী যাবতীয় পাপের উৎস। নারী হচ্ছে শয়তানের প্রবেশস্থল এবং তারা আল্লাহ তাআলার মান সম্মানে বাধা দানকারী।” (আবুল আ’লা, সাইয়েদ, পর্দা ও ইসলাম, ঢাকা : আধুনিক প্রকাশনী, ১৯৮৭, পৃ. ১০।) এ প্রসঙ্গে মোস্তাম নামক এক খ্রিষ্ট ধর্মযাজক বলেন, “নারী এক অনিবার্য আপদ। পরিবার ও সংসারের জন্য হুমকি। মোহনীয় মোড়কে আবৃত বিভীষিকা।’’ (খরনৎধ, ডড়সধহ যড়ড়ফ ধহফ ঃযব ইরনষব, ঘবি ণড়ৎশ, ১৯৬১, ঢ়. ১৮; ড. মুস্তফা আস-সাবায়ী, ইসলাম ও পাশ্চাত্য সমাজে নারী, আকরাম ফারুক অনূদিত, ঢাকা : বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার, ১৯৯৮, পৃ. ১৪।)

সপ্তম শতাব্দীতে ঈড়ঁহপরষ ড়ভ ঃযব রিংব-এর এক অধিবেশন রোম নগরীতে অনুষ্ঠিত হয়। এ অধিবেশনে সর্বসম্মতিক্রমে এ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়: “নারীর কোনো আত্মা নেই’’ (ডড়সধহ যধং হড় ংড়ঁষ.) খ্রিষ্টান সা¤্রাজ্যে নারীদের প্রতি নিষ্ঠুরতা ও অবিচার বর্ণনাতীত। নারী জাতিকে অতীব হীন ও তুচ্ছ প্রতিপন্ন করার ব্যাপারে ইহুদি ও খ্রিষ্টধর্মের প্রবল ভূমিকা রয়েছে। উভয় ধর্মই নারীকে পাপের আদি কারণরূপে আখ্যায়িত করেছে। বাইবেলে সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত আছে যে, “পরে তিনি নারীকে কহিলেন, আমি তোমার গর্ভবেদনা অতিশয় বৃদ্ধি করিব, তুমি বেদনান্তে সন্তান প্রসব করিবে; এবং স্বামীর প্রতি তোমার বাসনা থাকিবে; সে তোমার উপরে কর্তৃত্ব করিবে।” (ঐড়ষু ইরনষব, এবহবংরং, ৩ : ১৬, ঢ়, ৪.)

সেন্ট টমাস ঘোষণা করছেন, “নারী ঘটনাক্রমে সৃষ্ট একটি জীব। এটা জেনেসিস প্রতীকী হয়েছে, সেখানে হাওয়াকে আদমের একটি হাড় থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে।” (সিমোন, ডি. বিভোয়া, দ্য সেকেন্ড সেক্স, ঢাকা: এশিয়াটিক পাবলিকেশন্স, ২০০১, পৃ. ১৫।)

খ্রিষ্টান এক পাদ্রি বলেছেন, “নারী সব অন্যায়ের মূল, তার থেকে দূরে থাকাই বাঞ্ছনীয়। নারী হচ্ছে পুরুষের মনে লালসা উদ্রেককারী। ঘরে ও সমাজে যত অশান্তির সৃষ্টি হয় সব তারই কারণে। আর এ কারণেই তারা নারীর শিক্ষা অধিকার নিষিদ্ধ করে দিয়েছিল।” (ইসলাম ও পাশ্চাত্য সমাজে নারী, পৃ. ১৪।)
মেরি-ওলস্টোনক্রাফট (গধৎু ডড়ষষংঃড়হবপৎধভঃ) উল্লেখ করেন, “রুশো থেকে শুরু করে ড. গ্রেগরি পর্যন্ত যারাই নারীর শিক্ষা ও আচরণ সম্পর্কে কথা বলেছেন, তারা নারীকে দুর্বল এবং নিকৃষ্ট হিসেবে বিবেচনা করেছেন। তাদের মতে, নারীর স্বাধীনতা ভোগ করার ক্ষমতা নেই। পুরুষের মধু সাথী হিসেবেই তাকে ভালো মানায়। আনুগত্য তার প্রধান গুণ। পুরুষের তুলনায় নারীর এই দুর্বলতা প্রাকৃতিক ব্যাপার।” রুশোর এসব ধারণাকে ননসেন্স বলেছেন মেরি। (মোহাম্মদ, আনু, নারী, পুরুষ ও সমাজ, ঢাকা : বইপড়া, ১৯৯৭, পৃ. ১৮১৯।)

গ্রিক সভ্যতা

গ্রিকরা নারীদের সম্পর্কে বলত: “নারী জাতি সব অকল্যাণের মূল।” (হেমা, আসমা জাহান, ইসলামের ছায়াতলে নারী, ঢাকা: আল-এছহাক প্রকাশনী, পৃ. ৩০।) গ্রিক সভ্যতার যুগে নারীকে দুর্বিষহ মানবেতর দুর্গম পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। গ্রিক সভ্যতায় নারী কি মর্যাদার অধিকারী ছিল তা সক্রেটিস এবং এন্ডারস্কির ভাষায় অত্যন্ত সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। সক্রেটিস বলেন, ‘নারী বিশ্বজগতের বিশৃঙ্খল ও ভাঙনের সর্বশ্রেষ্ঠ উৎস। সে দাফালি বৃক্ষের ন্যায়, যা বাহ্যত খুব সুন্দর দেখায়। কিন্তু চড়ুইপাখি তা ভক্ষণ করলে তাদের মৃত্যু অনিবার্য।’ ‘সক্রেটিস বলেন, “ডড়সধহ রং ঃযব মৎবধঃবংঃ ংড়ঁৎপব ড়ভ পযধংব ধহফ ফরংৎঁঢ়ঃরড়হ রহ ঃযব ড়িৎষফ. ঝযব রং ষরশব ঃযব উধভধষর ঞৎবব যিরপয ড়ঁঃধিৎফষু ষড়ড়শং াবৎু নবধঁঃরভঁষ, নঁঃ রভ ংঢ়ধৎৎড়ংি বধঃ ঃযবু ফরব রিঃযড়ঁঃ ভধরষ.” (ঘধুযধঃ অভুধ ধহফ কযঁৎংযরফ অযসধফ, ঞযব ঢ়ড়ংরঃরড়হ ড়ভ ডড়সধহ রং ওংষধস, কঁধিরঃ: ওংষধসরপ নড়ড়শ ঢ়ঁনষরংযবৎং, ১৯৮২, ঢ়. ৯-১০.)

গ্রিক সভ্যতায় নারী সম্পর্কে ধারণা ব্যক্ত করতে যেয়ে এন্ডারসকি বলেন: “অগ্নিদগ্ধ রোগী ও সর্পদংশিত ব্যক্তির আরোগ্য লাভ সম্ভব। কিন্তু নারীর জাদু প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়।” “এন্ডারসকি বলেন, “ঈঁৎব রং ঢ়ড়ংংরনষব ভড়ৎ ভরৎবনঁৎহং ধহফ ঝহধশব-নরঃব; নঁঃ রঃ রং রসঢ়ড়ংংরনষব ঃড় ধৎৎবংঃ ড়িসধহ’ং পযধৎসং.” (ঘধুযধঃ অভুধ ধহফ কযঁৎংযরফ অযসবফ, ঞযব ঢ়ড়ংরঃরড়হ ড়ভ ডড়সধহ রহ ওংষধস, ওনরফ.)
গ্রিক সমাজে বিয়ের ক্ষেত্রে নারীর মতামত বিবেচনাযোগ্য ছিল না। নারীকে তার অভিভাবকের ইচ্ছার কাছে নতি স্বীকার করতে হতো। (অষষবহ, ঊ. অ., ঐরংঃড়ৎু ড়ভ ঈরারষরুধঃরড়হ, ৩ ঢ়ধৎঃ, ঢ়. ৪৪৩.)

রোমান সভ্যতা

বিশ্বের প্রাচীনতম রোমান সভ্যতায় নারীর আইনগত কোনো অধিকার স্বীকৃত ছিল না। নারীরা সামাজিক, নৈতিক তথা শিক্ষা-দীক্ষায় ছিল অবহেলিত ও বঞ্চিত। রোমান সমাজে মেয়ে সন্তানকে আজীবন পিতার অনুগত হয়ে থাকতে হতো। পুরুষের গৃহ সজ্জিত করার জন্য প্রয়োজনীয় আসবাবপত্রের অন্তর্ভুক্ত ছিল নারী। স্বামীর মৃত্যুর পর তার পুত্র বা দেবর-ভাসুরদের তার ওপর আইনানুগ অধিকার জন্মাত। (অষ-ঐধঃরসু, ঝধরফ অনফঁষষধয ঝবরভ, ডড়সধহ রহ ওংষধস, খধযড়ৎব: ওংষধসরপ ঢ়ঁনষরপধঃরড়হং খঃফ., ১৯৭৯, ঢ়. ৩. ৪.) পুরুষদের যৌনক্ষুধা নিবারণের হাতিয়ার হিসেবে নারী ব্যবহৃত হতো। এমনকি স্বামী কোনো অপরাধের দায়ে স্ত্রীর মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত দিতে পারতো। (ডড়সধহ রহ ওংষধস, ঢ়.৩-৪.)

চীনা সভ্যতা

পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন চৈনিক সভ্যতায় নারীর মর্যাদা ছিল সর্বাপেক্ষা নিকৃষ্ট। চীনের ধর্মগ্রন্থে নারীকে “ডধঃবৎ ড়ভ ড়িব” (দুঃখের প্র¯্রবণ) হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে, যা সব সৌভাগ্য ভাসিয়ে নিয়ে যায়। (খালেক, আব্দুল, নারী ও সমাজ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ঢাকা: ১৯৯৫, পৃ. ৫।) একটি চীনা প্রবাদে আছে: “তোমরা স্ত্রীর কথা শোন, কিন্তু বিশ্বাস করো না।” (ইসলাম ও পাশ্চাত্য সমাজে নারী, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৩।) এ কথাতেই প্রতীয়মান হয় চীন সভ্যতায় কন্যার অবস্থা ছিল অত্যন্ত শোচনীয়।
বেটানি বলেছেন : ‘অতলান্ত মৎস্যের গতিবিধির ন্যায় অপ্রমেয় ও অবোধ্য নারী চরিত্র বহুবিধ ছলনায় আচ্ছাদিত। তার মধ্যে সত্য পাওয়া দুষ্কর। তার নিকট মিথ্যা সত্য সদৃশ এবং সত্য মিথ্যাসম।” (দ্য এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা, পৃ. ৭৩২।)

হিন্দু সভ্যতা

পৃথিবীর প্রচলিত ধর্মসমূহের মধ্যে হিন্দু ধর্ম সম্ভবত সবচেয়ে প্রাচীন। এ ধর্ম বৈদিক ধর্ম, আর্যধর্ম, সনাতন ধর্ম ইত্যাদি নামেও পরিচিত। হিন্দু ধর্মে নারীর কোনো মর্যাদা দেয়া হয়নি। এ ধর্মের অন্যতম গ্রন্থ ‘মহাভরত’-এ বলা হয়েছে, “নারী অশুভ, সকল অমঙ্গলের কারণ, কন্যা দুঃখের হেতু।” (মহাভারত, ১ : ১৫৯ : ১১।) বেদে উল্লেখ রয়েছে, “যজ্ঞকালে কুকুর, শুদ্র ও নারীর দিকে তাকাবে না।” (বেদ, ৩ : ২ : ৪ : ৬।) হিন্দু ধর্মে নারীকে কোনো উত্তরাধিকার স্বত্ব প্রদান করা হয়নি।

ভারতীয় সভ্যতায় নারীর অবস্থা ছিল অতীব শোচনীয়। উচ্চশ্রেণী ও রাজবংশের নারীদেরকে অধিকতর সাবধানতার সাথে ভিন্ন পুরুষদের কাছে হতে দূরে রাখা হতো। কারণ, তাদের মতে, সব ধ্বংসের মৌল উৎস ছিল নারী। বৈদিক যুগে নারী ছিল যুদ্ধলব্ধ লুটের মালামালের মতো। যুদ্ধে বিজয়ের পর বিজয়ী পক্ষ জোরপূর্বক নারীদের অপহরণ করতো এবং লুণ্ঠিত সামগ্রীর মতো তাদেরকে নিজেদের মধ্যে বণ্টন করতো। তৎকালীন সময়ে স্বামী স্ত্রীকে সেবাদাসীরূপে ব্যবহার করতো। কন্যাসন্তান প্রসবকারিণী স্ত্রী সর্বক্ষেত্রে লাঞ্ছিত ও অপমানিত হতো। স্বামীর ব্যভিচার, পতিতাগমন, এমনকি মৃত্যুতেও বিবাহ ভঙ্গ করা যেত না। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে অমিল, রেষারেষি, শত্রুতা ও ঘৃণা বিরাজ করলেও বিবাহ-বিচ্ছেদ নারীর পক্ষে সম্ভব ছিল না।

ভারতীয় সমাজে কন্যাসন্তান জন্ম নেয়া যেমন অপরাধ ছিল, তেমনি গোটা সমাজে নারী ছিল ব্যবহার সামগ্রী সদৃশ। মানুষ হিসেবে নারীর ছিল না কোনো মানবাধিকার।

বৌদ্ধধর্ম

বিশ্বের প্রাচীনতম ধর্মসমূহের মধ্যে বৌদ্ধধর্ম অন্যতম। বৌদ্ধধর্মের প্রবর্তক গৌতম বুদ্ধ নারী জাতির জন্য কিছুই করে যাননি এবং কিছু করার প্রয়োজনও বোধ করেননি। তবে হিন্দুধর্মের ন্যায় বৌদ্ধ ধর্মে নারী ততটা অবহেলিত নয়। মহামঙ্গল সূত্রে গৌতম মাতার সেবা ও স্ত্রীর ভরণ-পোষণকে উত্তম মঙ্গল বলে আখ্যায়িত করেন। (দৌলাতানা, মমতাজ, ধর্ম, যুক্তি ও বিজ্ঞান, ঢাকা: জ্ঞানকোষ, ১৯৯৭, পৃ. ১০৮।) জানা যায়, রাজমহিষী মল্লিকাদেবী কন্যাসন্তান প্রসব করলে রাজা বিমর্ষ হন। আর বুদ্ধ রাজাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন, “কন্যাসন্তানের জন্মহেতু কারো দুঃখ করা উচিত নয়। সুশীলা ও ধর্মপ্রাণ কন্যা হলে সে পুত্র অপেক্ষা শ্রেয় হয়।” (বড়–য়া, ড. সনন্দা, বৌদ্ধ ধর্মের আলোকে নারীর অবস্থান, ঢাকা: বাংলাদেশ বুদ্ধিস্ট ফেডারেশন, স্মরণিকা, ১৯৯৬, পৃ. ২২।)

উপযুক্ত বিবরণ থেকে এটা সুস্পষ্ট যে, ইহুদি, খ্রিষ্টান ও হিন্দু ধর্মের কোন একটিতেও কন্যা বা নারীর কোন মর্যাদা ছিল না। নারী যে একটি প্রাণী, পুরুষের মতো তারও প্রাণ আছে তা উপরে বর্ণিত কোনো ধর্মই স্বীকার করতো না। নারীকে গৃহের অন্যান্য আসবাবপত্রের মতো মনে করা হতো।

আরব সমাজ

ইসলাম-পূর্ব আরব সমাজে কন্যাসন্তানের পারিবারিক ও সামাজিক অবস্থান খারাপ ছিল। কন্যারা ছিল ঘৃণিত, মর্যাদাবহির্ভূত এবং অধিকার ও মূল্যহীন। তারা মানবরূপে গণ্য ছিল না। কন্যাসন্তান জন্মানো চরম অভিশাপ বলে গণ্য করা হতো। কন্যাসন্তানকে জীবন্ত কবর পর্যন্ত দেয়া হতো। ভোগ্যপণ্যের চেয়ে অবমূল্যায়িত ছিল নারী। এককথায় কন্যারা সে সমাজে ছিল শোষিত, অধিকারবঞ্চিত এবং শিক্ষা-দীক্ষা বা জ্ঞান অর্জনের কোনো সুযোগই তারা পেত না। এ প্রসঙ্গে ঊহপুপষড়ঢ়ধবফরধ ড়ভ ইৎরঃধহরপধ-য় বলা হয়েছে, ‘সে সমাজে নারীদের স্থান এত অধঃপতিত ছিল যে, তাদের সন্তানরা তাদেরকে দাসে পরিণত করত। নারীরা নিজ গৃহেই ছিল নির্বাসিত। স্ত্রীদের শিক্ষার অধিকার ছিল না। তাদের স্বামী কর্তৃক তারা একটা বাচাল বৈ কিছুই মনে করা হতো না।’
(ঊহপুপষড়ঢ়ধবফরধ ইৎরঃধহরপধ-য় বলা হয়েছে, “ডড়সবহ’ং ংঃধঃঁং যধফ ফবমবহবৎধঃবফ ঃড় ঃযধঃ ড়ভ পযরষফ নবধৎরহম ংষধাবং. ডরাবং বিৎব ংবপষঁফবফ রহ ঃযবরৎ যড়সব, যধফ হড় বফঁপধঃরড়হ ধহফ ভবি ৎরমযঃং ধহফ বিৎব পড়হংরফবৎবফ নু ঃযবরৎ যঁংনধহফং হড় নবঃঃবৎ ঃযধহ যধঃঃবৎ.” (ঞযব ঊহপুপষড়ঢ়ধবফরধ ইৎরঃধহরপধ, ঠড়ষষ. ১৯, ঢ়. ৯০৯.)

অথচ কন্যাসন্তান প্রসবে নারীর কোনো হাত নেই। সে যুগে আবু হামযা নামে এক সম্ভ্রান্ত সর্দার কন্যাসন্তান জন্মের পর অপমানে আত্মগোপন করে বেড়ালে তার স্ত্রী মনের দুঃখে এ কাব্য আবৃত্তি করেছিল- ‘আবু হামযার কী হলো! সে আমাদের নিকট না এসে প্রতিবেশীর বাড়িতে রাত্রি কাটায়। আমি পুত্রসন্তান প্রসব না করার দরুনই সে আমার ওপর অসন্তুষ্ট হয়েছে। আল্লাহর কসম! পুত্রসন্তান জন্মদান আমার ক্ষমতাধীন নয়। আমরা শস্যক্ষেত্র তুল্য। স্বামীগণ আমাদের মাঝে যে বীজ বপন করে, তাতে সে শস্যের চারাই জন্মে।

এভাবে দেখা যাচ্ছে, কুরআন নাজিলের আগে দুনিয়ার কোনো দেশে, কোনো সভ্যতায়ই নারীকে কোনোরকম মর্যাদা দেয়া হয়নি। কোথাও নারী সম্পত্তির মালিক ও উত্তরাধিকারী হতে পারতো না। (Malik, Fida Hussain, Wives of the Prophet, Lahore : Ashraf publications, 1983, p. 12-15.)


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us