ভারত কেন ১৯৬৫ সালের যুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তান আক্রমণ করেনি?

মো: ইখতিয়ার উদ্দিন রিবা | Apr 03, 2021 06:10 pm
ভারত কেন ১৯৬৫ সালের যুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তান আক্রমণ করেনি?

ভারত কেন ১৯৬৫ সালের যুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তান আক্রমণ করেনি? - ছবি সংগৃহীত

 

আজকের সংখ্যালঘুরাই অতীতে ছিল বাংলায় সংখ্যাগুরু। ব্রিটিশ আমলে ১৮৮১-এর দ্বিতীয় ও ১৮৯১-এর তৃতীয় আদমশুমারির মধ্যবর্তী সময় থেকে পূর্ববাংলা (পূর্বপাকিস্তান ও পরবর্তী বাংলাদেশ) মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ হতে শুরু করে। ১৯৪৭-এ বাংলা ভাগের সময় আসামসহ বাংলায় মুসলমান প্রায় ৫২ শতাংশ ও সংখ্যালঘুরা শতকরা ৪৮ ভাগ। কিন্তু শুধু কৃষি ছাড়া পূর্ববাংলায় শিক্ষা, সরকারি চাকরি ও ব্যবসা-বাণিজ্যে মুসলমানরা ছিল নিদারুণ পশ্চাৎপদ। তখন এদেশে ছিল চারটি বস্ত্রকল, চারটি চিনিকল ও একটি বিশ্ববিদ্যালয়। নামে চট্টগ্রাম বন্দর থাকলেও মুখ্য ছিল কলকাতা বন্দর। ছিল না আদৌ কোনো পাটকল, চামড়ার কারখানা। তবে পশ্চিম বাংলার শিল্পে জোগান দিত পূর্ববাংলার কাঁচামাল। ১৯৪৭-এর ভাগে পূর্ববাংলা পাকিস্তানে যোগ দেয়ায় এর নিয়ন্ত্রণ চলে যায় তার হাতে। ফলে পশ্চিম বাংলায় ক্রমে ক্রমে বন্ধ হওয়া (১৯১২ সালের পরিসংখ্যানে ৫৮টি), প্রায় ১০৬টি পাটকল পুনরায় চালু হয় ১৯৭১-এ স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পরে। একটি অনস্বীকার্য সত্য ছিল যে, পাঞ্জাবের পরে ভারতে অবিভক্ত বাংলা হলো ভারতবর্ষের সমৃদ্ধ প্রদেশ।

নদীমাতৃক বাংলায় যোগাযোগের কল্পনাতীত অব্যবস্থায় শাসনের সুবিধার্থে যার যার পছন্দ মতো এটাকে কয়েকটি অঞ্চলে প্রথম ভাগ করে রাজত্ব করেন বল্লাল সেন (১১১৯-১১৬৯ সাল)। এরই ধারাবাহিকতার সর্বশেষে ১৯০৫ সালে করা ব্রিটিশদের বাংলা ভাগে সংখ্যালঘুদের উত্থাপিত সর্বপ্রথম বাঙালি জাতীয়তাবাদী সহিংস আন্দোলনে তা রদ করা হয়। এর ৪১ বছর পরে, মুসলমানদের ‘স্বাধীন বাংলা’র দাবির প্রেক্ষাপটে সংখ্যালঘুরা এবারে করলেন বাংলা ভাগের দাবি। এহেন টানাপড়েন নিয়ে জানতে চাওয়া পণ্ডিত নেহরুর মতামত প্রসঙ্গে লর্ড মাউন্ট ব্যাটেন বলেন, “Pandit Nehru had stated that he would not agree to Bengal being independent...They had also ruled that Dominion status would not be granted to East Bengal independently. In his opinion, Eastern Bengal was likely to be a great embarrassment to Pakistan. Presumably Pandit Nehru considered that Eastern Bengal was bound sooner or later to rejoin India.” (পণ্ডিত নেহরু বলেছেন যে, বাংলার স্বাধীনতায় তিনি সম্মত নন। ... তারা স্বাধীনভাবে পূর্ববাংলাকে অধীনস্থ রাষ্ট্রের মর্যাদায় পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের অধিকারও অনুমোদন করছেন না। তার মতে (নেহরু), পূর্ববাংলা পাকিস্তানের জন্য বিব্রতকর হওয়ার সম্ভাব্য এক প্রধান কারণ হবে। মনে হয়, পণ্ডিত নেহরুর ধারণায় পূর্ববাংলা একদিন না একদিন ভারতের সাথে পুনরায় যুক্ত হতে বাধ্য হবে)। (Larry Collins & Dominique Lapierre’s Mountbatten and the Partition of India, page 143 হতে উদ্ধৃত)।

বাংলাদেশের অর্জিত স্বাধীনতায় বইটির ৪৪ পৃষ্ঠায় ১৯৭৩ সালে মাউন্টব্যাটেন বলেন, Bangladesh and all that misery which I forecast twenty five years ago. Rajagopalachari and I said it would last 25 years. It had to...” (বাংলাদেশ ও ওইসব দুঃখের পূর্বাভাস আমি ২৫ বছর আগে দিয়েছিলাম; রাজা গোপালাচারী (স্বাধীন ভারতের প্রথম গভর্নর জেনারেল) ও আমি এটা ২৫ বছর টেকার কথা বলেছিলাম। এটাই হয়েছে...) তাদের দূরদর্শিতার বিস্ময়কর দিক হলো ২৪ বছরেই পাকিস্তান ভেঙে গেছে।

১৯৪৭-এর ১৮ আগস্ট। ওই বাংলা ভাগের মাত্র চার দিনের মাথায় কলকাতার অমৃত বাজার পত্রিকায় প্রকাশিত, কংগ্রেস সভাপতি আচার্য কৃপালনীর মন্তব্য, “Neither the Congress nor the nation has given up the claim of a united India.” (কংগ্রেস বা জাতি কেউই অখণ্ড ভারতের দাবি ত্যাগ করে নাই)। ১৯৫০-এর ১৭ জানুয়ারি তারিখের তথ্য মতে স্টেটসম্যান পত্রিকায় প্রকাশিত, দু'দিন আগের কলকাতার জনসভায় ভারতের প্রথম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বল্লভভাই প্যাটেল বলেন, “How can Bengal ever forget the days of direct action and the situation in Calcutta which followed in its wake (in 1946). Artificial boundaries cannot separate (East Pakistan Hindus) from us. our relationship and economic ties cannot be broken... West Bengalis want more room for expansion. It is my earnest desire to help Bengal in its hour of need to the maximum of our capacity.” (বাংলা কী করে ডাইরেক্ট অ্যাকশন ও তার অব্যবহিত পরে কলকাতার অবস্থা (১৯৪৬) ভুলতে পারে। কৃত্রিম সীমানা আমাদের থেকে পূর্বপাকিস্তান হিন্দুদের আলাদা করতে পারে না। আমাদের সম্পর্ক ও অর্থনৈতিক বন্ধন ছিন্ন করা যায় না। পশ্চিমের বাঙালিরা সম্প্রসারণের জন্য আরো জায়গা চায়। বাংলার প্রয়োজনের সময়ে তাকে আমাদের সামর্থ্যরে সর্বাধিক সাহায্য করাই আমার আন্তরিক বাসনা)।

১৯৬৫-এর ৬ সেপ্টেম্বর শুরু হওয়া ভারত-পাকিস্তানের ১৭ দিনের যুদ্ধে ২৩ সেপ্টেম্বর বিরতি ঘোষিত হয়। তখন পাকিস্তানের সাহায্যার্থে দু’টি মিসাইল জাহাজসহ একটি ইন্দোনেশিয়ান সাবমেরিন ২-৩ সপ্তাহ ধরে করাচি বন্দরে থাকার ভারতীয় তথ্যটি সত্য। আরো সত্য যে, ভারত সীমান্তে সেনা সমাবেশ করে তৎকালীন চীনা প্রধানমন্ত্রী চৌ-এন-লাই পূর্বপাকিস্তান আক্রমণের ব্যাপারে ভারতকে হুঁশিয়ার করেছিলেন। এও বলা হয় যে, পোল্যান্ডের ওয়ারশ’তে আমেরিকান কূটনীতিক জন মুর ক্যারট তখন বলেছেন, ভারত পূর্বপাকিস্তান আক্রমণ করলে এ ক্ষেত্রে চীনের সরাসরি হস্তক্ষেপের কথা। ওই যুদ্ধের সময়ে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার অজুহাতে কমিউনিস্টপন্থী বেশ কিছু নেতাকে পূর্বপাকিস্তানে গ্রেফতার করা হয়। তাদের সহমতাদর্র্শী অন্যরা গুপ্ত আন্দোলনে সক্রিয় হন, যাদের মধ্যে মনি সিং, বারীন দত্ত, খোকা রায়, অমল সেন, নলিনী দাস, সুখেন্দু দস্তিদার প্রমুখ উল্লেখযোগ্য বলে বলা হয়।

ওই বছরই ১১ অক্টোবর। যুদ্ধ বিরতির প্রায় ২৩ দিন পরে নতুন দিল্লির ব্রিটিশ কমনওয়েলথ রিলেশনস অফিস হতে ঢাকাসহ সংশ্লিষ্ট দেশে পাঠানো টেলিগ্রামে জানানো হয়, ‘নতুন দিল্লির সংবাদমাধ্যম অল ইন্ডিয়া রেডিওর সংবাদে পূর্বপাকিস্তানে রাজনৈতিক অসন্তোষ ও নির্যাতনের কারণে গঠিত বিপ্লবী পরিষদের প্রধান কার্যালয় পার্বত্য চট্টগ্রামের কোথাও হতে গোপন রেডিও পরিচালনা এবং পরিষদ কর্তৃক বিলি করা প্রচারপত্রে ভারতের সাথে যুদ্ধে পূর্বপাকিস্তানকে জড়িয়ে আইয়ুব খানকে ধ্বংস করতে না দেয়া তথা যুদ্ধ হতে পূর্ব-পাকিস্তানিদের দূরে থাকার পরামর্শ দেয়া; সে অবস্থার সৃষ্টিতে পরিষদ আলাদা স্বাধীন সার্বভৌম পূর্বপাকিস্তান গঠন, আইয়ুব ও পাকিস্তান বিরোধী আন্দোলন দমনে ছাত্রসহ প্রায় এক হাজারেরও অধিক গ্রেফতার এবং অধিকাংশ রাজনৈতিক নেতার গুপ্ত প্রতিরোধের কথা প্রকাশ করা হয়েছে।’ দুই দিন পরেই ঢাকার অফিস হতে দিল্লিসহ সংশ্লিষ্ট ওই সব দফতরে এর উত্তরে জানানো হয় যে, ‘আমরা বা আমেরিকানরা কেউই এ ধরনের গঠিত বিপ্লবী পরিষদ বা কোনো প্রচারপত্র বিলির আদৌ কোনো চিহ্ন পাই নাই। নতুন দিল্লির টেলিগ্রামে বলা বিচ্ছিন্নতাবাদ ও পশ্চিম পাকিস্তানবিরোধী মনোভাব কোনো কোনো অংশে থাকার ব্যাপারে সন্দেহ না থাকলেও বর্তমানে তা সর্বজনীন মনে করা সম্পূর্ণ ভুল।’ (The British Papers, secret and confidential, India, Pakistan, Bangladesh Documents 1958-1969, Page-412, 413 হতে উদ্ধৃত)।

১৯৬৬ সালের ১০ জানুয়ারি। রাশিয়ার মধ্যস্থতায় ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তি ‘তাসখন্দ ঘোষণা’ বলে পরিচিত হয়। ফেব্রুয়ারির ৫-৬ তারিখে এই চুক্তির বিরোধিতায় লাহোরে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে যোগ দেয়া বিরোধীদলীয় ৭৪০ প্রতিনিধির মধ্যে ২১ জন ছিলেন পূর্বপাকিস্তানি। সে চুক্তিবিরোধী প্রস্তাব উত্থাপিত হলেও সম্মেলনে পাঠ করা আওয়ামী লীগের ছয় দফা প্রস্তাবে পাকিস্তানি কেউ কোনো মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকেন। ওই যুদ্ধের পরেই কলকাতার ‘আকাশবাণী’ থেকে দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় পরিচালনা করতে শুরু করেন ‘এ পার বাংলা-ওপার বাংলা’ অনুষ্ঠান, যাতে উৎসাহিত করা হতো বাঙালি জাতীয়তাবাদকে। পশ্চিম বাংলায় গোপন রেডিওর মাধ্যমে পূর্ব-পাকিস্তানে নাশকতা ও বিচ্ছিন্নতাবাদে প্ররোচনার সরকারি অভিযোগ করা হয় এবং ’৬৭ সালের এপ্রিলে পাকিস্তানে রবীন্দ্রসঙ্গীত নিষিদ্ধ করা হয়।

ওই ১৯৬৬-এর ২১ নভেম্বর। পূর্ব-পাকিস্তানকে স্বাধীন করার প্রয়াসে এর তৎকালীন ৫৫টি মহাকুমায় মুসলিম ব্রাদারহুড নামক দল গঠনে ৫৫ লাখ টাকার আর্থিক সহযোগিতা চেয়ে যশোরের আবু সাইদ বেঙ্গল ঢাকার আমেরিকান দূতাবাসে আবেদন করেন। দূতাবাস কর্মকর্তা মেটকাফের (Metcalf) প্রেরিত প্রাসঙ্গিক রিপোর্টসহ আবেদনটি The American papers, secret and confidential India, Pakistan, Bangladesh Documents 1965-1973, page 239 to 241-এ উদ্ধৃত আছে।

১৯৬৭ সালের ৯ ডিসেম্বর। চট্টগ্রামস্থ পিআইএর স্টেশন ম্যানেজার এম এম রমিজসহ দেশের বিভিন্ন স্থান হতে মোট ২৮ জনকে গ্রেফতারের পরে সরকারিভাবে ঘোষিত হয় ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’, যা মিথ্যা মনে করা হতো সর্বজনীনভাবে। এর প্রায় ৪৪ বছর পরে ওই মামলার ২৬নং অভিযুক্ত মরহুম কর্নেল (অব:) এবং সংসদের ডেপুটি স্পিকার এম শওকত আলী মিঞা, এর সত্যতা স্বীকার করে ২০১১ সালে প্রকাশ করেন ‘সত্য মামলা আগরতলা’ নামক বই। এর ১৭৬ পৃষ্ঠামতে ‘ভারত কর্তৃক সরবরাহকৃত অস্ত্র, গোলাবারুদ ও তহবিলের সহায়তায় সংঘটিতব্য সশস্ত্র বিদ্রোহের দ্বারা পাকিস্তানের একটি অংশকে বিচ্ছিন্ন করা এবং সেখানে ভারত-স্বীকৃত সরকার গঠনের পরিকল্পনাই ছিল ১নং অভিযোগ। কিন্তু এই প্রক্রিয়া ব্যর্থ হলেও দুই বছর পরেই শুরু হওয়া আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে অনুরূপ সহযোগিতা করার সুযোগে মূল পরিকল্পনাটি বাস্তবায়ন করে ভারত।’

অতএব, শিরোনামের প্রশ্নোত্তরে এটা বলা যায় যে, বাঙালি সেনারা ভারতের বিরুদ্ধে ১৯৬৫ সালে পাকিস্তানে যুদ্ধরত থাকার প্রতিক্রিয়ায় তখন পূর্বপাকিস্তান আক্রমণ করলে এর কাক্সিক্ষত বিচ্ছিন্নতায় বহু গুণ মূল্যের স্বীয় ঐতিহাসিক আধিপত্য ভারতের পক্ষে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা আর সম্ভব হতো না।


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us