সিয়াম সাধনার আধ্যাত্মিক তাৎপর্য

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ | Apr 17, 2021 02:34 pm
সিয়াম সাধনার আধ্যাত্মিক তাৎপর্য

সিয়াম সাধনার আধ্যাত্মিক তাৎপর্য - ছবি : সংগৃহীত

 

সংযম সিয়াম সাধনার অন্যতম পূর্বশর্ত। রোজা পালনের দ্বারা প্রবৃত্তির ওপর আক্লের পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হয়। এর দ্বারা মানুষের পাশবিক শক্তি অবদমিত হয় এবং আধ্যাত্মিক বা রূহানী শক্তি বৃদ্ধি পায়। কেননা ক্ষুধা ও পিপাসায় মানুষের জৈবিক ও পাশবিক ইচ্ছা হ্রাস পায়। এতে মনুষ্যত্ব জাগ্রত হয়। যেকোনো পরিস্থিতিতে ধৈর্য অবলম্বন, সহনশীলতা প্রকাশ, পারস্পরিক সম্ভ্রমবোধ ও সৌজন্য প্রদর্শন, সর্বোপরি সব কার্যকলাপে বুদ্ধি-বিবেচনাপ্রসূত মাত্রা ও মূল্যবোধের অনুসরণ ব্যক্তি তথা সমাজজীবনের অনিবার্য অবলম্বন হওয়া আবশ্যক। চলনে বলনে, চিন্তাচেতনায়, আগ্রহ আকাক্সক্ষায়, আবেগ উৎকণ্ঠায়, আনন্দ বিষাদে সর্বত্র একটা মধ্যপন্থা অবলম্বনের শিক্ষা সিয়াম সাধনায় বিশেষ গুরুত্ববহ হয়ে ওঠে। এটা অনস্বীকার্য যে যেকোনো ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি ভিন্নতর পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটায়। যেমন মাত্রা অতিক্রম করলেই সাহস হঠকারিতায়, আত্মোৎসর্গ আত্মহত্যায়, প্রতিযোগিতা হিংসায় পরিণত হতে পারে। পরিমিত বোধের ব্যাপারে আল কুরআনে বহুবার উপদেশ দেয়া হয়েছে। লোকমান হাকিম তার পুত্রকে উপদেশ দিচ্ছেন, ‘অহঙ্কার বশে তুমি মানুষকে অবজ্ঞা করো না। কারণ আল্লাহ কোনো উদ্ধত অহঙ্কারীকে পছন্দ করেন না। তুমি পদক্ষেপ করিও সংযতভাবে এবং তোমার কণ্ঠস্বর নিচু করিও; স্বরের মধ্যে গর্দভের স্বরই সর্বাপেক্ষা অপ্রীতিকর।’ (৩১ সুরা লুকমান আয়াত : ৮-১৯)।

ক্যানভাসে রঙ ও তুলির সুষম সমন্বয়ে শিল্পের সার্থকতা ফুটে ওঠে। পারিপার্শ্বিক সব কিছুর পরিমিত অবস্থান ও শৃঙ্খলামণ্ডিত উপস্থাপনার মধ্যেই সৌন্দর্যের যথার্থ বিকাশ। নিয়মনিষ্ঠা ও সহনশীলতা যেকোনো পরিবেশ পরিস্থিতিতে মেজাজ-মর্জি, আস্থা ও অবস্থান এমনকি প্রতিক্রিয়া প্রকাশের ক্ষেত্রেও দান করে এক অনুপম মর্যাদা। অর্থনীতিবিদরা স্পষ্টতই মত প্রকাশ করেছেন যে, অর্থ সরবরাহে অসম আচরণ এবং সম্পদ বণ্টনে বৈষম্য মুদ্রাস্ফীতির অন্যতম কারণ এবং মুদ্রাস্ফীতি অর্থনীতির অন্যান্য শৃঙ্খলাকে সংক্রমিত করে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে ব্যক্তি তথা সামষ্টিক জীবনে সব ক্ষেত্রে ও পর্যায়ে সংযম ও সহনশীলতা প্রদর্শনের, যুক্তিনিষ্ঠ ও নিরপেক্ষ মধ্যপন্থা অবলম্বনের আবশ্যকতা রয়েছে। আল কুরআনের ২৫তম সূরা ফুরকানে এ বিষয়ে ইঙ্গিত করা হয়েছে, ‘যখন তারা ব্যয় করে তখন তারা অপব্যয় করে না, কার্পণ্যও করে না, বরং তারা আছে এই উভয়ের মাঝে, মধ্যম পন্থায়।’ (আয়াত-৬৭) কিংবা ১৭তম সূরা বনি ইসরাইলে, ‘সালাতে স্বর উচ্চ করিও না এবং অতিশয় ক্ষীণও করিও না, এ দুইয়ের মধ্যপথ অবলম্বন কর।’ (আয়াত-১১০)।

বিশ্বাসে ও ব্যবহারে, জীবনযাপন ও মানবিকতায় মাত্রা অতিক্রমকারী বনি ইসরাইল, লুত ও ছামুদ জাতির অশুভ পরিণতির কথা কুরআনে প্রায়ই উদাহরণস্বরূপ বর্ণনা করা হয়েছে। সংযম ও সহনশীল হওয়ার উপদেশ বারবার দেয়ার পর- কুরআনে একাধিক স্থানে উল্লেখ করা হয়েছেÑ মাত্রাঅতিক্রমকারীর অশুভ পরিণতি এবং বলা হয়েছে আল্লাহ তাকে ভালোবাসেন না। (৫ম সূরা মায়িদা, আয়াত-৮৭। ২য় সূরা বাকারা, আয়াত-১৯০)। কুরআনে আরো উল্লেখ করা হয়েছে আচার-আচরণ, চিন্তা চেতনায় ও কার্যকলাপে মাত্রা অতিক্রমকারীদের স্বাভাবিক সুচিন্তাবোধ ও বুদ্ধি সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। বলা হয়েছে, ‘মানুষকে যখন দুঃখ দৈন্য স্পর্শ করে তখন সে শুয়ে বসে অথবা দাঁড়িয়ে আমাকে ডেকে থাকে; অতঃপর আমি যখন তার দুঃখ দৈন্য দূরীভূত করি, সে এমন পথ অবলম্বন করে, যেন তাকে যে দুঃখ দৈন্য স্পর্শ করেছিল তার জন্য সে আমাকে ডাকেই নাই। যারা সীমালঙ্ঘন করে তাদের কর্ম তাদের নিকট এভাবে শোভন প্রতীয়মাণ হয়। (১০ম সূরা ইউনুস। আয়াত ১২)।

সিয়াম সাধনায় মানবিক অধিকারের স্বীকৃতি, সাম্য এবং সামাজিক রীতিনীতি সম্পর্কে ইসলামের মহান শিক্ষার এ সত্য প্রতিফলিত হয় যে, কোনো মানুষ অপর মানুষকে যেন নিচ ও ঘৃণ্য মনে না করে বরং নিজের বংশগত মর্যাদা, পরিবার, অথবা ধন সম্পদ ইত্যাদির ভিত্তিতে গর্ব না করে। কেন না, এগুলো প্রকৃত গর্বের বিষয় নয়। এহেন গর্বের কারণে পারস্পরিক ঘৃণা ও বিদ্বেষের বীজ উপ্ত হয়। ইসলামের শিক্ষা হলো সব মানুষ একই পিতামাতার সন্তান হওয়ার দিক দিয়ে ভাই ভাই এবং পরিবার গোত্র অথবা ধন দৌলতের দিক দিয়ে যে প্রভেদ আল্লাহ তায়ালা রেখেছেন, তা গর্বের জন্য নয়, পারস্পরিক পরিচয়ের জন্য। কবি শেখ ফজলুল করিম যেমনটি বলেছেন,

কোথায় স্বর্গ কোথায় নরক কে বলে তা বহুদূর
মানুষের মাঝে স্বর্গ নরক মানুষেতে সুরাসুর।

ফজলুল করিম আরো মনে করেন মানুষের মধ্যে পরস্পরের প্রীতি ও সৌহার্দ্য যখন প্রতিষ্ঠিত হয়, স্বর্গ তখন তাদের কুঁড়ে ঘরেই বিরাজ করে। আল কুরআনে ব্যক্তিবর্গের পারস্পরিক হক, আদব ও সামাজিক রীতিনীতি নির্দেশ করা হয়েছে- ‘তাদের অধিকাংশ অনুমানেরই অনুসরণ করে, সত্যের পরিবর্তে অনুমান কোনো কাজে আসে না। তারা যা করে আল্লাহ্ সে বিষয়ে সবিশেষ অবহিত।’ (১০ম সংখ্যক সূরা ইউনুস, আয়াত- ৩৬) ‘তোমরা একে অপরের প্রতি দোষারোপ করো না এবং তোমরা একে অপরকে মন্দ নামে ডেকো না; ঈমানের পর মন্দ নামে ডাকা গর্হিত কাজ। হে মুমিনগণ! তোমরা বহুবিধ অনুমান করা থেকে দূরে থাকো, কারণ অনুমান কোনো ক্ষেত্রে পাপ এবং তোমরা একে অপরের গোপনীয় বিষয় অনুসন্ধান করো না এবং একে অপরের পশ্চাতে নিন্দা করো না।... (৪৯ সংখ্যক সূরা হুজুরাত, আয়াত ১১-১২)।
আয়াতগুলোতে (১) অনুমান করা, (২) কারো গোপনীয় বিষয় অনুসন্ধান করা, (৩) কাউকে ঠাট্টা ও উপহাস করা, (৪) কাউকে দোষারোপ করা এবং (৫) কারো পশ্চাতে নিন্দা করা বা গীবৎ করা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অনুমান বা ধারণা করা থেকে বিরত থাকার কারণ হিসেবে বলা হয়েছে কতক ধারণা পাপ। প্রত্যেক ধারণাই পাপ নয়। অতএব, কোন্ ধারণা পাপ তা জানা জরুরি সাব্যস্ত করতেই সাবধানতা অবলম্বনের এ নির্দেশ। কুরতবী তার তাফসিরে লিখেছেন, নিষিদ্ধ ধারণা বলতে এ ক্ষেত্রে অপবাদ বোঝানো হয়েছে। কোনো ব্যক্তির প্রতি জোরালো প্রমাণ ছাড়া কোনো দোষ আরোপ করা।

কারো গোপনীয় বিষয় বা দোষ অনুসন্ধান প্রসঙ্গে ভাষ্য এই যে, যে দোষ প্রকাশ্য তা ধরা যায়, কিন্তু যে দোষ প্রকাশ্য নয়, তা সন্ধান করা জায়েজ নয়। হাদিস শরিফে আছে, রাসূল সা: বলেছেন, ‘মুসলমানদের গীবৎ করো না এবং তাদের দোষ অনুসন্ধান করো না। কেন না যে ব্যক্তি মুসলমানদের দোষ অনুসন্ধান করে, আল্লাহ তার দোষ অনুসন্ধান করেন, তাকে স্বগৃহেও লাঞ্ছিত করে দেন।’ কাউকে ঠাট্টা বা উপহাসের বিষয়ে বলা হয়েছে যে, কোনো ব্যক্তির দেহে, আকার আকৃতিতে কিংবা কর্মকাণ্ডে কোনো দোষ দৃষ্টিগোচর হলে তা নিয়েও কারো হাসাহাসি বা উপহাস করা উচিত নয়। কেননা এটা হয়তো জানা নেই যে এই ব্যক্তি সততা, আন্তরিকতা ইত্যাদির কারণে আল্লার কাছে উপহাসকারীর চেয়ে উত্তম ও শ্রেষ্ঠ। এ প্রসঙ্গে রাসূলে করিম সা:-এর একটি হাদিস বিশেষভাবে উল্লেখ্য, ‘আল্লাহ্ মুসলমানদের আকার আকৃতি ও ধন দৌলতের প্রতি দৃষ্টিপাত করেন না, বরং তাদের অন্তর ও কাজকর্ম দেখেন’। কারো দোষ বের করা, দোষ প্রকাশ করা এবং দোষের কারণে ভর্ৎসনা করাকে আত্মঘাতী প্রবণতার সাথে তুলনা করা হয়েছে। ‘একে অপরের প্রতি দোষারোপকে’ একে অন্যকে হত্যা করার সাথে সমার্থক আকারে প্রকাশ করার রহস্য একথা বলা যে, অপরকে হত্যা করা যেমন নিজেকে হত্যা করার শামিল, তেমনই কেউ অন্যের দোষ বের করলে সেও তার দোষ বের করবে। পারস্পরিক দোষারোপের ফলে শত্রুতা বৃদ্ধি পায়, অস্বস্তিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় এবং মানবিক মূল্যবোধে অবক্ষয় সৃষ্টি হয়। সুস্থ ও সম্মানজনক সামাজিক পরিবেশ পরিস্থিতি সৃষ্টির ক্ষেত্রে তা হয়ে ওঠে এক দুঃখজনক প্রতিবন্ধকতা।

হিজরি-পূর্র্ব ১৩ সালের ২৭ রমজান (৬১০ খ্রিষ্টাব্দের ২৮ জুলাই, সোমবার) শেষ নবী হজরত মোহা¤মদ সা:-এর কাছে প্রত্যাদেশ (ওহি) প্রেরিত হয়- ‘পাঠ কর তোমার প্রতিপালকের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন- সৃষ্টি করেছেন মানুষকে ‘আলাক’ হতে। পাঠ কর। আর তোমার প্রতিপালক মহিমান্বিত, যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন- শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে, যা সে জানত না।’ (৯৬তম সূরা আলাক, আয়াত ১-৫)। এটিই আল কুরআনের প্রথম অবতীর্ণ ওহি এবং এটা স্পষ্টভাবে বোঝা যায় যে, কলমের সাহায্যে শিক্ষা দেয়ার নির্দেশ আল কুরআনের মাধ্যমে মানবজাতির প্রতি আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের প্রথম ও প্রধান নির্দেশ। বিশেষভাবে উল্লেখ্য, মানবজাতির ঐতিহাসিক মুক্তির এই নির্দেশনা এসেছে মাহে রমজানে। এই নির্দেশনা অন্ধকার থেকে আলোর পথে আসবার এবং অজ্ঞানতার বেড়াজাল পার হওয়ার অনুপ্রেরণা।

মানুষ আশরাফুল মখলুকাত, সৃষ্টির সেরা জীব। এই মানুষকে শিক্ষার মাধ্যমেই ফেরেশতাদের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দেয়া হয়েছে। কুরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘তিনি (আল্লাহ) আদমকে যাবতীয় নাম শিক্ষা দিলেন, তারপর এই বস্তুসমূহ ফেরেশতাদের সামনে উপস্থিত করে বললেন, ‘ঐ সবের নাম আমাকে বলে দাও যদি তোমরা সত্য অবগত হও।’ (২য় সূরা বাকারা, আয়াত ৩১)। ফেরশতাগণ নাম বলতে পারেনি, প্রথম মানব আদম (আ:) পেরেছিলেন। আল্লাহর ইচ্ছায় মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠিত হলো এবং সে কারণে আল্লাহর আদেশে আদম (আ:) কে ফেরেশতাগণ সিজদা করেছিল। শিক্ষাই হলো শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের অন্যতম উপায়। অর্থনৈতিক সম্পদ, সামরিক শক্তি, ভৌগোলিক বিরাটত্ব কিংবা বিশাল জনবল কোনো কিছুই চূড়ান্ত শ্রেষ্ঠত্ব বিচারের মানদণ্ড নয়। শিক্ষাদীক্ষা জ্ঞান-বিজ্ঞানে যে জাতি যত অগ্রসর- সে জাতির আধিপত্য ও স্থায়িত্ব তত বেশি নিশ্চিত। জ্ঞানের আলোয় উদ্ভাসিত একজন ব্যক্তির কাছে তার অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎ, তার ভালো-মন্দ, আনন্দ সর্বনাশ সবই অত্যন্ত পরিষ্কার। তাকে কেউ সহজে বিভ্রান্তকরতে পারে না। মানব ইতিহাসে অত্যাচার নির্যাতন শোষণ ও বঞ্চনার ঘটনাবলী পর্যালোচনা করলে দেখা যায় অজ্ঞ অশিক্ষিত সম্প্রদায়কেই সব ক্ষেত্রে অবর্ণনীয় ক্ষতির শিকার হতে হয়েছে।

একজন শিক্ষিত ব্যক্তি তার নিজের জন্য যেমন কল্যাণকর তেমনি সমাজের জন্য দেশের জন্য কল্যাণকর। অন্য দিকে একজন অজ্ঞ অশিক্ষিত ব্যক্তি নিজের জন্য তো বটেই দেশের জন্যও সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। তার বড় আফসোস দেশের সার্বিক উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে অগ্রগতি ও প্রতিযোগিতার সমাজে সে সচ্ছন্দে অভিযাত্রী হতে পারে না। সমাজের শিক্ষিত সমাজ তাকে আলোর পথে আনবার নৈতিক দায়িত্ব পালনে উদ্যোগী হলেও তাকে শোষণের সহজাত দূরভিসন্ধী ত্যাগ করাতে পারে না। একজন অজ্ঞ অশিক্ষিত ব্যক্তিকে নানান ছলছুতায় ঠকানো ও বিভ্রান্ত করা যেমন সহজ, তেমন একটি অশিক্ষিত ও জ্ঞান বিজ্ঞানে পশ্চাদপর জাতিকে নানানভাবে সমস্যার জালে জড়িয়ে বিভ্রান্ত ও বিভক্ত করে এর সব উন্নতির পথ অবরুদ্ধ করাও সহজ।
ব্যক্তি থেকেই সমাজ, দেশ, রাষ্ট্র। দেশে প্রকৃত কল্যাণ ও উন্নতির পূর্বশর্ত হলো ব্যক্তির উন্নতি। ব্যক্তির সশিক্ষিত হওয়ার অবকাশ সৃষ্টি না হলে, ব্যক্তি প্রকৃত প্রস্তাবে নিজের ও দেশের জন্য কল্যাণকর পর্যায়ে উন্নীত না হলে দেশের সার্বিক কল্যাণ নিশ্চিত হতে পারে না। এটিই বাস্তব সত্য। সুতরাং ব্যক্তি তথা সমাজের প্রকৃত কল্যাণ সাধনে সর্বাগ্রে তাকে শিক্ষিত ও জ্ঞান গরিমায় বলীয়ান হতে হবে। এবং তখনই অন্যান্য সকল সমস্যার সমাধান সহজতর হবে। শিক্ষিত জনশক্তিই জাতীয় মর্যাদা প্রতিষ্ঠার অন্যতম অবলম্বন।

নিরক্ষরকে অক্ষরদান, জ্ঞানহীনকে জ্ঞানের পথে নিয়ে আসা এবং সবাই মিলেই স্বাবলম্বী হওয়ার চেষ্টায় চেষ্টিত হওয়ার তাগিদ আজ আমাদের সামনে উপস্থিত। মাহে রমজানে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আল-কুরআনে যে মহান নির্দেশ মানবজাতির জন্য দিয়েছেন, তা উপলব্ধির মধ্যেই রয়েছে সিয়াম সাধনার যথার্থ সার্থকতা। সিয়াম সাধনা শুধু পরিপালনীয় আনুষ্ঠানিকতা নয়- এটি সার্বিক জাগৃতির অনুপ্রেরণাও বটে।

‘সবর’ বা ধৈর্য অবলম্বন সিয়াম সাধনার মহান শিক্ষা। আল কুরআনের দ্বিতীয় সূরা বাকারার ১৫৫ নং আয়াতে বলা হয়েছে, এবং আমি তোমাদিগকে ভয়, ক্ষুধা এবং ধন-সম্পদ, জীবন ও ফল-ফসলের ক্ষয়ক্ষতি দ্বারা অবশ্য পরীক্ষা করব। তুমি (হে রাসূল) শুভ সংবাদ দাও ধৈর্যশীলগণকে। ইসলাম প্রচারের প্রাথমিক পর্যায়ে দুশমনদের ব্যাপক অপপ্রচারে নবদীক্ষাপ্রাপ্ত মুসলমানদের মন বিষিয়ে তোলা হচ্ছিল। মুসলমানদের এ সঙ্কটকালে তাদেরকে সূরা বাকারার ১৫৩ আয়াতে ধৈর্য ও সালাতের মাধ্যমে প্রার্থনা করার পরামর্শ দিয়ে বলা হয়, ‘আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে আছেন’। এর পরপরই ১৫৪ আয়াতে বলা হয়, ‘আল্লাহর পথে যারা নিহত হয় তাদেরকে মৃত বলিও না, তারা জীবিত কিন্তু তোমরা তা উপলব্ধি করতে পার না।’ পূর্বে উল্লিখিত ১৫৫ আয়াতে বিষয়টি আরো স্পষ্ট করে ধৈর্যশীলদের জন্য শুভ সংবাদ উল্লেখ করা হয়েছে। বস্তুত এর চেয়ে বড় শুভ সংবাদ কী হতে পারে যে আল্লাহ স্বয়ং ধৈর্যশীলদের সাথে আছেন।

আরবি ‘সবর’ শব্দের বহুমাত্রিক অর্থ ও তাৎপর্য রয়েছে। আল্লামা ইউসুফ আলীর মতে সবর এর ব্যবহারিক অর্থ হতে পারে (১) ধীরস্থিরতা অবলম্বন, তাড়াহুড়া না করা (২) অব্যাহত অধ্যবসায়, একাগ্রতা, একনিষ্ঠতা, দৃঢ়তা, উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য অর্জনে অবিচল থাকা (৩) কোনো তাৎক্ষণিক কিংবা হঠাৎ কিছু পাওয়ার প্রত্যাশা না করা (৪) বিপদে আপদে পরাজয় কিংবা বিপর্যস্ত পরিস্থিতিতেও বিপদ ও বিসংবাদকে ঠাণ্ডা মাথায় সহজে ও সানন্দে গ্রহণ করা অর্থাৎ ওই সমস্ত পরিস্থিতিতে শোকাভিভূত কিংবা ক্রোধান্বিত কিংবা হঠকারি না হওয়া।’ বলাবাহুল্য ‘সবর’ মানবিক গুণাবলির মধ্যে শ্রেষ্ঠতর এবং এর মানসিক ও আত্মিক তাৎপর্য অপরিসীম। সবরের গুণ অর্জন স্বাভাবিকভাবেই সহজ নয়। আর এ কারণে এটি অর্জনেও আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছে প্রার্থনার পরামর্শ দেয়া হয়েছে।

এ পরিস্থিতিতে ব্যক্তি ও সমষ্টিকে ধৈর্য ও সালাতের শক্তি ও সাহায্য নিতে হয় একই সাথে ঈমানের ওপর দৃঢ় আস্থা রেখে ধৈর্যধারণে অবিচল থাকার জন্য পরস্পরকে সহযোগিতা করতে হয়। ১০৩ সংখ্যক সূরা ‘আসর’ -এ স্পষ্টতই উল্লেখ করা হয়েছে- ‘মানুষ অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত, কিন্তু তারা নয়, যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে এবং পরস্পরকে সত্যের উপদেশ দেয় ও ধৈর্যের উপদেশ দেয়।’ (আয়াত-২-৩)। বিপদে অন্যের সহযোগিতার বিষয়টিও এখানে বিশেষ তাৎপর্যবহ। বিপদগ্রস্ত সমাজের সকলে ধৈর্যধারণেই কেবল সীমাবদ্ধ থাকবে না পরস্পর সহযোগিতা অর্থাৎ বিপদগ্রস্ত ব্যক্তির বৈষয়িক সাহায্যে এগিয়ে আসাও অতীব গুরুত্বপূর্ণ। জরুরি পরিস্থিতিতে জরুরি পরিকল্পনা গ্রহণ এবং পারস্পরিক সাহায্য আদান প্রদানে ত্যাগ স্বীকারের মাধ্যমে উক্ত প্রয়াসে উপযোগী নেতৃত্ব দান ও সফল কর্ম সম্পাদনে সহায়তা করা বাঞ্ছনীয়। এরূপ ভূমিকা পালনে কোনো বিপর্যয়ই কোনো সমাজকে কাবু করতে পারে না।

ধৈর্যধারণের মাধ্যমে বিপদ মোকাবিলার মধ্যে রয়েছে আল্লাহর অপার সন্তুষ্টি ও সমর্থন। সূরা বাকারার ১৭৭ আয়াতের এই অংশটি এখানে প্রণিধানযোগ্য- ‘পূর্ব ও পশ্চিম দিকে তোমাদের মুখ ফিরানোতে কোনো পুণ্য নেই, কিন্তু পূণ্য আছে... অর্থ সঙ্কটে, দুঃখ ক্লেশে ও সংগ্রামে সঙ্কটে ধৈর্যধারণ করলে।’


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us