দুইয়ে দুইয়ে বাইশ

মাহবুব আলী | May 12, 2021 12:46 pm
দুইয়ে দুইয়ে বাইশ

দুইয়ে দুইয়ে বাইশ - ছবি : অন্য এক দিগন্ত

 

আকতারের মন ভালো নেই। মন ভালো না থাকার হাজার কারণ থাকতে পারে। আশ্চর্যের কিছু নয়। মন ভালো থাকাই বিস্ময়ের। তার মন চিরকাল বিষণ্ন। আজ একেবারে মুড অফ। সকাল থেকে একবার-দুবার করে নিজেকে কয়েকবার গালাগাল দিয়েছে। অস্থির। মাথার উপর কাজের বোঝা থাকলে এমন হয়।

সে মনিটর থেকে চোখ সরিয়ে পাশে তাকাল। রানা নিজ মনে কাজ করে যাচ্ছে। কাজ তো নয়, গুতিয়ে গুতিয়ে কম্পিউটার শেখা। তিন-চার মাস হলো এখানে কাজ করছে। মূলত প্রজেক্ট অডিট করতে এসেছিল। খাতির যত্ন হলো। প্রতিদিন কয়েক প্যাকেট ট্রিপল ফাইভ। নীল-ধূসর ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে থাকে অ্যাকাউন্টস সেকশন। দু-সপ্তাহ পরে শোনা যায়, তাকে ফাইন্যান্স সেলের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। এখন সেও একজন স্টাফ। হাউজিং-মোড় পানির ট্যাংকের ওখানে মেসে থাকে। সময় কাটে না। তাই অফিসে এসে এটা-ওটা করে। আড্ডা দেয়। কোনোদিন কম্পিউটার রুমে এসে শেখার চেষ্টা। আকতার দেখে। অনুরোধে মাঝে মধ্যে শিখিয়ে দিতে হয়। সাদিকুল কম্পিউটারের দফা রফা করে ছেড়েছে। তার চলনে বলনে সবসময় অহংকারি ভাব। নিজেকে বড় কৃষিবিদ মনে করে। অথচ সংস্থায় তার ইনপুট কতটুকু সেটা নিয়ে অনেকেরই প্রশ্ন আছে। শাহ ইমাম রেজা কিন্তু গদগদ। জগতের আজব নিয়ম, যে সিঁদ কেটে চুরি করছে, দেয়াল ধসিয়ে দিচ্ছে, সে-ই ভালো। আপন মনে কাজ করে যাওয়া কর্মীর কোনো দাম নেই, মূল্যায়ন নেই। আকতার ভাবে, যেখানে মূল্যায়ন নেই সেখানে থাকবে না।

রানা কয়েকবার তার দিকে ঘুরে তাকাল। আকতারের সঙ্গে চোখাচোখি হচ্ছে। বোধহয় কিছু কমান্ড শিখতে চায়। আজ সে কম্পিউটারের কোনোকিছু শেখাতে পারবে না। মাথা ধরেছে। ঠিক তা-ও না। কপালের দু-পাশে, মধ্যভাগ আর মাথার পেছনে চাপ চাপ ব্যথা। যতটুকু না মাথার সমস্যা তার চেয়ে বেশি কাজের লোড। রানা জিজ্ঞেস করে,
‘হরিপুর যাবেন?’
‘আমি তো বুঝতেই পারছি না গলদ কোথায়? কিসের পানিশমেন্ট?’
‘আকতার ভাই নিজের কাছে নিজের কোনো গলদ ধরা যায় না। তবে শুনেছি ডিরেক্টর আপনার উপর খুব একটা সন্তুষ্ট নয়। আপনি টেটিয়া টাইপের লোক।’
‘টেটিয়া...সেটা আবার কী?’

‘আপনি নাকি ফাউন্ডার স্টাফের কি এক পেপার লিখতে হেল্প করেন নাই। এ রকম বেশকিছু কথা শুনলাম।’
‘ও, বদরুল লাগিয়েছে। সে তো হোমায়রার কাজ, ঝযব ধিং ধংংরমহবফ ভড়ৎ ঃযধঃ...যিু ংযড়ঁষফ ও ঢ়ৎবঢ়ধৎব ঃযব ঢ়ধঢ়বৎ?’
‘আপনি আবার আর্গুমেন্ট করছেন। আরে ভাই, ওই মহিলার পাওয়ার কেমন জানেন? আপনি এসেছেন ৯৩ সালে, কয়টা ইনক্রিমেন্ট পেয়েছেন? সে পেয়েছে দুইটা। চাকরিতে এসে ১১ মাসে দুইটা ইনক্রিমেন্ট, কিছু রিয়ালাইজ করতে পারছেন?
‘বুঝতে পারলাম না।’
‘এই জন্যই তো বলি আপনারা দিনাজপুরের লোক হলেন গিয়ে গাঁড়–চাষা। আপনাদের ঘাড়ে বসে অন্য লোকেরা মাছ ভাজবে টের পাবেন না।’

আকতার সচকিত হয়। ঞযরহশ এষড়নধষষু অপঃ খড়পধষষু, এষড়নধষরুধঃরড়হ নানান বড় বড় স্লোগান মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে। মস্তিষ্কের নিউরনে বিদ্যুৎ স্ফুলিঙ্গের মতো ছুটোছুটি করে। পরশুদিন বীরগঞ্জ ফিল্ডে গিয়ে এই নিয়ে এরিয়া কো-অর্ডিনেটর আলমের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তার চোখেমুখে রাজ্যের উদ্বেগ, চাকরি যায় যায় আর কি! চাকরি নয় কাজ। ডিরেক্টর এভাবেই ব্রেইনওয়াশ করিয়েছে। সবারই করা হয়।
‘খড়ড়শ, ুড়ঁ ধৎব পড়সসরঃঃবফ ড়িৎশবৎ. ডব ধষষ ধৎব ড়িৎশবৎং বাবহ ুড়ঁ ঃড় নৎরহম ড়ঁঃ ংড়পরধষ পযধহমবং. এটা চাকরি নয়, বলুন কাজ।’
আকতারের হাসি পায় এসব বাগাড়ম্বর শুনে। কাজ আর চাকরি...চাকরি আর কাজ। যেভাবেই বলো দাদা একই কথা। ‘যাহা ভাত তাহাই অন্ন।’ এসব নিয়ে এত ন্যাকামি কেন? সব হিপোক্রাট...মুখোশধারী আর কি!
‘আকতার ভাই কিছু শুনছেন নাকি?’
‘কী?’

‘ব্যাপক রদবদল হচ্ছে। অনেকে ছাটাই হবে।’
‘কে বলেছে ভাই? কোথা থেকে শুনেছেন?’

‘আরে ভাই, আপনি হেড অফিসের লোক। প্রজেক্ট শেষ হলে এ রকমই হয় জানেন না?’
‘সে কি কথা আলম সাহেব, আপনি পুরাতন স্টাফ। অভিজ্ঞতা বেশি। এখানে কারও ছাটাই হয়েছে? বরং কাজের লোড আর দুর্ব্যবহার বাড়িয়ে কর্মীকে পালাতে বাধ্য করা হয়। এটা একধরনের ট্রিটমেন্ট। ম্যানেজমেন্ট পলিসি।’
‘সেইরকম কাজের লোড আসছে ভাই, কি যে করি!’
‘বিকল্প পথ খুঁজে রাখেননি? ভালো না লাগলে ছেড়ে দেবেন।’
‘ভালোলাগা না লাগার কথা নয় আকতার ভাই, অস্তিত্বের প্রশ্ন। দেশে বেকারত্ব বেশি বলে চাকরি পাওয়া যায় না। এখানে অল্প পয়সায় গাধার খাটুনি খাটতে হয়। কষ্ট হলেও এখানে কাজ করে খেতে-পরতে পারছি। চলে গেলে বাঁচব কী করে? আমাদের কোনো জীবন নেই।’

‘আমাদের ওই একটাই সমস্যা...অস্তিত্ব। এ দেশে জন্ম নেয়া পাপ হয়ে গেছে। অথচ দেখুন যত সম্পদ তার সুষ্ঠু বণ্টন হলে ষোলো কোটি কেন তার ডাবল জনসংখ্যা ভালোভাবে খেয়ে পরে বাঁচতে পারে।’
‘আপনি তো কমিউনিস্ট মার্কা কথাবার্তা বলছেন ভাই।’
‘তা নয় আলম সাহেব, ভেবে দেখুন; একদিকে সম্পদের পাহাড় অন্যদিকে হাহাকার। দেখুন বিশাল বাড়ি অথচ লোক মাত্র দু-জন আর আমাদের একটা ছোট ঘরে গাদাগাদি করে থাকতে হয়।’
‘আকতার ভাই, ভেবে ভেবে মাথার চুল তো উঠিয়ে ফেলবেন! বাদ দেন এসব; যত ভাববেন ততই মন খারাপ হবে।’
‘তাই! আচ্ছা, হোমায়রা এসেছিল আদিবাসীদের পিআরএ করতে?’
‘হ্যাঁ, ওই মহিলাকে সামাল দিতে তো প্রাণান্ত অবস্থা। গ্রামের মানুষের গায়ের গন্ধে নাকি মাথা ঘোরে, বমি পায়। এসব ধনী মানুষ দিয়ে দারিদ্র্যবিমোচনের কাজ হয় বলেন?’

‘কিসের মধ্যে কি বলেন! সংস্থায় দু-একজন শো-পিস না থাকলে চলে? সে হলো ডিরেক্টরের খাস লোক। কোনো এক ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় নাকি জয়েন করবে। তা ছাড়া গরিবের কুষ্ঠ দেখিয়ে তো ফান্ড আনতে হবে নাকি?’
‘শুনলাম তারও কি একটা পেপার তৈরি নিয়ে ডিরেক্টর আপনার উপর খাপ্পা?’

‘এখানেও পৌঁছে গেছে, আর পৌঁছাবে না কেন! আপনাকে বলি, ডিরেক্টর ঢাকা যাবে, সঙ্গে যাবে কে? একটা উপলক্ষ ছাড়া হোমায়রাকে নেয়া যায়? তাকে চৎড়নধনষব ংঃবঢ়ং ঃড়ধিৎফ ড়িসবহ বসঢ়ড়বিৎসবহঃ বিষয়ে পেপার লেখার কাজ ধরিয়ে দিলো। তার সঙ্গে আমি হলাম গেটিস। মূলত আমাকেই লিখতে হবে।’
‘অবশেষে লিখে তো দিয়েছেন।’
‘চাকরি করি ভাই। ওই যে বললেন, অস্তিত্বের প্রশ্ন।’

আকতারের মনে পড়ে, বিভিন্ন রেফারেন্স বই, পত্রপত্রিকা আর ফিল্ড এক্সপেরিয়েন্স রিপোর্ট ঘেঁটে চারদিনে পেপার তৈরি করে দিয়েছিল। এক-দেড় ঘণ্টা ধরে হোমায়রাকে ব্রিফিং। সেমিনারে যদি প্রশ্ন আসে, কী জবাব দেবে? মহিলা খুব খুশি। দাঁত কেলিয়ে হাসে। তখন আকতারের মনে হয়, বেচারা স্বামী আমেরিকায় বসে হৃষ্টপুষ্ট লাজবতীর কোনো নাটকই দেখতে পাচ্ছে না।

ঢাকা থেকে ফিরে হোমায়রার বেশ পরিবর্তন হয়। বিশ্বসুন্দরী আর কি! কুতকুতে চোখে গাঢ় আইশ্যাডো। পরনে জর্জেটের আঁটসাঁট সালোয়ার কামিজ। কলেজে সদ্যভর্তি হওয়া খুকি আর কি! অফিসের অনেকের চোখ তির্যক হয়ে যায়। সারাদিন সিঁড়ি টপকিয়ে একরুম থেকে অন্যরুমে ছুটোছুটি। মহা ব্যস্ত। লাঞ্চের পর বিকেলে ডিরেক্টরের চেম্বারে। অনেক ডিসকাশন। কথার পিঠে কথা। দু’জনই দেশ উদ্ধারে নিবেদিতপ্রাণ যোদ্ধা। সেই আলোচনা চলে অনেক রাত অবধি। তারপর কী হয় কে জানে, হয়তো রমজান জানে। তার মুখে সব সময় মুচকি হাসি। নিজের সঙ্গে অনেক গল্প করে রাত পাহারা দেয়।

সপ্তাহ তিনেকের মধ্যে শোনা গেল, এবার ডিরেক্টরের সঙ্গে হোমায়রা ফিলিপাইন যাচ্ছে। সাসটেইনবল ল্যান্ড ইউজ প্রশিক্ষণ কর্মশালায় অংশ নিতে। সেদিন বিকেলে ক্যান্টিনে বিষয়টি নিয়ে আড্ডা জমে ওঠে। আকতার পানি খেতে গিয়েছিল। দেখে রানা, শফিক, হাবিব আর সাদিকুল গল্প করছে। আলোচনার বিষয় মুহূর্তে বোঝা যায়। ফিলিপাইনের প্রশিক্ষণ হলো কৃষি সংক্রান্ত। সেখানে সাদিকুল কিংবা খামার বনায়ন প্রকল্পের শফিকের যাওয়া উচিত, অথচ যাচ্ছে কিনা তাহেরা। কোন্ নিড অ্যাসেস্মেন্টের ভিত্তিতে ম্যানেজমেন্ট এই ডিসিশন নিল? এ সহ্য করার মতো নয়। অসহ্য, তবু সইতে হচ্ছে। কেননা তারা চাকরি করে মাত্র। তখন হাবিব বলে বসে,
‘আকতার ভাই, এখানে কেন সস্তায় মেধা বিক্রি করছেন? আপনি যত স্পিডে কাজ করেন একটা বিদেশি ট্রেনিং সার্টিফিকেট পাওয়া উচিত ছিল।’
‘তাই তো রে ভাই! ফেসভ্যালু নেগেটিভ।’
সে বেশ হকচকিয়ে পালটা ঠাট্টা করে। সাদিকুল প্রায়শ আলতু ফালতু কথা বলে। কেন জানি সেবার বেছে বেছে মতামত জানায়। বলে,
‘রেজা ভাই ঝঁংঃধরহনধষব খধহফ টংব-এর কী বোঝে? আমরা কি ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে গরুর খড়বিচালি তৈরি করার ডিগ্রি নিয়েছি? এটা আমাদের বিষয়।’

‘গরপৎড়-গধপৎড়, ঊপড়-ংুংঃবস, ইরড়-ফরাবৎংরভরপধঃরড়হ, ঝড়রষ ঘঁঃৎরবহঃ, ঝববফ এবৎসরহধঃরড়হ, ঐবৎনধষ চবংঃ গধহধমবসবহঃ পযধঢ়ঃবৎ এলে মুখ হাঁ হয়ে যাবানে।’

শফিকের কথার উত্তরে হাবিব কী বলে আকতারের শোনা হয় না। সে ক্যান্টিন থেকে বেরিয়ে নিউজরুমে যেতে থাকে। ডিরেক্টর নেই। ঢাকা গেছে। আজ একটু পেপার দেখবে। দেশের কী খবর? ক্ষমতাসীন দল কি আবার কন্টিনিউ করবে? এই তীব্র শৈত্যপ্রবাহ আর কত দিন? সে নিজের প্রতি অসম্ভব করুণায় হেসে ওঠে। নিজের ঘরবাড়ির খবর ভালোমতো জানা হয় না, দেশের খবরে কী আসে যায়! আদার বেপারির জাহাজের খবর রাখার মতো।

আলম একটি স্পিড ব্রেকার পেরোয়। আকতার সেই ঝাঁকুনিতে সময়ে ফিরে আসে। মোটরবাইকের গতি বাড়ছে। দ্রুত সরে যাচ্ছে ফসলের খেত মাঠ বাজার মানুষজন। তাকে যেতে হবে চৌপুকুরিয়া গ্রাম। ক্যামেরায় কয়েকটি স্ন্যাপ নেবে। নোটবুকে কিছু তথ্য। ওয়াটার অ্যান্ড স্যানিটেশন প্রকল্পের জন্য কেসস্টাডি লিখতে হবে। সময় আছে মাত্র একদিন। যথাসময়ে টেবিলে দিতে না পারলে শাহ ইমাম রেজার কাঁচাপাকা গোঁফ বেড়ালের মতো ফুঁসে উঠবে। আকতার মনে মনে সে-রকম একটি ছবি চোখের সামনে ভেসে উঠতে দেখল। আলম আপন মনে বাইক চালাচ্ছে। হঠাৎ জিজ্ঞেস করে -

‘আগে এদিকে এসেছিলেন?’
‘এসেছি। একটা গ্রাম কিন্তু ঘর-বসতি বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো। তাই ভালোমতো ঘোরা হয়নি। ডাব্লিউ এস এল ইনস্টলেশন আছে তো?’

‘দেখেন গিয়ে গরুকে খড় ঘাস খাওয়ানোর ঘেরা করেছে। এরা বলে, খোলা জায়গা না হলে নাকি ওটা হয় না।’
‘তাই, বেশ ইন্টারেস্টিং তো!’
‘আকতার ভাই অনেক মটিভেশন দেয়া হয়েছে। ঋণ দেয়া হয়েছে। মাঠকর্মী রিং-সøাব ভ্যানে করে বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছে। অবস্থা আগের মতোই।’

‘না না এখন তো চেঞ্জ হচ্ছে। মানুষের শিক্ষার হার বাড়ছে। বুঝতে পারছে কীভাবে উন্নয়ন হবে।’
বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ। আকতার ভাবে, কেসস্টাডির কাজ না হয় আজ থাক। আগামীকাল শুক্রবার করবে। ওইদিন অথবা শনিবার জমা দিয়ে রবিবার সিএল নেবে। কয়েকদিন ধরে বেশ টায়ার্ড লাগছে। শরীর বিশ্রাম চায়। সে তো মেশিন নয়। অনেকদিন সবাই একসঙ্গে বসে খাবার সুযোগ হয় না। টিভি দেখা হয় না। দুনিয়ার সব মানুষের সাপ্তাহিক ছুটি আছে। তার নেই। আছে যা কাগজে কলমে।

‘আপনি গাড়ির রিকুইজিশন করছেন না কেন আকতার ভাই? এভাবে লিফট নিয়ে কতদিন কাজ করবেন?’
‘রিকুইজিশন করেছি তো, ফান্ড নেই; পরের ফেজে নাকি দেবে।’
‘হোমায়রাকে দেখছি বদরুলের গাড়িতে করে ফিল্ড করছে। ব্যাপার কী? বদরুল তো কাউকে এত খাতির করে না।’
‘এসব বলতে পারব না ভাই। তবে শুনেছি বেনিফিসিআরি লেভেলে জেন্ডার ইকুইটি মনিটর করার জন্য বদরুল অ্যাসিস্ট করছে। তাকে প্রোগ্রাম বোঝানো হচ্ছে।’

‘সে ভালোমতো শেখানো হচ্ছে বটে, কী বলেন? হা হা হা!’
‘ব্যাপার কি খুব হাসছেন?’

‘আকতার ভাই, আপনি আসলে কোনো খবর রাখেন না। নিজের মধ্যেই আছেন। মহিলা প্রেগন্যান্ট, গুজব উঠেছে বদরুলের কাজ।’

‘সে মহিলা তো বিবাহিতা। স্বামী আছে। কনসিভ করতেই পারে।’
‘আকতার ভাই, ফিল্ড ঘুরছেন চোখ-কান খোলা রাখেন। দেখবেন ডরমিটরিতে কে কার সঙ্গে রাত কাটায়।’
‘বাদ দেন এসব আলোচনা।’

আকতার অসম্ভব বিরক্তিতে মুখ ফিরিয়ে নিল। তার এসব বলতে শুনতে ভালো লাগে না। কেউ কেউ আবার এসব নোংরা আলোচনা করে দিন কাটিয়ে দেয়। তারাই সমাজে ভালো অবস্থায় আছে। তার মতো গর্দভ সুযোগের অভাবে চরিত্রবান। নিজের মনে আত্মপ্রসাদের মালা গাঁথছে। কি মানুষ আর কি সভ্যতা!
বিদ্যুৎ চলে গেল। ফ্লুরোসেন্ট বাল্বগুলো দপ করে অন্ধকার। রানা যে কম্পিউটারে কাজ করছিল অফ হয়ে গেছে। আকতারের কম্পিউটারে ইউপিএস থাকায় অফ হয়নি। টিঁ টিঁ বাঁশি বাজাতে শুরু করেছে। সে দ্রুত কেসস্টাডির ফাইল একপলক দেখে নেয়। শিরোনামগুলো আরও ভালো করতে হবে। ভাষাও রিটাচ করা দরকার। বেশি সময় নেই। সে ফাইল সেভ করে শাট ডাউন ক্লিক করে।

বাইরে আলোছায়ার মায়াময় সন্ধে। একটু আগে মাগরিবের আজান শেষ হয়েছে। নামছে শীতের রাত। বাড়ছে কনকনে ঠাণ্ডা। সে হাতের কাজ শেষ না করে বাসায় ফিরতে পারবে না। আজকেই ডিরেক্টরের টেবিলে জমা দেয়ার কথা। আগামীকালের জন্য অপেক্ষা করা সম্ভব নয়। এতক্ষণ কী লিখবে ভেবে ভেবে চলে গেল। এরমধ্যে লোডশেডিং। পাক্কা দেড়-দুই ঘণ্টার আগে আসবে কি না সন্দেহ। এই আশঙ্কায় কম্পিউটার রুমের মধ্যে বসে থাকতে দম বন্ধ হয়ে আসে তার। একটু বাইরে গেলে মন্দ হয় না। রানার ছায়া আবছা আলোতে হাতের আঙুল মটকাতে শুরু করেছে।

‘মোড়ে যাবেন চা খেতে?’
‘চলেন আপনাকে একটু কম্পেনি দিই। আপনি তো থাকবেন নাকি?’
‘হ্যাঁ কেসস্টাডি প্রায় শেষ করে এনেছি। আর এক দুই পাতা লিখলেই কমপ্লিট।’
‘আপনি তো কাজেই আছেন। আমার সময় কাটে না। মেসে গিয়ে কী করব? ভাবছি বিডিআর অডিটোরিয়ামে ছবি দেখতে যাই। মারাত্মক একটা ছবি নাকি চলছে, যাবেন?’
‘না ভাই।’

আকতার ছোট দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দেয়। তার জীবনে অবসর আনন্দ কিছু অবশিষ্ট নেই। এখন কাজ আর বেঁচে থাকা। এভাবে চলতে চলতে একদিন টুপ করে মরে যাবে। বিনোদন বিলাসিতা এখন বহুদূরের জিনিস। মাস শেষে সাড়ে তিন হাজার টাকায় সে-সব হয় না। কোনো সম্পদ তৈরি করা যায় না, যা ছেলেমেয়েদের নিরাপত্তা দেবে। সে চলে গেলে যাতে তারা বলতে পারে, বাবা অন্তত মাথাগোঁজার একটি ঠাঁই করে গেছে কিংবা দু-চার শতক জমি। কি জীবন! হাজার হাজার কোটি টাকা দরিদ্র ভূমিহীন মানুষদের জন্য বিদেশ থেকে আসছে। সে এমন অনেক ভূমিহীন মানুষের কেসস্টাডি আর ফিচার লিখে চলেছে। কিন্তু নিজে একজন ভূমিহীন মানুষ সে কথা কাউকে বলতে পারল না। তেমনভাবে অ্যাপ্রোচ করতে নিতান্তই অসহায়। নিজের এই দুর্বলতা ও প্রহসন মনকে আরও খারাপ করে দেয়। সে বিদ্যুতের জন্য হাহাকার করে ওঠে। কাজ শেষ করতে করতে রাত ১০-১১ বেজে যাবে। আজকাল একবেলাতে রান্না করা হয়। খড়ির দাম বেশি। সেই ভাত রাত অবধি ভালো থাকে না। হয়তো আজকেও লবণ মরিচ মাখিয়ে খেতে হবে। কোনো উপায় নেই।

রানা বিডিআর অডিটোরিয়াম চলে গেছে। তাকে কিছুক্ষণ সাধে। সে যায়নি। যেতে পারে না। তখন রানা বলে,
‘তা হলে হরিপুর যাচ্ছেন? একেবারে এরিয়া কো-অর্ডিনেটর। স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবেন। গরিবদের টাকা দেবেন, সুদ সমেত ফেরত নেবেন; এই তো কাজ। দু-হাতে টু-পাইস। কি যাবেন তো?’
‘না!’

সে রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে বাসস্ট্যান্ড মোড়ের এককোণায় দাঁড়িয়ে থাকে। সন্ধে ৭:৩৫। শিশু নিকেতনের নিচে পান দোকানের রেডিওতে সৈনিক ভাইদের জন্য অনুষ্ঠান দুর্বার শুরু হলো। লোডশেডিং চলছে। বিদ্যুৎ হয়তো ২০-২৫ মিনিটের মধ্যে চলে আসতে পারে। অথবা এক-দুই ঘণ্টা। কে জানে কখন! অপেক্ষার এই সময়টুকু প্রলম্বিত, অতিদীর্ঘ। এক দুই তিন চার পাঁচ ছয়। অথবা নিরানব্বই আটানব্বই সাতানব্বই ছিয়ানব্বই পঁচানব্বই। তার মন উন্মন অস্থির গণনা শুরু করে দেয়। নামতা পড়তে থাকে। জীবন হলো অঙ্ক। সে অঙ্কে কাঁচা। মনে পড়ে দুই যোগ দুই সমান সমান চার। দুই গুণন দুই সমান সমান চার। এটিই নিয়ম। অথচ এখন সেই নিয়ম নেই। অনিয়মের নিয়মই হলো নিয়ম। সেখানেও অঙ্ক। সেই অঙ্ক সকলে জানে না। জানলেও অনুসরণ করতে পারে না। যারা পারে, অনায়াসে দুইয়ে দুইয়ে বাইশ করে দেখায়; ভালভাবে টিকে আছে, টিকে থাকবে। দুইয়ে দুইয়ে বাইশ। সে এই নিয়ম জানে না।

আকতার আচমকা হিমবাতাসে অজানা আশঙ্কায় কেঁপে ওঠে।


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us