কেমন ছিল মুসলিম-শাসিত বাংলা

জি. মোস্তফা | Jun 23, 2021 04:37 pm
কেমন ছিল মুসলিম-শাসিত বাংলা

কেমন ছিল মুসলিম-শাসিত বাংলা - ছবি সংগৃহীত

 

এক.

স্যার এডমন্ড বার্ক নামক জনৈক বিখ্যাত ব্রিটিশ পার্লামেন্টারিয়ান তার এক গুরুত্বপূর্ণ ভাষণে বলেছিলেন, মুহাম্মদ স.-এর অনুসারীরা যে শাসন ব্যবস্থার সূচনা করেছিলেন,তাতে করে অন্তত পরবর্তী এক হাজার বছরের মধ্যে এমন কোনো দুঃসংবাদ আমরা পাই না যে তাদের শাসিত এলাকার মানুষ দুর্ভিক্ষের শিকার হয়েছে কিংবা কোনো মানুষ না খেয়ে মরেছে।

তিনি আরো বলেছেন, মুহাম্মদ স.-এর অনুসারীরা যেখানে যেথায় শাসনকাজ পরিচালনা করেছেন, সেখানে অন্ত খাওয়া পরার একটা নিশ্চয়তা বিদ্যমান ছিল।

বাংলায়ও এই ব্যবস্থাপনার ব্যতিক্রম কিছু ঘটেনি। মানুষ তখন চিরসুখে জীবনযাপন করছিল।দীর্ঘ সাড়ে ৬০০ বছর স্থায়ী মুসলিম শাসনে মানুষ সকল ধরণের সুযোগ সুবিধা ও মৌলিক অধিকারের গ্যারান্টি পেয়েছিল। দেশে ব্যাপক উন্নয়ন ঘটেছিল। শিল্প,সাহিত্য,সংস্কৃতি ও প্রতিটি ক্ষেত্রে পূর্ণ বিকাশ সাধিত হয়েছিল। মানুষের ভেতর তৈরি হয়েছিল ভালোবাসার সম্পর্ক। অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে মুক্তি মিলেছিল তো নিশ্চয়ই। সাম্য ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো পুরনো বৃক্ষের শিকড়ের মতো দৃঢ়রূপে।

বাংলা ছিলো দুনিয়ার স্বর্গ।এখানে সব রকমের ফসলেরর চাষ হতো।এ অঞ্চল কৃষিতে ছিল স্বয়ংসম্পূর্ণ।ফলে মানুষের কোনো অভাব ছিল না। এমনকি জাকাত নেয়ার মতো ব্যক্তি খুঁজে পাওয়া দুষ্কর ছিল। বাংলা অঞ্চল থেকে থেকে ৮০টি অঞ্চলে ফসল রফতানি করা হতো, যেখানে উৎপাদিত ৩০০-এর বেশি ফসল সমগ্র দুনিয়ায় পৌঁছে যেতো। খনিজ সম্পদে ছিলো প্রাচুর্যময়। জাহাজ নির্মাণশিল্পে এ অঞ্চল ছিলো উন্নত।উসমানি শাসকরা পর্যন্ত এ অঞ্চল থেকে জাহাজ আমদানি করত।

শিক্ষাব্যবস্থায় ব্যাপক উন্নতি হয়েছিল।এস বসুর এডুকেশন ইন ইন্ডিয়া গ্রন্থ থেকে জানা যায়, ইংরেজ শাসনের আগে কেবল বাংলাদেশেই ৮০ হাজার মকতব ছিল।(ম্যাক্স মুলারের রিপোর্ট অনুযায়ী)। প্রতি ৪০০ লোকের জন্য একটি করে মাদরাসা ছিল। সুলতান মুহাম্মদ বিন তুঘলকের আমলে দিল্লিতে এক হাজার মাদরাসা ছিল।সেখানে ধর্মতত্ত্বের সাথে দর্শন
শিক্ষার ব্যবস্থা ছিল। দিল্লির কেন্দ্রীয় সরকার দুর্বল হওয়ার পরও কেবলমাত্র রোহিলাখন্ড জেলার বিভিন্ন মাদরাসায় পাঁচ হাজার আলেম শিক্ষাদান কাজে নিয়োজিত ছিলেন। নওয়াব রহমত আলী খানের কোষাগার থেকে তারা নিয়মিত বেতন পেতেন। মাদরসায় দর্শন, অর্থনীতি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, পৌরনীতি, সমাজতত্ত্ব, ভাষা, সাহিত্য, গণিত, উসূল, ফিকহ, তাফসির, হাদিস, চিকিৎসাবিজ্ঞান ইত্যাদি পড়ানো হতো।

আল্লামা মওদূদী (রহ.) সে শিক্ষাব্যবস্থার পর্যালোচনা করতে গিয়ে বলেন," তখন আমাদের দেশে যে শিক্ষা ব্যবস্থা ছিল,তা সে সময়ের দাবি ও প্রয়োজন পূরণে যথেষ্ট ছিলো।এ ব্যবস্থায় এমন সব বিষয় পড়ানো হতে,যা তখনকার রাষ্ট্র পরিচালার জন্য প্রয়োজন ছিল। তাতে শুধু ধর্মীয় শিক্ষাই প্রদান করা হতো না, বরং সে শিক্ষা ব্যবস্থায় দর্শন, মানতিক, সমাজ ও রাষ্ট্রনীতি, সাহিত্য এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় বিষয়েও শিক্ষা দেয়া হতো। কিন্তু যখন সে রাজনৈতিক বিপ্লব সংঘটিত হয়, যার প্রেক্ষিতে আমরা গোলামে পরিণত হলাম, তখন গোটা শিক্ষা ব্যবস্থাই তার কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলে।(তা'লীমাত : সাইয়েদ আবুল আ'লা মওদূদী)।

ঐতিহাসিক ইবনে বতুতার সফরনামা থেকে জানা যায়, এ দেশে তখন স্বতন্ত্র মহিলা মাদরাসা ছিল। সুলতান গিয়াসুদ্দিন খিলজির মহলে দশ হাজার মহিলা ছিলো। মুহাম্মদ কাসিম ফিরিশতার ইতিহাস থেকে জানা যায়, এদের মধ্যে হাজার হাজার হাফেজা, ক্বারিয়া, আলেমা ও শিক্ষিকা ছিলেন।

দুই.

১৭৫৭ সালে ব্রাহ্মনবাদী ও ইংরেজদের চক্রান্তে পলাশী অভিনয়ের মাধ্যমে বাংলা ও ভারতবর্ষের স্বাধীনতার সূর্য হয় অস্তমিত। শুরু হয় ইংরেজদের দৌরাত্ম্য পিশাচের মতো আচরণ। জোঁকের মতো তারা শোষণ করে বাংলাকে।পলাশী বিপর্যের পর সাত দিন পর্যন্ত বাংলার রাজধানী মুর্শিদাবাদ বৃটিশরা লুণ্ঠন করে।মুর্শিদাবাদ হতে লুণ্ঠিত সোনা-চাঁদি,গহনা-পত্র এবং টাকা পয়সা ইত্যাদিসহ ৬০টি নৌকা বোঝায় মালামাল কলকাতায় নিয়ে যাওয়া হয়। সে সব মূল্যবান সম্পদ কলকাতায় পৌঁছার পর সেখান হতে স্বয়ং লর্ড ক্লাইভ চুরি করে ছয় লাখ পাউন্ড মূল্যমানের সম্পদ এবং তার চেলা চামুন্ডারা চুরি করে আরো চার লাখ পাউন্ড।

সর্বমোট ১০ লাখ পাউন্ড চুরি হওয়ার পরও অবশিষ্ট যে টাকাগুলো ইংল্যান্ডে পাঠানো হয়েছিল, তা দিয়ে ১৭৫৮ খ্রিস্টাব্দের ১ জুলাই সর্বপ্রথম ইউরোপের বুকে 'ব্যাংক অব ইংল্যান্ড' এর জন্ম হয়। আর সেই ব্যাংকের অর্থের সাহায্যেই তৎকালিন ইউরোপে শিল্প বিপ্লবের সূচনা হয়।

ইংরেজ প্রতবেদন অনুযায়ী পলাশী বিপর্য়ের পর এদেশ থেকে মাত্র ১০ বছরে ব্রিটিশরা মোট ৬০ লাখ পাউন্ড চুরি করে।বর্তমানে ১ পাউন্ড সমান বাংলাদেশী ১০৪.৭১ টাকা। এই ব্যাপক লুণ্ঠনের ফলে ১৭৭০ সালে (বাংলা ১১৭৬) বাংলা ও বিহারে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয় এবং প্রায় দেড় কোটি মানুষ মৃত্যুবরণ করে। ‘ছিয়াত্তরের মন্বন্তর’ নামে পরিচিত এই মহাদুর্ভিক্ষে ইংরেজ গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস-এর স্বীকারোক্তি মোতাবেক মৃতের সংখ্যা ছিল এক কোটি পঞ্চাশ লাখ! শুধু অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেই নয়, শিক্ষা, ভাষা, সাহিত্য প্রভৃতি ক্ষেত্রেও পলাশী পরবর্তীকালে ব্যাপক বিপর্যয় দেখা দেয়।

তারপর ২০০ বছর তারা বাংলা তথা ভারত বর্ষকে শোষণ করে। সবুজ শ্যামল সোনার বাংলা পরিণত হয় শুকনো খেজুরের পাতার মতো বস্তুতে। অসার ও শূন্য হয়ে ওঠে অর্থনৈতিক কোষাগার। সংস্কৃতি ও শিক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে গড়ে ওঠে শ্বেত চামড়াওয়ালাদের গোলামির প্রশিক্ষণ কেন্দ্র।

ইংরেজ আমলে মাদরসাগুলো বন্ধ হয়ে যায়। কৃষি ও শিল্পখাতে বিপর্যয় দেখা দেয়।তারা জোরপূর্বক খাদ্যশস্যের পরিবর্তে এদেশের কৃষকদের নীল চাষ করাতে বাধ্য করে। এতে সাধারণ মানুষ অনাহারে কষ্টে জীবন যাপন করে।

তিন.

পলাশীতে ভারতের স্বাধীনতা সূর্য অস্তমিত হওয়ার শুধু এ উপমহাদেশের চিত্রই পাল্টেনি বরং পুরো বিশ্বের চিত্রই পাল্টে গিয়েছিল। ভারতবর্ষে ইংরেজ আধিপত্য প্রতিষ্ঠার কারণেই উসমানি সাম্রাজ্যের পতন ত্বরান্বিত হয়, যার ফলে অবৈধ ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত।

ইসরাইল প্রতিষ্ঠার পর মধ্যপ্রাচ্যসহ গোটা দুনিয়ায় বিপর্যয় ও নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়। এখনো সেই তিক্ত বিষফলের স্বাদ মুসলিম উম্মাহ এবং সারা দুনিয়া ভোগ করছে।


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us