সাধু সাংবাদিক, কন্যা দায়গ্রস্ত পিতার বয়ান

হাসান মাহমুদ | Jul 21, 2021 08:44 pm
প্রতীকী ছবি

প্রতীকী ছবি - ছবি : সংগৃহীত

 

সেই কবেকার কথা। হঠাৎ মনে হওয়ায় বিভ্রম কেটে গেল। সুতায় টান পড়তেই বুঝলাম টোপ সত্যিই গিলে ফেলেছি। হেঁয়ালি বিধির খপ্পড়ে যখন পড়েই গেছি, তখন আর কিছু করার নেই। মরা ঢেঁকির মতো খেটেই মরতে হবে।

অনেক চড়াই-উৎরাই পার হয়ে সবে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছি। আগেই বুঝেছিলাম, পরের ধাপে যাওয়াটা তেমন সহজ হবে না। আর অমন গাধার খাটুনি করে ষাঁড়ের দৌড় প্রতিযোগিতায় আমি পরাজিত। কাজেই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার স্বাদ আগেই অম্ল হয়ে গেছে।

একদিন খবর পেলাম, পরের দিন একটি কর্মশালা হবে। ঢাকা থেকে বড় সাংবাদিকরা আসবেন, বেসিক কিছু প্রশিক্ষণ হবে। যারা ভালো করবে বিভিন্ন মিডিয়ায় কাজ করার সুযোগ করে দেবে কর্তৃপক্ষ। আমি সুযোগটা কাজে লাগানোর ফন্দি করলাম।

সোৎসাহে অংশ নিলাম। তিন দিনের টানা ক্লাস প্রাকটিক্যাল শেষে চূড়ান্ত প্রেজেন্টেশন দিতে গেলাম ভিন্ন জগৎ পার্কে। বলে রাখি, ভিন্ন জগৎ রংপুর শহরের অদূরে বৃহৎ একটি কমার্শিয়াল পার্ক : প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম পরিবেশের অসাধারণ এক সংমিশ্রণ। স্ক্রিপ্ট তৈরি করেই গেলাম। প্রথম ক্যামেরা ট্রায়াল, সবারই পা কাঁপাকাঁপি অবস্থা। আমি একবারের ট্রায়েলেই পাস করলাম।

কিন্তু, নিয়মের ঘোর প্যাঁচে আমার মতো অছাত্রের উন্নতি হলো না। আমার উচ্চমাধ্যমিকের রেজাল্ট তখনো বের হয়নি। কাজেই আমি কাজের অযোগ্য বিবেচিত হলাম। ওই সময় ক্লাস নিতে গিয়েছিল এটিএন বাংলার বিশেষ প্রতিনিধি মোর্শেদ ভাই। সাংবাদিকতায় আমার আগ্রহ দেখে ওনার বাস্তব জীবনের গল্প বলতে শুরু করলেন।

ওনি ভার্সিটির ভালো স্টুডেন্ট, ক্যাম্পাস সাংবাদিকতায় হাতেখড়ি। অনার্স শেষ করে যোগ দিলেন প্রতিষ্ঠিত একটি গণমাধ্যমে। এবার তার শিকলবদ্ধ হওয়ার পালা। পাত্রীও রেডি, মানে নিজেদের মধ্যেই বোঝাপড়া। কিন্তু বাধ সাধল পাত্রীর বাবা। কোনোভাবেই তিনি সাংবাদিকের হাতে মেয়েকে তুলে দেবেন না। বেচারা অন্য জাতের মানুষ। কী আর করার, দুটার যেকোনো একটি ছাড়তে হবে। সাংবাদিক বেচারাও ঘাড় ত্যাড়া। কোনোভাবেই তার ভালো লাগার পেশা ছাড়বেন না। অবশেষ নিজের ভালো লাগাকে ধরে রাখতে ভালোবাসা ছেড়ে দিলেন। নতুন করে ঘর করা শুরু করেছেন। কিছু দিন আগে ঢাকায় মোর্শেদ ভাইয়ের সঙ্গে দেখা, শুনলাম সব কিছু নাকি তার ভালোই চলছে।

একটু অন্যদিকে চলে গিয়েছিলাম। এবার কাজের কথায় আসি। কর্মশালায় এই গল্প বলে আমাকে সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে দশবার চিন্তা করতে বললেন। আমি চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নিলাম, যদি কিছু হই তাহলে সাংবাদিকই হবো।

এর পর কেটে গেছে দুই বছর। পাবলিক প্রাইভেট কোথাও ভর্তি হওয়া হলো না। আইনের গ্যাঁড়াকলে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়েও ভর্তি হওয়া হলো না। তখন সন্ন্যাসী হওয়া ছাড়া উপায় রইল না। সত্যিই একদিন সন্ন্যাসী হলাম। রংপুর পাবলিক লাইব্রেরী হয়ে উঠল আমার সাধনার তীর্থ স্থান। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে আমার সাধনা। মাঝখানে শুধু একটি টিউশনি করাতাম। সেটা দিয়েই দিব্বি চলছিল আমার। এভাবে দুই বছর পর বুঝতে পারলাম, যা হচ্ছে তার অ্যাকাডেমিক কোনো মূল্য এই সমাজে নেই। তত দিনে লাইব্রেরির সব তাক আর বেশির ভাগ বই পরিচিত হয়ে উঠল। পড়ার মতো বই পাচ্ছিলাম না। সেখানকার স্টাফরা কিছুটা বিস্মিত। অনেকটাই বিরক্ত। বুঝতে শুরু হলো, একটা অনিশ্চয়তা চারদিকে প্রকট হচ্ছে। বড় ধরনের আইডেন্টিটি ক্রাইসিস তৈরি হলো। অধিক সন্ন্যাসিতে গাঁজন নষ্ট হওয়ার উপক্রম।

মাধ্যমিকে ভালো রেজাল্ট করে রংপুর সরকারি কলেজে ভর্তি হয়েছিলাম, এজন্য প্রত্যাশার পারদ ছিল অনেক উপরে। সবাই আশা করেছিল, আমার কিছু একটা হওয়া দরকার ছিল। কিন্তু আমার তখন কোনো একাডেমিক পরিচয় ছিল না। ফলে কোথাও নিজের পরিচয় দিতে পারছিলাম না। ধীরে ধীরে সেটি আরো প্রকট হতে শুরু করল। কিছু কিনারা না পেয়ে একক সীদ্ধান্তে ঢাকায় এসে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগে ভর্তি হলাম।

দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে একটা কম্পানিতে পার্টটাইম চাকরি করে পড়ালেখাটা চালিয়ে নিলাম। আজ অনার্স শেষ হওয়ার আগেই বেতনভুক্ত সাংবাদিক হওয়ার পথে কিছুটা অগ্রসর। এখন বিধির বাম, একটি ঝালিয়ে নেয়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু মোর্শেদ ভাইয়ের পরিণতি যে আমারও হবে সেটা মনে হয় তখনও ভাবিনি। পরিবর্তিত পৃথিবীতে সবকিছু বদলেছে বলে মনে হয়েছিল, কিন্তু আদতেই যে পরিবর্তন হয়নি সেটা নিজে ভুক্তভোগী না হলে বিশ্বাস করতাম না।


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us