উপমহাদেশে সঙ্গীতে নজরুল- আব্বাসউদ্দিনের যোগসূত্র

সীমান্ত আকরাম | Jun 30, 2019 05:00 pm
উপমহাদেশে সঙ্গীতে নজরুল- আব্বাসউদ্দিনের যোগসূত্র

উপমহাদেশে সঙ্গীতে নজরুল- আব্বাসউদ্দিনের যোগসূত্র - ছবি : সংগ্রহ

 

নজরুল-আব্বাসউদ্দিন উপমহাদেশে সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে প্রধান দুই কালপুরুষ। প্রথম মুসলমান কবি যার কবিতা সব ধর্মের লোক পাঠ করতে বাধ্য, তার নাম কাজী নজরুল ইসলাম। প্রথম মুসলমান গায়ক যার গান সবার কণ্ঠের, কর্ণের ভেতর দিয়ে মর্মে পৌঁছেছিল। সে হলো আব্বাসউদ্দিন। দু’জনের যখন সম্মিলন ঘটল বাংলার মুসলমানরা ঘুমন্ত অবস্থা থেকে জাগ্রত হতে লাগল। নজরুল ও আব্বাসউদ্দিন তারা দু’জনে মিলে মুসলমানদের জাগিয়ে তুলেছেন। নজরুল-আব্বাসউদ্দিন বাংলা সংস্কৃতির নির্মাতা। নজরুল-আব্বাসউদ্দিনের যোগসূত্রতা উপমহাদেশে সঙ্গীতে একটা জাগরণ সৃষ্টি হলো।
সভা-সমাবেশে উপস্থিত সবাই উজ্জীবিত হতো আব্বাসউদ্দিনের গানে। কুচবিহারে ভর্তি হওয়ায় তার জীবনের আরেক সোনালি অধ্যায়ের দ্বার খুলে গেল। এই সময়ে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামে সাথে তার প্রথম পরিচয় হয়। নজরুলের অনুরোধে আব্বাসউদ্দিন সেই দিন অনেক সঙ্কোচে গাইলেন একটা রবীন্দ্র সঙ্গীত- ‘সে আসে ধীরে যায় ফিরে লাজে...।’ গান শুনে কবি জড়িয়ে ধরলেন আব্বাসউদ্দিনকে। গভীর আবেগে বললেন ‘তোমার গানের গলা অনেক ভালো। তুমি অনেক বড় গায়ক হবে।’ পরবর্তী সময়ে তিনি কলকাতায় যান। কবি নজরুল ইসলামের সাথে দেখা করেন। নজরুলও তাকে পেয়ে খুশিতে আত্মহারা হয়ে ওঠেন। নজরুল কালবিলম্ব না করে আব্বাসউদ্দিনকে নিয়ে যান গ্রামোফোন কোম্পানিতে এবং আব্বাসউদ্দিনের কণ্ঠে গাওয়া গান রেকর্ড করান। প্রথমে নানা কাব্যসঙ্গীতের মাধ্যমে তার প্রতিভার বিকাশ, বিশেষ করে ইসলামী গান রচনায় তার অনুপ্রেরণা নজরুলের লেখনীতে যে স্ফূর্তি বয়ে এনে দিয়েছিল তা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি তার আত্মজীবনীতে লিখছেন : ‘কাজিদার লেখা গান ইতোমধ্যে অনেকগুলো রেকর্ড করে ফেললাম। তার লেখা- বেনুকার বনে কাঁদে বাতাস বিধুর, অনেক ছিল বলার যদি দু’দিন আগে আসতে, গাঙে জোয়ার এলো তুমি ফিরে এলে কই, বন্ধু আজো মনে রে পড়ে আম কুড়োনো খেলা, ইত্যাদি।’

নজরুলকে আব্বাসউদ্দিন নিয়ে আসেন কুচবিহারে ছাত্রদের মিলাদ উপলক্ষে, কুচবিহার ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্রাবাসে। আব্বাসউদ্দিন লিখেছেন তার ‘আমার শিল্পী জীবনের কথা’ আত্মজীবনীতে : ‘দু’দিন রইলেন কুচবিহারে, কিছু গানে গানে কী যে উন্মাদনা সৃষ্টি করে গেলেন! আর তো মনকে কিছুতেই বইয়ের আখতে পারি না। আমার মনের গহন বলে সুরের পাখি সর্বদাই বিচিত্র সুরকাকলিতে আমায় করে তুলে উন্মনা।’
এরপর নজরুলের সাথে তার দ্বিতীয় সাক্ষাৎ দার্জিলিংয়ে। তিনি লিখেছেন : ‘তিল ধারণের স্থান নেই হলের ভেতর। কাজিদা তখন আবৃত্তি করছেন তার বিপ্লবী কবিতা ‘বিদ্রোহী’। পূর্ণ নিস্তব্ধতা কক্ষে বিরাজমান। জলদ্গম্ভীর সুরে আবৃত্তি করে চলেছেন। প্রতিটি শ্রোতা পলকহীন দৃষ্টিতে চেয়ে তার মুখের পানে। শেষ হওয়ার সাথে কী বিপুল করতালি। আমার দিকে চোখ পড়তেই তিনি আমাকে ইশারায় ডাকলেন। বলে উঠলেন, ‘কই, কোথায়’? আমি সামনে এসে আদাব করলাম। তিনি দাঁড়িয়ে উঠে ঘোষণা করলেন, ‘এক নতুন শিল্পীর সাথে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি- আব্বাসউদ্দিন।’ বললাম, ‘আপনার গানই গাই, কেমন?’ সানন্দে অনুমতি দিলেন। ধরলাম, ‘ঘোর ঘোররে আমার সাধের চরকা ঘোর।’ এক গানেই আসর মাৎ।’

এরপর কাজী নজরুল লিখে চললেন ইসলামী গান। আল্লাহ-রসুলের গান গেয়ে বাংলার মুসলমানদের ঘরে ঘরে জাগল এক নব উন্মাদনা। যার গান শুনলে কানে আঙুল দিত তাদের কানে গেল ‘আল্লাহ নামের বীজ বুনেছি নাম মুহাম্মদ বোলরে মন, নাম আহমদ বোল’। কান থেকে হাত ছেড়ে দিয়ে তন্ময় হয়ে শুনল ‘এলো আবার ঈদ ফিরে এলো আবার ঈদ, চল ঈদগাহে’ ঘরে ঘরে এলো গ্রামোফোন রেকর্ড, গ্রামে গ্রামে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল আল্লাহ-রসুলের নাম।’
আব্বাসউদ্দিন আহমেদ বিএ পড়ার সময় স্বদেশী আন্দোলন পাকিস্তান আন্দোলনের সাথে জড়িয়ে পড়েন। তিনি আন্দোলনের সুবাদে বাংলার কৃতী সন্তান শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, মাওলানা আবুল কালাম আজাদ এবং বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম প্রমুখের সান্নিধ্যে আসেন। সুকণ্ঠী গায়িকা ইন্দুবালা ও হিজ মাস্টার ভয়েস গ্রামোফোন কোম্পানির সংস্পর্শে আসেন। আব্বাসউদ্দিন শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের সাথে ঘুরে বেড়ান দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। বিভিন্ন সভা সমাবেশে তিনি গান পরিবেশন করতেন। সুযোগ ফেলে আব্বাসউদ্দিন পরিবেশন করতেন কাজী নজরুল ইসলামের সেই জাগরণী গান। ‘বাজিছে দামাম বাঁধরে আমামা/শির উঁচু করি মুসলমান/দাওয়াত এসেছে নয়া জামানার/ভাঙ্গা কেল্লায় ওড়ে নিশান’, ‘ত্রি-ভুবনে প্রিয় মুহাম্মদ এলোরে দুনিয়ায়/আয়রে সাগর আকাশ বাতাস দেখবি যদি আয়’, ‘ভারতের দুই নয়ন তারা হিন্দু মুসলমান/দেশ জননীর সমান প্রিয় যুগল সন্তান/হিন্দু মুসলমান’। (সূত্র : বাংলা সঙ্গীতের দিগন্তে ইসলামী সুবাতাস, মুস্তাফা জামান আব্বাসী, অনুরণন-২০১৬, পৃষ্টা- ...)

শিল্পী আব্বাসউদ্দিন কাজী নজরুল ইসলামের ৫০টি ইসলামী গানে কণ্ঠ দিয়েছেন। এ দিক থেকে তিনিও কাজী নজরুলের একজন সহযোদ্ধার মর্যাদার দাবিদার। এই সম্মিলনের ফলেই বাঙালি মুসলমান তার ধর্মকে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি দিয়ে আত্তীকৃত করতে পেরেছে। (তথ্যসূত্র : আমার শিল্পীজীবনের কথা (১৯৬০), আব্বাসউদ্দিন আহমদ)।
কাজী নজরুলের শতাধিক ইসলামী গানের মধ্যে সর্বাধিক জনপ্রিয় হলো ‘ও মোর রমজানের ওই রোজার শেষে এল খুশির ঈদ’ গানটি। আব্বাসউদ্দিন আহমদের জীবনী থেকে জানা যায়, সঙ্গীতশিল্পী আব্বাসউদ্দিনের অনুরোধেই কাজী নজরুল ইসলাম এ গান রচনা করেছিলেন। তবে আব্বাসউদ্দিনের অনুরোধে রচনা করলেও এই গান নজরুলের জীবনব্যাপী সংগ্রামেরই অংশ যেখানে তিনি স্বজাতির বেদনা ও মুক্তির তাড়নায় প্রতিনিয়ত সৃষ্টির আনন্দে মেতে ছিলেন। কবি তার কালজয়ী এ গানটি রচনা করেন ১৯৩১ সালে। শিল্পী আব্বাসউদ্দিনের কণ্ঠে গানটি রেকর্ড করা হয়। রেকর্ড করার দুই মাস পর ঈদের ঠিক আগে আগে এই রেকর্ড প্রকাশ করা হয়। উদ্দিনের ‘দিনলিপি ও আমার শিল্পী জীবনের কথার এ গান সম্পর্কে উদ্দিন লিখেন,

একদিন কাজীদাকে বললাম, ‘কাজীদা, একটা কথা মনে হয়। এই যে পিয়ারু কাওয়াল, কাল্লু কাওয়াল- এরা উর্দু কাওয়ালি গায়, এদের গানও শুনি অসম্ভব বিক্রি হয়। এ ধরনের বাংলায় ইসলামী গান দিলে হয় না? তারপর আপনি তো জানেন, কিভাবে কাফের-কুফর ইত্যাদি বলে বাংলার মুসলমান সমাজের কাছে আপনাকে হেয় করে রাখার জন্য আদাজল খেয়ে লেগেছে এক দল ধর্মান্ধ! আপনি যদি ইসলামী গান লেখেন, তাহলে মুসলমানের ঘরে ঘরে আবার উঠবে আপনার জয়গান।’ কথাটা তার মনে লাগল। তিনি বললেন, ‘তুমি ভগবতীবাবুকে বলে তার মত নাও। আমি ঠিক বলতে পারব না।’ আমি ভগবতী ভট্টাচার্য অর্থাৎ গ্রামোফোন কোম্পানির রিহার্সেল-ইনচার্জকে বললাম। তিনি তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলেন, ‘না না না, ওসব গান চলবে না। ও হতে পারে না।’ মনের দুঃখ মনেই চেপে গেলাম।

প্রায় ছয় মাস পর। একদিন দুপুরে বৃষ্টি হচ্ছিল, আমি অফিস থেকে গ্রামোফোন কোম্পানির রিহার্সেল ঘরে গিয়েছি। দেখি, একটা ঘরে আশ্চর্যময়ী আর ভগবতীবাবু বেশ রসালো গল্প করছেন। আমি নমস্কার দিতেই বললেন, ‘বসুন, বসুন’। আমি তার রসাপ্লুত মুখের দিকে চেয়ে ভাবলাম, এ-ই উত্তম সুযোগ। বললাম, ‘যদি কিছু মনে না করেন, তাহলে বলি। সেই যে বলেছিলাম, ইসলামী গান দেয়ার কথা। আচ্ছা; একটা এক্সপেরিমেন্টই করুন না, যদি বিক্রি না হয় আর নেবেন না, ক্ষতি কী’? তিনি হেসে বললেন, ‘নেহাতই নাছোড়বান্দা আপনি, আচ্ছা আচ্ছা, করা যাবে।’ শুনলাম, পাশের ঘরে কাজীদা আছেন। আমি কাজীদাকে বললাম, ভগবতীবাবু রাজি হয়েছেন। তখন সেখানে ইন্দুবালা কাজীদার কাছে গান শিখছিলেন। কাজীদা বলে উঠলেন, ‘ইন্দু, তুমি বাড়ি যাও, আব্বাসের সাথে কাজ আছে।’ ইন্দুবালা চলে গেলেন। এক ঠোঙা পান আর চা আনতে বললাম দশরথ থেকে। তারপর দরজা বন্ধ করে আধঘণ্টার ভেতরই লিখে ফেললেন, ‘ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে এল খুশির ঈদ।’

পরের দিন ঠিক এই সময় আসতে বললেন। পরের দিন লিখলেন, ‘ইসলামের ওই সওদা লয়ে এল নবীন সওদাগর।’ তখনই সুর সংযোগ করে শিখিয়ে দিলেন। গান দু’খানা লেখার ঠিক চার দিন পরই রেকর্ড করা হলো। কাজীদার আর ধৈর্য মানছিল না। তার চোখেমুখে কী আনন্দই যে খেলে যাচ্ছিল! তখনকার দিনে যন্ত্র ব্যবহার হতো শুধু হারমোনিয়াম আর তবলা। গান দু’খানা আমার তখন মুখস্থ হয়নি। তিনি নিজে যা লিখে দিয়েছিলেন, মাইকের পাশ দিয়ে হারমোনিয়ামের ওপর ঠিক আমার চোখ বরাবর হাত দিয়ে কাজীদা নিজেই সেই কাগজখানা ধরলেন, আমি গেয়ে চললাম। এই হলো আমার প্রথম ইসলামী রেকর্ড। শুনলাম; দুই মাস পর ঈদুল ফিতরের সময় গান দু’খানা তখন বাজারে বের হবে। ঈদের বাজার করতে একদিন ধর্মতলার দিকে গিয়েছি। বিএন সেন অর্থাৎ সেনোলা রেকর্ড কোম্পানির বিভূতিদার সাথে দেখা। তিনি বললেন, ‘আমার দোকানে এসো।’ তিনি এক ফটোগ্রাফার ডেকে নিয়ে এসে বসলেন, ‘এর ফটোটা নিন তো’। আমি তো অবাক! বললাম, ‘ব্যাপার কী’? তিনি বললেন, ‘তোমার একটা ফটো নিচ্ছি, ব্যস, আবার কী?’
ঈদের বন্ধে বাড়ি গেলাম। কলকাতা ফিরে এসে ট্রামে চড়ে অফিসে যাচ্ছি। রাস্তার আশপাশে আমার ছবি সংবলিত হাজার হাজার পোস্টার। ট্রামে একটি যুবক আমার পাশে গুনগুন করে গাইছে, ‘ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে।’ আমি একটু অবাক হলাম। এ গান কী করে শুনল! অফিস ছুটির পর গড়ের মাঠে বেড়াতে গিয়েছি, মাঠে বসে একদল ছেলের মাঝে একটি ছেলে গেয়ে উঠল, ‘ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে।’ আনন্দে-খুশিতে মন ভরে উঠল। ছুটলাম কাজীদার বাড়ি। শুনলাম, তিনি রিহার্সেল রুমে গেছেন। দেখি, দাবা খেলায় তিনি মত্ত। দাবা খেলতে বসলে দুনিয়া ভুলে যান তিনি। আমার গলার স্বর শুনে একদম লাফিয়ে উঠে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন, ‘তোমার গান কী যে-’ আর বলতে দিলাম না, পা ছুঁয়ে তার কদমবুসি করলাম। ভগবতীবাবুকে বললাম, ‘তাহলে এক্সপেরিমেন্টের ধোপে টিকে গেছি, কেমন?’ তিনি বললেন, ‘আরো-আরো গান চাই। বাজার মাত। মশাই আপনারা দু’জন জাদু জানেন। তাড়াতাড়ি গান লিখে সুর করতে বলুন কাজীদাকে-

‘আল্লাহ নামের বীজ বুনেছি/এবার মনের মাঠে/ফলবে ফসল বেচব তারে/কিয়ামাতের হাটে’, ‘নাম মুহাম্মদ বোল রে মন/নাম আহেম্মদ বোল/যে নাম নিয়ে চাঁদ সিতারা/আসমানে খায় দোল’, ‘আল্লাহ আমার প্রভু/আমার নাহি নাহি ভয়/আমার নবী মোহাম্মদ/যাহার তারিফ জগৎময়’ এবং ‘ত্রিভুবনের প্রিয় মোহাম্মদ এলো রে দুনিয়ায়/আয়রে সাগর আকাশ বাতাস দেখ্বি যদি আয়’। এমনিভাবে কাজী নজরুল ইসলামকে দিয়ে আব্বাসউদ্দিন লিখিয়েছিলেন এ ধরনের অসংখ্য ইসলামী গান। ঘুমন্ত মুসলিম জাতিকে জাগিয়ে তোলার গান শুনিয়ে দিলেন। নজরুলকে চিনলো বাংলার মুসলমানেরা। ডাক পড়তে লাগল বিভিন্ন সভা-সমাবেশ ও সমিতিতে। সাথে যাবেন আব্বাসউদ্দিন। নজরুল লেখেন গান আর আব্বাসউদ্দিন সে গান গেয়ে শোনান জনগণকে। জমে ওঠতে লাগল মুসলমানদের আসর। সত্যি সত্যি জেগে উঠল মুসলিম যুব সম্প্রদায় ও মুসলিম সমাজ। বাংলার ঘরে ঘরে পরিচিত হলেন নজরুল সাথে আব্বাসউদ্দিনও।
একদা আব্বাসউদ্দিন আহমদ নজরুলের বাসায় গিয়ে দেখেন, আগে থেকেই কবি নজরুল গভীর মনোযোগে কী যেন লিখছেন। আব্বাসউদ্দিনকে বসতে ইঙ্গিত দিয়ে আবার মন দিলেন লেখায়। জোহরের সময় হলে আব্বাসউদ্দিন কবির কাছে একটা চাদর চাইলেন, আর বললেন, একটি গজল লিখে দিতে হবে। কবি পরিষ্কার একটি চাদর এনে বিছিয়ে দেন আব্বাসউদ্দিনকে নামাজ পড়ার জন্য। আব্বাসউদ্দিন নামাজ পড়তে লাগলেন আর নজরুল গান লিখতে শুরু করে দিলেন। আব্বাসউদ্দিনের নামাজ শেষ হতে না হতেই নজরুল তার হাতে একটা কাগজ দিয়ে বললেন, নাও তোমার গজল। আব্বাসউদ্দিন তো অবাক হয়ে কবির দিকে তাকিয়ে থাকলেন, এই অল্প সময়েই নজরুল চমৎকার ইসলামী গান লিখে ফেলেছেন; তা-ও আব্বাসউদ্দিনের নামাজ পড়ার প্রসঙ্গ এনে। নজরুলের বিখ্যাত সেই গজলটি হলো- ‘হে নামাজী, আমার ঘরে নামাজ পড় আজ/দিলাম তোমার চরণতলে হৃদয় জায়নামাজ।’ (সূত্র : নজরুলের ইসলামী গান ও ভক্তিগীতি, মোস্তারী পারভীন টিনা, রাইটার্স ফাউন্ডেশন ২০০৩, পৃষ্টা-৬৩)

এই মহান কবি ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট ইন্তেকাল করেন। তাকে ঢাকায় সমাহিত করা হবে কোথায় তা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। এ প্রসঙ্গে কবির একটি গান প্রণিধানযোগ্য, ‘মসজিদেরই পাশে আমার কবর দিও ভাই/যেন গোর থেকেও মুয়াজ্জিনের আজান শুনতে পাই।’ কবির সেই বিখ্যাত ইসলামী গানে ব্যক্ত হওয়া অন্তিম ইচ্ছে অনুযায়ীই তাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে কবরস্থ করা হয়।

কাজী নজরুল ইসলাম যে পরিমাণ আর যে মানের গান উপহার দিয়ে গেছেন, তাতে বাংলা গানের এই রসদ পূর্ণ হয়ে রয়েছে। নজরুলের ইসলামী গান রচনার আগে মুসলমানরা লোকসঙ্গীত ধাঁচের ইসলামী সঙ্গীত নিয়ে যে হীনম্মন্যতায় ভুগতেন, কবির এই অপূর্ব সৃষ্টিসম্ভার তা ঘুচিয়ে দিয়েছে। তার এই সৃজন যে কেবল বাংলা গানে নতুন মাত্রা সংযোজিত করেছেন তা নয়, বরং বিশ্ব পরিমণ্ডলে ইসলামী গানের যে সুবৃহৎ ক্ষেত্র রয়েছে, সেই ধারাকেও করে গেছেন সমৃদ্ধ। কারণ, নজরুল রচিত ইসলামী সঙ্গীতগুলো সুরে কিংবা বাণীতে বিশ্বের প্রথিতযশা ইসলামী সঙ্গীতকারদের রচিত সঙ্গীতের তুলনায় কোনো অংশে কম নয়।

পরে শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের সাথে আব্বাসউদ্দিনের সাক্ষাৎ ঘটলে শেরেবাংলা আব্বাসউদ্দিনকে বললেন- ‘তোমার গান শুনে আমি মুগ্ধ হয়েছি। পরশু আমার বাসায় মিলাদ। তুমি আসবে। হামদ, না’ত শোনাবে আমাকে। মৌলভীদের শোনাবে। এত ভালো কাজ তুমি করেছ, মোলভী সাহেবরা জানেন না। ওদেরও জানিয়ে দেবো। আমি হারমোনিয়াম তবলা ইত্যাদি সব জোগাড় করে রাখব। আসবে কিন্তু।’ আব্বাসউদ্দিন বিনয়ের সাথে বললেন, ‘এত আমার সৌভাগ্য। আপনি বাংলার জন্য- মুসলমানের জন্য এত কিছু করছেন, আর আমি আসব না? আমিও তো আপনাদের কাজের একজন সামান্য সহযোগী।’

ঠিক সময়ে শেরেবাংলার বেনে পুকুর লেনের বাসা গিয়েছিলেন আব্বাসউদ্দিন। মৌলভী সাহেবরা উপস্থিত হয়েছিলেন আগেই। শেরেবাংলা আব্বাসউদ্দিনের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন তাদের। শিল্পীর প্রশংসা করলেন অকুণ্ঠচিত্তে। কিন্তু মৌলভী সাহেবরা তেমন খুশি হতে পারলেন না। কেমন যেন উশখুশ করতে লাগলেন। তারা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করতে লাগলেন- গায়ক আবার মুসলমান হয় নাকি? মুসলমানরা কি গান গায়? যথাসময়ে মিলাদ শুরু হলো। শেষও হলো। মুনাজাত শেষ হতেই শেরে বাংলা পাশের ঘর থেকে নিজ হাতে নিয়ে এলেন হারমোনিয়াম। মৌলভী সাহেবদের তো চক্ষু চড়কগাছ। তারা পরস্পরে মুখ চাওয়া চাওয়ি করতে লাগলেন। এমন সময় হক সাহেব মৌলভী সাহেবদের উদ্দেশে বললেন- ‘এতক্ষণ আপনারা মিলাদ পড়লেন বিদেশী ভাষায়। অনেক কথাই শ্রোতারা বুঝতে পারেনি। অনেক শব্দের অর্থ তারা জানতে পারেনি। এবার আব্বাসউদ্দিন আমাদের প্রিয় নবী হজরতের গুণগান করবে বাংলা ভাষায়। গানে গানে অভিবাদন জানাবে আমাদের প্রিয় মহানবীকে। আপনারা শুনুন। বুঝতে চেষ্টা করুন। ওর গান আমি শুনেছি। ওর গান শুনলে আমার চোখ দিয়ে পানি আসে। এই ভাবে সে যদি মুসলমানদের কাছে আমাদের প্রিয় নবীর কথা প্রচার করতে পারে তবে বাংলার মানুষ পাক্কা মুসলমান হবে।’ একজন মৌলভী সাহেব বললেন, ‘হুজুর গান শোনা নাজায়েজ। বেদাত কাজ।’ শেরেবাংলা রীতিমতো ধমকে ওঠলেন, বললেন, ‘মিথ্যে কথা। হজরতের আমলেও গানের প্রচলন ছিল। যুদ্ধের ময়দানে গান গেয়ে সৈনিকদের উৎসাহিত করা হতো। বিয়ে-শাদির মতো অনুষ্ঠানেও গান পরিবেশিত হতো। কাওয়ালি, হামদ, না’ত আসলে তো গান। সুরের ব্যাপার। সুর মনকে গলিয়ে দিতে পারে। উদ্দিন যে গান গাইবে তা আমাদের প্রিয় নবীর বাণী। এতে আপত্তি থাকার কথা নয়। আপনারা তো এতক্ষণ সুর দিয়ে মিলাদ পড়লেন। ভালো কথায় সুরের শেষ নেই।’ মৌলভী সাহেবরা শেরেবাংলার কথা মানলেন না। তারা জুতা হাতে একে একে উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, ‘আমরা আসি।’ হক সাহেব অনেকটা ক্ষুণ্ন স্বরে বললেন, ‘আসুন। জোর করে শোনাব না। তবে শুনলে বুঝতে পারতেন কেন আমি মিলাদে মাহফিলে গানের ব্যবস্থা করেছি। বুঝতে পারতেন, আমি বাংলার অশিক্ষিত ইসলাম ভক্তদের কাছে কেমন করে আমার প্রিয় নবীকে পরিচিত করতে চাই। আপনারা এতদিন যা পারেননি- আজ আব্বাসউদ্দিনকে দিয়ে তা আমি পারব বলে আশা রাখি। আমি চাই মুসলমানদের জাগাতে। নজরুলকে আপনারা কাফের ফতোয়া দিয়ে দূরে সরিয়ে দিয়েছিলেন। শুনলে বুঝতে পারতেন, আব্বাসউদ্দিন কী করে তাকে মুসলিম সমাজের জন্য কাজে লাগিয়েছে।’

হক সাহেবের এত বড় বক্তৃতায়ও কাজ হলো না। মৌলভী সাহেবরা আসর ছেড়ে বারান্দায় গেলেন। ঠিক এমনি সময়ে আব্বাসউদ্দিনের দরাজ কণ্ঠে ভেসে উঠল- ‘তোরা দেখে যা আমেনা মায়ের কোলে/মধু পূর্ণিমারই সেথা চাঁদই দোলে।’ এ গান শোনার পর মৌলভী সাহেবরা একে একে বারান্দা থেকে এসে আবার আসরে বসে পড়লেন। উদ্দিন গাইলেন- ‘এই সুন্দর ফল সুন্দর ফুল মিঠা নদীর পানি/খোদা তোমার মেহেরবাণী।’ মৌলভী সাহেবরা মুগ্ধ হয়ে শুনছেই, উঠছে না আর। আব্বাসউদ্দিন গাইলেন- ‘বাজিছে দামামা বাঁধরে আমামা/শির উঁচু করি মুসলমান/দাওয়াত এসেছে নয়া জামানার/ভাঙ্গা কেল্লায় ওড়ে নিশান।’ মৌলভী সাহেবরা উদ্দিনের কণ্ঠে গান শুনে অভিভূত হয়ে পড়লেন। তারা হক সাহেবের প্রশংসা করলেন এমন আসর করার জন্য।

আব্বাসউদ্দিনের ছেলে ও নজরুল গবেষক শিল্পী মুস্তাফা জামান আব্বাসী বলেন, ‘কাজী নজরুল ইসলাম ও আব্বাসউদ্দিন আহমেদ বাঙালি মুসলিম জাগরণের অগ্রদূত। তাদের যুগ্ম ভূমিকা জাতি ভুলবে কেমন করে? পিছিয়ে পড়া ঘুমিয়ে পড়া বাঙালি মুসলমান বিস্মৃতির অন্ধকার থেকে জেগে উঠেছিলেন যে দু’জনের হাত ধরে, তার প্রথম কবিকণ্ঠ কাজী নজরুল, প্রথম গীতকণ্ঠ আব্বাসউদ্দিন। ‘ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে এল খুশির ঈদ।’ গেয়েছিলেন আব্বাসউদ্দিন তার দরদি কণ্ঠে। সেই গান সবার কানে চিরদিনের জন্য অক্ষয় হয়ে রয়েছে। চারশত হামদ ও নাত লিখেছেন নজরুল। গেয়েছেন : আববাসউদ্দিন, কে. মল্লিক, বেদারউদ্দিন, গিরীন চক্রবর্তী, ধীরেন দাশ, আরো শত শিল্পী। অথচ সে গানগুলোকে আমরা অনায়াসে অবহেলা করলাম, এই বলে যে আল্লাহ্ ও রাসূলকে পরিত্যাগ করলেও চলবে, আধুনিকতাকে পরিত্যাগ করা যাবে না। তারা বুঝলেন না, আধুনিকতার উপাদান একমাত্র আল্লাহ্ ও তার রাসূল। নজরুল আমাদের জাতীয় কবি এই কারণে যে তিনি আল্লাহ্ ও রাসূলকে চিনেছেন। তা না হলে শত প্রেমের কবিতাও কাজে আসত না। আব্বাসউদ্দীন-এর ক্ষেত্রেও তাই। তিনি এ দেশের প্রথম জাতীয় কণ্ঠশিল্পী। তার স্বীকৃতি জাতি দিয়েছে। এই জমিনে যতদিন মুসলমান বাস করবে, তত দিন তারা নজরুল-আব্বাসউদ্দীনকে এই স্বীকৃতি দেবেই। নজরুল ও আব্বাসউদ্দিন বাঙালির জন্য অপরিহার্য।’ (সীমান্ত আকরাম সম্পাদিত মুস্তাফা জামান আব্বাসীর সাক্ষাৎকার গ্রন্থ ‘তার সাথে দেখা’, কাঠপেন্সিল-২০১৯, পৃষ্ঠা-৫৭)

উপমহাদেশে সঙ্গীতে নজরুল- আব্বাসউদ্দিনের যোগসূত্র
সীমান্ত আকরাম
নজরুল-আব্বাসউদ্দিন উপমহাদেশে সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে প্রধান দুই কালপুরুষ। প্রথম মুসলমান কবি যার কবিতা সব ধর্মের লোক পাঠ করতে বাধ্য, তার নাম কাজী নজরুল ইসলাম। প্রথম মুসলমান গায়ক যার গান সবার কণ্ঠের, কর্ণের ভেতর দিয়ে মর্মে পৌঁছেছিল। সে হলো আব্বাসউদ্দিন। দু’জনের যখন সম্মিলন ঘটল বাংলার মুসলমানরা ঘুমন্ত অবস্থা থেকে জাগ্রত হতে লাগল। নজরুল ও আব্বাসউদ্দিন তারা দু’জনে মিলে মুসলমানদের জাগিয়ে তুলেছেন। নজরুল-আব্বাসউদ্দিন বাংলা সংস্কৃতির নির্মাতা। নজরুল-আব্বাসউদ্দিনের যোগসূত্রতা উপমহাদেশে সঙ্গীতে একটা জাগরণ সৃষ্টি হলো।
সভা-সমাবেশে উপস্থিত সবাই উজ্জীবিত হতো আব্বাসউদ্দিনের গানে। কুচবিহারে ভর্তি হওয়ায় তার জীবনের আরেক সোনালি অধ্যায়ের দ্বার খুলে গেল। এই সময়ে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামে সাথে তার প্রথম পরিচয় হয়। নজরুলের অনুরোধে আব্বাসউদ্দিন সেই দিন অনেক সঙ্কোচে গাইলেন একটা রবীন্দ্র সঙ্গীত- ‘সে আসে ধীরে যায় ফিরে লাজে...।’ গান শুনে কবি জড়িয়ে ধরলেন আব্বাসউদ্দিনকে। গভীর আবেগে বললেন ‘তোমার গানের গলা অনেক ভালো। তুমি অনেক বড় গায়ক হবে।’ পরবর্তী সময়ে তিনি কলকাতায় যান। কবি নজরুল ইসলামের সাথে দেখা করেন। নজরুলও তাকে পেয়ে খুশিতে আত্মহারা হয়ে ওঠেন। নজরুল কালবিলম্ব না করে আব্বাসউদ্দিনকে নিয়ে যান গ্রামোফোন কোম্পানিতে এবং আব্বাসউদ্দিনের কণ্ঠে গাওয়া গান রেকর্ড করান। প্রথমে নানা কাব্যসঙ্গীতের মাধ্যমে তার প্রতিভার বিকাশ, বিশেষ করে ইসলামী গান রচনায় তার অনুপ্রেরণা নজরুলের লেখনীতে যে স্ফূর্তি বয়ে এনে দিয়েছিল তা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি তার আত্মজীবনীতে লিখছেন : ‘কাজিদার লেখা গান ইতোমধ্যে অনেকগুলো রেকর্ড করে ফেললাম। তার লেখা- বেনুকার বনে কাঁদে বাতাস বিধুর, অনেক ছিল বলার যদি দু’দিন আগে আসতে, গাঙে জোয়ার এলো তুমি ফিরে এলে কই, বন্ধু আজো মনে রে পড়ে আম কুড়োনো খেলা, ইত্যাদি।’

নজরুলকে আব্বাসউদ্দিন নিয়ে আসেন কুচবিহারে ছাত্রদের মিলাদ উপলক্ষে, কুচবিহার ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্রাবাসে। আব্বাসউদ্দিন লিখেছেন তার ‘আমার শিল্পী জীবনের কথা’ আত্মজীবনীতে : ‘দু’দিন রইলেন কুচবিহারে, কিছু গানে গানে কী যে উন্মাদনা সৃষ্টি করে গেলেন! আর তো মনকে কিছুতেই বইয়ের আখতে পারি না। আমার মনের গহন বলে সুরের পাখি সর্বদাই বিচিত্র সুরকাকলিতে আমায় করে তুলে উন্মনা।’
এরপর নজরুলের সাথে তার দ্বিতীয় সাক্ষাৎ দার্জিলিংয়ে। তিনি লিখেছেন : ‘তিল ধারণের স্থান নেই হলের ভেতর। কাজিদা তখন আবৃত্তি করছেন তার বিপ্লবী কবিতা ‘বিদ্রোহী’। পূর্ণ নিস্তব্ধতা কক্ষে বিরাজমান। জলদ্গম্ভীর সুরে আবৃত্তি করে চলেছেন। প্রতিটি শ্রোতা পলকহীন দৃষ্টিতে চেয়ে তার মুখের পানে। শেষ হওয়ার সাথে কী বিপুল করতালি। আমার দিকে চোখ পড়তেই তিনি আমাকে ইশারায় ডাকলেন। বলে উঠলেন, ‘কই, কোথায়’? আমি সামনে এসে আদাব করলাম। তিনি দাঁড়িয়ে উঠে ঘোষণা করলেন, ‘এক নতুন শিল্পীর সাথে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি- আব্বাসউদ্দিন।’ বললাম, ‘আপনার গানই গাই, কেমন?’ সানন্দে অনুমতি দিলেন। ধরলাম, ‘ঘোর ঘোররে আমার সাধের চরকা ঘোর।’ এক গানেই আসর মাৎ।’

এরপর কাজী নজরুল লিখে চললেন ইসলামী গান। আল্লাহ-রসুলের গান গেয়ে বাংলার মুসলমানদের ঘরে ঘরে জাগল এক নব উন্মাদনা। যার গান শুনলে কানে আঙুল দিত তাদের কানে গেল ‘আল্লাহ নামের বীজ বুনেছি নাম মুহাম্মদ বোলরে মন, নাম আহমদ বোল’। কান থেকে হাত ছেড়ে দিয়ে তন্ময় হয়ে শুনল ‘এলো আবার ঈদ ফিরে এলো আবার ঈদ, চল ঈদগাহে’ ঘরে ঘরে এলো গ্রামোফোন রেকর্ড, গ্রামে গ্রামে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল আল্লাহ-রসুলের নাম।’
আব্বাসউদ্দিন আহমেদ বিএ পড়ার সময় স্বদেশী আন্দোলন পাকিস্তান আন্দোলনের সাথে জড়িয়ে পড়েন। তিনি আন্দোলনের সুবাদে বাংলার কৃতী সন্তান শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, মাওলানা আবুল কালাম আজাদ এবং বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম প্রমুখের সান্নিধ্যে আসেন। সুকণ্ঠী গায়িকা ইন্দুবালা ও হিজ মাস্টার ভয়েস গ্রামোফোন কোম্পানির সংস্পর্শে আসেন। আব্বাসউদ্দিন শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের সাথে ঘুরে বেড়ান দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। বিভিন্ন সভা সমাবেশে তিনি গান পরিবেশন করতেন। সুযোগ ফেলে আব্বাসউদ্দিন পরিবেশন করতেন কাজী নজরুল ইসলামের সেই জাগরণী গান। ‘বাজিছে দামাম বাঁধরে আমামা/শির উঁচু করি মুসলমান/দাওয়াত এসেছে নয়া জামানার/ভাঙ্গা কেল্লায় ওড়ে নিশান’, ‘ত্রি-ভুবনে প্রিয় মুহাম্মদ এলোরে দুনিয়ায়/আয়রে সাগর আকাশ বাতাস দেখবি যদি আয়’, ‘ভারতের দুই নয়ন তারা হিন্দু মুসলমান/দেশ জননীর সমান প্রিয় যুগল সন্তান/হিন্দু মুসলমান’। (সূত্র : বাংলা সঙ্গীতের দিগন্তে ইসলামী সুবাতাস, মুস্তাফা জামান আব্বাসী, অনুরণন-২০১৬, পৃষ্টা- ...)

শিল্পী আব্বাসউদ্দিন কাজী নজরুল ইসলামের ৫০টি ইসলামী গানে কণ্ঠ দিয়েছেন। এ দিক থেকে তিনিও কাজী নজরুলের একজন সহযোদ্ধার মর্যাদার দাবিদার। এই সম্মিলনের ফলেই বাঙালি মুসলমান তার ধর্মকে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি দিয়ে আত্তীকৃত করতে পেরেছে। (তথ্যসূত্র : আমার শিল্পীজীবনের কথা (১৯৬০), আব্বাসউদ্দিন আহমদ)।
কাজী নজরুলের শতাধিক ইসলামী গানের মধ্যে সর্বাধিক জনপ্রিয় হলো ‘ও মোর রমজানের ওই রোজার শেষে এল খুশির ঈদ’ গানটি। আব্বাসউদ্দিন আহমদের জীবনী থেকে জানা যায়, সঙ্গীতশিল্পী আব্বাসউদ্দিনের অনুরোধেই কাজী নজরুল ইসলাম এ গান রচনা করেছিলেন। তবে আব্বাসউদ্দিনের অনুরোধে রচনা করলেও এই গান নজরুলের জীবনব্যাপী সংগ্রামেরই অংশ যেখানে তিনি স্বজাতির বেদনা ও মুক্তির তাড়নায় প্রতিনিয়ত সৃষ্টির আনন্দে মেতে ছিলেন। কবি তার কালজয়ী এ গানটি রচনা করেন ১৯৩১ সালে। শিল্পী আব্বাসউদ্দিনের কণ্ঠে গানটি রেকর্ড করা হয়। রেকর্ড করার দুই মাস পর ঈদের ঠিক আগে আগে এই রেকর্ড প্রকাশ করা হয়। উদ্দিনের ‘দিনলিপি ও আমার শিল্পী জীবনের কথার এ গান সম্পর্কে উদ্দিন লিখেন,

একদিন কাজীদাকে বললাম, ‘কাজীদা, একটা কথা মনে হয়। এই যে পিয়ারু কাওয়াল, কাল্লু কাওয়াল- এরা উর্দু কাওয়ালি গায়, এদের গানও শুনি অসম্ভব বিক্রি হয়। এ ধরনের বাংলায় ইসলামী গান দিলে হয় না? তারপর আপনি তো জানেন, কিভাবে কাফের-কুফর ইত্যাদি বলে বাংলার মুসলমান সমাজের কাছে আপনাকে হেয় করে রাখার জন্য আদাজল খেয়ে লেগেছে এক দল ধর্মান্ধ! আপনি যদি ইসলামী গান লেখেন, তাহলে মুসলমানের ঘরে ঘরে আবার উঠবে আপনার জয়গান।’ কথাটা তার মনে লাগল। তিনি বললেন, ‘তুমি ভগবতীবাবুকে বলে তার মত নাও। আমি ঠিক বলতে পারব না।’ আমি ভগবতী ভট্টাচার্য অর্থাৎ গ্রামোফোন কোম্পানির রিহার্সেল-ইনচার্জকে বললাম। তিনি তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলেন, ‘না না না, ওসব গান চলবে না। ও হতে পারে না।’ মনের দুঃখ মনেই চেপে গেলাম।

প্রায় ছয় মাস পর। একদিন দুপুরে বৃষ্টি হচ্ছিল, আমি অফিস থেকে গ্রামোফোন কোম্পানির রিহার্সেল ঘরে গিয়েছি। দেখি, একটা ঘরে আশ্চর্যময়ী আর ভগবতীবাবু বেশ রসালো গল্প করছেন। আমি নমস্কার দিতেই বললেন, ‘বসুন, বসুন’। আমি তার রসাপ্লুত মুখের দিকে চেয়ে ভাবলাম, এ-ই উত্তম সুযোগ। বললাম, ‘যদি কিছু মনে না করেন, তাহলে বলি। সেই যে বলেছিলাম, ইসলামী গান দেয়ার কথা। আচ্ছা; একটা এক্সপেরিমেন্টই করুন না, যদি বিক্রি না হয় আর নেবেন না, ক্ষতি কী’? তিনি হেসে বললেন, ‘নেহাতই নাছোড়বান্দা আপনি, আচ্ছা আচ্ছা, করা যাবে।’ শুনলাম, পাশের ঘরে কাজীদা আছেন। আমি কাজীদাকে বললাম, ভগবতীবাবু রাজি হয়েছেন। তখন সেখানে ইন্দুবালা কাজীদার কাছে গান শিখছিলেন। কাজীদা বলে উঠলেন, ‘ইন্দু, তুমি বাড়ি যাও, আব্বাসের সাথে কাজ আছে।’ ইন্দুবালা চলে গেলেন। এক ঠোঙা পান আর চা আনতে বললাম দশরথ থেকে। তারপর দরজা বন্ধ করে আধঘণ্টার ভেতরই লিখে ফেললেন, ‘ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে এল খুশির ঈদ।’

পরের দিন ঠিক এই সময় আসতে বললেন। পরের দিন লিখলেন, ‘ইসলামের ওই সওদা লয়ে এল নবীন সওদাগর।’ তখনই সুর সংযোগ করে শিখিয়ে দিলেন। গান দু’খানা লেখার ঠিক চার দিন পরই রেকর্ড করা হলো। কাজীদার আর ধৈর্য মানছিল না। তার চোখেমুখে কী আনন্দই যে খেলে যাচ্ছিল! তখনকার দিনে যন্ত্র ব্যবহার হতো শুধু হারমোনিয়াম আর তবলা। গান দু’খানা আমার তখন মুখস্থ হয়নি। তিনি নিজে যা লিখে দিয়েছিলেন, মাইকের পাশ দিয়ে হারমোনিয়ামের ওপর ঠিক আমার চোখ বরাবর হাত দিয়ে কাজীদা নিজেই সেই কাগজখানা ধরলেন, আমি গেয়ে চললাম। এই হলো আমার প্রথম ইসলামী রেকর্ড। শুনলাম; দুই মাস পর ঈদুল ফিতরের সময় গান দু’খানা তখন বাজারে বের হবে। ঈদের বাজার করতে একদিন ধর্মতলার দিকে গিয়েছি। বিএন সেন অর্থাৎ সেনোলা রেকর্ড কোম্পানির বিভূতিদার সাথে দেখা। তিনি বললেন, ‘আমার দোকানে এসো।’ তিনি এক ফটোগ্রাফার ডেকে নিয়ে এসে বসলেন, ‘এর ফটোটা নিন তো’। আমি তো অবাক! বললাম, ‘ব্যাপার কী’? তিনি বললেন, ‘তোমার একটা ফটো নিচ্ছি, ব্যস, আবার কী?’
ঈদের বন্ধে বাড়ি গেলাম। কলকাতা ফিরে এসে ট্রামে চড়ে অফিসে যাচ্ছি। রাস্তার আশপাশে আমার ছবি সংবলিত হাজার হাজার পোস্টার। ট্রামে একটি যুবক আমার পাশে গুনগুন করে গাইছে, ‘ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে।’ আমি একটু অবাক হলাম। এ গান কী করে শুনল! অফিস ছুটির পর গড়ের মাঠে বেড়াতে গিয়েছি, মাঠে বসে একদল ছেলের মাঝে একটি ছেলে গেয়ে উঠল, ‘ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে।’ আনন্দে-খুশিতে মন ভরে উঠল। ছুটলাম কাজীদার বাড়ি। শুনলাম, তিনি রিহার্সেল রুমে গেছেন। দেখি, দাবা খেলায় তিনি মত্ত। দাবা খেলতে বসলে দুনিয়া ভুলে যান তিনি। আমার গলার স্বর শুনে একদম লাফিয়ে উঠে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন, ‘তোমার গান কী যে-’ আর বলতে দিলাম না, পা ছুঁয়ে তার কদমবুসি করলাম। ভগবতীবাবুকে বললাম, ‘তাহলে এক্সপেরিমেন্টের ধোপে টিকে গেছি, কেমন?’ তিনি বললেন, ‘আরো-আরো গান চাই। বাজার মাত। মশাই আপনারা দু’জন জাদু জানেন। তাড়াতাড়ি গান লিখে সুর করতে বলুন কাজীদাকে-

‘আল্লাহ নামের বীজ বুনেছি/এবার মনের মাঠে/ফলবে ফসল বেচব তারে/কিয়ামাতের হাটে’, ‘নাম মুহাম্মদ বোল রে মন/নাম আহেম্মদ বোল/যে নাম নিয়ে চাঁদ সিতারা/আসমানে খায় দোল’, ‘আল্লাহ আমার প্রভু/আমার নাহি নাহি ভয়/আমার নবী মোহাম্মদ/যাহার তারিফ জগৎময়’ এবং ‘ত্রিভুবনের প্রিয় মোহাম্মদ এলো রে দুনিয়ায়/আয়রে সাগর আকাশ বাতাস দেখ্বি যদি আয়’। এমনিভাবে কাজী নজরুল ইসলামকে দিয়ে আব্বাসউদ্দিন লিখিয়েছিলেন এ ধরনের অসংখ্য ইসলামী গান। ঘুমন্ত মুসলিম জাতিকে জাগিয়ে তোলার গান শুনিয়ে দিলেন। নজরুলকে চিনলো বাংলার মুসলমানেরা। ডাক পড়তে লাগল বিভিন্ন সভা-সমাবেশ ও সমিতিতে। সাথে যাবেন আব্বাসউদ্দিন। নজরুল লেখেন গান আর আব্বাসউদ্দিন সে গান গেয়ে শোনান জনগণকে। জমে ওঠতে লাগল মুসলমানদের আসর। সত্যি সত্যি জেগে উঠল মুসলিম যুব সম্প্রদায় ও মুসলিম সমাজ। বাংলার ঘরে ঘরে পরিচিত হলেন নজরুল সাথে আব্বাসউদ্দিনও।
একদা আব্বাসউদ্দিন আহমদ নজরুলের বাসায় গিয়ে দেখেন, আগে থেকেই কবি নজরুল গভীর মনোযোগে কী যেন লিখছেন। আব্বাসউদ্দিনকে বসতে ইঙ্গিত দিয়ে আবার মন দিলেন লেখায়। জোহরের সময় হলে আব্বাসউদ্দিন কবির কাছে একটা চাদর চাইলেন, আর বললেন, একটি গজল লিখে দিতে হবে। কবি পরিষ্কার একটি চাদর এনে বিছিয়ে দেন আব্বাসউদ্দিনকে নামাজ পড়ার জন্য। আব্বাসউদ্দিন নামাজ পড়তে লাগলেন আর নজরুল গান লিখতে শুরু করে দিলেন। আব্বাসউদ্দিনের নামাজ শেষ হতে না হতেই নজরুল তার হাতে একটা কাগজ দিয়ে বললেন, নাও তোমার গজল। আব্বাসউদ্দিন তো অবাক হয়ে কবির দিকে তাকিয়ে থাকলেন, এই অল্প সময়েই নজরুল চমৎকার ইসলামী গান লিখে ফেলেছেন; তা-ও আব্বাসউদ্দিনের নামাজ পড়ার প্রসঙ্গ এনে। নজরুলের বিখ্যাত সেই গজলটি হলো- ‘হে নামাজী, আমার ঘরে নামাজ পড় আজ/দিলাম তোমার চরণতলে হৃদয় জায়নামাজ।’ (সূত্র : নজরুলের ইসলামী গান ও ভক্তিগীতি, মোস্তারী পারভীন টিনা, রাইটার্স ফাউন্ডেশন ২০০৩, পৃষ্টা-৬৩)

এই মহান কবি ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট ইন্তেকাল করেন। তাকে ঢাকায় সমাহিত করা হবে কোথায় তা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। এ প্রসঙ্গে কবির একটি গান প্রণিধানযোগ্য, ‘মসজিদেরই পাশে আমার কবর দিও ভাই/যেন গোর থেকেও মুয়াজ্জিনের আজান শুনতে পাই।’ কবির সেই বিখ্যাত ইসলামী গানে ব্যক্ত হওয়া অন্তিম ইচ্ছে অনুযায়ীই তাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে কবরস্থ করা হয়।

কাজী নজরুল ইসলাম যে পরিমাণ আর যে মানের গান উপহার দিয়ে গেছেন, তাতে বাংলা গানের এই রসদ পূর্ণ হয়ে রয়েছে। নজরুলের ইসলামী গান রচনার আগে মুসলমানরা লোকসঙ্গীত ধাঁচের ইসলামী সঙ্গীত নিয়ে যে হীনম্মন্যতায় ভুগতেন, কবির এই অপূর্ব সৃষ্টিসম্ভার তা ঘুচিয়ে দিয়েছে। তার এই সৃজন যে কেবল বাংলা গানে নতুন মাত্রা সংযোজিত করেছেন তা নয়, বরং বিশ্ব পরিমণ্ডলে ইসলামী গানের যে সুবৃহৎ ক্ষেত্র রয়েছে, সেই ধারাকেও করে গেছেন সমৃদ্ধ। কারণ, নজরুল রচিত ইসলামী সঙ্গীতগুলো সুরে কিংবা বাণীতে বিশ্বের প্রথিতযশা ইসলামী সঙ্গীতকারদের রচিত সঙ্গীতের তুলনায় কোনো অংশে কম নয়।

পরে শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের সাথে আব্বাসউদ্দিনের সাক্ষাৎ ঘটলে শেরেবাংলা আব্বাসউদ্দিনকে বললেন- ‘তোমার গান শুনে আমি মুগ্ধ হয়েছি। পরশু আমার বাসায় মিলাদ। তুমি আসবে। হামদ, না’ত শোনাবে আমাকে। মৌলভীদের শোনাবে। এত ভালো কাজ তুমি করেছ, মোলভী সাহেবরা জানেন না। ওদেরও জানিয়ে দেবো। আমি হারমোনিয়াম তবলা ইত্যাদি সব জোগাড় করে রাখব। আসবে কিন্তু।’ আব্বাসউদ্দিন বিনয়ের সাথে বললেন, ‘এত আমার সৌভাগ্য। আপনি বাংলার জন্য- মুসলমানের জন্য এত কিছু করছেন, আর আমি আসব না? আমিও তো আপনাদের কাজের একজন সামান্য সহযোগী।’

ঠিক সময়ে শেরেবাংলার বেনে পুকুর লেনের বাসা গিয়েছিলেন আব্বাসউদ্দিন। মৌলভী সাহেবরা উপস্থিত হয়েছিলেন আগেই। শেরেবাংলা আব্বাসউদ্দিনের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন তাদের। শিল্পীর প্রশংসা করলেন অকুণ্ঠচিত্তে। কিন্তু মৌলভী সাহেবরা তেমন খুশি হতে পারলেন না। কেমন যেন উশখুশ করতে লাগলেন। তারা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করতে লাগলেন- গায়ক আবার মুসলমান হয় নাকি? মুসলমানরা কি গান গায়? যথাসময়ে মিলাদ শুরু হলো। শেষও হলো। মুনাজাত শেষ হতেই শেরে বাংলা পাশের ঘর থেকে নিজ হাতে নিয়ে এলেন হারমোনিয়াম। মৌলভী সাহেবদের তো চক্ষু চড়কগাছ। তারা পরস্পরে মুখ চাওয়া চাওয়ি করতে লাগলেন। এমন সময় হক সাহেব মৌলভী সাহেবদের উদ্দেশে বললেন- ‘এতক্ষণ আপনারা মিলাদ পড়লেন বিদেশী ভাষায়। অনেক কথাই শ্রোতারা বুঝতে পারেনি। অনেক শব্দের অর্থ তারা জানতে পারেনি। এবার আব্বাসউদ্দিন আমাদের প্রিয় নবী হজরতের গুণগান করবে বাংলা ভাষায়। গানে গানে অভিবাদন জানাবে আমাদের প্রিয় মহানবীকে। আপনারা শুনুন। বুঝতে চেষ্টা করুন। ওর গান আমি শুনেছি। ওর গান শুনলে আমার চোখ দিয়ে পানি আসে। এই ভাবে সে যদি মুসলমানদের কাছে আমাদের প্রিয় নবীর কথা প্রচার করতে পারে তবে বাংলার মানুষ পাক্কা মুসলমান হবে।’ একজন মৌলভী সাহেব বললেন, ‘হুজুর গান শোনা নাজায়েজ। বেদাত কাজ।’ শেরেবাংলা রীতিমতো ধমকে ওঠলেন, বললেন, ‘মিথ্যে কথা। হজরতের আমলেও গানের প্রচলন ছিল। যুদ্ধের ময়দানে গান গেয়ে সৈনিকদের উৎসাহিত করা হতো। বিয়ে-শাদির মতো অনুষ্ঠানেও গান পরিবেশিত হতো। কাওয়ালি, হামদ, না’ত আসলে তো গান। সুরের ব্যাপার। সুর মনকে গলিয়ে দিতে পারে। উদ্দিন যে গান গাইবে তা আমাদের প্রিয় নবীর বাণী। এতে আপত্তি থাকার কথা নয়। আপনারা তো এতক্ষণ সুর দিয়ে মিলাদ পড়লেন। ভালো কথায় সুরের শেষ নেই।’ মৌলভী সাহেবরা শেরেবাংলার কথা মানলেন না। তারা জুতা হাতে একে একে উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, ‘আমরা আসি।’ হক সাহেব অনেকটা ক্ষুণ্ন স্বরে বললেন, ‘আসুন। জোর করে শোনাব না। তবে শুনলে বুঝতে পারতেন কেন আমি মিলাদে মাহফিলে গানের ব্যবস্থা করেছি। বুঝতে পারতেন, আমি বাংলার অশিক্ষিত ইসলাম ভক্তদের কাছে কেমন করে আমার প্রিয় নবীকে পরিচিত করতে চাই। আপনারা এতদিন যা পারেননি- আজ আব্বাসউদ্দিনকে দিয়ে তা আমি পারব বলে আশা রাখি। আমি চাই মুসলমানদের জাগাতে। নজরুলকে আপনারা কাফের ফতোয়া দিয়ে দূরে সরিয়ে দিয়েছিলেন। শুনলে বুঝতে পারতেন, আব্বাসউদ্দিন কী করে তাকে মুসলিম সমাজের জন্য কাজে লাগিয়েছে।’

হক সাহেবের এত বড় বক্তৃতায়ও কাজ হলো না। মৌলভী সাহেবরা আসর ছেড়ে বারান্দায় গেলেন। ঠিক এমনি সময়ে আব্বাসউদ্দিনের দরাজ কণ্ঠে ভেসে উঠল- ‘তোরা দেখে যা আমেনা মায়ের কোলে/মধু পূর্ণিমারই সেথা চাঁদই দোলে।’ এ গান শোনার পর মৌলভী সাহেবরা একে একে বারান্দা থেকে এসে আবার আসরে বসে পড়লেন। উদ্দিন গাইলেন- ‘এই সুন্দর ফল সুন্দর ফুল মিঠা নদীর পানি/খোদা তোমার মেহেরবাণী।’ মৌলভী সাহেবরা মুগ্ধ হয়ে শুনছেই, উঠছে না আর। আব্বাসউদ্দিন গাইলেন- ‘বাজিছে দামামা বাঁধরে আমামা/শির উঁচু করি মুসলমান/দাওয়াত এসেছে নয়া জামানার/ভাঙ্গা কেল্লায় ওড়ে নিশান।’ মৌলভী সাহেবরা উদ্দিনের কণ্ঠে গান শুনে অভিভূত হয়ে পড়লেন। তারা হক সাহেবের প্রশংসা করলেন এমন আসর করার জন্য।

আব্বাসউদ্দিনের ছেলে ও নজরুল গবেষক শিল্পী মুস্তাফা জামান আব্বাসী বলেন, ‘কাজী নজরুল ইসলাম ও আব্বাসউদ্দিন আহমেদ বাঙালি মুসলিম জাগরণের অগ্রদূত। তাদের যুগ্ম ভূমিকা জাতি ভুলবে কেমন করে? পিছিয়ে পড়া ঘুমিয়ে পড়া বাঙালি মুসলমান বিস্মৃতির অন্ধকার থেকে জেগে উঠেছিলেন যে দু’জনের হাত ধরে, তার প্রথম কবিকণ্ঠ কাজী নজরুল, প্রথম গীতকণ্ঠ আব্বাসউদ্দিন। ‘ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে এল খুশির ঈদ।’ গেয়েছিলেন আব্বাসউদ্দিন তার দরদি কণ্ঠে। সেই গান সবার কানে চিরদিনের জন্য অক্ষয় হয়ে রয়েছে। চারশত হামদ ও নাত লিখেছেন নজরুল। গেয়েছেন : আববাসউদ্দিন, কে. মল্লিক, বেদারউদ্দিন, গিরীন চক্রবর্তী, ধীরেন দাশ, আরো শত শিল্পী। অথচ সে গানগুলোকে আমরা অনায়াসে অবহেলা করলাম, এই বলে যে আল্লাহ্ ও রাসূলকে পরিত্যাগ করলেও চলবে, আধুনিকতাকে পরিত্যাগ করা যাবে না। তারা বুঝলেন না, আধুনিকতার উপাদান একমাত্র আল্লাহ্ ও তার রাসূল। নজরুল আমাদের জাতীয় কবি এই কারণে যে তিনি আল্লাহ্ ও রাসূলকে চিনেছেন। তা না হলে শত প্রেমের কবিতাও কাজে আসত না। আব্বাসউদ্দীন-এর ক্ষেত্রেও তাই। তিনি এ দেশের প্রথম জাতীয় কণ্ঠশিল্পী। তার স্বীকৃতি জাতি দিয়েছে। এই জমিনে যতদিন মুসলমান বাস করবে, তত দিন তারা নজরুল-আব্বাসউদ্দীনকে এই স্বীকৃতি দেবেই। নজরুল ও আব্বাসউদ্দিন বাঙালির জন্য অপরিহার্য।’ (সীমান্ত আকরাম সম্পাদিত মুস্তাফা জামান আব্বাসীর সাক্ষাৎকার গ্রন্থ ‘তার সাথে দেখা’, কাঠপেন্সিল-২০১৯, পৃষ্ঠা-৫৭)


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us