আল মাহমুদ কবি এবং কবি

জাকির আবু জাফর | Jul 17, 2019 01:50 pm
আল মাহমুদ কবি এবং কবি

আল মাহমুদ কবি এবং কবি - ছবি : সংগ্রহ

 

আল মাহমুদের আলোচিত আলোড়িত গ্রন্থ ‘সোনালী কাবিন’। তারুণ্যের মুখে আল মাহমুদ উচ্চারিত হলেই সানন্দে ফোটে সোনালী কাবিনের নাম। বিশেষ করে এই গ্রন্থের ১৪টি সনেট তরুণদের গভীর বাসনাকে উষ্ণতায় জাগিয়ে তোলে। প্রবলভাবে উসকে দেয় আবেগ। ফলে পাঠকের চোখে আল মাহমুদের গুরুত্বপূর্ণ বইয়ের নাম হয়ে ওঠে সোনালী কাবিন। আল মাহমুদ অবশ্য শুধু সোনালী কাবিনকে তার সেরা রচনা কখনো ভাবেননি। সেই সাথে ‘মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো’ থেকে শুরু করে ‘সেলাই করা মুখ’ পর্যন্ত বেশ কিছু গ্রন্থকে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ ভাবতেন। বলেছেন, সোনালী কাবিন তার কাব্য যৌবনের স্বচ্ছন্দ দীপ্তি। নতুন উপমা, নতুন চিত্রকল্প এবং নতুন ঢঙের কথা-বাণীর একটি উপত্যকা। যেখানে তিনি প্রকৃতির রহস্যময়তা এবং নরনারীর প্রেমের অন্বয় ঘটিয়েছেন। সম্বন্ধ রচেছেন মাটি ও মানুষের চৈতন্যের শিরায়। বাঙালি মুসলিম চাষি পরিবারের মুখের নিত্যভাষা থেকে ছেঁকে শব্দ তুলে এনেছেন আল মাহমুদ। গ্রামীণ চাষি পরিবারের আঞ্চলিক শব্দ তার কবিতায় আধুনিক হয়ে উঠেছে। ব্যবহারে এসব শব্দ পেয়েছে আধুনিকতার রূপ। সোনালী কাবিনে এসব শব্দের উপস্থিতি কবিতাকে দিয়েছে ভিন্নমাত্রা। দিয়েছে অন্যরকম ব্যঞ্জনা।

সোনালী কাবিনের আঞ্চলিক শব্দের ঢেউ অনেক কবির কবিতাকে প্লাবিত করেছে। অনেক কবিই এর প্রভাবে আঞ্চলিক শব্দ বাক্য ব্যবহার করে কবিতা নির্মাণের চেষ্টা করেছেন। এমনকি আঞ্চলিক ভাষায়ও লিখেছেন কেউ কেউ। আস্ত বই লিখেছেন কোনো কোনো কবি। যেমন সৈয়দ শামসুল হক লিখেছেন ‘পরানের গহীন ভেতর’। কিন্তু সেসব কবিতা, শব্দ, বাক্য ও ভাষা আঞ্চলিকতার সীমা ডিঙ্গাতে পারেনি। পারেনি গ্রামীণ আঁচল টেনে আধুনিক ভাষার সঙ্গী হতে। আঞ্চলিক ভাষা আঞ্চলিকই থেকে গেছে। উপস্থাপনায়ও আসেনি আহামরি কোনো নতুন ভঙ্গি, যা সোনালী কাবিনে পেয়েছে স্বতঃস্ফূর্ততা। পেয়েছে নতুনত্বের দ্যুতি। সোনালী কাবিনের কবিতা পাঠক মুখে তুলে নতুন স্বাদে পুলকিত হলো। কণ্ঠে পেল নতুন উচ্চারণের গতি। এভাবে সোনালী কাবিন পাঠককে জড়িয়েছে কবিতার নতুন বন্ধনে।

আল মাহমুদের কবিতার শরীরে বাংলা মাটির গন্ধ মিশে আছে। জড়িয়ে আছে যুবক-যুবতীর প্রেমের সবুজ উত্তাপ। প্রাচীন বাংলার ঐতিহ্যের রঙে রাঙা এসব কবিতা পাঠককে দোলায়। ভাসায়। আশায় জাগিয়ে তোলে এক অন্যরকম আয়োজনে। পাঠক তার মনের কাছে নতুন বার্তা নতুন উপমার সুখ পেল।

এসব উচ্চারণ হয়তো সবার মুখে জড়ানো। হয়তো সবাই জানেন সোনালী কাবিন একটি অন্যরকম কাব্য, যা আল মাহমুদকে নতুন করে দেখার আগ্রহ জাগিয়েছে। আল মাহমুদ পাঠকের কাছে পেয়েছেন মর্যাদার নতুন অভিধা। সোনালী কাবিনের ঘোরলাগা ঘোর পাঠককে স্পন্দিত করে। আবিষ্ট করে। মৌন করে। একই সাথে উত্তাল করে চাঞ্চল্যের ঢেউয়ে। আল মাহমুদ লিখেছেন- বধূ বরণের নামে দাঁড়িয়েছে মহামাতৃকুল/গাঙের ঢেউয়ের মতো বলো কন্যা কবুল কবুল। এই যে গাঙের ঢেউয়ের কলোকল উত্তালতায় উদ্বুদ্ধ হওয়ার মন্ত্র এখানে তুমুল। প্রবল উচ্ছ্বাসের উৎসব দেখিয়ে দেয়ার কাজটি করেছেন আল মাহমুদ।

কুয়াশার সাদা পর্দা দোলাতে দোলাতে/আবার আমি ঘরে ফিরবো/শিশিরে আমার পাজামা ভিজে যাবে/চোখের পাতার ওপর শীতের বিন্দু জমতে জমতে/হঠাৎ মুখের ওপর উঠে আসবে লাল সূর্য/পরাজিতের মতন আমার মুখের ওপর রোদ নামলে সামনে দেখবো ছড়ানো ছিটানো ঘর বাড়ি গ্রাম/জলার দিকে বকের ঝাঁক উড়ে যাচ্ছে। এই যে প্রাকৃতিক চিত্রাবলির সরস বর্ণনা, এটিও সোনালী কাবিনের বিশেষ বৈশিষ্ট্য।
পাঠক যাই বলুন না কেন, সোনালী কাবিনই তার শ্রেষ্ঠ কাজ এ কথা মানতে নারাজ ছিলেন আল মাহমুদ। তিনি বলেছেন, সোনালী কাবিন আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ ‘মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো’, ‘অদৃষ্টবাদীদের রান্নাবান্না’, ‘মিথ্যাবাদী রাখাল’, ‘বখতিয়ারের ঘোড়া’, ‘আরব্য রজনীর রাজহাঁস’, ‘আমি দূরগামী’, ‘দ্বিতীয় ভাঙন’- এসব বই।

কেন তিনি তার এ বইগুলো গুরুত্বপূর্ণ বলেছেন, তার ব্যাখ্যা- রহস্য অজানা নয়।
মানুষের জীবনে প্রেমের আনন্দ থাকে। বিরহের ভার থাকে। থাকে যাপিত জীবনের স্মৃতির রেখা। কিন্তু এ তিন সেতুই জীবনের সব নয়। জীবনের সব সত্য নয়। জীবনে আছে আরো বহুবিধ সেতুর যোগ। আছে জীবনের বিভিন্ন প্রসঙ্গ অনুষঙ্গের বীণা। ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় যা বেজে যায় প্রতিটি মানুষের মনে। বিশ্বাস-অবিশ্বাস, আশা-নিরাশা, সুখ-দুঃখ, পরিবার সমাজ রাষ্ট্র এবং মানবজাতি- এসব মানুষের নিত্যচলার অনুষঙ্গ। চেতন-অবচেতন, বোধ ও দৃষ্টি এসবও গভীর অনুভবের বিষয়। এই অনুভব থেকেই আল মাহমুদ লিখেছেন তার মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো, অদৃষ্টবাদীদের রান্নাবান্না, দ্বিতীয় ভাঙন, মিথ্যাবাদী রাখাল, বখতিয়ারের ঘোড়া, সেলাই করা মুখ প্রভৃতি কাব্য।

এসব কাব্যে আল মাহমুদ নতুন কাব্যভাষা নির্মাণ করেছেন। নতুন বক্তব্য হাজির করেছেন। চিত্রকল্পে এবং উপস্থাপনায় এনেছেন বিস্ময় রকম নতুনত্ব। নিজস্ব বাক্যভাষা রচনা করেছেন আল মাহমুদ। তার কাব্যভাষা কাদামাটির বাংলাদেশের হৃদয় থেকে উঠে এসেছে। সাধারণ বিশ্বাসী মানুষের প্রেম ভালোবাসা বিরহ ও বেদনার এক মায়াবী জাল বুনন করেছেন তিনি। একজন কবির মৌলিক বিষয় অথবা একজন মৌলিক কবির পরিচয় হলো তার নিজস্ব ভাষা থাকবে। আল মাহমুদের নিজস্ব এ কাব্যভাষা বেশ হৃষ্টপুষ্ট।
কবিতা পাঠ করেই পাঠকমন রায় দেবে- এ তো অমুকের কবিতা। আল মাহমুদ তার ভাষার উচ্ছ্বাস উৎসবে নিজস্বতার বৈশিষ্ট্য এঁটে দিয়েছেন। লেপে দিয়েছেন নিজস্ব ভাষার রঙ। ফলে একজন পাঠক কবিতা ঠোঁটে তুলে নিতেই বোঝেন কবিতাটি আল মাহমুদের। আল মাহমুদীয় গন্ধে পাঠক বিভোর হয়ে ওঠেন। এ গন্ধ তাকে চিনিয়ে দেয় আল মাহমুদের কবিতার রঙ, যা পাঠকের হৃদয়কে জড়িয়ে রাঙা করে তোলে। পাঠক ঘ্রাণ শুঁকে ঢুকে পড়েন কবিতার গভীরে।

আল মাহমুদের কবিতা আধুনিকতার আনন্দে উজ্জ্বল। জীবনের ব্যাখ্যা অথবা বিশ্বাসের গাম্ভীর্য নিয়েও আধুনিক তার কবিতা। আধ্যাত্মিকতার সৌরভ যেখানে, তাও আধুনিক। মানুষের জীবন যন্ত্রণার টানাপড়েন সংশয়ের তীব্রতা এবং গতির বিস্ময় আল মাহমুদের কবিতাকে আধুনিকতার লোয়াজিমা দিয়েছে।
আল মাহমুদ তার কবিতার সাথে আর কিছু সমান্তরাল করেননি। কবিতা ছিল তার সর্বোচ্চ প্রেমের বিষয়। কবিতার জন্য জীবনে ত্যাগ করেছেন অনেক লোভনীয় বিষয়। কবিতার বিপক্ষে আপস করার কোনো বিষয় গ্রহণ করেননি তিনি। বরাবর আপসহীন ছিল তার কবিতার সংসার। সারাটা জীবন ধরে নিজেকে একজন কবি হিসেবেই উপস্থাপন করেছেন। চলেছেন বলেছেন এবং সয়েছেন কেবল কবিতার জন্য। কেবলি কবিতার দিকে ছিল তার পক্ষপাত। সম্মান পেয়েছেন কবিতার জন্য। অপমানও কম জোটেনি তার। কিন্তু অপমানের সব জ্বালা নিভিয়েছেন কবিতার শীতল জলে। মানুষের ভালোবাসা পেয়েছেন অজস্র। একই সাথে অবহেলাও জুটেছে বেশ। খাটো করে দেখার, ছোট করে ভাবার লোকের অভাব কোনো কালেই কম ছিল না। কিন্তু আল মাহমুদ কাব্যশক্তির দৃঢ়তায় এসব দারুণভাবে উপেক্ষা করেছেন। মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন এসব ক্ষীণদৃষ্টির মানুষ থেকে। কখনো কখনো রক্তাক্ত হয়েছেন ভীষণভাবে। পাঠকের ভালোবাসায় সেই রক্তই আবার প্রেমের জলোচ্ছ্বাসে ছাপিয়েছে হৃদয়কূল।

আল মাহমুদকে বিচার করতে হবে তার সামগ্রিকতার আয়োজনে। খণ্ডিত দৃষ্টির সঙ্কীর্ণতায় তার বিচার করার সুযোগ নেই। রাজনৈতিক বিবেচনায় তো নয়ই। একজন কবির জন্য রাজনৈতিক বিবেচনা কবিতার পক্ষে অবশ্যই যৌক্তিক নয়। কবিকে বিচার করার মাধ্যম কেবলি কবিতা। কবিতাই কবির পরিচয়। কবিতাই কবির দান অবদান। কবিতার বাইরে আলোচনা হতে পারে, কিন্তু বিচার চলে না। একজন কবিকে কবিতা ছাড়া আর কী দিয়ে বিচার চলে!

এ দুর্ভাগ্য আমাদের বাংলা সাহিত্যের এবং বাংলাদেশের এখানে সাহিত্যের চেয়ে কবিতামূল্যের চেয়ে রাজনীতির মূল্য বেশি। একজন কবিকেও রাজনীতির বাটখারায় ওজন দেয়ার সর্বনাশা খেলা এখানে প্রবল। যে কোনোভাবে, যেনতেন প্রকারে একটি রাজনৈতিক দলের লেজে বেঁধে দেয়ার প্রবণতা এক কথায় ভয়ঙ্কর। এমন ভয়ঙ্কর খেলা যারা খেলেন তারা শেষ পর্যন্ত সাহিত্যের সীমানা থেকে ছিটকে পড়েন। ডুবে যান তাদেরই সৃষ্ট রাজনৈতিক পঙ্কিলতার ডোবায়। সুতরাং সাময়িক সুযোগ সুবিধা এবং লাভালাভের যোশে সাহিত্যকে কলুষিত করার কাজটি মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়; বরং একে ঘৃণার চোখে দেখাই যুক্তিসঙ্গত।

শিল্প-সাহিত্য রাজনীতি ফাজনীতির ঊর্ধ্বের বিষয়। একে সীমাবদ্ধতার কোটরে বন্দী করা অথবা লোভের লালায় ভিজিয়ে তোলা সঙ্গত নয়। কবিতার ক্ষেত্রে তো নয়ই। একজন কবি তিনি সবার। সকলের। সকল মানুষের। তাকে যে গ্রহণ করে তার। যে গ্রহণ করে না তারও। আজ যিনি গ্রহণ করেননি কাল করবেন না এমন তো বলা যায় না। অতএব, কবিকে তার কবিতার জায়গা থেকেই বিচার করতে হবে। তবে কবির প্রতি হবে সুবিচার। কবিতা ছাড়া আল মাহমুদের বিচার চলেই না। চলতে পারে না। আল মাহমুদ কবি, কবি এবং কবি। এর বাইরে তার কোনো পরিচয় নেই।


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us