পাপ বাপকেও ছাড়ে না!

গৌতম দাস | May 09, 2020 09:36 pm

-

 

ভারতে লকডাউন পালন শুরু করা হয়েছিল গত ২৩ মার্চ বিকেল থেকে। আর এ বছরে দিল্লির তাবলিগ জামাত সমাবেশ শুরু ও শেষ হয়েছিল এর অন্তত ১০ দিন আগেই; অর্থাৎ এর আয়োজনে কোনো আইনভঙ্গ করা হয়নি, বরং অনুমতি নিয়েই ওই সমাবেশ করা হয়েছিল। কিন্তু লকডাউন শুরু হওয়ার পর সমাবেশফেরত মুসল্লিদের বাড়ি বাড়ি অনুসন্ধানে তাদের অনেকের মধ্যে (বিবিসির ভাষায় প্রায় ৩০০) করোনা পজিটিভ পাওয়া গেছে। এতে এবার বিজেপি এ ঘটনাকে তাদের মুসলমানবিদ্বেষী প্রচারণার বিষয় বানিয়েছে। তারা বলা শুরু করেছিল যে, মুসলমানদের জীবন আচার-অভ্যাসই নীচু ধরনের, ওরা খারাপ, তারা নিম্ন কালচারের, ধর্মীয় জাতিগতভাবে তারা নীচুসহ প্রভৃতি বয়ান তৈরি করে জাতবিদ্বেষী, প্রবল রেসিজমের এক জোয়ার তুলেছিল সামাজিক নেটওয়ার্কজুড়ে। কাজটা বিজেপি সংগঠিত ও প্রবলভাবে করেছিল তাদের আইটি সেল ও ক্যাম্পেইনের প্রধান অমিত মালব্যের নেতৃত্বে। এভাবে করোনা সংক্রমণে দুর্বিষহ জীবনে থাকা, সাধারণ মানুষের মনে এক ঘৃণা ঢুকানো হয়েছে। এতে ভারতজুড়ে হিন্দুজাত শ্রেষ্ঠত্বের সুপ্রিমিস্ট ধারণা, এক গভীর রেসিজমে ভারত ঢেকে গিয়েছিল। বিজেপি-আরএসএস তাদের এমন পারফরম্যান্স দেখে বেজায় খুশি। কিন্তু ধর্মের কল বাতাসে নড়ে! পাপ বাপকেও ছাড়ে না!

বিজেপির তরুণ এমপি তেজস্বী সূর্য, তার এমন এক ‘পুরনো পাপ’ ঘটেছে ২০১৫ সালের মার্চে। তিনি আরব নারীদের সম্পর্কে খুবই অসম্মানজনক মন্তব্য টুইট করেছিলেন তখন। লিখেছিলেন, ‘৯৫ শতাংশ আরব নারী যৌন-সন্তুষ্টি জিনিসটাই জীবনে বোঝেনি। তাদের প্রতিটি মা ভালোবাসায় যৌন-সন্তুষ্টির দিকটা কী তা না বুঝেই খালি বাচ্চা পয়দা করে যাচ্ছে।’ বলাবাহুল্য, আরব নারীদের সম্পর্কে এর চেয়ে অপমানজনক মন্তব্য সম্ভবত আর হয় না। নিজেদের জাতশ্রেষ্ঠত্বের অসুখে ভোগা এক গভীর বর্ণবাদ বা রেসিজম এটি।

মানব জনগোষ্ঠী দুনিয়ার বসতি স্থাপন করে যাত্রা শুরু করেছিল নানা কোণে ছড়িয়ে ছিটিয়েই, আর শুরুতে তা ছিল পরস্পর যোগাযোগবিহীন। এ ছাড়া সবাই একসাথেই বসতি স্থাপন শুরু করেনি। তবু নৃতত্ত্ববিদদের কড়া মন্তব্য হলো, দুনিয়ার ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্রতিটি মানবসভ্যতা তার নিজের বিকাশে সবাই শ্রেষ্ঠত্বের গুণসম্পন্ন হওয়ার সক্ষমতা নিয়েই বেড়ে ওঠে। কিন্তু পরে নানা দখলদার সভ্যতার চাপে নিজেদের আর আলাদা বৈশিষ্ট্যে টিকিয়ে রাখতে পারে না, অবিকশিত থেকে যায় বা চাপা পড়ে থাকে।

মানে তারা বলতে চেয়েছেন; কাজেই সভ্যতার বিকাশে বড় ছোট বলে কিছু নেই, সবাই শ্রেষ্ঠ হওয়ার সম্ভাবনাময় হয়েই জন্মায়। বরং পরে এমন জাতশ্রেষ্ঠত্বের দাবি মানে, আসলে অন্যায় কলোনি দখলের পক্ষেই মিথ্যা সাফাই দেয়া। অথবা ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়িয়ে নিজেদের জুলুমকেই বৈধতা দেয়ার চেষ্টা করে থাকে। তবে খুশির কথা, দুই বিশ্বযুদ্ধ মানুষকে অনেক কিছু শিখিয়েছে। বিশেষ করে হিটলারের চরম বর্ণবাদ দেখার পর থেকে এসবের বিরুদ্ধে গ্লোবাল মানুষ নানা আন্তর্জাতিক আইন ও কনভেনশন তৈরি করে ফেলেছে। চলতি শতক থেকে একে জাতশ্রেষ্ঠত্বের বর্ণবাদ বা রেসিজম বলে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা, আন্তর্জাতিক আইন আদালত- সবই এখন অনেক শক্ত ভিতের ওপর প্রতিষ্ঠিত এবং জনমতও প্রবল সোচ্চার।

কিন্তু ২০১৫ সালে করা ঘৃণামূলক মন্তব্য নিয়ে সে সময়ে ততটা প্রতিবাদ না হলেও এবার ২০২০ সালে তা প্রবল প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়েছে। এর মূল কারণ ইতোমধ্যে ‘তাবলিগের কারণেই ভারতে করোনা ছড়িয়েছে’ অথবা ‘মুসলমানরা নীচু সভ্যতা আচার ও কালচারের মানুষ’ এসব প্রপাগান্ডা করে ঘৃণা ছড়ানোর কাজ এবার প্রবল হওয়ায় এতে মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে এক বিরাট নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন শহরে কাজ করে নিচের আয়ের শ্রমবিক্রেতা অথবা হোয়াইট কলার ম্যানেজার, সেমি ম্যানেজার ধরনের সব পদই ভরিয়ে রেখেছে ভারতীয়রা। যেমন কোনো হোটেলে কেবল মালিকরা হয়তো আরব। এ ছাড়া মিড লেভেলের ম্যানেজার পর্যন্ত সবাই একচেটিয়া দক্ষিণ ভারতের। বাকি সবাই- নিচের দারোয়ান পর্যন্ত এশিয়ান আর সব দেশের। এবার করোনাকালে মধ্যপ্রাচ্যের ভারতীয়দের সবার মন-মানসিকতাতে মুসলমানদের ওপরে হিন্দুজাত শ্রেষ্ঠত্বের মিথ্যা বয়ান স্থান পেয়েছিল। আর সেখান থেকে মধ্যপ্রাচ্যের সোশ্যাল মিডিয়ার হিন্দু ভারতীয়রা তাদের বিভিন্ন স্ট্যাটাসে যেহেতু আরবরাও মুসলমান, ফলে তাদের সম্পর্কেও অবাধে যেন হিন্দুশ্রেষ্ঠত্বের বোধে বিভিন্ন বর্ণবাদী মন্তব্য করতে থাকে। আর এ সময়েই একপর্যায়ে একজন ২০১৫ সালে তেজস্বী সূর্যের এক মন্তব্যও সামনে নিয়ে আসে। আর এভাবে পুরো ব্যাপারটাতে শুরু হয় আরব সরকারগুলোর কড়া অ্যাকশন। তারা মন্তব্যকারীদের অফিসকে মন্তব্য নিয়ে নোটিফাই করাতে অফিস থেকে তাদের চাকরিচ্যুতির এবং দেশ থেকে বের করে দেয়ার নোটিশ হাতে ধরিয়ে দেয়া শুরু করেছিল।

ভারতের দ্যা প্রিন্ট পত্রিকা বলছে, অ্যাকশন শুরু হয়েছিল দুবাইয়ের এক আরব নারী ব্যবসায়ীর উদ্যোগ থেকে। তিনি এক টুইটে লিখেছেন, ‘করুণা হয় সেই শিক্ষাকে যা তোমাকে নারীদের অসম্মান করতে শিক্ষা দিয়েছে।’ এ ছাড়া তিনি ‘আরব দেশে ঘুরে আরব নারীদের অপমান করার ব্যাপারে’ সতর্ক করে, এমপি সূর্যের পুরনো টুইটটাকে সাথে গেঁথে দিয়ে নতুন করে টুইট করে দিলেন। স্বভাবতই এবার এটি ভাইরাল হয়ে যায়।

দ্বিতীয় উদ্যোগ বা সতর্কবাণী আসে আরেক আরব নারীর কাছ থেকেও। তিনি দুবাই রাজপরিবারের রাজকুমারী এক বিদুষী হেন্দ আল কাসেমি। তিনি সতর্ক করে বলেন, ‘এটি খোলাখুলি রেসিজম এবং মানুষে মানুষে বৈষম্য সৃষ্টির চোখে দেখা মন্তব্য যা দুবাইয়ের আইন অনুসারে জরিমানাযোগ্য অপরাধ এবং এ কারণে দেশ থেকে বের করে দেয়া হতেও পারে।’ এর পর থেকে এক চেইন রিঅ্যাকশনে মধ্যপ্রাচ্যের শহরগুলো থেকে প্রতিক্রিয়া ও অ্যাকশনের ঝড় বইতে শুরু করে। অনেকেই চাকরি হারায় এবং অনেককে ও দেশ থেকে বের করে দেয়া হয়। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মোদি এর প্রতিক্রিয়ায় বলেন, করোনা কোনো ধর্ম মানে না। তাই সংক্রমণে আক্রান্তের জাত ধর্ম বিচার ঠিক নয়।’ বাস্তবে তার দলের নেতাকর্মীরা মুসলমানদের নীচু দেখানো আর করোনা সংক্রমণ ছড়ানোর জন্য দায়ী করে প্রপাগান্ডা চালাতেই থাকেন।

এ দিকে ভারতের এক নারী তেজস্বী সূর্যকে উদ্দেশ করে আর্টিকেল লিখে তাকে চ্যালেঞ্জ করেছেন। তিনি বলেন, নারী-পুরুষের সম্পর্কের সমস্যাটা আরব-অনারবের সমস্যাই নয়। তিনি প্রশ্ন রেখেছেন, ভারতীয় নারীদের অবস্থা কী, সেটা খুঁজে না দেখে সে সমস্যা কেবল আরব নারীদের বলে দাবি করতে গেছে। এটাই বর্ণবাদ।
কিন্তু প্রশ্ন জাগে এই তরুণ সূর্য আরব নারীদের অপমান করে নীচু করছেন কেন? বিশেষত তিনি যখন মাত্র ২৪ বছরের তরুণ?

এর সম্ভাব্য কারণ হলো, প্রথমত এই তরুণ কেবল বিজেপির নয়, একেবারে আরএসএসের স্বয়ংসেবক। মানে এর কোর মেম্বার ও প্রশিক্ষিত। কোন প্রশিক্ষণ? আরএসএসের প্রতিষ্ঠাতা মাধব সদাশিব গোলওয়ালকার যিনি হেডগেওয়ারের পরে আরএসএসের পরবর্তী সর্বোচ্চ প্রধান নেতা হয়েছিলেন, তিনি হিটলারের বর্ণ-বিশুদ্ধতার মতবাদে অনুপ্রাণিত ছিলেন। তাদের হাতে এই প্রশিক্ষণের মূল নীতি নির্ধারিত হয়েছে। তাই হিটলারের জাতের ‘খাঁটিত্ব’ তারাও মানতেন। তবে বিজেপিতে এটি মানা না মানার ব্যাপারে শিথিলতা রাখা হয়। এ কারণে যারা সরাসরি আরএসএসের সদস্য তারা এত কট্টর। তেজস্বী সূর্য আরএসএসের সদস্য হিসেবেই সবিশেষ প্রশিক্ষিত। এ ছাড়া তেজস্বী সূর্য বেঙ্গালুরু বিজেপির আইটি সেলের প্রধান। আইটি সেল হলো প্রমিত মালব্যের অধীনে মূলত মুসলমানবিদ্বেষী প্রপাগান্ডা সেল। গত বছর ইউরোপীয় ইউনিয়ন তদন্ত করেছিল ইউরোপের বসে কারা মুসলমানের নামে ফেক ওয়েবসাইট চালায়। তাতে যাদের নাম প্রকাশিত হয়েছিল তাদেরই একজন হলো তারেক ফাতাহ। তিনি মূলত পাকিস্তানি-কানাডিয়ান। তিনি বিজেপিকে ভুয়া ওয়েবসাইট আয়োজন করে দিয়ে অর্থ কামিয়ে নেন। ভারতীয় ইয়া প্রিন্ট পত্রিকা থেকেই এ সম্পর্কে জানা যায়।


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us