সংক্রামক রোগ প্রসঙ্গে ইসলাম কী বলে

এফ এম শামীম | Jun 02, 2020 06:34 am
সংক্রামক রোগ প্রসঙ্গে ইসলাম কী বলে

সংক্রামক রোগ প্রসঙ্গে ইসলাম কী বলে - সংগৃহীত

 

আনাস রা: থেকে বর্ণিত, রাসূল সা: বলেছেন : রোগের সংক্রমণ ও শুভ-অশুভ বলতে কিছু নেই। শুভ লক্ষণই আমার নিকট পছন্দনীয়, আর তা হলো উত্তম বাক্য। (বুখারি, ইফা : ৫৩৪৫)

উক্ত হাদিস দেখে অনেকেই ইসলামে সংক্রামক রোগের অস্তিত্ব নিয়ে দ্বিধায় ভোগেন। অনেকেই মনে করেন, ইসলাম ছোঁয়াচে রোগের ব্যাপারটি অস্বীকার করে। অথচ মেডিক্যাল সাইন্সে ছোঁয়াচে রোগ প্রমাণিত। তাই রাসূল সা:-এর এই কথাটি মিথ্যা প্রমাণিত হয় বলে অনেকেই ধারণা করতে পারেন।
বিষয়টি বোঝার জন্য ইসলামের একটি মৌলিক নীতি আমাদের জেনে রাখতে হবে। ‘আর তোমরা চাইলেই কিছু হয় না, যতক্ষণ না বিশ্বজাহানের প্রতিপালক তা না চান।’ (সূরা তাকবীর-২৯) সৃষ্টিজগতের প্রতিটি বস্তুর ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া, কর্মক্ষমতা, কর্মফল সবকিছুই আল্লাহর ইচ্ছায় হয়। সৃষ্টি শুধু ইচ্ছা করতে আর কর্মপ্রচেষ্টা চালাতে পারে। এর বেশি কিছু নয়। ‘আর এই যে, মানুষ তাই পায় যা সে চেষ্টা করে।’ (সূরা আন-নাজম-৫৩) অর্থাৎ সৃষ্টি শুধু চেষ্টা করতে পারে, কিন্তু আল্লাহ না চাইলে কোনো কিছু সম্ভব নয়। যেমন, আগুন সব পুড়িয়ে দেয়। কিন্তু ইবরাহিম আ:-কে আগুনে নিক্ষেপ করা হলেও আল্লাহর ইচ্ছা না থাকায় আগুন তার কোনো ক্ষতিই করতে পারেনি। সংক্রামক রোগের ব্যাপারটিও এই মূলনীতির আলোকে বোঝার চেষ্টা করতে হবে।

হাদিসে যে শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে তা হলো ‘আদওয়া’। একজনের রোগ অন্যজনের শরীরে সংক্রমিত হওয়াকে আদওয়া বলা হয়। (ফতওয়া আরকানুল ইসলাম, শায়খ মুহাম্মদ বিন সালিহ আল উসাইমিন রহ:। সংক্রামক রোগের ক্ষেত্রে একটা কথা মনে রাখতে হবে যে, প্রকৃতপক্ষে রোগ ছড়ায় না। রোগ সংক্রামক জীবাণু একজন থেকে অন্যজনে ছড়িয়ে পড়ে। জীবাণু ছড়িয়ে পড়ার মানেই রোগ ছড়িয়ে পড়া নয়। চিকিৎসাবিজ্ঞানে রোগ সংক্রামক জীবাণু হচ্ছে এমন কোনো কিছু, যা রোগ উৎপন্ন করতে পারে। জীবাণুগুলোর রোগ সৃষ্টি করার ক্ষমতাকে ইংরেজিতে প্যাথোজেনেসিটি (চধঃযড়মবহরপরঃু) বলা হয়। জীবাণু এক দেহ থেকে অন্য দেহে ছড়িয়ে তার রোগ সৃষ্টিকারী ক্ষমতা দিয়ে রোগ তৈরি করতে পারে। আর এটি অবশ্যই আল্লাহর ইচ্ছার অধীন। আল্লাহর ইচ্ছা ব্যতীত কোনো জীবাণু কারো দেহে রোগ তৈরি করতে পারে না। রোগ আর সুস্থতা উভয়ই আল্লাহর পক্ষ থেকে আসে। তবে আল্লাহ তার অনিবার্য তাকদিরের মাধ্যমে জীবাণুর মধ্যে রোগ তৈরির ক্ষমতা দিয়েছেন, জীবাণুরা যে দেহেই প্রবেশ করে তার নির্ধারিত তাকদির অনুযায়ী রোগ তৈরি করে। তাই যিনি জীবাণু সংক্রামক রোগীর সংস্পর্শে আসবেন জীবাণু তার শরীরে রোগ সৃষ্টি করবে।

জাহেলি যুগে মনে করা হতো, রোগ নিজে নিজেই সংক্রমিত হয়। রোগের সংক্রমণের ক্ষেত্রে আল্লাহর কোনো ক্ষমতা নেই। তাদের এই ধারণাকে অপনোদন করে সঠিক নির্দেশনা দেয়ার জন্যই রাসূল সা: এই কথাটি বলেছিলেন। কোনো কিছু ঘটার পেছনে কোনো কারণ থাকলে সেটিকে কারণ হিসেবেই বিশ্বাস করতে হবে। (ফতোওয়া আরকানুল ইসলাম, শায়খ মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল উসাইমিন রহ:) এর বাইরে অন্য কিছু নয়। জীবাণুর সংক্রমণ রোগ ছড়াবার একটি কারণ। ইসলাম চূড়ান্ত—ভাবে সংক্রামক রোগের অস্তিত্ব অস্বীকার করে না। আর তাই হাদিসে এসেছেÑ আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত। রাসূল সা: বলেছেন, কুষ্ঠ রোগী থেকে দূরে থাকো, যেভাবে দূরে থাকো তুমি বাঘ থেকে।’ (বুখারি-কিতাবুত তিব্ব) হাদিসে আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে কুষ্ঠ রোগী থেকে দূরে থাকার কথা বলা বলা হয়েছে। এখানে রোগ সংক্রমিত হওয়ার বিষয়টিকে মেনে নেয়া হয়েছে। তবে রোগ নিজের ক্ষমতায় অন্যের কাছে যায় এমনটি নয়।

এখানে আরেকটি হাদিসের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন : রাসূল সা: বলেছেন : ‘কোনো রোগ ছোঁয়াচে নয়, কোনো বস্তুতে শুভাশুভের কোনো প্রভাব নেই, না সফর মাস অমঙ্গলের মাস এবং না কোনো মৃতের খুলিতে পেঁচার প্রভাব আছে। তখন জনৈক বেদুঈন বলেন : যদি এরূপ অবস্থা হয়, তবে মরুভূমির উটদের ব্যাপার কী? যারা হরিণের মতো সুস্থ হয়, পরে যখন তাদের সাথে কোনো খোস-পাঁচড়া উট মিলিত হয়, তবে সবাই ওই রোগে আক্রান্ত হয়। রাসূল সা: বলেন : তবে প্রথম উটটি কিভাবে খোস-পাঁচড়া বিশিষ্ট হয়?’ (আবু দাউদ, ইফা-৩৮৭১) উক্ত হাদিসে রাসূল সা: বেদুঈন লোকটির সংক্রমণের তথ্যকে অস্বীকার করেননি। বরং বেদুঈন ব্যক্তির সন্দেহ দূর করা হয়েছে যে, রোগ আল্লাহর পক্ষ থেকেই আসে।

যেমন প্রথম উটটি কোনো সংক্রমণ ব্যতীত আল্লাহর ইচ্ছাতেই রোগে আক্রান্ত হয়েছে। এরপর এটি অন্যান্যের মধ্যে ছড়িয়েছে। রাসূল সা: রোগাক্রান্ত কোনো কিছুকে সুস্থ কোনো কিছুর সাথে রাখতে নিষেধ করেছেন। রাসূল সা: বলেছেন : ‘রোগাক্রান্ত উট সুস্থ উটের মধ্যে মিশাবে না।’ (বুখারি, ইফা-৫৩৬০) আবু হুরাইরা থেকে বর্ণিত, রাসূল সা: বলেছেন, ‘পালের মালিক (তার) অসুস্থ উট অন্য মালিকের সুস্থ উটপালের নিকট নিয়ে আসবে না’। (মুসলিম, ইফা-৫৫৯৮) আমর ইবনু শারীদ রহ: সূত্রে তার পিতা থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, সাকীফ গোত্রীয় প্রতিনিধি দলের মাঝে একজন কুষ্ঠ রোগী ছিলেন। রাসূল সা: তার কাছে (সংবাদ) পাঠালেন যে, আমরা তোমাকে বায়আত করে নিয়েছি। তুমি ফিরে যাও। (মুসলিম, ইফা-৫৬২৮) এখানেও দেখা যাচ্ছে রাসূল সা: সংক্রমণ থেকে নিরাপত্তা লাভের ব্যবস্থা হিসেবে কুষ্ঠ রোগী থেকে দূরে থেকেছেন।

কোনো এলাকায় কোনো রোগের কারণে মহামারী দেখা দিলে রাসূল সা: সে এলাকা থেকে কাউকে বের হতে বা নতুন করে সেই এলাকায় যেতে নিষেধ করেছেন। ‘উসামা ইবনু যায়েদ রা: থেকে সা’দ রা:-এর কাছে রাসূল সা: থেকে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি বলেছেন : যখন তোমরা কোনো এলাকায় প্লেগের প্রাদুর্ভাবের সংবাদ পাও তখন সেই এলাকায় প্রবেশ করো না। আর তোমরা যেখানে অবস্থান করো, তথায় প্লেগের প্রাদুর্ভাব ঘটলে সেখান থেকে বেরিয়ে যেয়ো না। (বর্ণনাকারী হাবিব ইবনু আবু সাবিত বলেন) আমি জিজ্ঞাসা করলাম : আপনি কি উসামা রা:-কে এ হাদিস সা’দ রা:-এর কাছে বর্ণনা করতে শুনেছেন যে, (সা’দ) তাতে কোনো অসম্মতি প্রকাশ করেননি? ইবরাহিম ইবনু সা’দ বলেন, : হ্যাঁ। (বুখারি, ইফা-৫৩১৭) হজরত উমার রা: একবার শামের (সিরিয়ার) দিকে রওনা হলেন। ‘সার্গ’ নামক স্থান পর্যন্ত পৌঁছালে তিনি সংবাদ পান যে, শামে মহামারী আরম্ভ হয়েছে। তখন খলিফা অন্য সাহাবিদের পরামর্শক্রমে তার শাম যাত্রা স্থগিত করেন। (মুসলিম, ইফা-৫৫৯১)

হাদিসগুলোতে দেখা যায় রাসূল সা: সংক্রমণকারী রোগীদের থেকে নিজেদের দূরে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন এবং নিজেও দূরে থেকেছেন। সংক্রমণ প্রতিরোধে বিচ্ছিন্নকরণ ব্যবস্থার নির্দেশনা প্রদান করেছেন। তাই এটা বলা যায় যে, ইসলাম সংক্রামক রোগকে অস্বীকার করে না। সংক্রমিত হয়ে রোগ ছড়িয়ে পড়ে এটাই বাস্তবতা। তাই ‘রোগের মধ্যে সংক্রমণ নেই’ মানে হলো রোগ স্বয়ংক্রিয়ভাবে যে কাউকে আক্রমণ করতে পারে না। বরং আল্লাহ যাকে চান রোগ দেন। মুমিন বিশ্বাস করেন যে, সব বিষয়ের ন্যায় রোগের ক্ষেত্রেও আল্লাহর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। এ জন্য সংক্রমণের ভয়ে অস্থির বা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হওয়ার কোনো কারণ নেই। (খুতবাতুল ইসলাম, ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর) কাজেই, রোগের সংক্রমণ নেইÑ এটা নয়। বরং রোগের কোনো ক্ষমতা নেই কাউকে আক্রমণ করে, এই বিশ্বাস রেখে রোগ থেকে বেঁচে থাকার প্রচেষ্টা চালানোই হাদিসগুলোর প্রকৃত শিক্ষা।

লেখক : শিক্ষক, সাভার ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল ও কলেজ


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us