মৃত্যুকালের অসিয়ত : কী করা যাবে, কী করা যাবে না

জামান শামস | Jul 08, 2020 08:52 am
মৃত্যুকাল

মৃত্যুকাল - প্রতীকী ছবি

 

সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস রা: বর্ণনা করেন, বিদায় হজের বছর আমার কঠিন অসুখ হয়েছিল। রাসূল সা: আমাকে দেখতে এলেন। 

আমি বললাম, ইয়া রাসূলুল্লাহ! আপনি আমার অসুখের অবস্থা তো দেখতে পাচ্ছেন। আমি প্রচুর সম্পদের অধিকারী। আমার একজন কন্যা ছাড়া কোনো ওয়ারিশ নেই। এমতাবস্থায় আমি কি আমার সম্পদের দুই-তৃতীয়াংশ সাদাকা করতে পারি ?
তিনি বললেন, না।

আমি বললাম, ইয়া রাসূলুল্লাহ! তবে অর্ধেক?
তিনি বললেন, না।
আমি বললাম, ইয়া রাসূলুল্লাহ! তবে এক-তৃতীয়াংশ?
তিনি বললেন, করতে পারো। তবে তাও বেশি।
আপন ওয়ারিশদের মানুষের দরজায় হাত পাতা অবস্থায় রেখে যাওয়ার চেয়ে তাদের সচ্ছল অবস্থায় রেখে যাওয়া অনেক উত্তম। জেনে রেখো, আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার উদ্দেশ্যে তুমি যাই খরচ করবে তার প্রতিদান অবশ্যই পাবে। এমনকি স্ত্রীর মুখে তুলে দেয়া খাদ্যের লোকমাটিরও। (ম্তুাফাকুন আলাইহি)
বলাবাহুল্য গুরুত্ব বিবেচনায় এই হাদিসটি সহিহ আল বুখারিতে বিভিন্ন অনুচ্ছেদে ছয়বার বর্ণিত হয়েছে। রিয়াদুস সালেহীন প্রথম খণ্ডের প্রথম ভাগেই হাদিসটি গ্রন্থিত করেছে।

সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস রা: ছিলেন মহানবী মুহাম্মদ সা:-এর অন্যতম প্রধান সাহাবি। মাত্র ১৭ বছর বয়সে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। তিনি ইসলাম গ্রহণকারীদের মধ্যে ১৭তম ব্যক্তি। ৬৩৬ সালে পারস্য বিজয়ের নেতৃত্ব ও শাসনের জন্য তিনি অধিক পরিচিত। ৬১৬ ও ৬৫১ সালে তাকে কূটনৈতিক দায়িত্ব দিয়ে চীন পাঠানো হয়েছিল। ধারণা করা হয় চীনে যাওয়ার সময় নৌরুটে তিনি চট্টগ্রাম বন্দরে থেমেছেন এরং বাংলাকে ইসলামের সাথে পরিচয় করানোয় তার অবদান আছে। ধারণা করা হয়, ৬৪৮ খ্রিষ্টাব্দে তিনি বাংলাদেশের লালমনিরহাটে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন, যা স্থানীয়ভাবে আবু আক্কাস মসজিদ নামে পরিচিত।

(সূত্র : মাহমুদ, কাজল ইফতিখার রশিদ, (২০১২-১০-১৯)। সাড়ে ১৩০০ বছর আগের মসজিদ : প্রথম আলো )
হজরত সা’দের মধ্যে কাব্য প্রতিভাও ছিল। প্রাচীন সূত্রগুলোতে তার কিছু কবিতা সঙ্কলিত হয়েছে। ইবন হাজার ‘আল-ইসাবা’ গ্রন্থে কয়েকটি পঙ্ক্তি উদ্ধৃত করেছেন।

আল্লাহর পথে জিহাদে হজরত সা’দের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর বীরত্ব ও সাহসিকতা ইসলাম-দুশমনদের খুব মারাত্মক পরিণতির দিকে ঠেলে দিয়েছিল। তিনিই প্রথম মুসলিম যিনি আল্লাহর পথে তীর নিক্ষেপ করেন।
হজরত সা’দের সবচেয়ে বড় পরিচয় তিনি ‘আশারায়ে মুবাশ্শারাহ’ অর্থাৎ জীবদ্দশায় জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত দশজনের অন্যতম এবং তিনি এ দলের সর্বশেষ ব্যক্তি যিনি দুনিয়া থেকে বিদায় নেন।
এই হাদিসটিতে মানুষের ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজ জীবনের অনেক হিদায়েত রয়েছে।

প্রথমত, তিনি বলছেন, তার অসুস্থতার সময়ে রাসূলুল্লাহ সা: তাকে দেখতে গিয়েছেন। যে সময়ে এই ঘটনাটি সংঘটিত, তখন ইসলামের বিজয়ের কাল, আল্লাহর নবী সা: রাষ্ট্রপ্রধানের পদে। বুঝা গেলো, বড়দের উচিত অপেক্ষাকৃত ছোট ও অধীনস্থদের অসুস্থতা, বিপদাপদ বা প্রয়োজনে সাহায্য করা। এতে বড়দের প্রতি ছোটদের সম্মান, আনুগত্য, ভক্তি ও ভালোবাসা সৃষ্টি হয়। বড়দের প্রতি বিনয় ও শ্রদ্ধা প্রতিষ্ঠিত হয়। বড়রা আদেশ ও আনুগত্য প্রত্যাশা করবেন কিন্তু তার সবক সমাজে নিজেরা দেখাবেন না, এটা হতে পারে না। আজ আমরা বলি, আমাদের সমাজে আদব আখলাকের ঘাটতি আছে। দ্বিতীয়ত, চরম অসুস্থতার সময় অসুস্থ ব্যক্তি শুধু নিরাময়ের জন্য ব্যাকুল হবেন না বরং তার অনুপস্থিতিতে যে পারিবারিক সঙ্কট উপস্থিত হবে এবং তাতে পরিবারে যে চিরস্থায়ী অশান্তির বীজ বপন হবে সে আশঙ্কার কথাও ভাবতে হবে। নিকটজনের সাথে বিষয়গুলো নিয়ে মতবিনিময় করাও সুন্নাহ। এসব ক্ষেত্রে আমরা অসুখ নিয়েই অধৈর্য ও পেরেশান হয়ে পড়ি। ফলে কোনো কার্যকর দ্বিতীয় সারির নেতৃত্ব তৈরি হতে পারে না। কুরআনে হাকিমে যেকোনো মুসিবতকালে ধৈর্য ও সালাতের প্রতি গুরুত্ব এই কারণেই দেয়া হয়েছে।

তৃতীয়ত, আপনাকে আল্লাহ তায়ালা যে সম্পদ দান করেছেন তার কোনোটির মালিকই আপনি নন। মালিক আল্লাহ, আপনি আমি পাহারাদার মাত্র। কিন্তু মালিক নই ভেবে ওয়ারিশদের শূন্য হাতে পথে বসিয়ে সব সম্পত্তি আমার মৃত্যুর আগেই মসজিদ মাদ্রাসার নামে উইল করে দিতে পারি না। ইসলাম এটা সমর্থন করে না। রাসূল সা:-এর সাথে সাহাবি রা:-এর কথোপকথনটি বার বার পড়–ন। তৃতীয়বারে তিনি বলেছেন, সর্বোচ্চ এক-তৃতীয়াংশ পর্যন্ত তুমি দিতে পারো তবে সেটাও বেশি।

চতুর্থত, হাদিসটি যে বাক্য দিয়ে সমাপ্ত হয়েছে সেটি অনেক গুরুত্ববহ। আমার মতে, এটি ইসলামী অর্থনীতির একটি বড় মূলনীতিও বটে। কত বড় কথাÑ ‘ওয়ারিশদের মানুষের দোয়ারে হাত পাতা অবস্থায় রেখে যাওয়ার চেয়ে সচ্ছল করে যাওয়া অনেক উত্তম।’ এটা এক ধরনের দায়িত্ব। আমরা যা কষ্ট করে কামাই করি তার সবই খরচ করে ফেলি। অনেকের তো খরচ বাতিক রয়েছে। প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে খরচ।

ইসলাম আমাদের তাবৎ প্রয়োজনকে তিন ভাগে ভাগ করে দিয়েছে। ইমাম শাতিবীর রহ:-এর মতে, অত্যাবশ্যকীয়, আরামদায়ক ও বিলাসপ্রদ। মুসলমান অত্যাবশ্যক খরচে কৃপণতা করবে না। আরামদায়ক বাহুল্য না হলে এবং সামর্থ্যে কুলালে করবে কিন্তু কোনো অবস্থাতেই অবিবেচকের মতো বিলাস করতে পয়সা খরচ করবে না। দুনিয়া বিলাসের স্থান নয়।’ না মুক্তহস্ত, না বদ্ধমুষ্টি। মধ্যম পথ হলো ইসলামের পথ।

সুতরাং আপনার সামগ্রিক আয়ের সামঞ্জস্যপূর্ণ বণ্টন হবে তিন খাতেÑ সাংসারিক প্রয়োজনে, আল্লাহর রাস্তায় এবং কোনো অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ মোকাবেলায়Ñ যেটাকে আধুনিক ব্যাংকিং পরিভাষায় বলে- ভবিষ্যৎ সঞ্চয়। আল্লাহ রাস্তায় বলতে সমাজের নিরন্ন অসহায় ও বঞ্চিত মানুষের জন্য এনফাক, সাদাকা, জাকাত ও নফল দান।

খরচের বিষয়ে পরিবার অগ্রগণ্য। নিজের স্ত্রী ও সন্তানাদির জন্য অগ্রাধিকার এবং সেটা নিঃশেষ হবে না বরং সাদাকার মর্যাদায় আগামী আখিরাতের ব্যাংকে জমা হবে। সুবহান আল্লাহ। প্রতিদিন যখন আমরা বাড়ি ফিরি কিছু না কিছু হাতে করে নেই, সেটা সামান্যই হোক। আপনার স্বচ্ছ সুন্দর নিয়তের জন্য দুনিয়াতেও আল্লাহ আপনাকে পারিবারিক শান্তি ও নিরাপত্তা দান করবেন।
আল্লাহ আমাদের সব কাজকে বন্দেগি হিসেবে কবুল করুন।

লেখক : সাবেক অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লি:


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us