আরবের কোরবানির পশুর হাট কেমন?

মাসুদ আলম | Jul 18, 2021 07:57 am
আরবের কোরবানির পশুর হাট কেমন?

আরবের কোরবানির পশুর হাট কেমন? - ছবি : সংগৃহীত

 

সংযুক্ত আরব আমিরাতের পশুর হাটগুলো স্থায়ী হাট। আমি মূলত আবুধাবি রিজিয়নের কথাই বলছি। কেননা সংযুক্ত আরব আমিরাতের মোট সাতটি আমিরাত বা রাজ্যের সবারই রয়েছে সম্পূর্ণ আলাদা আইন কানুন, অর্থনীতি, পুলিশ, বিচার বিভাগ, ট্রাফিক ব্যবস্থা ইত্যাদি। এককথায় একক সামরিক বাহিনী, পাসপোর্ট ও মুদ্রা ছাড়া অন্য সব কিছুই আলাদা। যাহোক বলছি, গরু ছাগলের হাট নিয়ে...

গরু ছাগলের হাট না বলে এখানের হাটগুলোকে উট-দুম্বার হাট বলাই শ্রেয়। বাংলাদেশের মতো মাইকে ঘোষণা হতে থাকবে... বিশাল উট দুম্বা'র হাট!

কিন্তু না, এখানে কদাচিত অতিপ্রয়োজনেই শুধু কেউ গাড়ির হর্ণ বাজায়, তাছাড়া আজানের শব্দ ছাড়া অন্য যেকোনো শব্দ সৃষ্টি করা আইনত অপরাধ! জরিমানা হয়।
পশুর হাটগুলো জনস্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করে মূল শহর বা আবাসিক এলাকা থেকে বেশ কয়েক কিমি দূরে (কমপক্ষে ৫ কিমি) স্থায়ীভাবে নির্মিত। আমি আবুধাবির আল আইন অঞ্চলের পশুর হাটের কথা পাঠককে জানাচ্ছি।

দাবার ছকের মতো ব্লক আকারে (সাদা কালোর সীমানাগুলো রাস্তা কল্পনা করুন) প্রায় এক বর্গ কিমি এলাকাজুড়ে বিস্তৃত বাজারে উটের সারি সারি দোকান রয়েছে হাতের দুই পাশে লম্বালম্বিভাবে, তেমনিভাবে পরের দুটি গলিতে চার সারিতে রয়েছে নানা জাতের ছাগল, সবশেষ গলিতে রয়েছে গরু। আপনি প্রত্যেকটি দোকানের সামনেই গাড়ি বা ট্রাক নিয়ে যেতে পারবেন। যেখানে চারটি দোকান যোগ চিহ্নের মতো করে তৈরি করা- একই ছাদের নিচে, তবে দেয়ালগুলো কোমর সমান উঁচু এবং দোকানের পশুগুলোকে বেঁধে রাখা হয় না। ছাগলের দোকানগুলোতে দেয়ালের উপর তারের জাল দিয়ে বন্ধ রাখা হয়....কারণ তারা তো ছাগল! দেয়াল টপকে বেরিয়ে যাবে।

আমি এমনও ছাগল দেখেছি যেটা ১৫ হাত উঁচু খেজুর গাছে উঠে খেজুর খাচ্ছে! সোমলিয়ান ছাগল দেখেছি কলাগাছের মতো মোটা কাঠগাছের ছাল বাকল কামড়ে খেতে খেতে গাছটিকে এক সময় ভূপাতিত করেছে!

পাকিস্তানের মারখোর জাতের ছাগল, সুন্দর পশমওয়ালা কেশমিরি ছাগল, দুই ফুট লম্বা কান ওয়ালা ছাগল... এমনকি ৭০-৮০ কেজি ওজনের ছাগলও এখানে পশুর হাটগুলোতে দেখতে পাওয়া যায়।

আরবদের কাছে কোরবানির জন্য সবচেয়ে পছন্দের পশু হলো উট, তারপর দুম্বা। তারা গরু বা ছাগল দিয়ে কুরবানি করে না বললেই চলে। তবে গোশত খেয়ে থাকে। আরবদের সবচেয়ে পছন্দের গোশত হলো- ছোট্ট ছাগলের গোশত। জবাই করে আস্ত রান্না করা হয়। কখনো কখনো এরকম রান্না করা ছাগলের মুখে ঘাসও পাওয়া যায়। আমরা তো একবার উপহার পাওয়া এরকম গোশতের মাঝে ছাগলের লাদি পেয়েছি!

দুম্বা আসলে এক জাতের ছাগল। এগুলো মধ্য এশিয়া, আরব উপসাগরীয় অঞ্চল ও আফ্রিকার উত্তর অংশে পালিত হয়। দুম্বার গোশতে একটু উটকো গন্ধ আছে। প্রথমবার যারা খায় তাদের এই গন্ধ সহ্য করা খুবই কঠিন হয়।

আমাদের দেশে অনেকেই দুম্বা সম্পর্কে বেশ কৌতুহলী। তাদের জন্য বলছি- প্রাপ্তবয়স্ক একেকটি দুম্বার গড় ওজন ৩৫-৫০ কেজি (জাত ভেদে), কোনোটির ওজন ১২০ কেজি পর্যন্ত হয়ে থাকে। মাথাটা একটু বড় এবং শিংবিহীন, নাকটা একটু লম্বাটে যা কিছুটা নিচের দিকে কলার মতো বেঁকে গেছে। প্রাপ্তবয়স্ক স্ত্রী পুরুষ দুটিরই পশ্চাৎদেশে লিঙ্গের নিচে একটি বড় তেলগ্রন্থী ঝুলতে থাকে। একটি বেলুনে তিন লিটার পানি ঝুলালে যেমন দেখা যায়, ঠিক সেরকম।

পশুর বাজারটি সারা বছর একই রকম, ঈদ উপলক্ষে আলাদা কোনো বাড়বাড়ন্ত নেই, হাঁকডাক নেই, তবে পশুর আমদানি কিছুটা বাড়ে। আমি এখন পর্যন্ত পাঁচটি ছাগল কিনেছি এখান থেকে। দরদাম করেই কিনতে হয়। ১৪ শ' দিরহাম দাম চাওয়া ছাগল কিনেছি ৫ শ' দিয়ে! দোকান কর্মচারীরা ৮০% বেলুচি (পাকিস্তান ও ইরান), ১০% মৌরিতানিয়া এবং বাকি ১০% সোমালিয়া, ইথিওপিয়া, সুদান, মিসর এবং বাংলাদেশের নাগরিক। মালিক বরাবরই স্থানীয় আরব। তবে কেউ কেউ আরব ব্যক্তির নামে লাইসেন্স করে নিজে ব্যবসা করে, অনেক আরব এক্ষেত্রে মাসোহারা নিয়ে থাকে আবার কেউ কেউ ফিসাবিলিল্লাহ্ অনুমতি দিয়ে থাকে।

উট ছাড়া অন্যান্য পশুর ৯৯%ই আসে অন্য দেশ থেকে। সোমালিয়া, কেনিয়া, ইথিওপিয়া, জিবুতি, দক্ষিণ আফ্রিকা, সুদান, ইরিত্রিয়া, সিরিয়া, ইরান, পাকিস্তান, অষ্ট্রেলিয়া, ও ককেশীয় দেশ গুলো থেকে আসে নানা প্রজাতির ছাগল ভেড়া দুম্বা, আর গরুগুলো সাধারণত ব্রাজিল, পাকিস্তান ইউরোপ ইরান ও ককেশীয় দেশগুলো থেকে আনা হয়।

আমাদানির সময় জাহাজে তোলার আগেই সেগুলোর 'ডাক্তারি' পরীক্ষা সম্পন্ন হয় এবং বাজারে ঢোকানোর সময় পরীক্ষা করে পশুগুলোর কানে একটি হলুদ রঙের প্লাস্টিক ট্যাগ লাগিয়ে দেয়া হয়, যাতে বিভিন্ন সংক্ষিপ্ত তথ্য থাকে।

পশুপালন সংক্রান্ত যাবতীয় জিনিস পত্র এই পশুর বাজারেই কিনতে পাবেন, অন্য কোথাও না!
পশু কেনা হয়ে গেলে বাজারের গা ঘেঁষেই রয়েছে পাবলিক এবাট্টর বা পশু জবাইখানা।

আপনার পশু কেনার রশিদ দেখিয়ে জবাইখানায় পশু জমা দিলে তারা রশিদ দিবে, সেটা নিয়ে বাইরে অপেক্ষা করবেন। ভিতরে হালাল উপায়ে জবাই করে অত্যাধুনিক মেশিনে কেটে বড় বড় ৮/১০ টুকরা করে ট্রলিতে করে নিয়ে এসে সিরিয়াল নম্বর অনুযায়ী ডাকবে।

মাথা এবং পা চাইলে আগেই রশিদে উল্লেখ করতে হবে। নাড়িভূড়ি চামড়া ও ফুসফুস দেয়া হয় না। কলিজা থেকে ছোট্ট এক টুকরা কেটে রাখা হয় মূলত পরীক্ষার জন্য, কোনো রোগ আছে কিনা। জবাইখানার ভিতরেই (আলাদা ভবনে) ২৪ ঘন্টা একজন পশু চিকিৎসক ও তাদের দল থাকেন, যারা তাৎক্ষণিকভাবে ল্যাবরেটরিতে কলিজা ও ফুসফুস পরীক্ষা করেন। ফুসফুসটি ভালো হলেও সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করা হয়, এ দেশে পশুর ফুসফুস বিক্রি ও খাওয়া নিষিদ্ধ। কেননা সকল রোগের শুরু মূলত ফুসফুস থেকেই হয়। কোনো পশুতে অগ্রহণযোগ্য রোগ পাওয়া গেলে সেই পশুর কোনো কিছুই আপনাকে দেয়া হবে না, সেগুলো ধ্বংস করা হবে। তবে আপনাকে নির্ধারিত কাগজে সার্টিফিকেট দেয়া হবে, যেটা দেখিয়ে এবং পশু ক্রয়ের রশিদ দেখিয়ে অর্ধেক টাকা ফেরত পাবেন। বিক্রেতা বিনাবাক্যব্যয়ে টাকা ফেরত দিতে বাধ্য।

পশু জবাইয়ের জন্য সকল জবাইখানায় ফি নির্ধারিত, প্রতিটি ছাগল সর্বনিম্ন ১৭ দিরহাম থেকে শুরু করে যেকোনো উট ১০৫ দিরহাম পর্যন্ত।

কোরবানির দুদিন আগে থেকেই পশু জমা নেয়া শুরু হয়, সারা বছর ২৪ ঘন্টাই চলে পশুর হাট ও জবাইখানা। এখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য কোনো পুলিশ থাকে না, সব ফটকেই ২৪x৭ সিকিউরিটি গার্ড থাকে। তবে মূল প্রবেশপথগুলোতে ঈদের আগের দিন থেকে দু-একজন অতিরিক্ত সিকিউরিটি গার্ড দেখা যায়। যদিও সাদা পোশাকে বলদিয়া বা সিটি করপোরেশন এবং স্বাস্থ্য বিভাগের লোকজন এসে থাকে, যারা দোকানের পরিবেশ, পশুর খাবারের মান ও পশুর অকারণ কষ্ট ভোগ হচ্ছে কিনা ইত্যাদি পর্যবেক্ষণ করতে থাকে। অসামঞ্জস্য পেলে সাথে সাথে ছবি তুলে জরিমানা করা হয়।

পশুর বাজারের মূল ফটকে একটি ১০ ফুট চওড়া অগভীর খালের মধ্যে জীবাণুনাশক পানি থাকে সারা বছর, যখন আপনার গাড়িটি প্রবেশ করবে ও বের হয়ে যাবে তখন টায়ারগুলো যেন ধুয়ে যায় এবং যেন কোনো জীবাণু বহন করতে না পারে। হেঁটে আসা যাওয়া পশুগুলোর পাগুলোও এভাবে জীবাণুমুক্ত হয়ে যায়।

মার্কেটে গোশত বিক্রির জন্য যেসব পশু এখানে জবাই করা হয়, সেগুলো জবাইয়ের পর সাথে সাথে সরবরাহ করা হয় না। কেননা তাতে রাস্তায় ও বাজারে রক্ত পড়ার আশঙ্কা থাকে, এতে রোগ ছড়াতে পারে। তাই দুই ঘন্টা শীতল কক্ষে (৪ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড) ঝুলিয়ে বাতাসে শুকানো হয় এবং তারপর সাদা মোটা সুঁতি কাপড়ে মুড়িয়ে গোশত বহনের জন্য নির্ধারিত শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত গাড়িতে সরবরাহ করা হয়।

গোশতের উপর সবুজ রংয়ের সিলমোহর মেরে নিরাপদ ক্লিয়ারেন্স দেয়া হয়। ওই রংটি তৈরি হয় পুদিনা পাতা থেকে অর্থাৎ জৈব রং। ফলে রংটি খেলেও কোনো সমস্যা হয় না।

এদেশে জবাইখানা ছাড়া অন্যত্র পশু জবাই করা নিষেধ। ধরা পড়লে ৫ শ' থেকে এক হাজার দিরহাম পর্যন্ত জরিমানা। যদিও ঈদের সময় অনেকেই গোপনে এই কাজটি করে থাকে, বিশেষ করে ছাগল জবাইয়ের ক্ষেত্রে।

নির্ধারিত এলাকায়ই শুধু পশু পালন ও হাঁস মুরগি পালন করা যায়। লোকালয় থেকে বহু দূরে মরুভূমির কোনো একপ্রান্তে সরকার নির্ধারিত স্থানেই এসব খামার দেখা যায়, যেগুলোকে উজবা বলা হয়। এর জন্য লাইসেন্স বাধ্যতামূলক। অবশ্য, সরকার থেকে এজন্য ভর্তুকি ও ভাতা দেয়া হয়। ঘোড়া, কুকুর, বাঘ, সিংহ ইত্যাদি পালনের জন্য ও লাইসেন্স বাধ্যতামূলক। এখানে পশুর জন্য আবাসিক হাসপাতাল আছে।

এদেশে কখনোই কোরবানির পশু নিয়ে কোনো প্রদর্শনী হয় না। আরবরা নিজেরা সাধারণত শেষ দিনে পশু কিনতে আসে এবং কিনেই কাউকে দিয়ে জবাইখানার লাইনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে চলে যায়। অনেকেই তো তাদের কেনা পশুটি চোখেও দেখে না! বাড়ির কর্মচারী ও ড্রাইভারকে পাঠিয়ে দেন- যাও! এই দামে উট দুম্বা কিনে কোরবানি দিয়ে আসো!

তারা ফিরে এসে পশু কেনার রশিদ দেখায়। কারণ এখানে কোনো কেনাকাটাতেই রশিদ নিয়ে হাঙ্কিপাঙ্কি চলে না। (হাঙ্কিপাঙ্কির সঠিক অর্থ আমার জানা নেই)

তবে অনেক চাচি বয়সী মহিলাকে 'ঝাড়ু বোরকা' পরে পশুর হাটে ঘুরতে দেখা যায়। তারা নাক ও ঠোঁটের উপর ঐতিহ্যবাহী দো'চালা নেকাব লাগিয়ে ব্যাপক দরদাম করতে থাকে। যেমন কোনো একটি দুম্বার দাম চাওয়া হয়েছে ৪ হাজার দিরহাম (প্রকৃত মূল্য ১২-১৫ শ')। চাচি শুরু করবেন ৪-৫ শ' থেকে!

বলছি, ঝাড়ু বোরকা হলো- যে সব বোরকা যেগুলো পায়ের পাতার চেয়ে এক ফুট লম্বা থাকে এবং হাঁটার সময় রাস্তার ময়লা আবর্জনা পরিষ্কার করে নিয়ে যায়!
অনেক পাঠক নিশ্চয়ই আফসোস শুরু করেছেন- কতো চমৎকার নিয়ম কানুন! আর বাংলাদেশ ওমুক তমুক ইত্যাদি।

(আমার কাছে তো বাংলাদেশের টাই ভালো লাগে...গরুর হাতে পায়ে বাইন্দা জবা কইরা, চৌদ্দগোষ্ঠি এক সাথে বইসা আমরা একদিনের কসাই হইয়া যাই।)

আসরের আগে আগে ভাগাভাগি করে হুলুস্থুল আয়োজন, মা-চাচিরা যারা সারা দিন তামাশা দেইখ্যা কাটাইছে তারা এবার রসুইঘরে ব্যস্ত। গরিব মানুষ আসে, দু-এক টুকরা গোশত লইয়া খুশি হইয়া চইল্যা যায়, আত্মীয়রাও খুশি হয়...মশলার বাজার গরম হয়, কামাড়ের দোকান গরম হয়, চামাড়ের বাড়ী গরম হয়...শেষমেশ পেট গরম হয়!! এই আনন্দ, এই গরম আপনি আরবে কই পাইবেন...।

যাই হোক পাঠক, নিয়মতান্ত্রিক সব কিছুই নিরাপদ, কল্যাণমূলক এবং বেশি সুন্দর। আরবের নিয়মগুলো আমাদের জন্য শিক্ষনীয়...
আদহা মুবারক, আপনার ঈদ আল আদহা বরকতময় হোক।

আল আইন সিটি
ইউএই
১৯-৮-২০১৭


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us