গণমাধ্যমের নিরপেক্ষতা ও বস্তুনিষ্ঠতা

ড. এ কে এম মাকসুদুল হক | Jul 31, 2021 08:19 pm
গণমাধ্যমের নিরপেক্ষতা ও বস্তুনিষ্ঠতা

গণমাধ্যমের নিরপেক্ষতা ও বস্তুনিষ্ঠতা - ছবি : সংগৃহীত

 

গণমাধ্যম হলো রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ। শক্তির দিক দিয়ে মিডিয়া পারমাণবিক বোমার চেয়েও শক্তিশালী। অ্যাটম বোমা একটি জনপদকে ধ্বংস করে দিতে পারে। কিন্তু মিডিয়া একটি জনপদের গণমানুষের মননে পরিবর্তন এনে একটি সভ্যতার মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে। পুরাতন সভ্যতাকে ভেঙে সেখানে গড়ে তুলতে পারে নতুন সভ্যতা। বেশ কিছু দিন ধরে সংবাদমাধ্যমের যে একদেশদর্শী ধরনের দৈন্য উপস্থাপিত হচ্ছে তা আজ সর্বজনবিদিত।

এমনকি খোদ সংবাদমাধ্যমেও এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, যদিও তা হয়েছে সামাজিক মাধ্যমের চাপে। বিশেষ করে কলেজছাত্রী মুনিয়ার অপমৃত্যুর পরই এই বিষয়টি চাউর হলেও আরো আগে থেকেই গণমাধ্যমের এ ধরনের একপেশে উপস্থাপনা চলে আসছিল। বাংলাদেশের ইসলামিস্টদেরকে নিয়ে এই বস্তুনিষ্ঠহীনতার চর্চা হলেও কোনো মহলই তেমন গা করেনি। কিন্তু এই চর্চা যখন সেকুলার অঙ্গনেও বিস্তৃত হলো তখনই সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো সরব হয়ে উঠেছে। অর্থাৎ এ দেশের ইসলামিস্টরা তাদের মানবাধিকার বা ন্যায়বিচার না পেলেও গণমাধ্যমের তাতে কিছু যায়-আসে না কিংবা তাদের পেশাদারিত্ব বা নিরপেক্ষতা খর্ব হয় না। গণমাধ্যমের এ ধরনের বিশেষ দৈন্যের বিষয়টি বিশ্লেষণ করার দাবি রাখে। প্রথমেই আমরা গত কিছু দিনে দেশব্যাপী ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনা তুলে ধরব যেন বুঝতে পারি গণমাধ্যম কিভাবে সেগুলো উপস্থাপন করল জাতির সামনে।

ক. গত ৬ জুলাই নোয়াখালীর মাইজদী থানার এক অজপাড়া গাঁ থেকে অপহরণের শিকার হন ধর্মপ্রচারক মাহমুদুল হাসান গুণবী। তার আত্মীয়স্বজন এ ব্যাপারে কোথাও সহযোগিতা না পেয়ে নোয়াখালীতে মানববন্ধন করে। কিন্তু এই মানববন্ধনের খবর না প্রচারের কারণ জানতে চাইলে দেশের ভাইগেন্ট ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়াগুলো তাদের প্রতি ‘নিষেধাজ্ঞা রয়েছে’ বলে জানায়। উল্লেখ্য, ওই অপহৃত মাওলানা সাহেবের হাতেই বান্দরবানের ওমর ফারুক ত্রিপুরা মুসলমান হয়েছিলেন বলে জানা যায়।

খ. গত ২ জুন নারায়ণগঞ্জের বান্টি বাজার এলাকা থেকে একই দিনে শহিদুল, নোমান ও নাসির নামে তিনজন নিখোঁজের শিকার হন, যার মধ্যে শহিদুল বান্টিবাজার মসজিদের ইমাম এবং পাশ্ববর্তী মাদরাসার শিক্ষক। এটি গণমাধ্যম না জানলেও আমরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জানতে পারি। তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম অনিয়ন্ত্রিত হলেও আনুষ্ঠানিক সংবাদমাধ্যমের চেয়েও অনেকেই এটিতেই আস্থা রাখছে বলে মনে হচ্ছে।

গ. গত ২৮ জুন ঢাকার মিরপুর থেকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী ধর্মপরায়ণ মানুষ জাহিদ হাসান রাজু (২৬) নিখোঁজ হন। এই খবরটি একটি জাতীয় দৈনিক এবং একটি চ্যানেলে জানানো হয়।

ঘ. গত ১৮ জুন রাতে বান্দরবানের রোয়াংছড়ি উপজেলার তুলাছড়ি গ্রামে খুন হন নওমুসলিম, ইমাম এবং ধর্মপ্রচারক ওমর ফারুক ত্রিপুরা। অত্যন্ত সংবেদনশীল এই সংবাদটি কয়েকটি পত্রিকায় নিয়ন্ত্রিতভাবে প্রকাশিত হয়েছে পাহাড়ের আর ১০টি সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের মতোই। অথচ এর ভেতরে-বাইরে সংবাদের গভীরতায় কোনো সংবাদমাধ্যম স্পর্শ করেনি। কিন্তু ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের বেলায় এর আগে অনেক হইচই করা প্রতিবেদন বা ডকুমেন্টারি দেখা গেছে মিডিয়ায়!

ঙ. গত ১০ জুন আবু ত্বহা আদনান নামে একজন ইসলামী বক্তা গাড়ি ও তিনজন সঙ্গীসহ নিখোঁজ হন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এ ব্যাপারে ঝড় তুললেও আমাদের মেইন স্ট্রিম মিডিয়ার তেমন কোনো চঞ্চলতা প্রদর্শিত হয়নি। সামাজিকমাধ্যমের চাপের মুখেই প্রায় ১১ দিন পর আবু ত্বহা আত্মপ্রকাশ করেন বা ফিরে আসেন।

চ. গত ৯ জুন ঢাকার অদূরে আশুলিয়ার বোটক্লাবে চিত্রনায়িকা পরীমনি অসামাজিক দুর্ঘটনার শিকার হন। কোথাও প্রতিকার না পেলে, গণমাধ্যমে পরীমনির পক্ষে সমালোচনার ঝড় উঠলে অভিযুক্তরা দ্রুত আইনের আওতায় আসে।

ছ. এর আগে ২৬ এপ্রিল গুলশানের একটি ফ্ল্যাট থেকে কলেজছাত্রী মোসারাত জাহান মুনিয়ার মৃতদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। এই অপমৃত্যু মামলায় একমাত্র আসামির নাম মিডিয়াতে খুব একটা উচ্চারিত হয়নি, কেমন যেন একটা লাজুকতার পরিবেশ বিরাজ করছিল। বরং অভিযুক্ত শিল্প গ্রুপের এমডির কাছে ঘটনার পর একটি রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের কয়েকজনকে দেখা করে শুভেচ্ছা জানাতে যাওয়ার সংবাদ পাওয়া যায়। এমনকি তার একটি ক্লাবে নেতা নির্বাচিত হওয়ার চিত্রও সামাজিকমাধ্যমে দেখা যায়। কিন্তু এ বিষয়ে গণমাধ্যমের নিষ্প্রভতা বা নিষ্ক্রিয়তাই লক্ষণীয় ছিল যদিও চ্যানেলগুলো এ সময়ে হেফাজতিদের বিভিন্ন চারিত্রিক দোষত্রুটির খবরাখবর প্রচারে অত্যন্ত ব্যতিব্যস্ত সময় পার করেছে। হেফাজত নেতারা কে কয়টি বিয়ে করেছেন, কার হ্যান্ডসেটে পর্নোচিত্র পাওয়া গেছে ইত্যাদিই ছিল সেই সময়ের ‘মহা আবিষ্কার’!

জ. এরই মাঝে বাংলাদেশের একজন সাবেক রাষ্ট্রপতির মৃত্যুবার্ষিকী নিভৃতে চলে গেল। দুই-একটি পত্রিকা ছাড়া বাকিগুলোতে তার ছবির স্থান হয়েছে ভেতরের পাতার কোণায় বা শেষের পাতায়। এই মিডিয়াই হয়তো বা একদিন বর্তমান ক্ষমতাধরদের ছবি সেই জায়গাতেই নিয়ে যাবে যদি তারা ক্ষমতায় না থাকে।

ঝ. কার্টুনিস্ট কিশোরের কারাবাস এবং নির্যাতনের বিষয়ে মিডিয়া যৌক্তিকভাবে সরব হলেও হেফাজতের প্রায় সব নেতাই এবার রোজার মাসে গ্রেফতার হয়েছেন এবং দীর্ঘ দিন ধরে পুলিশ হেফাজতে আছেন; সেই ব্যাপারে কোনো মানবাধিকারের আকুতি নেই। বরং একতরফাভাবে সরবরাহকৃত সংবাদের ভিত্তিতে ওই নেতাদের চরিত্র হননের প্রক্রিয়ায় তারা সরবে অংশগ্রহণ করছে।

ঞ. লেখক মোশতাক কারাগারে মৃত্যুবরণ করেছেন বলে গণআকাক্সক্ষা পূরণ করে সবগুলো চ্যানেলেই এবং প্রিন্ট মিডিয়াতে লাগাতার প্রতিবেদন প্রচার করা হয়েছে। কিন্তু হেফাজত নেতা মাওলানা ইকবাল হোসেন পুলিশ হেফাজতে গত ২০ মে মৃত্যুবরণ করলে তা শুধুই একটি ‘মৃত্যু সংবাদ’ হিসেবে এসে মৃতের সংখ্যা পূরণ করেছে। মাওলানা ইকবাল একজন ইসলামিস্ট আর লেখক মোশতাক একজন সেকুলার ব্যক্তিত্ব ছিলেন বলেই কি এই বৈষম্য? ট. মাওলানা মামুনুল হক সোনারগাঁওয়ে রয়েল রিসোর্টে দ্বিতীয় স্ত্রীসহ ‘আবিষ্কৃত’ হওয়ার পর থেকে গ্রেফতার হওয়া এবং আজ পর্যন্ত তার প্রতিটি বিষয়ে মিডিয়া ফলাও করে অনুসরণ চলছে। কিন্তু একটি শিল্প গ্রুপের এমডি সম্পর্কে একটি কল রেকর্ডের বাইরে কি আর কিছু আছে মিডিয়ায়? মিডিয়া কি এখন স্বপ্রণোদিত নীরব নয়?

ট. বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী এবং স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত জাতীয় অনুষ্ঠানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আগমনের বিরুদ্ধে হেফাজতের আন্দোলনে গত ২৬ থেকে ২৯ মার্চ পর্যন্ত সময়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে ভাঙচুর ও প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। এতে প্রায় ‘২১ জন হেফাজত কর্মী-সমর্থক নিহত হয়েছেন’ বলে হেফাজত দাবি করেছে। সেই প্রাণগুলো কিভাবে নিভে গেল, কারা তাদের হত্যা করল, কেন হত্যা করল, তাদের পরিবারেরই বা কী অবস্থা ইত্যাদি বিষয়ে মিডিয়ার কোনো সুস্পষ্ট বক্তব্য বা সংবাদ না থাকলেও ‘হেফাজত’ যে তাণ্ডব করেছে, তা কিন্তু মিডিয়া ডকুমেন্টারি করে অবারিতভাবে প্রদর্শন করেছে। কেউ যদি তাণ্ডব করে থাকে তবে তা অবশ্যই নিন্দনীয় ও বিচার্য। কিন্তু এতগুলো মানুষের জীবনের কি কোনোই মূল্য নেই? না কি তারা ‘ইসলামিস্ট’ হওয়ার অপরাধেই মনোযোগ পায়নি?

যে ঘটনাগুলো বর্ণনা করা হলো তাতে যদি কেউ পক্ষপাতদুষ্টতা খুঁজে পান তবে তাতে এককথায় মিডিয়াকে দোষারোপ করা যাবে না। এর জন্য স্বাধীনতার পর থেকে বিকশিত হওয়া এ দেশের আর্থরাজনৈতিক পরিবেশ এবং সংস্কৃতির বিশ্লেষণ করা দরকার। প্রবাসী গবেষক প্রফেসর আলী রিয়াজের মতে, একটি গণতান্ত্রিক পরিবেশে তিন ধরনের গণমাধ্যম থাকে-

১. রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন; ২. ব্যক্তিমালিকানাধীন এবং ৩. রাজনৈতিক দলের মালিকানাধীন বা পরোক্ষ সমর্থনপুষ্ট- বাংলাদেশের স্বাধীনতার সূচনা থেকেই সেগুলো ছিল। তখন দৈনিক পত্রিকার সংখ্যা ছিল ৩০, অর্ধ সাপ্তাহিকের সংখ্যা ছিল তিনটি এবং সাপ্তাহিকের সংখ্যা ১৫১। ১৯৭৫ সালের জানুয়ারিতে দৈনিকের সংখ্যা চারটিতে নামিয়ে এনে তা সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন করা হয়। এরপর ১৯৯০ সাল পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন টেলিভিশনকে ‘সাহেব-বিবির ব্যাক্স’ বলেই অভিহিত করা হতো। ১৯৯০-এর পর ইলেকট্র্রনিক গণমাধ্যমের ব্যক্তিমালিকানার সূচনা হয়। বর্তমানে দেশে টিভি চ্যানেল ৪৫টি, ২৮টি এফএম এবং ৩২টি কমিউনিটি রেডিও, এক হাজার ২৪টি দৈনিক পত্রিকা এবং কমপক্ষে ১০০টি অনলাইন নিউজ পোর্টাল রয়েছে।

আলী রিয়াজ তার একটি গবেষণায় দেখিয়েছেন, এ দেশে ক্ষমতাসীন দলের ঘনিষ্ঠ না হয়ে গণমাধ্যমের, বিশেষ করে ক্রমবর্ধমান টেলিভিশন চ্যানেলের মালিক হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় নেই। এই মালিকানা বিশ্লেষণ করে তিনি তিনটি প্রধান প্রবণতা লক্ষ করেছেন- ১. মালিকদের ক্ষমতাসীন দলের সংশ্লিষ্টতা; ২. এই মালিকানা ও পরিচালকদের একটি বড় অংশই একই পরিবারের সদস্যদের মধ্যে সীমাবদ্ধ এবং ৩. গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের মালিক ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান এবং মালিকরা অন্যান্য ব্যবসার সাথে যুক্ত। এই গণমাধ্যমগুলো সামাজিক-রাজনৈতিকভাবে মালিকদের মর্যাদা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে এবং অন্যান্য বাণিজ্যিক স্বার্থের রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করছে। আবার রাষ্ট্র আইনকানুন করে সংবাদের কনটেন্টের ওপর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারে। কখনো কখনো মালিক বা পরিচালকরাই এমন সিদ্ধান্ত নেন, যা ওই আইনকানুন দ্বারা অর্জনের চেষ্টা করা হয়। ফলে গত ৫০ বছরেও বাংলাদেশে সাংবাদিকতা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি। কাজেই সংবাদমূল্য, সততা, বস্তুনিষ্ঠতা ও প্রাসঙ্গিকতা ছাড়াও অন্যান্য বিবেচনাও সংবাদ প্রচারের সিদ্ধান্ত গ্রহণে কাজ করছে (প্রথম আলো- ২১, ২২ এবং ২৩ মে ২০২১)।

গত ২০ এপ্রিল আন্তর্জাতিক সংগঠন ‘রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স’ (আরএসএফ) ২০২১ সালের মুক্ত গণমাধ্যম সূচক প্রকাশ করেছে যাতে ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৫২তম। এটা ২০২০ এবং ২০১৯ সালে যথাক্রমে ১৫১তম এবং ১৫০তম ছিল। ‘আরএসএফ’ ২০১৮ সালের ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন’কে সরকারের বিশেষ অস্ত্র হিসেবে উল্লেøখ করেছে যার জন্য সম্পাদকরা সঙ্গতকারণেই জেল খাটছেন বা গণমাধ্যম বন্ধের ঝুঁকি এড়াতে আত্মনিয়ন্ত্রণ অবলম্বন করছেন (প্রাগুক্ত-২১ এপ্রিল ২০২১)। গত ৩ মে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংগঠন ‘হিউম্যান রাইটস ওয়াচ’সহ আটটি মানবাধিকার সংগঠন জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার প্রধানকে জানায়, ২০২০ সালে কমপক্ষে ২৪৭ জন সাংবাদিক বাংলাদেশে হামলা-মামলার শিকার হয়েছেন রাষ্ট্রীয় অফিসিয়াল এবং সরকার সংশ্লিষ্টদের হাতে। তাদের মতে, সাংবাদিকরা নজিরবিহীন স্ব-আরোপিত নিয়ন্ত্রণের পথ বেছে নিয়েছেন (ডেইলি স্টার-৪ মে ২০২১)। ২০২০ সালের প্রথম পাঁচ মাসে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট (ডিএসএ) আইনে দায়েরকৃত ৪০০ মামলার মধ্যে বেশির ভাগই ছিল অস্পষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে। অ্যাকাডেমিশিয়ান সিআর আবরার লিখেছেন, এর মধ্যে ১৯৭টি মামলার ৮৮টির বাদি আওয়ামী লীগের এমপি, ইউপি চেয়ারম্যান এবং যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের কর্মী এবং ৭০টির বাদি পুলিশ (প্রাগুক্ত-৩০ মে ২০২১)।

বিশিষ্ট আইনজ্ঞ ড: শাহদীন মালিক এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘বলতে গেলে দু’-একটি ব্যতিক্রম বাদে প্রায় সব সংবাদমাধ্যম-সংবাদপত্র, টিভি চ্যানেল, নিউজ পোর্টালের পেছনে রয়েছে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান। ব্যবসায়ীরা যেমন দলে দলে সংসদে ঢুকছেন, তার থেকেও বেশি ঢুকছেন সংবাদমাধ্যমের জগতে। ব্যতিক্রম আছে। কিন্তু ব্যবসায়িক স্বার্থে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সীমিত হওয়ার প্রবণতা তো এখন আর উপেক্ষা করা যায় না’ (প্রথম আলো-৩ মে ২০২১)।

দেশের প্রবীণ সাংবাদিক রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ এক প্রশ্নের জবাবে স্বাধীন সাংবাদিকতার পথে তিনটি বড় বাধার কথা উল্লেখ করছেন- ১. স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক পরিবেশের অভাব। কেউ সাহস করে সত্য বলতে চাইছে না, পারছে না; ২. সাংবাদিকতা পেশায় সম্পাদকীয় প্রতিষ্ঠানটিকে নষ্ট করে ফেলা হয়েছে। যার টাকা আছে, তিনিই সম্পাদক হতে পারেন। অভিজ্ঞতার কোনো প্রয়োজন নেই ৩. বিভিন্ন কালাকানুন, যার কতগুলো নতুন করে সামনে এসেছে। এর বাইরে আছে রাজনৈতিক প্রেশার গ্রুপ, কালোবাজারি প্রেশার গ্রুপ, ব্যবসায়ীদের প্রেশার গ্রুপ- এ রকম নানা গোষ্ঠী কখনো টাকা বা কখনো পেশিশক্তি দিয়ে স্বাধীন সাংবাদিকতাকে বাধাগ্রস্ত করে (প্রাগুক্ত-৬ জুন ২০২১)।

গত ২ মে বিশ্ব মুক্তগণমাধ্যম দিবস উপলক্ষে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান এক বিবৃতিতে বলেন, ‘বেশির ভাগ সংবাদমাধ্যমের মালিকানা ব্যবসায়ীদের হাতে। এই ব্যবসায়ী মহলের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার কারণে ‘মিডিয়া ক্যাপচার’ বা এখন গণমাধ্যম জবরদখল প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি পেয়েছে। ফলে পেশাদার সাংবাদিকও অনেক ক্ষেত্রে তাদের সুরক্ষায় সংবাদ প্রচার কিংবা গোপন করতে বাধ্য হচ্ছেন এবং পেশাগত দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হচ্ছেন’ (প্রাগুক্ত-৩ মে ২০২১)। গত ২২ জুন অন্য একটি আলোচনা সভায় তিনি বলেন, ‘মূল রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ঘায়েল হয়ে গেলে ক্ষমতাসীনদের দৃষ্টি পড়ে নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যমের ওপর। গণমাধ্যম অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার মাধ্যমে ভুলত্রুটি তুলে ধরে সরকারের সহায়ক ভূমিকা পালন করতে চায়। কিন্তু গণমাধ্যমের এই প্রয়াসকে সরকারের একাংশ শত্রু হিসেবে দেখে’ (প্রাগুক্ত-২৩ জুন ২০২১)। ফলে দেশে সাংবাদিক নির্যাতনের প্রবণতা বেড়ে গেছে বলে অনেকে মনে করেন। আইন ও সালিশকেন্দ্রর (আসক) এক প্রতিবেদনে জানা যায়, গত ছয় মাসে ১২০ জন সাংবাদিক বিভিন্নভাবে নির্যাতন, হামলা-মামলা ও হয়রানির শিকার হয়েছেন (নয়া দিগন্ত-১ জুলাই ২০২১)।

গণমাধ্যমকে একটি দেশের ‘ফোর্থ এস্টেট’ বলা হয় যা জাতির ওয়াচডগ হিসেবে সদা জাগ্রত থাকে এবং জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে পরিপূর্ণ নিরপেক্ষ থেকে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রবাহ অব্যাহত রেখে সরকার ও জাতিকে সঠিক পথ দেখায়। কিন্তু বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার জালে আটকে আছে গণমাধ্যম। এই প্রতিকূলতার মধ্যে সাংবাদিকতার বিবেককে হারিয়ে ফেললে গণমাধ্যমসহ পুরো জাতিই কিন্তু বিবেকহীন হয়ে পড়বে। উপরের ঘটনাগুলো থেকে দেখা যায়, আজকে গণমাধ্যম নিরপেক্ষতা হারিয়ে দেশের একটি গোষ্ঠীকে উপেক্ষা করছে বা তাদের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। ফলে সেই গোষ্ঠীর বিষয়ে সংবাদ প্রচারে সত্য-মিথ্যা একাকার হয়ে যাচ্ছে। অথচ আল্লাহ পাক পবিত্র কুরআনে ঘোষণা দিয়েছেন, ‘তোমরা সত্যকে মিথ্যার সাথে মিশিয়ে দিও না এবং জানা সত্ত্বেও সত্যকে তোমরা গোপন করো না’ (সূরা বাকারা, ২:৪২)।
লেখক : নিরাপত্তা বিশ্লেষক

Email: maksud2648@yahoo.com

 


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us