ভারতীয়রা কেন ডাক্তারি পড়তে ইউক্রেন যায়?

অন্য এক দিগন্ত | Feb 28, 2022 08:01 pm
ভারতীয়রা কেন ডাক্তারি পড়তে ইউক্রেন যায়?

ভারতীয়রা কেন ডাক্তারি পড়তে ইউক্রেন যায়? - ছবি : সংগৃহীত

 

রাশিয়ার আগ্রাসনের পর আগে থেকেই ইউক্রেন ছাড়ার হিড়িক পড়ে যায় অন্য দেশের নাগরিকদের। রাশিয়া সামরিক অভিযান শুরু করার আগেই কয়েক হাজার ভারতীয় ইউক্রেন থেকে দেশে ফেরে। আর যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর বাকি থাকা নাগরিকদের দেশে ফেরাচ্ছে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। অনেকেই ইতিমধ্যেই ফিরে এসেছে, আবার কয়েক হাজার বাড়ি ফেরার অপেক্ষায় রয়েছে। এদের মধ্যে রয়েছেন ইউক্রেনে ডাক্তারি পড়তে যাওয়া কয়েক হাজার শিক্ষার্থী। পূর্বে খারকিভ থেকে পশ্চিমে লাভিভ, ডাক্তারি পড়ার জন্য ইউক্রেনের বিভিন্ন শহর ভারতীয়দের জন্য জনপ্রিয় গন্তব্য। ইউক্রেন ছাড়াও রোমানিয়া এবং বুলগেরিয়ারমতো অন্যান্য পূর্ব ইউরোপীয় দেশেও ভারতীয় ছাত্ররা ডাক্তারি পড়তে যায়। কারণগুলো হলো- কলেজগুলোতে সহজে প্রবেশের মানদণ্ড, তুলনামূলকভাবে কম প্রতিযোগিতা, ভারতের তুলনায় ইউরোপের প্রাইভেট কলেজে ডাক্তারি পড়ার খরচ কম। তবে, এই দেশগুলোর কলেজ থেকে পড়াশোনা শেষ করার পরে ভারতে প্র্যাকটিস করা চ্যালেঞ্জিং হতে পারে। যারা বিদেশী চিকিৎসা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে স্নাতক হয়েছে, তাদের সকলকে ভারতে উচ্চতর শিক্ষা নেয়ার আগে লাইসেন্স পরীক্ষা দিতে হবে। ফরেন মেডিকেল গ্র্যাজুয়েটস একজামিনেশন নামে এই পরীক্ষায় পাসের হার খুবই কম।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং হার্ভার্ড টিএইচ চ্যান স্কুল অফ পাবলিক হেলথের প্রাক্তন ছাত্র সোনালি বৈদ্য ট্যুইটারে লিখেছেন, "আমি বুলগেরিয়াতে আমার চিকিৎসা প্রশিক্ষণ নিয়েছি যা ভারতে প্রাইভেট কলেজের থেকে সস্তা আর ঘোরার আকাঙ্ক্ষাও ছিল, ওখানে শিক্ষক-ছাত্র অনুপাত ভালো। জনস্বাস্থ্য, ছাত্র সংগঠন, নীতিশাস্ত্র, অন্যান্য দেশের সঙ্গে বিনিময় প্রোগ্রাম এবং আরো অনেক কিছুর প্রাথমিক সুবিধা রয়েছে।"

ডাক্তারি পড়ার জন্য নিয়ম, খরচ : ভারতে ডাক্তারি শিক্ষা পরিচালনা করে এমন এজেন্সিগুলো বলে যে ইউক্রেনের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ইংরেজিতে ডাক্তারি পড়ানো হয় এবং বিদেশি ছাত্রদের জন্য কোনো পরীক্ষা বা ভর্তির মানদণ্ড নেই। ২০১৮ সাল থেকে এমবিবিএস-এর জন্য বিদেশে যাওয়া শিক্ষার্থীদের জন্য নিট-ইউজি পরীক্ষা দেয়া বাধ্যতামূলক করেছে ভারত।

ভারতে চিকিৎসা শিক্ষা নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর সঙ্গে কাজ করেছেন, এমন একজন ডাক্তার বলেন, "যারা পূর্ব ইউরোপের দেশ, রাশিয়া বা চীনে ডাক্তারি পড়তে যায়, তাদের বেশিরভাগই নিট-ইউজি-তে ২০ শতাংশের কম স্কোর করে, এটা ভারতে কাট অফ। এমনকি প্রাইভেট কলেজগুলোতেও প্রায় ৬০ শতাংশ কম স্কোর দেখা যায়।" এইমস-র প্রাক্তন ডিরেক্টর ডক্টর এম সি মিশ্র বলেন, "যে কেউ ফি দিলেই ডাক্তারি পড়তে পারে। ইউক্রেন, রাশিয়া এবং চীন বহু বছর ধরেই ডাক্তারি পড়ার জন্য জনপ্রিয় গন্তব্য। কারণ এই দেশগুলোতে ভারতের বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলির তুলনায় ডাক্তারি পড়া সস্তা।"

ইউক্রেনে মেডিসিনে স্নাতক হওয়ার খরচ ৬ বছরের পুরো সময়কালের জন্য প্রায় ১৫-২০ লাখ টাকা। ভারতে সাড়ে ৪ বছরের কোর্সের জন্য প্রাইভেট মেডিকেল কলেজগুলির ফি ৫০ লাখ থেকে দেড় কোটি টাকার মধ্যে হতে পারে। ইউক্রেনে ডাক্তারি পড়ার প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার আরেকটি কারণ হলো যে সেখানকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ইউরোপীয় ক্রেডিট ট্রান্সফার সিস্টেম মেনে চলে, যা শিক্ষার্থীদের জন্য তাদের কোর্স চলাকালীন ইউরোপে প্রতিষ্ঠানের বিষয়টি সহজ করে তোলে। এছাড়াও ইউক্রেনের মেডিকেল ডিগ্রিগুলো বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ইউরোপীয় কাউন্সিল এবং অন্যান্য বৈশ্বিক সংস্থা দ্বারা স্বীকৃত।

ফরেন মেডিকেল গ্র্যাজুয়েটস একজামিনেশন : বিদেশ থেকে ভারতে ফিরে এসে সমস্ত মেডিসিন স্নাতকদের ফরেন মেডিকেল গ্র্যাজুয়েটস একজামিনেশন দিতে হবে। এই পরীক্ষায় পাসের হার খুবই কম। ন্যাশনাল বোর্ড অফ একজামিনেশন ভারতে এ পরীক্ষাটি পরিচালনা করে। দেখা গিয়েছে যে ২০২০ সালে যারা পরীক্ষার জন্য আবেদন করেছিল তাদের মধ্যে মাত্র ১৬.৪৮ শতাংশ পাস করেছিল। ইউক্রেনে ডাক্তারি পড়া ছাত্রদের মাত্র ১৬.৬ শতাংশ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পেরেছিল। এমন হাজার হাজার মেডিকেল স্নাতক রয়েছে যারা এখনও পরীক্ষাটি পাস করার জন্য অপেক্ষা করছে। তারা ভারতে প্র্যাকটিস করতে পারছে না। তারা বিভিন্ন কোচিং ইন্সটিটিউটে গিয়ে পড়াশোনা করছে।

ভারতে প্রতিযোগিতা : ন্যাশনাল মেডিক্যাল কমিশনের অধীনে মেডিকেল অ্যাসেসমেন্ট অ্যান্ড রেটিং বোর্ডের সভাপতি বি এন গঙ্গাধর বলেছেন, "ভারতে প্রায় ৯০ হাজার এমবিবিএস আসন রয়েছে। আমরা শিগগিরই ১ মিলিয়ন জনসংখ্যার জন্য ১০০ মেডিকেল আসন তৈরি করব, এবং এটি আমাদের জন্য যথেষ্ট। দেশে যখন এত আসন, ছেলেমেয়েরা কেন বিদেশে যাবে?"

যাই হোক, ভারতে এমবিবিএস আসনের সংখ্যা বাড়লেও কলেজে ভর্তি হওয়া কঠিন। ২০২১ সালে ১৬ লাখেরও বেশি শিক্ষার্থী নিট-ইউজি-র জন্য আবেদন করেছে। এর মানে হলো যে দেশের প্রতিটা এমবিবিএস আসনের জন্য আবেদন করেছে ১৬ জনেরও বেশি। ইউক্রেনে জনসংখ্যা ৪.৪ কোটি, সেখানে অন্তত ২৫টি মেডিকেল কলেজ রয়েছে যেখানে ভারতীয়রা পড়াশোনা করে। এর মানে প্রতি ১.৭ লাখ মানুষের জন্য সেখানে কমপক্ষে একটি মেডিকেল কলেজ রয়েছে। অন্য দিকে, ১৩৮ কোটি জনসংখ্যার ভারতে প্রায় ৫৩৬টি মেডিকেল কলেজ রয়েছে, প্রতি ২৫.৭ লাখ লোকের জন্য একটি মেডিকেল কলেজে।

ইউক্রেনে কতজন ভারতীয় ছাত্র আছে?

ইউক্রেনের শিক্ষা ও বিজ্ঞান মন্ত্রকের ওয়েবসাইট অনুসারে, ইউক্রেনে ২০ হাজারেরও বেশি ভারতীয় নাগরিক রয়েছে এবং তাদের মধ্যে ১৮ হাজারই পড়ুয়া। ইউক্রেনে পড়াশোনা করা প্রায় ৭৬ হাজার বিদেশি ছাত্রদের মধ্যে তারাই সবচেয়ে বড় দল। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে প্রায় ৪ হাজার ভারতীয় ইউক্রেন ছেড়ে আসতে সক্ষম হয়েছে, কিন্তু ১৬ হাজার জন এখনও আটকে রয়েছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে আটকে পড়া শিক্ষার্থীদের নিরাপদে সরিয়ে নেয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করতে রাজ্য সরকারগুলো কেন্দ্রকে অনুরোধ করেছে। ইতিমধ্যেই কেন্দ্রীয় সরকার ইউক্রেনের প্রতিবেশী দেশ রোমানিয়া, পোলান্ড, হাঙ্গেরি, স্লোভাক রিপাবলিকের মাধ্য়মে আটকে পড়া লোকজনকে দেশ ফেরাচ্ছে। ইতিমধ্যেই 'অপারেশন গঙ্গা' শুরু করে দেওয়া হয়েছে। ইউক্রেনে আটকে থাকা ভারতীয়দের ফিরিয়ে আনার জন্য 'অপারেশন গঙ্গা' নামে একটি ট্যুইটার হ্যান্ডেল চালু করা হয়েছে। এই ট্যুইটার হ্যান্ডেলের মাধ্যমে উদ্ধারকারী বিমান ও অন্য বিষয়ে খোঁজ পেতে পারবেন আটকে পড়া ব্যক্তির পরিবারের সদস্যরা। এখনও পর্যন্ত এয়ার ইন্ডিয়ার পাঁচটি বিশেষ ফ্লাইট ইউক্রেন থেকে ১ হাজারেরও বেশি ভারতীয়কে উদ্ধার করে দেশে ফিরিয়েছে। আজ সকালে দিল্লি বিমানবন্দরে অবতরণ করে অপারেশন গঙ্গার পঞ্চম ফ্লাইট ৷ ওই ফ্লাইটে করে দেশে ফিরেছেন ২৪৯ জন ৷

প্রতিবেশী দেশগুলোর মাধ্যমে ইউক্রেন থেকে ভারতীয়দের সরিয়ে আনার জন্য অপারেশন গঙ্গার জন্য ফ্লাইটের একটি তালিকা গতকাল প্রকাশ করেছেন পররাষ্ট্রসচিব হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা। তিনি বলেন, "আটকে পড়া ভারতীয়দের আনতে বিমানভাড়া সরকার দেবে। নির্দিষ্ট দেশের সীমান্ত ক্রসিং পয়েন্টগুলি চিহ্নিত করা হয়েছে এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তরফ থেকে এই প্রক্রিয়াতে সহায়তা করার জন্য দল মোতায়েন করা হয়েছে। যেহেতু ইউক্রেনের আকাশপথ বন্ধ, তাই হাঙ্গেরি, পোল্যান্ড, স্লোভাকিয়া এবং রোমানিয়া থেকেই ভারতীয়দের দেশে ফেরানো হচ্ছে।"

সূত্র : নিউজ ১৮


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us