বারমুডা ত্রিভূজে কোন কোন জাহাজ ডুবেছে?

মীযানুল করীম | Jan 09, 2021 04:24 pm
বারমুডা ট্রায়াঙ্গাল

বারমুডা ট্রায়াঙ্গাল - ছবি সংগৃহীত

 

বারমুডা ত্রিভুজে ১৯৮৬ সালের ১৪ মে ডুবে যায় ‘প্রাইড অব বাল্টিমোর’ জাহাজ। এর কারণ ঠাণ্ডা বাতাসের প্রচণ্ড ধাক্কায় তলিয়ে যাওয়া। হঠাৎ বাতাসের গতিবেগ বেড়ে ঘণ্টায় ৩২ কিলোমিটার থেকে ১৪৫ কিলোমিটার হয়ে যায়। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল হারিকেন সেন্টারের উপগ্রহ বিশেষজ্ঞ জেমস লুশাইনের ভাষায়, ‘আবহাওয়া খুব খারাপ হয়ে গেলে উপর থেকে ঠাণ্ডা বাতাস বোমার মতো আঘাত করে। তখন বাতাস আর পানি মিলে দানবের মতো বিস্ফোরণ ঘটায়।’ একই ঘটনা ঘটেছে ব্রাজিলের কাছে ২০১০ সালে ‘কনকর্ডিয়া’ জাহাজের বেলায়। এভাবে ‘হাওয়া বোমা’ ২৭০ কিলোমিটার পর্যন্ত বেগে আঘাত হানতে পারে।

বারমুডা ট্রায়াঙ্গলে নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার কিছু ঘটনার সম্ভাব্য কারণ, সাগরে প্রাকৃতিক গ্যাস মিথেন হাইড্রেটের বিশাল ক্ষেত্র। পানির নিচে ‘কন্টিনেন্টাল শেলফ’গুলোতে এর অবস্থান। অস্ট্রেলিয়ার গবেষকরা দেখেছেন, বুদবুদ পর্যন্ত পানির ঘনত্ব কমিয়ে জাহাজকে ডুবিয়ে দিতে পারে। তখন বিধ্বস্ত জাহাজের কোনো অংশ ভেসে উঠলেও উপসাগরের স্রোতে তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। ধারণা করা হচ্ছে, মাঝে মাঝে মিথেন উদগীরণ (কখনো তা ‘কাদার অগ্নিগিরি’) সাগরবক্ষে ফেনাযুক্ত পানির জন্ম দেয়। ফলে আর জাহাজ পানিতে ভেসে থাকতে পারে না। তখন কোনো হুঁশিয়ারি ছাড়াই জাহাজ দ্রুত ডুবে যেতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ সৈকতের অদূরে ‘ ব্লেক রিজ’ এলাকাতে এবং বিশ্বজুড়ে, পানির নিচে হাইড্রেটের বিরাট মজুদ বিদ্যমান। তবে মার্কিন জিওলজিক্যাল সার্ভে দফতর মনে করছে, বারমুডা ট্রায়াঙ্গলে গত ১৫ হাজার বছরেও এই গ্যাসের উদগীরণ ঘটনি।

ফ্লাইট-১৯ ছিল ‘অ্যাভেঞ্জার’ নামের টর্পোডো পাঁচটি বোমারু বিমানের প্রশিক্ষণ। বিশ্বযুদ্ধের কিছু দিন পরে ১৯৪৫ সালের ৫ ডিসেম্বর এগুলোর সবক’টি নিখোঁজ হয়ে যায় একত্রে। তখন তারা উড়ছিল আটলান্টিকের ওপর দিয়ে। কথা ছিল, বিমানগুলো উড়বে যুক্তরাষ্ট্রের ফোর্ট লডারডেল থেকে প্রথমে ২২৭ কিলোমিটার সোজা পূর্বদিকে, এরপর ১১৭ কিলোমিটার উত্তর দিকে এবং সবশেষে ২৩০ কিলোমিটার উড়ে ট্রেনিং উড্ডয়ন শেষ করবে। তবে বিমানগুলো ঘাঁটিতে আর ফেরেনি। নৌবাহিনীর অনুসন্ধানে বলা হয়েছে, উড্ডয়নে ভুল করায় বিমানগুলোর জ্বালানি ফুরিয়ে গিয়েছিল। তবে এর সন্ধান ও উদ্ধার কাজে নেমে আরেকটি বিমান ১৩ জন ক্রুকে নিয়ে নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিল কেন? ফ্লোরিডা উপকূলের অদূরবর্তী একটি ট্যাংকার জানায়, বিমানটি ব্যর্থ অনুসন্ধান অভিযান চালানোর সময়ে বিস্ফোরণ ঘটে এবং এর জ্বালানি পড়ে যায়। এর পরই ঝড়ো আবহাওয়া দেখা দেয়। জানা যায়, হারিয়ে যাওয়া অনুসন্ধানী বিমানটিতে তেল বেশি ভরলে ত্রুটিবশত বিস্ফোরণ ঘটত। হয়তো সেদিন দীর্ঘসময়ের জন্য, জ্বালানি বেশি নেয়া হয়েছিল।

১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারি স্টার টাইগার নামের বিমান যাচ্ছিল অ্যাজোর্স থেকে বারমুডা। পরের বছর ১৭ জানুয়ারি বারমুডা থেকে জ্যামাইকার রাজধানী কিংস্টনে যাচ্ছিল ‘স্টার অ্যারিয়েল’ বিমানটি। দুটিই ব্রিটিশ সাউথ আমেরিকান এয়ারওয়েজের বিমান। দুটিই নিখোঁজ, যদিও তাদের গতিবেগ ছিল স্বাভাবিক। ন্যূনতম ভ্রান্তি বা ত্রুটির কারণেও গন্তব্যে তাদের পৌঁছার কথা নয়।

১৯৪৮ সালের ২৮ ডিসেম্বর একটি ডগলাস ডিসি-৩ বিমান হারিয়ে যায়। যাচ্ছিল পুয়ের্টোরিকোর সান জুয়ান থেকে ফ্লোরিডার মিয়ামি। বিমানটি বা এর ৩২ যাত্রীর কোনো খোঁজ মিলেনি। কর্তৃপক্ষের অনুসন্ধান প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘অপর্যাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে বিমানটি নিরুদ্দেশ হওয়ার সম্ভাব্য কারণ জানা গেল না।’
বারমুডা ট্রায়াঙ্গল নিয়ে কেন এত রহস্য ভীতি আর উদ্বেগ? কিছু ঘটনা এর কারণ। এর মধ্যে কয়েকটি নমুনাস্বরূপ উল্লেখ করা হলো।

যুদ্ধ ছাড়া আর কোনো মার্কিন নৌবাহিনীর ইতিহাসে এত বেশি মানুষ প্রাণ হারায়নি। ব্যাপার হলো, ১৯১৮ সালের ৪ মার্চ ৩০৯ জন নাবিকসমেত একটি জাহাজ ‘সাইক্লপস চিরনিরুদ্দেশ হয়ে যায়। এই জাহাজের আর কোনো দিন হদিস মেলেনি। বার্বাডোজ দ্বীপ থেকে এটি ছেড়েছিল ম্যাঙ্গানিজ বোঝাই করে। নৌযানটির এক ইঞ্জিন ছিল অকার্যকর। কেউ বলছেন ঝড়ের কথা; কেউবা দুর্ঘটনাবশত ডুবে যাওয়াকে দায়ী করেছেন। আবার কারো বক্তব্য হলো, প্রথম মহাযুদ্ধকালে আমেরিকার শত্রুরা জাহাজটিকে ডুবিয়ে দিয়েছে। এ ঘটনার পরপর জাহাজটির ঘনিষ্ঠ দুটি জাহাজ ‘প্রটিয়াস’ আর ‘নিরিয়াস’ উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরে হারিয়ে যায়। দুটোই ধাতুর আকরিকে ছিল বোঝাই। তিনটি জাহাজে একই ধাতু বোঝাই করা হয়। ডুবে যাবার সম্ভাব্য কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, অতিরিক্ত বোঝা নেয়ায় এটা ঘটেছিল।

১৯২১ সালের ৩১ জানুয়ারি এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটে। যুক্তরাষ্ট্রের উত্তর ক্যারোলিনার কেপ হ্যাটেরাস উপকূলের চরে ‘ক্যারল এ ডিয়ারিং’ নামের পাঁচটি মাস্তুল যুক্ত একটি জাহাজকে পরিত্যক্ত এবং শক্তভাবে আটকা পড়া অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল। মাত্র দুই বছর আগে এটি তৈরি করা হয়। গুজব রটে, জাহাজটি ডাকাতির শিকার। সম্ভবত, নিষেধাজ্ঞা বিরোধী ও বেআইনি মদের পরিবহন ব্যবসার সাথে এই ঘটনা সম্পৃক্ত। হয়তো একই কারণে, একই সময়ে ‘হিউইট’ নামের আরেক জাহাজ হাওয়া হয়ে গিয়েছিল। কয়েক ঘণ্টা পরে একটি স্টিমার ডিয়ারিং জাহাজটির পথ ধরে যাচ্ছিল পাল তুলে। ধারণা করা হয়েছে, জাহাজের সব সংকেত অমান্যকারী এই স্টিমারই ‘হিউইট’ জাহাজ এবং এটাই ডিয়ারিং-এর সব নাবিককে সরিয়ে নিয়েছিল।

১৯৫৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর বারমুডার দক্ষিণে, আটলান্টিক মহাসাগরে দেখা যায়, একটি বিনোদন নৌকা পড়ে আছে। প্রায়শ উল্লেখ করা হয়, সাগরে তিন তিনটি ঝড়ের মোকাবেলার সময়ে এর নাবিকরা হাওয়া হয়ে গেছেন আর নৌকাটি টিকে আছে। সে বছর আটলান্টিকের ঝড়ের মওসুমে সেপ্টেম্বর মাসের হারিকেন প্রভাব ফেলেছিল বারমুডাতেও। ২২ সেপ্টেম্বর সকালে দেখা গেছে- কারলিসলে উপসাগরের কাছে খোলা জায়গায় ‘কনেমারা’ নামের এই নৌযান দৃঢ়ভাবে নোঙর করা। আসন্ন ঝড়ের আশঙ্কায় শক্ত রশি দিয়ে এবং অতিরিক্ত দুটি নোঙরের সাহায্যে এটা প্রোথিত ছিল তখন। ঝড়ের পর উপসাগর ভয়াবহ ও বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। তদন্তে জানা যায়, তখন নোঙর ছিঁড়ে নৌযানটি সাগরে চলে গিয়েছিল।

১৯৬৩ সালের ২৮ আগস্ট মার্কিন বিমানবাহিনীর দুটি বিমান (স্ট্রাটোট্যাংকার) পারস্পরিক সংঘর্ষে বারমুডার ৩০০ মাইল পশ্চিমে বিধ্বস্ত হয়ে মহাসাগরে গিয়ে পড়ে। বিমান দুটির সংঘর্ষ বাঁধলেও পরস্পর থেকে ২৬০ কিলোমিটার দূরে ছিল বিধ্বস্ত হওয়ার স্থান দুটি। মার্কিন বিমানবাহিনীর তদন্ত রিপোর্টে দেখা যায়, এই দুটি জায়গার দ্বিতীয়টিতে পুরনো একটি বয়াতে কিছু আগাছা ছাড়া আর কোনো বস্তু পাওয়া যায়নি।


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us