হাজার গুণের হাজারি গুড়

আব্দুর রাজ্জাক ঘিওর (মানিকগঞ্জ) | Jan 06, 2020 06:33 am
হাজারি গুড়

হাজারি গুড় - ছবি : সংগৃহীত

 

মানিকগঞ্জের ‘হাজারী গুড়’। গোটা দেশে এক নামেই পরিচিতি আছে বিশেষ এই খেজুর গুড়ের। অতুলনীয় স্বাদ আর মনমাতানো সুগন্ধের হাজারী গুড়ের চাহিদা আছে দেশের বাইরেও। একবার খেলে দ্বিতীয়বার খেতে চাইবে না এমন লোকের সংখ্যা নেই বললেই চলে। ইংল্যান্ডের রানী এলিজাবেথকেও এ গুড় উপহার দেয়া হয়েছিল। এমনকি বিশ্বের কমপক্ষে ২০টি দেশের বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ এ গুড়ের স্বাদ নিতে মুখিয়ে থাকেন, করেন ভূয়সী প্রশংসা। তাই শীত মৌসুম এলেই হাজারী গুড়ের কারণে মানিকগঞ্জ হয়ে উঠে একটা শিল্প এলাকায়। ইতিহাসখ্যাত হাজারী গুড়ের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এটি দু’হাতে গুঁড়ো করে ফুঁ দিলে তা ছাতুর মতো বাতাসে উড়ে যায়। এ ঐতিহ্য দু’একদিনের নয়; প্রায় ২০০ বছরের।

হাজারী গুড়ের সুনাম আজো টিকিয়ে রেখেছে দেশের একমাত্র হাজারী গুড় উৎপাদনকারী জেলা মানিকগঞ্জের হরিরামপুরের ঐতিহ্যবাহী হাজারী পরিবারসহ শতাধিক গাছি পরিবার। তবে এক শ্রেণীর অসাধু গুড় তৈরিকারক সাদা রঙয়ের গুড়ের ওপর হাজারী গুড়ের নাম খোদাই করে বাজারজাত করে সাধারণ ক্রেতাদের ধোঁকা দিচ্ছে। নির্বিচারে খেজুর গাছ কেটে ইট ভাটায় লাকড়ি হিসেবে পুড়িয়ে এই গুড়শিল্পকে ধ্বংস করা হচ্ছে। এ ছাড়াও গাছি সঙ্কট তো রয়েছেই। ফলে দিন দিন জৌলুস আর জনপ্রিয়তায় ভাটা পরছে হাজারী গুড়ে। ভোজন রসিকরা এর মান নিয়ে নানা প্রশ্ন তুললেও স্বাদেগন্ধে ঝিটকার হাজারী গুড় এখনো সারা বাংলায় তুলনাবিহীন এবং এর চাহিদা ব্যাপক।

জেলার খেজুর গাছের দুই তৃতীয়াংশই রয়েছে হরিরামপুর উপজেলায়। সেখানে প্রতি একরে ১৫টি খেজুর গাছ দেখা যায়। এ অঞ্চলের পথে-প্রান্তরে রয়েছে সারি সারি খেজুর গাছ। আর এ খেজুর গাছ এ অঞ্চলের অসংখ্য মানুষের জীবন-জীবিকার একটি মাধ্যম। শীতে খেজুর গাছের রস দিয়ে তৈরি করা হাজারী গুড় দেশ-বিদেশে বেশ প্রিয়। তিন পুরুষ ধরে গুড় উৎপাদন করে আসা গাছি আজমত আলি হাজারী (৬৫) জানান, ১৫ থেকে ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় এই গুড় উৎপাদন করতে হয়। আগের দিন বিকেলে গাছ কেটে হাড়ি বেঁধে দেয়া হয়। পর দিন ভোরে (সূর্য উঠার আগে) রস সংগ্রহ করে পরিষ্কার করে ছেঁকে মাটির তৈরি (জালা) পাত্রে চুলায় (বাইনে) জ্বালিয়ে বিশেষ পদ্ধতিতে তৈরি করা হয় হাজারী গুড়। তবে এ পদ্ধতি এখন আর হাজারী পরিবারের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। প্রায় গাছিদের মধ্যেই ছড়িয়ে পড়েছে। এই গুড় দেখতে যেমনি সুন্দর খেতেও তেমনি সুস্বাদু। মিষ্টি ও টল টলে রস ছাড়া হাজারী গুড় হয় না। প্রতিকেজি গুড় ৬০০ টাকা থেকে হাজার টাকা পর্যন্তও বিক্রি হয় বলে তিনি জানান।

কালোই গ্রামের গাছি করিম মিয়া জানান, বাজারে এক ধরনের হাজারী সদৃশ্য গুড় পাওয়া গেলেও মৌলিক দু’টি গুড়ের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। নানা প্রতিকূলতায় খেজুরের গুড় প্রায় বিলীন হতে চলেছে। প্রতি বছর হাজার হাজার গাছ কেটে ইটভাটায় লাকড়ি হিসেবে পুড়িয়ে এই গুড় শিল্পকে ধ্বংস করা হচ্ছে। সরকারিভাবে উদ্যোগ নিয়ে এই শিল্পকে রক্ষা করা জরুরি বলে জানান এই এলাকার গুড় শিল্পীরা।

হাজারী গুড় নিয়ে রয়েছে নানা রূপকথা। হাজারী কোনো বংশগত নাম নয়। এটা ব্যক্তি বিশেষের নাম। প্রায় দেড়শ’ বছর আগে ঝিটকা অঞ্চলে হাজারী প্রামাণিক নামে একজন গাছি ছিলেন। যিনি খেজুরের রস দিয়ে গুড় তৈরি করতেন। হঠাৎ একদিন বিকেলে খেজুর গাছ কেটে হাঁড়ি বসিয়ে গাছ থেকে নামামাত্রই একজন দরবেশ তার কাছে রস খেতে চান। তখন ওই গাছি দরবেশকে বলেছিলেন, সবেমাত্র গাছে হাঁড়ি বসানো হয়েছে। এ অল্প সময়ে বড়জোর ১০-১৫ ফোঁটা রস হাঁড়িতে পড়েছে। তবুও দরবেশ তাকে গাছে ওঠে হাঁড়ি নামিয়ে তাকে রস খাওয়ানোর আকুতি জানান। দরবেশের রস খাওয়ার ইচ্ছায় গাছি খেজুর গাছে উঠেই হতবাক হয়ে যান। দেখতে পান, মাত্র কয়েক মিনিটেই পুরো হাঁড়ি রসে ভরে গেছে। গাছি হাঁড়ি নিয়ে নিচে নেমে দরবেশকে রস খাওয়ান এবং পা-জড়িয়ে ধরেন। গাছিকে উঠিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে দরবেশ বললেন, কাল থেকে তুই যে গুড় তৈরি করবি তা সবাইকে খাওয়াবি এবং তোর গুড়ের সুনাম দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়বে। তোর সাত পুরুষ এ গুড়ের সুনাম ধরে রাখবে বলেই দরবেশ দ্রুত চলে যান। এরপর অনেক খোঁজাখুঁজি করেও ওই দরবেশকে পাওয়া যায়নি। ওই দিন থেকেই হাজারী প্রামাণিকের নামেই এ গুড়ের ‘হাজারী’ নামকরণ করা হয়।

আবার প্রবীণ অনেকেরই মতে, গাছের রস থেকে বিশেষ কৌশলে সুগন্ধময় স্বাদ সফেদ এ গুড়ের উদ্ভাবন করেছিলেন হরিরামপুর উপজেলার ঝিটকা গ্রামের মিনহাজ উদ্দিন হাজারী। প্রকৃত হাজারী গুড় তৈরির গোপন কৌশল একমাত্র তার পরিবারের সদস্যদের মধ্যেই রয়ে গেছে। তার নামেই এই গুড়ের নামকরণ করা হয়েছে ‘হাজারী গুড়’।

যেভাবে তৈরি হয় হাজারী গুড় : স্থানীয় গাছিরা দুপুরের পর থেকে খেজুর গাছ কেটে হাঁড়ি বসিয়ে দেন। সারা রাত ওই হাঁড়িতে রস পড়ার পর ভোর রাতে আবার গাছ থেকে হাঁড়ি নামানো হয়। এরপর গাছি পরিবারের মহিলারা মাটির চুলায় ভোর থেকে রস জাল দিয়ে ঘন করেন। রসের ঘনত্ব বেড়ে গেলে একটি মাটির হাঁড়িতে বিশেষ প্রক্রিয়ায় ঘুটে ঘুটে তৈরি করা হয় সাদা রঙের হাজারী গুড়।
ঝিটকা বাজার বখি সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো: জহিরুল ইসলাম সেন্টু জানান, শীত মৌসুমে খেঁজুর গাছ হাজারী গুড়ের বদৌলতে এখানে অর্থনৈতিক চাঙ্গা ভাব বিরাজ করে। রস থেকে গুড় উৎপাদন ও ভোক্তাদের হাতে পৌঁছে দিতে পেশাদার গাছি, কুমার, কামার, জ্বালানি ব্যবসায়ী, পরিবহনের শ্রমিক, ট্রাক মালিক- চালক, ভ্যানচালক, আড়তদারসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ সংযুক্ত হন। পৌষের মাঝামাঝি থেকে মাঘ মাস পর্যন্ত প্রায় প্রতিদিনই এই হাজারী গুড় দেশ-বিদেশে চলে যায়।

গালা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান শফিক বিশ্বাস জানান, বাংলাদেশের মধ্যে একমাত্র মানিকগঞ্জেই তৈরি হয় হাজারী গুড়। হরিরামপুরের ঝিটকা এলাকা খেঁজুর গুড় শিল্পের প্রধান কেন্দ্র। গুণেমানে, স্বাদে-গন্ধে অতুলনীয় এই গুড়ের সুনাম দেশ ছাড়িয়ে পৌঁছে গেছে বিশ্বের অন্তত ২০টি রাষ্ট্রে।
নানা প্রতিকূলতায় হাজারী গুড় প্রায় বিলীন হতে চলেছে। প্রতিবছর হাজার হাজার গাছ কেটে ইট ভাটায় লাকড়ি হিসেবে পুড়িয়ে এই গুড়শিল্পকে ধ্বংস করা হচ্ছে। এ ছাড়াও নকল গুড় উৎপাদনকারীদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় প্রশাসনিক ব্যবস্থা না নেয়ায় দিন দিন জৌলুস ও নাম-ডাক নষ্ট হচ্ছে হাজারী গুড়ের। সরকারিভাবে উদ্যোগ নিয়ে এই শিল্পকে রক্ষা করা জরুরি বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

 


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us