মোসাদের গুপ্তচর বৃত্তি : সুদানি স্টাইল

নিজস্ব প্রতিবেদক | Apr 28, 2020 04:59 pm
মোসাদের গুপ্তচর বৃত্তি

মোসাদের গুপ্তচর বৃত্তি - সংগৃহীত

 

সুদানের মরুভূমিতে লোহিত সাগরের তীরের একটি ছোট্ট পর্যটন গ্রাম অ্যারোস। সেখানে ডাইভিং আর মরুভূমিতে আনন্দ করার নানা উপকরণ ছিল। কিন্তু বেশিরভাগ মানুষের জানা নেই, এই রিসোর্টটি আসলে ইসরায়েলি গুপ্তচরদের একটি গ্রাম।

রিসোর্টের বিজ্ঞাপনে সাগরের তীরে চমৎকার সাজানো সৈকতের পাশাপাশি যুগলের স্কুবা করার বা মাছ ধরার ছবি। লেখা রয়েছে, এখান থেকে স্বর্গের দেখা মেলে।

ইউরোপের বিভিন্ন ট্রাভেল এজেন্টের মাধ্যমে এখানে বুকিং দেয়া যায়। একই সঙ্গে এক হাজার অতিথি এখানে বাস করতে পারেন।

সুদান সরকারের কাছ থেকে ইউরোপীয় ব্যবসায়ীর একটি দল এই জায়গাটি লিজ নিয়ে রিসোর্টটি গড়ে তোলে। যেখানে প্রায়ই বিদেশি অতিথিরা বেড়াতেও আসেন।

কিন্তু পুরো ব্যাপারটাই আসলে সাজানো। এটি আসলে ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের একটি ফ্রন্ট বেজ।

আশির দশকের প্রথমদিকে মোসাদের এজেন্টরা এই রিসোর্টটি গড়ে তোলে। এটি ছিল তাদের একটি মানবিক মিশনের অংশ। সুদানের শরণার্থী শিবির গুলোয় যে হাজার হাজার ইথিওপিয়ান ইহুদি আটকে পড়ে ছিল, তাদের উদ্ধার করে ইসরায়েলে নিয়ে যাওয়াই ছিল তাদের উদ্দেশ্য।

সে সময় এই রিসোর্টে কাজ করা একজন এজেন্ট গ্যাড শিমরন বলছেন, ''এটি ছিল একটি রাষ্ট্রীয় গোপন ব্যাপার, কেউ এ নিয়ে কথা বলতো না। এমনকি আমার পরিবারও এ বিষয়ে কিছু জানতো না।''

ইথিওপিয়ার ইহুদিরা বেটা ইসরায়েল গোত্রের সদস্য, যাদের সত্যিকারের অতীত ইতিহাস এখনো অজানা।

অনেকে মনে করেন, তারা প্রাচীন ইসরায়েলের তথাকথিত হারিয়ে যাওয়া ১০টি গোত্রের একটি। অথবা কুইন অব শেবা এবং কিং সলোমনের একজন পুত্রের বংশধর, যিনি ইথিওপিয়ায় ফিরে গিয়েছিলেন। অনেকে মনে করেন, তারা ৫৮৬ খৃষ্টপূর্বাব্দে তখনকার জেরুসালেম এলাকা থেকে ইথিওপিয়ায় পালিয়ে গিয়েছিলেন।

একসময় তারা সারা বিশ্বের ইহুদিদের থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলেন এবং তারা মনে করতেন, তারাই বিশ্বের একমাত্র জীবিত ইহুদি।

১৯৭৭ সালে ইথিওপিয়ার গৃহযুদ্ধ থেকে বাঁচতে অন্য অনেক অ-ইহুদির সঙ্গে তাদের একজন সদস্য, ফ্রেরেডে আকলুম সীমান্ত অতিক্রম করে সুদানে আসেন এবং শরণার্থী সংস্থাগুলোর কাছে সহায়তা চেয়ে চিঠি লেখেন। এর একটি চিঠি মোসাদের হাতে পড়ে।

তখনকার ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী মেনাচেম বেগিন মোসাদকে আদেশ দেন এই ইহুদিদের বের করে ইসরায়েলে নিয়ে আসার। কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন, ইসরায়েল হলো সব ইহুদির আশ্রয়কেন্দ্র।

ফ্রেরেডে আকলুমের মাধ্যমে ইথিওপিয়ার ইহুদিদের কাছে বার্তা পাঠানো হয় যে, জেরুজালেমে যাওয়ার একটি ভালো উপায় রয়েছে। ফলে তাদের ২৭০০ বছরের পুরনো স্বপ্ন পূরণের সুযোগ তৈরি হলো।

এরপর প্রায় ১৪ হাজার বেটা ইসরায়েলি পায়ে হেটে ৮০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে সুদানে আসেন। এই পথে আসতে গিয়ে অন্তত ১৫০০ মানুষ মারা যায়।

মুসলিম প্রধান সুদানে সঙ্গে ইসরায়েলের সম্পর্ক ভালো নয়। যেহেতু দেশটিতে ইহুদিদের বসবাস নেই, তাই তাদের বলা হয়, যেন তারা সুদানি কর্তৃপক্ষের কাছে নিজেদের ধর্ম পরিচয় প্রকাশ না করেন।

উদ্ধার অভিযান

এই ইথিওপিয়ান ইহুদিদের ইসরায়েলে নিয়ে আসতে হলে লোহিত সাগর পাড়ি দিতে হবে। এজন্য ইসরায়েলি নেভির সহায়তা চান মোসাদ এজেন্টরা। তারা সহায়তা করতে রাজি হন।

এরপর মোসাদের কয়েকজন এজেন্ট লোহিত সাগরের তীরে গিয়ে একটি সুবিধামত জায়গা খুঁজে বের করেন।

ইটালিয়ান ব্যবসায়ীরা ১৯৭২ সালে সেখানে ১৫টি বাংলো তৈরি করেন। একটি রান্নাঘর ও বড় খাবারের ঘর তৈরি হয়। কিন্তু পানি আর বিদ্যুতের অভাবে রিসোর্টটি চালু হয়নি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন এজেন্ট বলে, ''এটা খুবই দুর্গম একটি জায়গা। মোসাদ পেছনে না থাকলে সেটি চালানোও সম্ভব হতো না।''

ভুয়া পাসপোর্টে সুইস অপারেটিং কোম্পানির ছদ্ম পরিচয়ে একদল মোসাদ এজেন্ট সুদান সরকারের কাছে গিয়ে এই গ্রামটি লিজ নেয়ার প্রস্তাব করেন এবং তিন বছরের জন্য প্রায় সোয়া তিন লাখ ডলারের বিনিময়ে ভাড়া নেন।

প্রথম বছর জুড়ে তারা পুরো গ্রামটি নতুন করে তৈরি করে। তবে বিশুদ্ধ পানি আর জ্বালানি সরবরাহ নিয়ে স্থানীয় একজন ব্যবসায়ীর সঙ্গে তাদের একটি সমস্যাও হয়।

সেখানে স্থানীয় ১৫জনকে চালক, পাচক, ওয়েটার ইত্যাদি পদে চাকরি দেয়া হয়, যাদের বেতন নির্ধারিত করা হয়েছিল দ্বিগুণ। কিন্তু এই কর্মীরাও জানতো না রিসোর্টের আসল পরিচয় বা তাদের ম্যানেজার একজন মোসাদ এজেন্ট।

দিনের কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য কয়েকজন নারী এজেন্ট নিয়োগ করা হয়েছিল, যাতে কারো সন্দেহ তৈরি না হয়।

''রাতের বেলায় এজেন্টরা গিয়ে ইথিওপিয়ান ইহুদিদের ছোট ছোট দলকে এই রিসোর্টে নিয়ে আসতো। তাদের এজন্য আগে কোন তথ্যই জানানো হতো না। তারাও জানতো না আমরা ইসরায়েলি এজেন্ট। তাদের বলতাম, আমরা ভাড়াটে সৈনিক।'' বলছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন মোসাদ এজেন্ট।

ট্রাকে করে তাদের এই রিসোর্টের উত্তর প্রান্তে নিয়ে আসার পর ইসরায়েলি নৌবাহিনী, বিমান বাহিনী আর সিল সদস্যরা ছোট নৌকায় করে দেড় ঘণ্টা দূরের জাহাজে নিয়ে যেতো। সেখান থেকে লোহিত সাগরের মাঝ দিয়ে তাদের ইসরায়েলে পৌঁছে দেয়া হতো।

১৯৮২ সালের মার্চে তাদের তৃতীয় অভিযানটি ধরে ফেলে সুদানের সেনা সদস্যরা। তাদের সঙ্গে গোলাগুলিও হয়। কিন্তু কেউ হতাহত হয়নি। তারপর থেকে সাগর পাড়ি দেয়ার পরিকল্পনাটি স্থগিত করা হয়।

তার বদলে মরুভূমির মাঝে একটি সুবিধাজনক বিমান অবতরণ ক্ষেত্র খুঁজে বের করে এজেন্টরা। সেখান থেকে হারকিউলিস বিমানে করে শরণার্থীদের ইসরায়েলে নিয়ে আসা হতো।

কিন্তু এরপরেও ওই রিসোর্টটি পরিচালনা অব্যাহত রাখে মোসাদ এজেন্টরা।

সেখানে বেড়াতে গেছে মিশরের সেনাবাহিনী, ব্রিটিশ এসএএস সৈন্যরা, সুদানি আর ব্রিটিশ কূটনীতিকরা-কিন্তু তাদের কেউ জানতো না এর পরিচালকদের আসল পরিচয়।

এরপর কিছুদিন যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ আর বড় অংকের অর্থ লেনদেনের বিনিময়ে সুদানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল জাফর নিমেইরি সরাসরি খার্তুম থেকেই ইহুদিদের ইউরোপে যাবার অনুমতি দেন। তারা ব্রাসেলস হয়ে ইসরায়েলে পৌঁছাতো। কিন্তু আরব বিশ্বের কেউ এ কথা জানতো না।

তবে সুদান থেকে শরণার্থীদের বিমানে করে বের করে আনার এই খবরটি ১৯৮৫ সালের ৫ই জানুয়ারি বিশ্বের সংবাদপত্রগুলোয় প্রকাশিত হয়। এরপর সুদানিজ সরকার এই অভিযান বন্ধ করে দেয়।

কিন্তু রিসোর্টটি পরিচালনা অব্যাহত রাখে মোসাদ। যদিও তখন আর তাদের এর পেছনে কোন খরচ করতে হতো না, কারণ পর্যটকদের কাছ থেকেই পর্যাপ্ত মুনাফা আসতো।

কিন্তু ১৯৮৫ সালের ৫ এপ্রিল সুদানে সামরিক অভ্যুত্থানের পর রিসোর্ট থেকে মোসাদ এজেন্টদের চলে আসার নির্দেশ দেন সংস্থাটির প্রধান। কারণ নতুন সামরিক সরকার এই রিসোর্ট আর মোসাদ এজেন্টদের নিয়ে সন্দেহ করতে শুরু করেছিল।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক এজেন্ট বলছেন. ''এক রাতেই আমাদের ছয়জন সদস্য সেখান থেকে চলে আসি। তখনো রিসোর্টে অনেক পর্যটক ছিলেন। কিন্তু তারা সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখেন, স্থানীয় কর্মীরা রয়েছে, কিন্তু ডাইভিং ইন্সট্রাকটর, নারী ম্যানেজার আর সবাই লাপাত্তা হয়ে গেছে।"

এরপর থেকেই রিসোর্টটি বন্ধ হয়ে যায়।


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us