বিশ্বকে যেভাবে গ্রাস করেছিল ইউরোপ

মুসা আল হাফিজ | Sep 25, 2020 05:54 pm
বিশ্বকে যেভাবে গ্রাস করেছিল ইউরোপ

বিশ্বকে যেভাবে গ্রাস করেছিল ইউরোপ - ছবি : সংগৃহীত

 

বাকি বিশ্বের ওপর ইউরোপ বরাবরই প্রভুত্বকামী। ইউরোপের এই মানসিকতার নমুনা প্রাচীন অতীত থেকে আজকের বাস্তবতায় জ্বলন্ত। তাদের আর্টিলারি থেকে নাট্যমঞ্চ এবং বোমা থেকে গীতিকাব্য অবধি সবকিছুতেই রয়ে গেছে এই মানসিকতার ছাপ। আধুনিক পশ্চিমা ঔপনিবেশিকতার মধ্যে সেটা অনেক বেশি খোলাসা হয়েছে। ইউরোপীয় আধুনিক জাগরণের সূচনাবিন্দুতে বাকি বিশ্বের প্রতি তার মনোভাব কেমন ছিল, সেটা দেখার জন্য টরডিসিলাস চুক্তির সিদ্ধান্তের দিকে তাকাতে পারি। বিশ্বের ওপর স্পেন ও পর্তুগালের অধিকার প্রশ্নে পোপ ষষ্ঠ আলেকজান্ডার (১৪৩১-১৫০৩) এ সিদ্ধান্ত প্রদান করেন ১৪৯৪ সালের ৭ জুন। তিনি ইউরোপের বাইরের গোটা দুনিয়াকে বণ্টন করে দেন স্পেন ও পর্তুগালের মধ্যে। ইউরোপবহির্ভূত দুনিয়াকে তিনি দুই ভাগ করেন। পশ্চিম ভাগ দেন স্পেনকে, পূর্বভাগ পর্তুগালকে। উত্তর ও দণি আমেরিকা মহাদেশ দখল করে শাসন করবে স্পেন। পর্তুগাল দখল ও শাসন করবে আফ্রিকা, ভারতবর্ষ, ইন্দোনেশিয়ার মালাক্কা দ্বীপসমূহ। সেখানকার জীবন, সম্পদ, মানুষ ও প্রকৃতি, সভ্যতা-ঐতিহ্য, শিক্ষা-সংস্কৃতি সবকিছুতে তারা কর্তৃত্ব কায়েম করতে পারবে।


দেশ দখল ও শাসন, দাস বানানো বা শাস্তিদান, আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ, সম্পদ আত্মসাৎ কিংবা ব্যবহার সবকিছুতেই তাদের অধিকার। তারা সেখানকার অসভ্যদের সভ্য বানাবে, তথা অখ্রিষ্টানদেরকে খ্রিষ্টান বানাবে। বিনিময়ে নেটিভদের জীবন ও জগতে প্রতিষ্ঠা পাবে তাদের অধিকার।

সেকালে গড়পড়তা একজন পাদ্রী ও ইউরোপীয় দুনিয়াকে কিভাবে নিজের শিকার ক্ষেত্র মনে করতেন, তারই নমুনা ওই সিদ্ধান্ত। সিদ্ধান্তটি যিনি দেন, তিনি পশ্চিমা মানসিকতার এক অনস্বীকার্য প্রতিনিধি। ১৪৩১ সালের ১ জানুয়ারি স্পেনের কিংডম অব ভ্যালেন্সিয়ায় (এরাগন রাজ্যের হাতিভাতে) তার জন্ম হয়। বালক বয়সে তার ডাকনাম ছিল রডরিগো বুর্জিয়া। স্পেনের মুসলিম সভ্যতার উচ্ছেদে কিংডম অব ভ্যালেন্সিয়া লড়াই করছিল যুগ যুগ ধরে। বালক রডরিগো শুনেছেন সেই লড়াইয়ের কাড়া-নাকাড়ার আওয়াজ। তার দাদা রডরিগো গিল ডে বুর্জিয়া (জন্ম ও মৃত্যুসন অজ্ঞাত) ছিলেন ক্রুসেডের প্রচারক। চাচা লুইস জোয়ান অব মিলা (১৪৩২-১৫১০) ছিলেন ক্যাথলিক চার্চের কার্ডিনাল এবং পিতা জফ্রি লিয়াঙ্কল ই ইস্ক্রিভা (১৩৯০-১৪৩৭) ছিলেন ভেলেন্সিয়ার প্রভাবশালী নেতা। তার মা ইসাবেলা ডে বুর্জিয়া ই কাভানিলেস (মৃত্যু-১৯ অক্টোবর, ১৪৬৪) ছিলেন বিখ্যাত বুর্জিয়া পরিবারের কন্যা। যে পরিবার শত শত যোদ্ধা, পাদ্রী, রাজনৈতিক নেতা ও শিক উপহার দিয়েছে খ্রিষ্ট বিশ্বকে। ফলত অবধারিতভাবে তিনি ছিলেন রাজনীতি সচেতন। নানা জুয়ান ডোমিঙ্গো ডে বুর্জিয়া ছিলেন। ১ বুর্জিয়া ওরফে ক্যালিকস্টাস-৩ (১৩৭৮-১৪৫৮) ছিলেন ক্যাথলিক পোপ। বিশপ অব রোম।


ইউরোপের রাজনীতি তখন মুসলিম ভীতির জ্বরাক্রান্ত। কয়েক শতকের ধারাবাহিক ক্রুসেড পরাজয়ে পরিণত হয়েছে। ওসমানী সালতানাতের বিজয় অভিযানে জার্মানি, ইতালি ও বলকান অঞ্চল কম্পমান। ১৪৫৩ সালে সুলতান মুহাম্মদ আল ফাতেহ (১৪৩২-১৪৮১) এর কনস্টান্টিনোপল জয় ছিল প্রবল এক আঘাত। এরপর ১৪৫৯ সালে সার্বিয়া দখল করে নেয় ওসমানীরা। ১৪৭০ সালে আলবেনিয়া চলে যায় তুর্কি অধিকারে। ১৪৮০ সালে ওসমানী বিজয় অভিযান প্রবেশ করে ইতালিতে। অধিকার করে নেয় অন্যতম শহর ওটরান্টো। ১৪৮১ সালে মুহাম্মদ ফাতেহ এর ইন্তেকালের পর মুসলিমরা ইতালি ত্যাগ করলেও ইউরোপীয়রা প্রবলভাবে ছিল আতঙ্কিত। কখন আবার এগিয়ে আসে তুর্কি বাহিনী! আত্মরক্ষার কোনো পথই খুঁজে পাচ্ছিল না রাষ্ট্রগুলো। ইতালির পোপ দ্বিতীয় পিয়াস (১৪০৫-১৪৬৪) হতাশা প্রকাশ করে বলেছিলেন, আমি তো কোথাও আর আশার কোনো আলোই দেখতে পাচ্ছি না! তখন ক্যাস্টাইল-ভ্যালেন্সিয়ায় ইউরোপের আশার আলো প্রজ্ব¡লনের কাজ চলছে। ইতিহাস নিচ্ছে নতুন মোড়। আলেকজান্ডারের দাদা ও নানার পরিবার ছিল এর কেন্দ্রে।

‘মুসলিম শত্রু’ কথাটা শুনতে শুনতে পেরিয়েছে তার শৈশব, কৈশোর। জন্মদাগের মতো তার মনে গেঁথে যায় মুসলিমবিদ্বেষ। জাতীয় শত্রু হিসেবে মুসলিমবৈরী মানসিকতার ওপর দাঁড়ায় তার খ্রিষ্টীয় চেতনা। যৌবনে যখন তিনি বোলোগানা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গেলেন, সেখানে জ্ঞানের প্রায় প্রতিটি অধ্যায়ে মুসলিম প-িতদের বই ছিল পাঠ্য। আবার সেখানে ছিল মুসলিম শত্রুদের বিরুদ্ধে জ্ঞানগত লড়াইয়ের উদ্যম। তাদের জ্ঞান দিয়ে তাদের হারিয়ে দেয়ার প্রত্যয়। রডরিগো এ প্রত্যয়ে নিজের শৈশব-কৈশোরের পরিচিত চেতনার প্রতিধ্বনি শুনতে পেলেন। আইনবিদ্যায় ডক্টর অব ল উপাধি নিয়ে তিনি সেখানে পাঠ সম্পন্ন করলেন। কিন্তু এর সাথে সাথে পড়া চালিয়ে গেলেন বিশেষত ইসলাম ও ইসলামী দুনিয়া নিয়ে। মুসলিম ইতিহাসের বিজয় ও আধিপত্য তাকে বিস্মিত করত। রডরিগো বিশ্বাস করতেন, দুনিয়াজুড়ে দখলদারি কেবলই খ্রিষ্টানদের অধিকার। অন্যরা অন্যায়ভাবে সেটা ভোগ করছে। এ বিশ্বাস অবশ্য তিনি লাভ করেছিলেন উত্তরাধিকার সূত্রে। তার মামা বিশপ আলফন্সো ডে বুর্জিয়ার সহায়তায় ১৪৫৬ সালে তিনি হন ভ্যালেন্সিয়ার কার্ডিনাল।


ভ্যালেন্সিয়া তখন মুসলিম ম্যুরদের বিরুদ্ধে লড়ে চলেছে নিরন্তর। চারদিক থেকে আন্দালুসিয়ার পরিসর সীমিত করে এনেছে। আরাগনের রাজা ফার্নান্দো দ্বিতীয় (১৪৫২-১৫১৬) এবং ক্যাস্টাইলের রাণী ইসাবেলা প্রথম (১৪৫১-১৫০৪) বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হন ১৪৬৯ সালে। দুই রাজ্য এক হয় মূলত মুসলিম উচ্ছেদের জন্য। মুসলিমদের চূড়ান্ত পতন সময়ের ব্যাপার হয়ে উঠল। এতে রাজনৈতিক নেতৃত্বের পাশাপাশি ধর্মীয় নেতৃত্বের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সে ভূমিকা সর্বাত্মকভাবে পালন করছিলেন আলেকজান্ডার। রাজা ও রাণীর সহযোগিতায় তার উদ্যম ও প্রচেষ্টা ছিল প্রভাববিস্তারী। তাদেরই হাতে ১৪৯২ সালের ২ জানুয়ারি স্পেনে চূড়ান্ত অবসান ঘটে ৭৮১ বছরের মুসলিম শাসনের।


এরপর আলেকজান্ডারের পরিসর হয় আরো প্রসারিত। ১৪৯২ সালের ১১ আগস্ট তিনি নির্বাচিত হলেন খ্রিস্টান দুনিয়ার পোপ। ১৯৯৪ সালে আলেকজান্ডার আনুষ্ঠানিকভাবে ক্যাথলিক কিং এবং কুইন উপাধি প্রদান করেন বিজয়ী রাজা-রাণীকে।
স্পেন তখন নৌ-আধিপত্যে প্রতিযোগিতা করছিল পর্তুগালের সাথে। পোপ চাইলেন উভয়ের দ্বন্দ্বের বদলে ঐক্য। দ্বন্দ্ব এড়ানোর জন্য দুনিয়াকে করে দিলেন ভাগ-বাটোয়ারা। খ্রিষ্টীয় দুনিয়ার ঐক্যের অভিপ্রায় তিনি ছড়াচ্ছিলেন নানাভাবে। এরই প্রভাব পড়েছিল নানা ক্ষেত্র।

১৫০৯ সালে ফার্দিনান্দ ও ইসাবেলার কন্যা কাতেরিনার (১৪৮৫-১৫৩৬) বিয়ে হয় ইংল্যান্ডের রাজা অষ্টম হেনরির (১৪৯১-১৫৪৭) সাথে। ১৫১২ সালে রাজা ফার্ডিনান্ড নাভার রাজ্য দখল করেন এবং এর মাধ্যমে বিভক্ত স্পেনের একত্রীকরণ সম্পূর্ণ করেন। দুনিয়াজুড়ে দখলদারি বিস্তারে স্পেন এগিয়ে চলল দ্রুতই। অচিরেই গোটা ইউরোপ মেনে নেয় তার শ্রেষ্ঠত্ব। রাজা প্রথম কার্লোস (মেয়াদকাল ১৫১৬-১৫৫৬) ১৫১৯ সালে লাভ করবেন পবিত্র রোমান সম্রাটের উপাধি। এর ফলে জার্মানি, অস্ট্রিয়া, হল্যান্ড, ফ্রান্সের বিশাল অংশ এবং ইতালির একাংশ নিয়ন্ত্রণের মতা আসে তার হাতে। আমেরিকায় স্পেনের উপনিবেশ যখন প্রবল প্রতাপে প্রতিষ্ঠিত, তখন ১৫২১ সালের ১৭ মার্চ ফার্নান্দো ম্যাগেলান (১৪৮০-১৫২১) উপনীত হন ফিলিপাইনে। দাবি করেন স্পেনের মালিকানা, নিহত হন স্থানীয়দের আক্রমণে। আবিষ্কৃত হয় এশিয়ায় স্পেনিশদের নতুন নৌ-পথ। ১৫১৯-১৫২১ সালে হারনান্দো কারতেজ (১৪৮৫-১৫৪৭) আক্রমণ করেন আজটেকদের মেক্সিকো। কায়েম করেন স্পেনিশ দখলদারি। ১৫৩৩ সালে ফ্রান্সিসকো পিজারো (১৪৭৮-১৫৪১) ইনকাদের আক্রমণ করে দাস বানান। দখল করেন পেরু। ষোড়শ শতকের মধ্যভাগে মধ্য ও দণি আমেরিকা মহাদেশের কর্তৃত্ব চলে আসে স্পেনের হাতে। বলিভিয়া, মেক্সিকো ইত্যাদি দখল করে স্পেনিশরা বুঝতে পারে, তাদের পায়ের নিচে রুপার খনি। ১৫৬৫ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি মেক্সিকো থেকে মিগুয়েল ল্যাপেজ ডি লেগাজপির (১৫০২-১৫৭২) অভিযানে ফিলিপাইনে প্রতিষ্ঠিত হয় স্পেনিশ উপনিবেশ।

পর্তুগাল তার নির্ধারিত এলাকা অতিক্রম করে ল্যাতিন আমেরিকায়ও দখলদারি বিস্তার করে। ১৫০০ সালের ৯ মার্চ পেড্রো কাবরল (মৃত্যু-১৫২০) ১৩টি জাহাজ নিয়ে পৌঁছে যান ব্রাজিলে। কায়েম করেন উপনিবেশ। ১৮২২ সাল অবধি ব্রাজিল ছিল পর্তুগীজ দখলে। ভারতে পর্তুগীজরা পৌঁছে ১৪৯৮ সালের মে মাসে। গোয়ায় প্রতিষ্ঠা করে মিশনারি আস্তানা। অচিরেই তারা নিজেদের কুঠি গড়ে নেয় সিংহল, সুমাত্রা, জাভা ও মশলার দ্বীপে। ১৪১৭ সালে তারা উপনীত হয় চীনের ক্যান্টন বন্দরে। ১৪৪২-এ অভিযান চালায় জাপানে। আফ্রিকার অ্যাঙ্গোলা ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত পর্তুগালের উপনিবেশ ছিল এবং দেশটি পর্তুগীজ পশ্চিম আফ্রিকা নামেও পরিচিত ছিল। মোজাম্বিকে ৪০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে চলে পর্তুগীজ শাসন। দেশটি স্বাধীনতা অর্জন করে ১৯৭৫ সালে। দুনিয়াজুড়ে স্পেন-পর্তুগালের এই দখলদারির মূলে ছিল বাণিজ্যিক-রাজনৈতিক নানা কারণ। কিন্তু প্রধান কারণ ছিল ধর্মীয়। তাদের কাছে দখলদারি ছিল পবিত্র। এ ক্ষেত্রে যা যা করণীয়, সেগুলোও ছিল পবিত্র। কারণ তাদের অভিযানসমূহ মূলত অপবিত্র জাতিদের খ্রিষ্টীয় বিশ্বাস দ্বারা পবিত্র করার জন্য। অসভ্যদের সভ্য বানানোর জন্য। এ ছিল এক মহান ক্রুসেড।


এ কাজে তারা কত বেশি হিংস্র ও ধ্বংসাত্মক ছিলো তার নজির আমরা দেখতে পাই তাদের উপনিবেশ কায়েমের পরের পরিস্থিতিতে। ১৪৯২ সালের ১২ অক্টোবর কলম্বাস পৌঁছান বাহামা দ্বীপপুঞ্জে। সেখানে স্থানীয়দের দেখেই তার মনে হয় এদের সহজেই দাস বানানো এবং খ্রিষ্টধর্মে দীতি করা যাবে। ভূমি দেখে মনে হয়, এখান থেকে প্রচুর সোনা নেয়া যাবে। তিনি সে কাজই শুরু করেছিলেন। এরপর ১৪৯৩ এবং ১৪৯৮ সালে আমেরিকা মহাদেশে নৌযাত্রা করেন কলম্বাস। সেখানকার মানুষের জন্য তিনি নিয়ে যান গণহত্যা ও গণমৃত্যু। স্পেনের দরকার প্রচুর সোনা। হিস্পানিওলা দ্বীপের একটি প্রদেশে ১৪ বছরের বেশি বয়সী সব আদিবাসীকে তিন মাস পরপর একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ স্বর্ণ জমা দেয়ার আদেশ দিলেন কলম্বাস। এই নির্দেশ মানতে যারাই ব্যর্থ হত তাদেরই দুই হাত কেটে ফেলা হতো। অতিরিক্ত রক্তরণেই মারা যেত তারা। অনেকে পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা করেছে। তাদেরকে ধরে এনে জীবন্ত পুড়িয়ে হত্যা করা হতো। কেউই বাঁচতে পারত না। হিংস্র কুকুর দিয়ে খুঁজে বের করা হতো প্রত্যেক পলাতককে। হিস্পানিওলা দ্বীপে বসবাসকারীরা ছিল আরাওয়াক গোত্রের। কলম্বাস বাহিনীর নির্মমতা সইতে না পেরে ৫০ হাজার আদিবাসী বিষ খেয়ে গণ-আত্মহত্যা করেছিলেন। মায়েরা তাদের ছোট ছোট বাচ্চাদের বিষ খাইয়ে মেরে ফেলতেন যাতে ইউরোপীয়রা ওই বাচ্চাদের কুকুরের খাবারে পরিণত করতে না পারে। এরপরও যারা বেঁচে ছিলেন তাদের দাসে পরিণত করেন কলম্বাস।


এ কেবল হিস্পানিওলার বাসিন্দাদের নিয়তি ছিল না। আমেরিকার রেড ইন্ডিয়ানদের প্রধান অংশটির ভাগ্যে এমনই ঘটেছে। তাদের হত্যা করা হতো যে কোনো কারণে কিংবা কোনো কারণ ছাড়াই। কলম্বাসের সমকালীন পাদ্রী বার্তোলোমি ডে লা কাসা (১৪৮৪-১৫৬৬) তার History of the Indies গ্রন্থে লিখেন, স্পেনিশরা তরবারি বা চাকুর ধার পরীক্ষা করার জন্য আদিবাসী শিশুদের গলা কেটে ফেলতো। হিসপানিওলা দ্বীপে স্পেনিশ উপনিবেশ কায়েমের সময় লোকসংখ্যা ছিল আড়াই লাখ। সেখানে ১৫৩৮ সালে অবশিষ্ট ছিল মাত্র ৫০০ জন। মেক্সিকোয় স্পেনিশ উপনিবেশের ১০০ বছরে জনসংখ্যা বিশ শতাংশ কমে যায়। তারা নিশ্চিহ্ন হয়েছিল নির্বিচার গণহত্যা এবং স্পেনিশদের বহন করা এবং ছড়িয়ে দেয়া রোগে। দাসব্যবসার রমরমা শুরু হয় তাদের হাতে। অন্যান্য উপনিবেশের কথা বাদ দিলেও স্পেনিশরা কেবল আমেরিকায় অষ্টাদশ শতকে প্রতি বছর গড়ে ৭৫ থেকে ৯০ হাজার দাস ধরে আনত আফ্রিকা থেকে।


এই হতভাগা দাসদের বেশির ভাগই ছিল মুসলমান। মার্কিন কোস্টগার্ড আলেকজান্ডার মারে পামার ওরফে অ্যালেক্স হেলির (১৯২১-১৯৯২) আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘রুট্স : দ্য সাগা অব অ্যান অ্যামেরিকান ফ্যামিলি’ (১৯৭৬) এ বিষয়ে দুনিয়ার নজর খুলে দেয়। বইটিতে রয়েছে আফ্রিকা থেকে মানুষ ধরে আনার কিছু ঘটনার প্রামাণ্য বর্ণনা। দীর্ঘ দিন ধরে গবেষণার পর তিনি জানতে পারেন আমেরিকায় তার প্রথম পূর্বপুরুষের নাম কুন্তা কিন্তে। গাম্বিয়া থেকে কুন্তা কিন্তেকে ধরে নিয়ে আসে ইউরোপীয়রা। স্বজনেরা তাকে খুঁজে পায়নি কখনো। বিভিন্ন পণ্যের সাথে পশুর খাঁচায় ভরে ১৪০ জন শিকার করা মানুষকে জাহাজে করে নিয়ে আসা হয়। রাস্তায় নির্মমতায় মারা যায় ৪২ জন ভাগ্যহত। বেঁচে থাকেন ৯৮ জন। আমেরিকার আ্যনাপোলিসের বাজারে তাদেরকে বিক্রি করা হয়। কুন্তাকে কিনে নেন জনৈক জন ওয়ালার। নামপরিচয়হীন ঝরাপাতার মতো ঝরে গেছে কুন্তা-কিন্তেদের জীবন। আ্যালেক্স হেলির গবেষণা থেকে দুনিয়া জানল, সংখ্যাহীন, সন্ধানহীন এমন কুন্তা কিন্তেরা ছিলেন মুসলমান।

পর্তুগীজদের বর্বরতা ছিল ভয়াবহ। ১৪৯৭ সালে সূচিত ভাস্কো ডা গামার (১৪৬০-১৫২৪) অভিযান ছিল পর্তুগীজদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অভিযাত্রা। এর মাধ্যমে পর্তুগাল নিজের আধিপত্য নিয়ে দাঁড়াতে সম হয়। ভারতগামী যাত্রায় ভাস্কোর বাহিনী প্রথমে উপনীত হয় মোজাম্বিক ও তানজানিয়ায়। বাণিজ্যের নামে গিয়েও কামানের গোলায় উপকূলীয় শহর বিধ্বস্ত করে তারা শহরে প্রবেশ করে। যারা নতিস্বীকার করেনি, হত্যা করা হয় তাদের সবাইকে। স্থানীয় রাজা গণহত্যার তীব্রতা দেখে মেনে নেন তাদের বশ্যতা। পরে ভারতের গোয়ায় এসে ঘাঁটি গাড়েন গামা। “ফিরিঙ্গি বণিক তস্করের ন্যায় ভারতবর্ষের পুণ্যভূমিতে প্রথম পদপে করিলেন। ... বণিক ভিন্ন অন্য কেহ কালিকটে উপনীত হইত না। সুতরাং কালিকটরাজ ফিরিঙ্গি বণিককে বণিক বলিয়াই গ্রহণ করিয়াছিলেন। মুসলমান তাহাতে নিরুদ্বেগ আস্থা স্থাপনে সাহসী হইলেন না। তাহারা ফিরিঙ্গি বণিকের প্রকৃত স্বভাব অবগত ছিলেন। ... ফিরিঙ্গি বণিকও মনে মনে বুঝিলেন মুসলমানকে পরাভূত করিতে না পারিলে ভারত বাণিজ্যে ফিরিঙ্গি বণিকের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা লাভ করিবে না। যেখানে হিংসাদ্বেষ অপরিচিত ছিল, সেখানে হিংসাদ্বেষ অঙ্কুরিত হইয়া উঠিল। যেখানে বাণিজ্যে বাহুবলের সম্পর্ক অপরিজ্ঞাত ছিল, সেখানে বাহুবলই প্রবল হইবার উপক্রম হইল।”


১৫০২ সালে চতুর্থ বহর নিয়ে ভাস্কো সসৈন্যে এলেন কালিকটে। শ্বাসবিশিষ্ট প্রত্যেককেই হত্যার হুমকি দেয়া হয়। উপকূলে পৌঁছেই গর্তুগীজরা শুরু করল গোলা নিপে। বন্দরের মুসলিম বণিকদের সব জাহাজ পুড়িয়ে ফেলা হলো। মালাবারের বিভিন্ন বন্দরে কুঠি বানিয়ে সেখানে কামান ও গোলাবারুদ তারা জড়ো করল। কালিকটের বন্দরে যুদ্ধের সব আয়োজন সেরে ভারতীয়দের যুদ্ধ জাহাজগুলো কখন বন্দর রার চেষ্টা করবে সে অপোয় ছিল গামার বাহিনী। যখন তারা দৃশ্যমান হলো, পর্তুগীজ জাহাজগুলো তাদের ওপর ঝাপিয়ে পড়ল। কালিকট রাজ্যের নৌ-সেনারা নিহত কিংবা বন্দি হলো। ৮০০ বন্দির নাক, কান ও দুই হাত কেটে ফেলা হলো। উপহার হিসেবে তা প্রেরণ করা হলো রাজার কাছে। বেসামরিক নাগরিকদের সাথেও ছিল একই রকম আচরণ। অয় কুমার মৈত্রেয় জানাচ্ছেন, ‘একজন ব্রাণ দূত উপনীত হইবামাত্র গামা তাহার কর্ণদ্বয় ছেদন করিয়া তাহার স্থলে কুকুরের কর্ণ সংযুক্ত করিয়া দিয়া’ তাকে কালিকট রাজার নিকট পাঠালেন। এক মুসলমান বণিক সেখানে ছিলেন। প্রতিবাদ করেন তিনি। ফলে ‘গামার প্রধান পোতাধ্য তাহার পৃষ্ঠে কষাঘাত করিতে করিতে তাহাকে ধরাশায়ী করিয়া তাহার মুখে শুকরের মাংস বাঁধিয়া দিলেন।’


কালিকটের উত্তরে কানানুর ছিল এক সমুদ্রবন্দর। আরব বাণিজ্য জাহাজ সেখানে নোঙর করত। পর্তুগীজরা ব্যবসার নামে সেখানে যায়। ১০ দিন ধরে গোপনে অপেক্ষা করে কোনো জাহাজ আসে কি না? একটি হজযাত্রীদের জাহাজ এলো। তাতে কিছু বাণিজ্যপণ্য ছিল আর ছিল সাত শত হাজী। আরব ব্যবসায়ীদের স্ত্রী-কন্যা ও শিশুদের সংখ্যা ছিল অনেক। পর্তুগীজরা সহসা আক্রমণ করে জাহাজের সব মাল লুঠ করে নিলো। পুরুষদের অনেকেই আত্মরক্ষায় প্রাণ দিলেন। নিরীহ হজযাত্রী এবং নারী-শিশুদের জাহাজের কামরায় আবদ্ধ করে জাহাজে নিক্ষেপ করা হলো আগুনের গোলা। অগ্নিদগ্ধদের বুকফাটা চিৎকার ছিল ভাস্কো বাহিনীর পরম উপাদেয়। তারা এ রোদন শুনে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ছিল। ‘তীর্থযাত্রীবর্গের মধ্যে যেসব রমণী ছিলেন, তাহারা শিশু-সন্তানকে ঊর্ধ্বে উত্তোলিত করিয়া, গামার দিকে কাতর নয়নে চাহিয়া, বালক-বালিকার প্রাণ ভিক্ষা করিতে লাগিলেন। গামা অবিচলিত চিত্তে নারী হত্যায়, শিশু হত্যায় নিবিষ্ট রহিলেন।

১০
বিশিষ্ট মুসলিমদের অনুসন্ধান করছিলেন গামা। কিছু দিনের মধ্যেই একটি বড় দলকে আওতায় আনা হয়। গামা তাদেরকে জাহাজের মাস্তুলে লটকে দেন। তাদের চোখ, মুখ লক্ষ্য করে সৈন্যদের তীর অনুশীলনের আদেশ দেন। সৈন্যদের তীর যখন তাদের দেহ বিদ্ধ করত এবং যন্ত্রণায় তারা চিৎকার করতেন, সেটা ছিল ভাস্কো ডা গামার খুবই আনন্দের বিনোদন। এরপর শহরে ও জনপদে চলতে থাকল গণহত্যা, যার বিবরণ ভাস্কো দা গামার চিঠিপত্রে বিদ্যমান।

গামা তার নৃশংসতা দিয়ে জনমনে ভয় ধরিয়ে দিয়ে একটি চিঠি লিখলেন পর্তুগাল রাজার সমীপে। জানালেন- ‘আমি শহর জ্বালিয়ে দিয়েছি। এর আগে আমার অস্ত্রধারীরা একাধারে চার দিন অবধি শহরে রক্তের নদী বইয়ে দিয়েছে। শহরের শেষ মুসলিমটিকে হত্যা না করে আমাদের তরবারি থামেনি। আমরা মুসলমানদের লাশগুলো মসজিদে ভরে আগুন লাগিয়ে দিয়েছি।’ ভাস্কো দা গামার পদোন্নতি ছিল অবধারিত। তিনি যখন স্বদেশে ফেরেন, রাজা তাকে আরব ও পারস্যের অন্যান্য অঞ্চল দখল করা ও শাসন করার অধিকার প্রদান করেন। পশ্চিমা ইতিহাসে ভাস্কো দা গামা বরিত হয়েছেন অনেক শ্রদ্ধার সাথে। নতুন যুগের স্রষ্টা হিসেবে তাকে করা হয় মহিমান্বিত। যদিও ইউরোপীয় গবেষণায় এটা স্পষ্ট যে, ভাস্কো মনে করতেন, তিনি এক হলি ওয়ার বা পবিত্র যুদ্ধে বেরিয়েছেন এবং তার যাবতীয় প্রয়াসকে মনে করতেন ক্রুসেডের অংশ।

১১
শ্রী অয় কুমার মৈত্রেয়র মতে, এটি পাশ্চাত্য দুনিয়ায় এক গৌরবের ব্যাপার। তিনি পর্তুগীজ নাবিক আলবুকার্ক ও ফ্রান্সিসকো আলমিদার উদাহরণ পেশ করে বিষয়টি খোলাসা করেন। ভাস্কো ডা গামার সমকালে যিনি ভারত অভিযানে যুক্ত হন। মৈত্রেয় লিখেন, ‘তারা উভয়েই ছিলেন সমভাবে মুসলিমবিদ্বেষী। পার্থক্য ছিল দুইয়ের পরিকল্পনায়। আলবুকার্কের পরিকল্পনার কথাই ধরুন।... মিসরের সুলতানকে শিক্ষাদান করিবার জন্য আলবুকার্ক খাল কাটিয়া নীলনদকে লোহিত সাগরে টানিয়া আনিবার সংকল্প করিয়াছিলেন। ইহাতে সমগ্র মিশর দেশ মরুভূমিতে পরিণত হইত। সমগ্র মুসলমান সমাজকে শিক্ষাদান করিবার জন্য মুসলমান ধর্মপ্রবর্ত্তক মুহম্মদের পবিত্র অস্থি সর্ব্বসমে ভস্মসাৎ করিবার সংকল্প করিয়াছিলেন।’

১২
পশ্চিমের চোখে এ জাতীয় ব্যাপারগুলো কেমন ছিল? মৈত্রেয় জানাচ্ছেন, ‘আলবুকার্কের এই মুসলমান বিদ্বেষ সেকালের সকল ফিরিঙ্গির সাধারণ বিদ্বেষরূপে প্রচলিত থাকায়, চরিতাখ্যায়কগণ ইহার উল্লেখ করিতে কিছুমাত্র লজ্জাবোধ করেন নাই। তাহারা বরং ইহাকে দৃঢ়চরিত্র বীরপুরোষোচিত চিত্তবল বলিয়া বর্ণনা করিয়া গিয়াছেন।’

১৩
এই যখন পশ্চিমা মনের চিত্র, তখন কলম্বাস-ভাস্কোর এসব আচরণ এক ধরনের বীরত্ব না হয়ে যায় কোথায়? পশ্চিমা ইতিহাস কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া তাদেরকে মহিমান্বিত করেছে।
এভাবেই ঔপনিবেশিক ইউরোপের উন্নয়ন ও সুদিনের গাড়ির চাকা এগুতে থাকে। পশ্চিমা মন উল্লসিত হয়। যদিও এই চাকার তলে পিষ্ট হয় দুর্বল জাতিসমূহের সুখ, স্বাধীনতা, সংস্কৃতি, নিরাপত্তা, অধিকার কিংবা গোটা জীবন!

গ্রন্থপঞ্জী :
১. চার্লস র‌্যালফ বক্সার : দি পর্তুগীজ সি বোর্ন এমপায়ার ১৪১৫-১৮২৫, ২য় সংস্করণ, ম্যানচেস্টার মার্চেন্ট ইন অ্যাসোসিয়েশন উইথ দি ক্যালোস্ট গুলবেঙ্কিয়ান ফাউন্ডেশন, ১৯৯১।
২. বিশপ আর্নল্ড হেরিস মাথিউ : দি লাইফ অ্যান্ড টাইমস অব রডরিগো বুর্জিয়া, পোপ অলেকজান্ডার-৬ নিউইয়র্ক, ব্রেন্টানো, ১৯১২।
৩. প্রাগুক্ত
৪. এহসানুল করিম : মুসলিম ইতিহাসের ঘটনাপঞ্জী : মো: আফতাব হোসেন ও শহীদুদ্দীন হোসাইন অনূদিত। ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ২০১৫।
৫. নাইজেল কিফ : দ্য লাস্ট ক্রুসেড, দ্য এপিক ভয়েজেস অব ভাস্কো দা গামা, নিউইয়র্ক, হারপার পেরেনিয়াল,২০১২।
৬. পিটার ন্যাবোকভ: ইন্ডিয়ানস, স্লেভস অ্যান্ড মাস মার্ডার : দ্য হিডেন হিস্টোরি। এনওয়াইবুকস ডট কম, ২৪ নভেম্বর, ২০১৬
৭. ওয়ার্ড চার্চিল : কলম্বাসেস লিগ্যাসি অব জেনোসাইড : কমন কারেজ প্রেস, ১৯৯৪, ভলিউম-৯।
৮. শ্রী অয় কুমার মৈত্রেয় : ফিরিঙ্গি বণিক: দ্বিতীয় মুদ্রণ, ১৩৬১, পৃ. ৭৭ এবং ৮২-৮৩।
৯. প্রাগুক্ত
১০. প্রাগুক্ত
১১. নাইজেল কিফ: হোলি ওয়ার : হাউ ভাস্কো দা গামা’স এপিক ভয়েজেস টার্নড দ্য টাইড ইন এ সেঞ্চুরিস ওল্ড ক্যাশ অব সিভিলাইজেশনস। হারপার পেরেনিয়াল, নিউইয়র্ক, ২০১১।
১২. শ্রী অয় কুমার মৈত্রেয় : ফিরিঙ্গি বণিক : দ্বিতীয় মুদ্রণ, ১৩৬১।

লেখক : কবি, গবেষক

 


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us