হারানো কেনান

বুলবুল সরওয়ার | Oct 04, 2020 08:19 pm
হারানো কেনান

হারানো কেনান - ছবি : সংগৃহীত

 

সিনাইয়ের পথ ধরে বাস এগিয়ে গেল ওয়াদি ফিরান পর্যন্ত। গালফ অব সুয়েজের ঢেউ ক্রমে জোরদার হচ্ছে। এগিয়ে আসছে লোহিত সাগরের দর্পিত গর্জন। ‘হে অনন্তের গান’ আমি নিজেকে বললাম, ‘তোমার আশ্চর্য রূপের শেষ নেই। অনিঃশেষ তোমার আকর্ষণ। অনিবার্য তোমার মিলনাকাক্সা। কী তুচ্ছ আমরা তোমার বিশাল ব্যাপ্তির কাছে!’ সমুদ্র দেখলেই আমি এ রকম আবেগপ্রবণ হয়ে উঠি। জানি না, এর রহস্য কী।

সমুদ্রের পাশ কাটিয়ে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি অল-তুরের দিকে। কুরআন মানুষের উত্থান-পতনের অনিবার্যতার কথা বলতে গিয়ে এই পাহাড়ের শপথ করেছে। বিজ্ঞানীরা কলেরার ভয়ঙ্কর জীবাণু আবিষ্কার করেছেন এখানে যার নাম ভিব্রিও এল-টর। শৈশবে শুনেছি, এই পাহাড় থেকে সুর্মা নেয়া হয়। আহা, কোথায় হারিয়ে গেছে নারীদের সেই চোখ! মাশকারা আর শ্যাডোর নিচে প্রকট হয়েছে আঁখি হারিয়ে গেছে প্রেমের জাদু!

শার্মে প্রবেশ করলাম পশ্চিম দিক দিয়ে। ঢোকার মুখেই চোখ জুড়িয়ে গেল নয়নাভিরাম বিচ দেখে। অত্যন্ত ব্যয়বহুল সব ইয়ট পঙ্খীরাজের মতো ভাসছে। বোঝাই যাচ্ছে, এ হচ্ছে ধনীদের জায়গা।

স্টপেজে এসে দাঁড়াল বাস। মরুভূমিকে যত সুন্দর করেই সাজানো হোক তার রুক্ষতা ঢাকা কঠিন। প্যাসেঞ্জার লাউঞ্জ এসি’র বাতাসে শীতল। কিন্তু জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে আছে উট। কী অদ্ভুত এই বৈসাদৃশ্য! কফির কাপে চুমুক দিয়ে ভাবলাম, কোথায় যাই?

তিন ক্যাটাগরির হোটেল শার্মে সুপার ডিলাক্স, ডিলাক্স ও অর্ডিনারি। প্রথম ধাপে রয়েছে ফাইভ স্টার হোটেলগুলো ইবেরোটেল হেলনান, হিলটন, মেরিডিয়ান, শেরাটন, সনেস্টা, সোফিটেল, সানাফির গ্রুপের ২৭টি প্রাসাদ। ডিলাক্স গ্রুপে রয়েছে থ্রি এবং ফোর স্টার হোটেলের ঝাঁক। এদের সংখ্যা ৩৬ থেকে ৪০। বাকি ৩৩টি অর্ডিনারি তাদেরকেও টু-স্টার হোটেলের মান মেনে চলতে হয়। হিসাবের বাইরে রয়েছে অসংখ্য রিসোর্ট ও ক্যাম্প।

শার্মের সৈকতের খ্যাতি বিশ্বব্যাপী। এখানকার বিচে গা-পোড়াবার লোভে প্রতিদিন ৪ হাজারের ওপর পর্যটক আসে যাদের দুই-তৃতীয়াংশ বিদেশী। মিসরীয়দের মধ্যে যারা আসে, তারাও সংস্কারমুক্ত। আর আরব শেখদের ব্যাপার স্যাপারই আলাদা। শহরে ঢোকার মুখেই যে লেখা রয়েছে ‘রিল্যাক্স, আনওয়াইন্ড অ্যান্ড এনজয়’ শেখরা এর কদর্থকেই মোক্ষম জ্ঞান করে।

পিজিয়ন হাউস ‘বেদুইন’ স্টাইলের হোটেল। শামিয়ানা টাঙানো চত্বরে ঢালাও সিসার ব্যবস্থা। দু-চার টান বিনে পয়সাতেই দেয়া যায়। এক পাশে ছোট কুয়া। চার পাশে টেবিল-চেয়ার এমনভাবে পাতা যে, মনে হয় খিমার মধ্যে বসে আছি।
কবুতর এরা আমাদের মতো খায় না। ভেতরে মসলা-মাখানো ভাত ঠেসে রান্না করা হয়। প্রতিটির দাম কুড়ি পাউন্ড। ট্যাক্স আলাদা।

ওয়েটার বিনয়ের সাথে জানতে চাইল, ‘ক’টা আনব?’
আমি জানি, একটার বেশি খেতে পারব না। তবু লজ্জার মাথা খেয়ে বললাম, এতনিন মানে দু’টি।
‘ব্যাস!’ সে বিস্মিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
কিন্তু আমি কথা বাড়ালাম না। মিসরীয়দের খাওয়ার রসম আমি জানি। সারা সপ্তাহ সবজি-ডাল খাবে কিন্তু বৃহস্পতিবার তিনটি মুরগি। ওদের সাথে পাল্লা দিয়ে কারোর মরা ঠিক না।

*****

‘ইউম কিপ্পুর’ মানে ক্ষমা করার দিন। ইহুদি ধর্মীয় ঐতিহ্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিবস। ’৭৩-এর ৬ অক্টোবর রমজানের কারণে মুসলমানদের কাছেও ছিল পবিত্র। বহু দিনের কষ্ট, পরাজয়ের গ্লানি এবং পুঞ্জীভূত ক্ষোভকে মোছার জন্য আনোয়ার সা’দাত ওই দিনটিকেই বেছে নিলেন। শনিবার বেলা ২টা ৫ মিনিটকে ধরা হলো জিরো আওয়ার।

পুরনো মিত্র সিরিয়াকেও সাথে নেয়া হলো। তাদের গোলান হাইটসও ইসরাইলিদের দখলে। ’৬৭-এর ৫ জুন সিনাই ও গোলান মালভূমি কেড়ে নিয়েছে ইসরাইল। পুনর্জারণের নায়ক নাসেরের পদত্যাগেও শেষ রক্ষা হয়নি। ভেঙে গেছে ইয়েমেন-সিরিয়া-ইজিপ্ট প্যাক্ট। বেইমানি করেছে তুরস্ক, জর্দান ও লিবিয়া। সেই ধাক্কায় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেলেন নাসের। ভাইস প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সা’দাত নিয়েছেন রাষ্ট্রভার।
ফ্রি অফিসার্স মুভমেন্টের প্রথম দিন থেকেই নাসেরের সহযোগী সাদাত। ’৬৭-এর সিক্স-ডে ওয়ারের ফলাফল মানতে পারেননি তিনি। প্রস্তুতি নিয়েছেন একান্ত গোপনে। তারই প্রকাশ ঘটল ‘অপারেশন বদর’-এ।

৬ ঘণ্টার মধ্যে মিসরীয় বাহিনী সিনাইয়ের পাঁচ মাইল ছিনিয়ে নিলো। ১৭০ কিলোমিটার দীর্ঘ সুয়েজের ওপর ২০টি পন্টুন ব্রিজ বসিয়ে পূর্ব পাড়ে এসে দাঁড়াল ইজিপশিয়ান ট্যাঙ্ক। ২ হাজার আর্টিলারি ও ৮০ হাজার সৈন্য ঘাঁটি গাড়ল মূল সিনাইয়ে। আঁধার ঘনিয়ে আসার আগেই গালফ অব আকাবায় প্রবেশ করল মিসরীয় নৌবাহিনী।

দুই সপ্তাহ ধরে চলল লড়াই। সিরিয়ানদের আক্রমণে বিভ্রান্ত ইসরাইল স্থল বাহিনীকে জড়ো করেছিল পূর্ব সীমান্তে। মিসর এই সুযোগ পুরোপুরি কাজে লাগাল। পশ্চিমা মিত্ররা জাতিসঙ্ঘকে দিয়ে ‘সিজ-ফ্যায়ার’ করালো ২২ অক্টোবর সন্ধ্যা ৬টা ৫০ মিনিটে। সিনাই ছেড়ে দিতে বাধ্য হলো ইসরাইল। ছয় বছর পর, ২৬ মার্চ ১৯৭৯ সালে তাবায় উড়ল মিসরীয় পতাকা ইসরাইলের একমাত্র পরাজয়ের সাক্ষ্য দিতে।

‘কোথায়? কখন?’
‘যদ্দূর শুনেছি, হোটেল সানাফিরের প্রোগ্রামই ভালো। ওদের চার্জও রিজনেবল। একই প্রোগ্রাম তুমি যদি রসেটায় দেখো, দাম পড়বে দ্বিগুণ।’
‘তাই?’
‘হ্যাঁ, তাই। যেমন ধরো, একটা লোকাল বিয়ারের রিটেল প্রাইস ১১ পাউন্ড। শার্মে এর দাম ১৩। কিন্তু রসেটায় তোমাকে বিয়ার কিনতে হবে ২৫ পাউন্ডে।’
‘ভেরি স্ট্রেঞ্জ!’

হাঁটতে হাঁটতে আমরা কোরাল মন্তাজা বিচে চলে এসেছি। কনরাড ইন্টারন্যাশনাল হোটেলের গা-ঘেঁষে চাঁদ চমকাচ্ছে। দূরে দেখা যাচ্ছে গর্ডন, থমাস, জ্যাকসন ও উডহাউস-রিফ। এক আশ্চর্য বিহ্বল করা দৃশ্য। সৌন্দর্যের অপরূপ রূপ এতই ভীতিকর যে, এলিজাবেথ আমাকে আঁকড়ে ধরল।

৬ অক্টোবরের যুদ্ধ আরব বিশ্বের চোখ খুলে দিলো। তারা দেখল, অজেয় ইসরাইলকেও হার মানানো সম্ভব। শুধু চাই যথাযথ পরিকল্পনা, দুঃসাহস ও ত্যাগ। কিন্তু এ কথা তো নিষ্ঠুরভাবে সত্য যে, পুরো আরববিশ্ব এখনো পরিবার বা গোত্রের ঊর্ধ্বে ওঠেনি। মিসরই একমাত্র ব্যতিক্রম যারা আরব হয়েও গোত্রের সীমাবদ্ধতা থেকে অনেকটা মুক্ত। এ কারণেই তারা ধরে রাখতে পেরেছে আজহারের মতো বিশ্ববিদ্যালয় মিথ্যা ফতোয়ার জালে বন্দী না হয়ে। আবার এই আজহার থেকেই বেরিয়েছে সেসব পন্ডিত যারা ইখওয়ানের মতো চরম প্রান্তিক সংগঠনের নেতৃত্ব উপহার দিয়েছে। আবার এই আজহারই জন্ম দিয়েছে চূড়ান্ত আধুনিক সব মানুষের যারা মিসরকে বিজ্ঞানে-শিল্পে-সম্মানে পৃথিবীর শীর্ষে পৌঁছিয়েছে।

যদিও ’৭২-এর নিক্সন-ব্রেজনেভ শীর্ষ বৈঠকে কিন্তু ’৭৩-এর যুদ্ধ জয়ের পর ইঙ্গ-মার্কিন নেতৃত্বের সুর পাল্টে যায়। বৈঠকে মার্কিনিরা দম্ভভরে ঘোষণা দেয় যে, ইসরাইলের বিরুদ্ধে কারো টোকাটিও সহ্য করা হবে না। মার্কিন লবি সাদাতকে কাছে টেনে নেয়। অজ্ঞাত কারণে ১৫ হাজার রুশ বিশেষজ্ঞকে বহিষ্কার করেন সা’দাত। কেউ কেউ বলে, এটি ছিল সা’দাতের যুদ্ধ-কৌশল, যেন ইসরাইলিরা নিশ্চিন্তে ঘুমায়। সৌভাগ্যক্রমে তখন সৌদি তখতে ছিলেন ফয়সাল। চিন্তা ও দৃঢ়তার কারণে যিনি আরব বিশ্বে অনন্য সম্মান লাভ করেন।

’৭৩-এর ১৭ অক্টোবর বাদশাহ ফয়সালের নেতৃত্বে আরব দেশগুলো তেল-বয়কটের সিদ্ধান্ত নেয়। বাদশাহ ঘোষণা করেন, যেসব পশ্চিমা দেশ ইসরাইলকে মদদ দিচ্ছে তারা যদি বিরত না হয়, তাহলে প্রতি মাসে পাঁচ ভাগ তেল রফতানি হ্রাস করা হবে। ফল হলো ভয়াবহ। আমেরিকার রাস্তায় গাড়ি চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ক্ষিপ্ত নিক্সন দুই বিলিয়ন ডলার সাহায্য চাইলেন মার্কিন কংগ্রেসের কাছে ইসরাইল পুনর্গঠনের জন্য। খবর পাওয়া মাত্র বাদশাহ ফয়সাল এক দিনের শতকরা ১০ ভাগ তেল কমিয়ে দিলেন। নিক্সন-কিসিঞ্জার আরো ক্রুদ্ধ হয়ে সৌদিদের সব অর্থকড়ি বাজেয়াপ্ত করার সিদ্ধান্ত নিলেন। অনড় ফয়সাল ১০০ ভাগ তেল রফতানি বন্ধ করে দিলেন!


এই ঘটনাও মিসর-ইসরাইল যুদ্ধকে প্রভাবিত করেছিল। ১৭ দিনের যুদ্ধে ইসরাইল ২ হাজার ৫২৩ জন সৈন্য হারায়; মিসর ৮ হাজার। জনসংখ্যার বিচারে ইসরাইলের ক্ষতি অপূরণীয়। সা’দাত রাতারাতি আরব বিশ্বের হিরোতে পরিণত হন। পরিস্থিতি অনুকূলে আনতে কিসিঞ্জার দূতিয়ালি শুরু করেন সাদাত ও গোল্ডামেয়ারের মধ্যে।

আট বছর বন্ধ থাকার পর ৭৫-এর ৫ জুন সুয়েজ ক্যানেল উন্মুক্ত করা হয়। সা’দাত এ সময় আরো কিছু দুঃসাহসিক পদক্ষেপ নেন, যা তাকে আরবদের কাছে অগ্রহণযোগ্য করে তোলে। ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী মোনাচেম বেগিনের আমন্ত্রণে ’৭৭-এর ১৯ নভেম্বর তিনি জেরুসালেম সফর করেন। প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের উপস্থিতিতে ক্যাম্প-ডেভিডে শান্তিচুক্তি সই করেন ’৭৯-এর ২৬ মার্চ। এতে বলা হয় (১) জেরুসালেম অবিভক্ত থাকবে; (২) অভিবাসন চলবে (৩) স্বায়ত্তশাসন মানে সার্বভৌমত্ব নয় এবং (৪) প্যালেস্টাইন নামে কোনো রাষ্ট্র হবে না। চুক্তির পর দিনই ইসরাইলি নেসেটে সর্বসম্মতভাবে পাস হয় যে, জেরুসালেম হবে ইসরাইলের রাজধানী! কিন্তু তখন আর সা’দাতের ফেরার উপায় ছিল না।

ক্যাম্প-ডেভিড চুক্তি সা’দাতকে পশ্চিমা বিশ্বের নায়কে এবং আরব বিশ্বের ভিলেনে পরিণত করে। আরব লিগ থেকে বহিষ্কৃত হয় মিসর। শেষ পর্যন্ত সা’দাতকে প্রাণ দিতে হয় ব্রাদারহুডের হাতে ১৯৮১ সালে।

‘হোসনি মুবারকের নেতৃত্ব ২০ বছর চলছে। মুবারকের জন্ম আল-মনুফিয়া প্রদেশের অখ্যাত একটি গ্রামে। ১৯৫০ সালে মিলিটারি একাডেমি থেকে স্নাতক হওয়ার পর তিনি এয়ার ফোর্সে যোগ দেন এবং পাইলট হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করেন। বেস কমান্ডার, এয়ারফোর্স একাডেমির ডাইরেক্টর এবং চিফ-অব স্টাফ হওয়ার পর ৭৩-এ এয়ার মার্শাল র‌্যাংক পান তিনি। ’৭৫-এ ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং ’৮১ তে রাষ্ট্রপ্রধান হন মুবারক। ’৮৭, ’৯৩ ও ’৯৯ সালের নির্বাচনে তিনি পুনর্নির্বাচিত হন। বর্তমান আরব বিশ্বে মুবারক এক অপ্রতিদ্বন্দ্বী নেতা...।’

গাইডেড ট্যুরে আমরা যাচ্ছি শার্ম থেকে তাবা। হায়াম বিবলোয়ি আমাদের রাহবার। এমনিতে সুন্দরী হলেও তার কথা বলার ঢঙ একঘেয়ে। এলিজাবেথ বিরক্ত হয়ে বলল, ‘তোমাদের সব জীবিত নেতাই তো অপ্রতিদ্বন্দ্বী। মৃত হলেই কি দুর্বল?’
হায়াম থমকাল, কিন্তু ভাঙল না। এলিজাবেথকে লক্ষ করে বলল, ‘উইলিয়াম ওয়ালেস কি জীবিত বীর ছিল, না মৃত?’

এলিজাবেথের মুখে কথা জোগাল না। হায়ামও চুপ করে গেল। আরবরা সাধারণত খুব বিপ্লবী হয় না। নিরুপায় না হলে ক্ষমতার প্রতি ঘৃণা বা বিদ্বেষ পোষণ করে না তারা। এ জন্যই তাদের রাজা-বাদশাহরা বহুকাল ক্ষমতায় থাকার সুযোগ পান। জনসমক্ষে খুব কম মিসরীয়কেই আমি রাজনীতি নিয়ে কথা বলতে দেখেছি। এ এমন এক সংযম যা বারবার আমাকে বিস্মিত করেছে। এমনকি যে ইসরাইলিদের এরা মনপ্রাণ দিয়ে ঘৃণা করে তাদের সম্পর্কে জানতে চাইলেও এমন বোবার মতো তাকিয়ে থাকে যে, মনে হয় দেয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে আছি।

‘উই আর অ্যাপ্রোচিং টু তাবা দ্য লাস্ট সিটি অব সিনাই।’ হায়াম মাইক্রোফোনে ঘোষণা করল, ‘লুক আহেড। সমুদ্রের ওই পাড়ে যে শহরটা দেখছেন, ওটা ইসরাইল। ডানে দেখুন জর্দানের আকাবা বন্দর। আরো ডানে, ওই যে সোজা দক্ষিণে যে বাড়িঘর দেখা যাচ্ছে, ওটা সৌদি আরবের অংশ আল হুমাইদা পোর্ট। আমরা থামছি মিলিটারি চেকপোস্টে। সবাই পাসপোর্ট বের করুন প্লিজ।
আমাদের পাশ দিয়ে চলছে ক্রসেডারস ক্যাসেল নির্মাণ-কৌশলের অনন্য চেহারা দেখিয়ে। হাজার বছরের বেদনা স্তব্ধ হয়ে আছে ওই ফারাউনিক আইল্যান্ডে। আইলাত বন্দরের ইহুদিরা হয়তো জানেই না সে ইতিহাস। তবু ওখানে ওই রঙ্গমঞ্চেই অভিনীত হচ্ছে আধুনিক পৃথিবীর সবচেয়ে নির্মম প্রহসন ‘মধ্যপ্রাচ্যের শান্তি’ নাটকটি!

*****

মেলা থেকে ফিরে প্রধান পুরোহিত চিৎকার করে উঠলেন। হায় হায় আমার সর্বনাশ হয়েছে বড় দেবতা ছাড়া সব দেবতার মূর্তি চূর্ণবিচূর্ণ!
ভক্তের কান্নায় চার দিক প্রকম্পিত! ক্রুদ্ধ জনতা শেষ পর্যন্ত ধরে ফেলল যুবককে। নাম তার ইব্রাহিম। রাজা নিমরুদ জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি ভেঙেছ এসব?’

ইব্রাহিম শান্ত গলায় বললেন, ‘কেউ না কেউ তো অবশ্যই ভেঙেছে। দেবতাদের রাজা কাঁধে কুড়াল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাকেই জিজ্ঞেস করুন না কেন?’

রাজা হতভম্ব। সবাই জানে মাটির মূর্তি কথা বলে না। তবু প্রশ্নটা উপস্থিত জনতার বিশ্বাসের ভিত্তিতে আঘাত হানল। সেই আলোড়নকে কবর দেয়ার জন্যই চিৎকার করে উঠলেন রাজা, ‘একে জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ডে নিক্ষেপ কর।’

কিন্তু আগুন তাকে পোড়াল না। যদিও তিনি পুড়তে লাগলেন নিজের আগুনে। নীতিহীন সুবিধাভোগী মানুষ সত্য থেকে এত দূরে! স্রষ্টা থেকে এত বিমুখ!! বেদনা ও হতাশায় কান্ত ইব্রাহিম জন্মভূমি মেসোপটেমিয়া থেকে হিজরত করলেন কেনানে।

এর ২ হাজার ৭০০ বছর পর ৬৭টি শব্দের ছোট একটি ঘোষণায় স্বাক্ষর করলেন ব্রিটিশ ফরেন সেক্রেটারি আর্থার জেমস বেলফোর। ছয়জন যুদ্ধ উপদেষ্টা ও ডজনখানেক অধ্যাপকের দীর্ঘ গবেষণার ফসল এই ছোট্ট প্যারাটি। এত সাধারণ নিরীহ কথা যে, কেউ এ নিয়ে মাথাই ঘামাল না। এ রকমই চেয়েছিলেন বেলফোর। তবু সাবধানের মার নেই ভেবে চুক্তিপত্রটি সযত্নে গোপন করলেন ফ্রান্স সরকার এবং মধ্যপ্রাচ্যের উঠতি আরব-নেতা শরিফ হোসেনের কাছ থেকে।

তরুণ বয়সেই বেলফোর ব্রিটিশ পার্লামেন্ট কাঁপাতে সক্ষম হয়েছিলেন। পুরস্কারও দিয়েছিলেন ‘রানী-সমা। ১৯০২ সাল থেকে ১৯০৫ সাল পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী ছিলেন বেলফোর। অবশ্য তখন পর্যন্ত হার ম্যাজেস্টিক ইংল্যান্ডে প্রধানমন্ত্রী পদের মর্যাদা খুব উচ্চ ছিল না। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী কাজী জাফর আহমেদের চেয়ে সামান্য বেশি!

কিন্তু বেলফোর সফল হন ইহুদি লবিংয়ে। জায়নিজমের জনক থিওডোর হার্জলের বন্ধুত্ব তাকে ব্রিটিশ পররাষ্ট্র সচিবের সুউচ্চ সম্মানে নিয়ে যায়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের চরম ক্রান্তিলগ্নে ১৯০০ সালের নভেম্বরে তিনি এর বিনিময় দেন ‘বেলফোর ঘোষণা’ বা ইহুদি-নিবাস গড়ার অনুমোদনের মাধ্যমে।

ওদিকে জার্মান বাহিনী যখন টেমস নদীর কিনারে প্রায়, তখন অধ্যাপক চাইম ওয়েইজম্যান ‘করডাইট’ উপহার দেন ব্রিটিশ রাজকে। বিনিময়ে দাবি করেন একখণ্ড ভূমি। হোক সে লিটানি নদীর পশ্চিম পাশের রু-শুষ্ক বিরান প্রান্তর, আমরা সেখানেই মাথা গুঁজে থাকব। কৃতজ্ঞ ম্যাজেস্টি মঞ্জুর করলেন ওয়াইজম্যানের দাবি। বেলফোরের কূটনীতির কারণে কেউ চিন্তাও করেনি যে, কথাচ্ছলে বলা সেই লিটানি নদীর দক্ষিণ পাশের রু-ঊষর প্রান্তরই আসলে সুজলা-সুফলা প্যালেস্টাইন!

*****

কেনানের মানুষ ইব্রাহিমকে ভালোই আপ্যায়ন করল। কিন্তু ইব্রাহিমের কল্যাণব্রতের মিশন খুব সফল হলো না। তিনি এগিয়ে চললেন আরো দক্ষিণ-পশ্চিমে। সিনাই পাড় হয়ে পৌঁছালেন নীল উপত্যকায়।

ইব্রাহিমের স্ত্রী সারা অসাধারণ রূপবতী। বয়স হলেও তার সৌন্দর্যের ঘাটতি নেই। ইব্রাহিম সারাকে বললেন, তুমি স্ত্রী পরিচয় না দিয়ে আমার বোন পরিচয় দেবে। সারা সম্মত হলেন। কারণ, তারা একই পিতার সন্তান বলে এতে কোনো মিথ্যা নেই, যদিও তাদের মা দু’জন। এবং ভাই-বোনের পরিণয়ও তখনকার সমাজে বৈধ।

মিসরের সম্রাট তখন সেনোসেট-ওয়ান। ফারাও হিসেবে তার ক্ষমতা কিংবদন্তিতুল্য। কিন্তু সে ক্ষমতা অর্থহীন, কারণ সম্রাটের কোনো পুত্র নেই। কন্যা হাগার দ্রুত বড় হচ্ছে। আরো দু’টি কন্যা জন্মেছে অন্যান্য রানীর ঘরে। কিন্তু পুত্র না থাকলে কে ধরবে রাজদন্ড? ফারাওয়ের বুকজুড়ে নেই নেই হাহাকার।

ফারাওয়ের নির্দেশ ছিল বহিরাগত কেউ এলেই সম্রাটকে দর্শন দিতে হবে। সেই দর্শনে সম্রাট যদি কোনো নারীকে পছন্দ করে বসেন, তবেই বিপদ। সেই নারী বিবাহিত হলে প্রাণ দিতে হয় স্বামী বেচারাকে। সেই ভয়েই ইব্রাহিম সারাকে বোন পরিচয় দিতে বলেছেন। ইব্রাহিমের জীবন বাঁচল কিন্তু সারাকে পছন্দ হয়ে গেল সম্রাটের।

গভীর রাতে, যথারীতি সারার কক্ষের দিকে এগোলেন সম্রাট। সারা তাকে অনুরোধ করলেন তার অন্যায় ইচ্ছা থেকে নিবৃত হতে। কিন্তু মিসরের ফারাও কি দুর্বল নারীর উপদেশ কানে তোলে? নিকটবর্তী হওয়ার জন্য পা তুললেন সম্রাট।

স্থির হয়ে গেল তার শরীর। সম্রাট হতভম্ব। তার ক্ষমতা, দক্ষ ও প্রতাপ কাজে লাগছে না। এ কি কোনো জাদু? নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছেন না তিনি।

বাধ্য হয়ে সেনোসেট মিনতি করলেন সারাকে, ‘নিশ্চয়ই তুমি ভাগ্যবতী কোনো নারী। আচারে ও প্রার্থনায় তুমি আমাদের থেকে ভিন্ন। আমার বিশ্বাস, তুমি তোমার ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করলে আমি সুস্থ হয়ে যাবো।’

সারা তাই করলেন। সেনোসেট সুস্থ হলেন। সুস্থ হয়েই তিনি পূর্বমূর্তি ধারণ করে সারার দিকে আরো অগ্রসর হলেন। সারা আবার তাকে নিবৃত হতে অনুরোধ করলেন। কিন্তু সেনোসেট এবার আরো বেপরোয়া। কিন্তু মাত্র এক পা বেশি এগোতে পারলেন না তিনি। তারপর সেই একই কান্ড! পাথর হয়ে গেল তার পা। এবার শুধু একা নন, প্রাসাদের সব পুরুষ ভৃত্যও জমে গেল। সেনোসেট স্তম্ভিত!

ফারাওয়ের অনুরোধে আবারো প্রার্থনা করলেন সারা। ধীরে ধীরে রক্ত মাংসে ফিরে এলো সবাই। সম্রাট এবার ভণিতা না করে লাফ দেয়ার কোশেশ করলেন। ওই বিদেশিনীর অভিশাপের আগেই তাকে কব্জা করবেন তিনি। ওকে তার চাই-ই চাই।

এবার ঘটনা ঘটল আরো দ্রুত। মাটি থেকে পা বিচ্ছিন্ন হওয়ার আগেই পুরো পরিবার সাথে নিয়ে পাথর হলেন রাজা। সারা হেসে উঠে বললেন, ‘সেই খোদার ভয় করুন, যিনি তৈরি করেছেন আকাশ, মাটি এবং এর ভেতরকার সব কিছু। আর বিশ্বাস করুন, আমি কোনো সাধারণ নারী নই। অবিবাহিতও নেই। আমার স্বামী বাবেলের গৌরব ইব্রাহিম। আল্লাহর প্রেরিত পুরুষ তিনি।’

ভীত সম্রাট তার আসঙ্গলিপ্সা পরিত্যাগ করে সারাকে ভেতরে পাঠালেন এবং নিজে উপস্থিত হলেন শহরতলির তাঁবুতে। কে এই অসীম ক্ষমতাবান ইব্রাহিম?

ইব্রাহিম সব ঘটনাই জানতেন। তিনি বললেন, ‘আমি আপনার কষ্ট ও বেদনা জানি। আল্লাহর ইচ্ছায় আপনি পুত্রসন্তানের জনক হবেন, যদি ঈমান আনেন তার একত্বে ও আধিপত্যে যিনি ছাড়া কোনো উপাস্য নেই। যিনি এক ও অদ্বিতীয়।’
সেনোসেট মেনে নিলেন ইব্রাহিমের অনুরোধ। মিসরের বাতাস মুখরিত হলো রাজার পুত্রসন্তান লাভের আনন্দ-সংবাদে। ইব্রাহিম ফিরে চললেন কেনানে। অশ্রুসজল সেনোসেট ইব্রাহিমের হাতে তুলে দিলেন নিজের অষ্টাদশী কন্যা হাগারকে (আরবিতে হাজেরা)।
নবী ইসার জন্ম হতে তখনো ১ হাজার ৯০০ বছর বাকি।

*****

বেশির ভাগ ব্রিটিশ নীতিনির্ধারক তুরস্কের অটোমান সাম্রাজ্যকে দু’টি কারণে সহ্য করতে পারে না। প্রথমত এরা সেই মুসলিম সেনাপতি সালাদিন আইউবীর বংশধর, যাদের পূর্বপুরুষের হাতে পরাজিত হয়েছিল ইংল্যান্ডের কিং রিচার্ড (দ্য লায়ন হার্ট), জার্মানির মহামহিম সম্রাট ফ্রেডরিখ বারবারোজ এবং ফ্রান্সের অমিতবিক্রম রাজা ফিলিপ অগাস্টাসের যৌথ ক্রুসেডার বাহিনী। পবিত্র নগরী জেরুসালেমকে কব্জা করতে পারেনি ইউরোপিয়ান চার্চ। রিচার্ড-দ্য লায়ন হার্টের সাথে ১১৯২-এর নভেম্বরে যে চুক্তি হয়েছিল সুলতান সালাদিনের ব্রিটিশরা তাকে নতজানু নীতি বলেই মনে করে। সুতরাং ওসমানী খিলাফত ভাঙতে চাওয়া ইংল্যান্ডের পুরনো মানসিকতারই অংশ। দ্বিতীয়ত, ভারত ও আফ্রিকার কর্তৃত্বের পথে সুয়েজ খাল। সেই খালের ওপর খবরদারি করে বন্ধু-আরব ও তুর্কিরা! কী করে এ অবস্থা ব্রিটিশরাজ বরদাশত করে?

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগেই ‘পলিটিক্যাল অফিসার’ নামে কিছু গোয়েন্দা পাঠানো হয় মধ্যপ্রাচ্যে। এদের মধ্যে দু’জনের নাম উল্লেখযোগ্য স্যার গিলবার্ট ফ্রেইটন ও টি ই লরেন্স (লরেন্স অব অ্যারাবিয়া) এদের কাজ ছিল আরব গোত্রগুলোকে তুর্কিদের বিরুদ্ধে খেপিয়ে তোলা। হেজাজের শাসক শরিফ হোসেন কূটনীতির এই ফাঁদে পা দিয়ে কায়রোর ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত হেনরি ম্যাকমোহনের সাথে গোপন চুক্তি করলেন (শরিফ-ম্যাকমোহন ট্রিটি)। একই সময়ে আরবকে নিজেদের মধ্যে ভাগ করার সমঝোতা হলো ফ্রান্সের সাথে (সাইকস-পিকট ট্রিটি)। দু’টি চুক্তিরই ‘নারদ’ ছিলেন বেলফোর এবং দু’টিতেই অনুল্লেখিত ছিল প্যালেস্টাইন। মজার ব্যাপার, দু’মুখো দু’টি চুক্তির পার্টনাররা শরিফ হোসেন ও ফ্রান্স সরকার অন্য চুক্তির খবরই জানত না!

শরিফ হোসেনের দুই পুত্র আমির আবদুল্লাহ এবং আমির ফয়সাল এই মীরজাফরির প্রধান সহযোগী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করলেন। ১৯১৪ সালে আমির আবদুল্লাহ কায়রো যান ব্রিটিশ সিক্রেট এজেন্ট ও কনসাল জেনারেল কিচেনারের সাথে ‘হোসেন-রাষ্ট্রের’ সম্ভাব্যতা যাচাই করতে। বলা বাহুল্য কিচেনার সেই সময় তাকে পাত্তা দেননি। কিন্তু বিশ্বযুদ্ধের পর পরিস্থিতি বদলে যায়। তেলনীতির ব্রিটিশ স্বার্থে এবং সুয়েজ পথে ইঙ্গ-ভারতীয় বাণিজ্যে হুমকি আসে। কিচেনার তখন স্বরাষ্ট্র সচিব। তিনি শরিফ হোসেনের প্রস্তাব পুনর্বিবেচনা করতে ব্রিটিশ প্রশাসনকে প্রভাবিত করেন। ঘোষণা করা হয় ব্রিটিশ ম্যান্ডেট। সেই ম্যাপে ইসরাইল ও প্যালেস্টাইনের সাথে ব্রিটিশ বাহিনীরও থাকার সিদ্ধান্ত হয় যারা নিয়ন্ত্রণ করবে বেথেলহেম, নাজারেথ, জেরুসালেম ও ভূমধ্যসাগরের করিডর। ইতোমধ্যে শরিফ হোসেনের বেইমানির পুরস্কার দেয়া হয়েছে পুত্র আমির ফয়সালকে সিরিয়ার এবং আমির আবদুল্লাহকে ট্রান্স জর্দানের শাসনকর্তা নিয়োগ করে। ফলে প্রকাশ হয়ে পড়ে হোসেন-ম্যাকমোহন ট্রিটি। ক্রুদ্ধ ফ্রান্স রাতারাতি সিরিয়া দখল করে আমির ফয়সালকে উৎখাত করে। ব্রিটিশ আবার তাকে পুরস্কৃত করে ইরাকের শাসনভার দিয়ে।

ইহুদিদের সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য প্রবাদটি এ রকম ‘সেই দেশটি তার, যার কোনো দেশ নেই।’ একজন ইহুদি বুদ্ধিজীবীর হাতে ষষ্ঠদশ শতাব্দীতে প্রবাদটির জন্ম এবং পরে ওয়েইজম্যান ও মেয়ার কাহান এটিকে বিশ্বে ছড়িয়ে দেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর বিবিসি প্রবাদটি এমনভাবে প্রচার করে যেন তা পবিত্র তোরার অংশ। ধীরে ধীরে ইউরোপবাসী এই বাক্যের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে ওঠে। মার্চেন্ট অব ভেনিসের লেখক যে দেশের সন্তান, সেই দেশই আয়োজন করে ইহুদি পুনর্বাসনের। ১৯১৯ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর ‘লন্ডন টাইমস’-এর সম্পাদকীয়তে বলা হয়, ‘অবশ্যই আমাদের সীমানা শেষ হবে লেবাননের উত্তর প্রান্তে। হোক সে বাইবেলের পবিত্র-ভূমি, কিংবা না-ই হোক।’

সম্পাদকীয়টি লিখেছিলেন একজন অর্থোডক্স খ্রিষ্টান এবং পরোক্ষে তা সমগ্র ব্রিটিশ মনোভাবকেই প্রকাশ করে। বিশ্বযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে শরিফ হোসেনের সহায়তায় তুর্কিদের তাড়িয়ে জেনারেল অ্যালেনবাই ঘোষণা করলেন, ‘দ্য ক্রুসেড ওয়ারস হ্যাভ ফাইনালি এন্ডেড। গুডবাই সালাদিন!’

খয়বরের পরাজয়ের পর মধ্যপ্রাচ্যের ইহুদিরা মূলত আশ্রয় নেয় পূর্ব ইউরোপ, রাশিয়া, কাশ্মীর এবং পশ্চিম ইউরোপে। ইউরোপের ইহুদিরা ধর্মভিত্তিক ‘কোহিলট’ বা সেমেটিক-সমাজ গড়ে বসবাস করছিল। রুশ জার নিকোলাস-ওয়ান ইহুদিদের ‘কেবল-বাণিজ্যনীতি’র বিরোধিতা করে কোহিলেট ভেঙে দিয়ে ইহুদিদের বাধ্য করেন সামাজিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করতে। ক্ষুব্ধ রাব্বিরা তরুণদের দেশ ছাড়তে পরামর্শ দেন। পোল্যান্ড, রুমানিয়া, চেকোস্লোভাকিয়া, ইটালি ও পশ্চিম ইউরোপে পাড়ি জমায় তারা। বাকিরা সম্রাটের নির্দেশ মেনে ‘মাসকালিম’ বা বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর জন্ম দেন। মাসকালিমরা বৈজ্ঞানিক বিষয়াদিতে প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে।

১৮৫৫ সালে জার দ্বিতীয় আলেক্সান্ডার ক্ষমতায় আসেন। তিনি ইহুদিদের প্রতি সদয় ছিলেন। মাসকালিমরা আবার চিকিৎসা, প্রকৌশল, প্রশাসন এবং রাষ্ট্রনীতিতে জায়গা করে নেয়। ১৮৮১ সালে জার নিহত হলে তৃতীয় আলেক্সান্ডার ক্ষমতায় আসেন। তিনি প্রথম আলেক্সান্ডারের মতোই ইহুদিদের ব্যাপারে বিরূপ ছিলেন। মাসকালিমরা কেউ যোগ দেয় সন্ত্রাসী দলে, কেউ কমিউনিস্ট হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই সমাজতন্ত্রের ভয়ে ২ লাখ ৫০ হাজার ইহুদি রাশিয়া ছাড়ে যাদের মধ্যে ২ লাখ আশ্রয় নেয় যুক্তরাষ্ট্রে।

রাশিয়া, পশ্চিম ইউরোপ ও মার্কিন প্রশাসনের সর্বস্তরে মাসকালিমরা ঢুকে পড়ে যার খোঁজ ওই দেশগুলোও জানে না, কিন্তু ইহুদিরা জানে। যেমন প্যালেস্টাইন নিযুক্ত ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত স্যার হেনরি স্যামুয়েল যিনি ইহুদি অভিবাসনকে প্রকাশ্যে উৎসাহিত করেছিলেন ইহুদি। ওয়াইজম্যান অনেক কৌশল করে তার পদায়ন করান। তেমনি, প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলের স্ত্রী ইহুদি হওয়ায়, ঘনিষ্ঠতম বন্ধু এবং মন্ত্রী লর্ড ময়নিহান খুন হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনিও ছিলেন ইহুদি রাষ্ট্রের অন্ধ সমর্থক অথচ তার ধারণা ছিল যে, তার স্ত্রী উদার মানবতাবাদী রোমান ক্যাথলিক।

*****
লিয়া ও র‌্যাচেল দুই বোন। তাদের বিয়ে হয়েছে ফুফাতো ভাই ইয়াকুবের সাথে। ইয়াকুবের ডাকনাম ইসরাইল। বড় বোন লিয়ার ছয় ছেলে; র‌্যাচেলের দু’টি। বাকি ছ’টি ছেলে জন্মেছে দুই দাসীর ঘরে। বীর-শেবায় ইয়াকুবের জন্ম, কিন্তু তিনি থিতু হয়েছেন লিটানি নদীর দক্ষিণে। সবাই এ-কবিলাকে ডাকে বনি-ইসরাইল।

ইসরাইল হিব্রু শব্দ। ইসরা ও এল থেকে শব্দটির উৎপত্তি। ইসরার অর্থ প্রভুর সেবক, প্রভুর শাসক কিংবা প্রভুর সাক্ষ্যদাতা। এল মানে প্রভু বা আল্লাহ। সুতরাং বনি ইসরাইলিদের সম্মান বেশ উঁচুতে। সেই সম্মান রূপ নিলো আভিজাত্য ও অহঙ্কারে।

ইয়াকুব (বা জ্যাকব) ছেলেদের বলতেন এই অহঙ্কার ত্যাগ করার জন্য। কিন্তু ছেলেরা তার কথায় কমই কান দেয়। ব্যতিক্রম শুধু ছোট বউ র‌্যাচেলের বড় ছেলে ইউসুফ (বা জোসেফ)। বাবাকে তার এত ভালো লাগে যে, বাবাই তার ধ্যান-জ্ঞান। ব্যাপারটা বাকি ভাইদের ঈর্ষাতুর করে তোলে এবং তারা ইউসুফের ওপর নানা অত্যাচার শুরু করে। বাধ্য হয়ে ইয়াকুব ভাইদের কাছ থেকে সরিয়ে নিলেন ইউসুফকে।

মাঝে মাঝে হেবরনে যান ইয়াকুব। সেখানেই দাফন করা হয়েছে তাদের পূর্বপুরুষ ইব্রাহিমকে। মানুষকে ভালো পথ দেখানোর জন্য ফোরাতের তীর থেকে নীল নদ পর্যন্ত ছুটে বেড়িয়েছেন ইব্রাহিম। নিজের পুত্রকে বলি দিতে উদ্যত হয়েছিলেন তিনি। ইয়াকুবের ইচ্ছা, ইসমাঈলের বংশধরদের সাথে আত্মীয়তা করেন। কিন্তু তারা থাকেন অনেক দূরে হেজাজে। ছেলেরাও আগ্রহী নয় মরুচারী আত্মীয়তায়। শুধু ইউসুফের ওপরই একটু ভরসা। কিন্তু সে কই?

কাঁদতে কাঁদতে ফিরে এলো ১১ পুত্র। ইউসুফকে নেকড়ে খেয়ে নিয়েছে। রক্তমাখা কাপড় তাদের হাতে। ইয়াকুব লা-জওয়াব। ছেলেরা অন্য দিকে তাকিয়ে হাসছে। বাপের স্নেহ বেশি পাচ্ছে বলে ছোট্ট ছেলেটির জন্য ফাঁদ পেতেছিল তারা। গভীর কুয়ায় ফেলে দেয়া হয়েছে হতভাগাকে। মৃত্যু ছাড়া গতি নেই!

ও দিকে ঘটনা ঘটেছে অন্য। মিসরীয় এক বণিক পিপাসার্ত হয়ে কুয়ায় বালতি ফেলেছে। সেই বালতি ধরে উঠে এসেছে ইউসুফ। শুধু নজরকাড়া সুন্দর নয় জগতের সব রূপ দিয়ে যেন তৈরি করা হয়েছে বালককে। বণিকের চোখ বিস্ময়-বিমূঢ়। মুগ্ধ দোকানি তাকে নিয়ে গেল নিজের দেশে। ব্যবসার বিরাট ধাক্কা তার মাথায়।

*****
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ঘোর কাটার আগেই নির্ধারিত হয়ে গেল পরাজিত পৃথিবীর বণ্টন। তুর্কি সাম্রাজ্যকে খণ্ড খণ্ড করে কাটা হলো; জার্মানিও রেহাই পেল না। অবস্থা এমন দাঁড়াল, আজ যে দেশ আফ্রিকা বা এশিয়ায়, দেখা যায় পরের দিন সেটি ইউরোপে। ৪০০ বছর যারা পৃথিবীর মধ্যভাগের শাসক, কলমের এক খোঁচায় সেই তুর্কিরা হয়ে গেল দাস। সুদূর ভার্সাইয়ে বসে সারা হলো এই শিল্পকর্ম। আজারবাইজানসহ মধ্য এশিয়ার বিশাল এলাকার রঙ পরিবর্তিত হলো সবুজ থেকে লালে।

মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক এলাকার প্রাচীন নাম কেনান মানে প্যালেস্টাইন। ব্যাবিলন ও মিসরের মতোই গৌরবময় তার ইতিহাস। সদ্যসমাপ্ত প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বহু আগে থেকেই এ এলাকার মানুষ শিক্ষা-সচেতন, অধিকার আদায়ের সংগ্রামে অনড়। ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে তো বটেই, ওসমানী খিলাফত থেকেও তারা স্বাধীন হওয়ার চেষ্টা করছিল।

১৮৭৫ সালে প্রথম আরব-ঐক্যপ্রচেষ্টার উদ্যোগ নেয় তারা, সাত বছর পরে মিসরের ওরাবি-আন্দোলনে শরিক হয়। ১৯১৯ সালে অল-প্যালেস্টাইন কংগ্রেসে দাবি তোলা হয় পূর্ণ স্বাধীনতার। ১৯ -এ গঠিত হয় কমিউনিস্ট পার্টি, ২০-এ আরব কংগ্রেস, ২৫-এ ট্রেড ইউনিয়ন, ২৯-এ নারী আন্দোলন ও স্টুডেন্ট ইউনিয়ন, ৩১-এ জার্নালিস্ট মুভমেন্ট। স্বায়ত্তশাসন প্রমাণের জন্য ৩১-এ বেদুইন-আদালত পর্যন্ত স্থাপিত হয়। তখন থেকেই সংঘর্ষের শুরু।

সাতটি পার্টির সমন্বয়ে ৩৪-এ গড়ে ওঠে ‘জয়েন্ট অ্যাকশন ফর লিবারেশন ফোরাম।’ ব্রিটিশ এটা মানতে নারাজ। ৩৫-এ তৈরি হলো আরেক জালিনওয়ালাবাগ বিনা উসকানিতে ব্রিটিশরা গুলি চালিয়ে হত্যা করল ৫ হাজার ৩২ জন প্যালেস্টাইনিকে। বন্দী হলো ৮ হাজার ৯৫৮ জন। বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেয়া হলো সাড়ে ৫ হাজার বাড়ি। কিন্তু আন্দোলন থামল না। তখনই শুরু হলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের লজ্জাকর অবমাননায় ক্ষুব্ধ হিটলার মরণপণ শপথ করেছেন ইঙ্গ-ফরাসি বদমায়েশী নির্মূল করার। কিন্তু চালে ভুল করে রাশিয়াকে আক্রমণ করে বসলেন তিনি। অসীম বীরত্ব প্রকাশ করল লেনিনগ্রাদের রেড-ফৌজ। মোড় ঘুরে গেল যুদ্ধের। পরাজিত হলেন হিটলার। এই পরাজয়ের পুরো ফায়দা নিলো জায়নিস্ট ইন্টারন্যাশনাল। নির্যাতনের বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনার সাথে কল্পনার রঙ ছড়িয়ে চরম তথ্য-সন্ত্রাস করা হলো। ইংল্যান্ড তো আগে থেকেই বেলফোরের সমর্থক, এবার ক্রেডিট নেয়ার লোভে মার্কিনিরাও এগিয়ে এলো। ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর মেজর বেন-গুরিয়ন ঘোষণা দিলেন, ‘যদি আমাদের ৬৫ ভাগ জায়গা দেয়া হয়, আমরা ইসরাইলে মার্কিন নৌ ও বিমান স্থাপনার সুযোগ দেবো।’

ইতোমধ্যে থিয়োডর হার্টজেল আরো অগ্রসর হয়েছেন। অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় বংশোদ্ভূত এই সাংবাদিকের লেখা ‘ডার জুডানস্টাট’ আলোড়ন তুলেছে পশ্চিম ইউরোপে। বিখ্যাত ব্রিটিশ বিজ্ঞানী চাইম ওয়াইজম্যান লুফে নিয়েছেন তাকে। দু’জনের মিলিত চেষ্টায় শুরু হলো বেলফোর-ঘোষণার বাস্তবায়ন।

১৮৭৮ সালে প্রথম একঘর কৃষক বসতি গাড়ে ‘বোটাক তিখভা’য়। এরপর বিংশ শতাব্দী শুরুর আগেই জমা হয় ২৫ হাজার, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে ৪০ হাজার, যুদ্ধের মধ্যে ৩৫ হাজার, ২৪ থেকে ২৮-এর মধ্যে ৬৭ হাজার, ত্রিশের দশকে ২ লাখ ৫০ হাজার এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ৬০ হাজার। এসব আদম-চালানের সাথে যুক্ত ছিলেন মান্যবর ব্রিটিশ কূটনীতিক উইনস্টন চার্চিল মানবতাবাদী স্ত্রীর কল্যাণে। ঘটনা প্রকাশ পায় ব্লাক-সিতে ব্রিটিশ মালবাহী জাহাজ ‘স্ট্রমা’ ডোবার পর। ৪২-এর এপ্রিলের এ দুর্ঘটনায় দু’জন ছাড়া সব যাত্রী প্রাণ হারায়। বেঁচে যাওয়া দু’জনের একজনের নাম মোনাচেম বেগিন; অন্যজন লেহি। ৪৪-এর নভেম্বরে লেহি কায়রোতে খুন করে ব্রিটিশ মন্ত্রী লর্ড ময়নিকে।

তলে তলে কাজ করছিল ইহুদি বুদ্ধিজীবী ও সমরবিদরা। রোডেশিয়ার স্থপতি চরম বর্ণবাদী সিসিল রোডসের পরিকল্পনামাফিক প্রতিষ্ঠিত হলো ইসরাইল ১৫ মে, ১৯৪৮ সালে। সন্ধ্যায় স্বীকৃতি দিলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র!

*****
আজিজের স্ত্রী প্রেমে পড়ল ইউসুফের। নিজের মর্যাদা এবং আভিজাত্য ভুলে ‘সুন্দর তুমি পবিত্রতম’-এর কাছে প্রণয় ভিক্ষা করল সে। ইউসুফ ছুটে পালাচ্ছিল, কিন্তু আজিজা পেছন থেকে খামচে ধরল তার জামা। ছিঁড়ে বেরিয়ে গেল ইউসুফ। তার মালিক ফারাও দরবারের প্রভাবশালী মন্ত্রী, আজিজের সাথে দেখা হয়ে গেল প্রাসাদের মুখে। তিনি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন ছিন্নবসন তরুণ হিব্রুর দিকে। কী ঘটেছে অন্দরে?
আমার সর্বনাশ করেছে তোমার ওই দাস চেঁচিয়ে অভিযোগ জানাল আজিজের স্ত্রী।

আজিজ কিংকর্তব্যবিমূঢ়। নগরজুড়ে কানকথা আর ছি ছি। ক্রুদ্ধ আজিজা দাওয়াত দিলেন সম্ভ্রান্ত নারীদের। আপেল ও ছুরি দেয়া হলো প্লেটে। নারীরা যখন ফল কাটছে, তখন ডাকা হলো ইউসুফকে। তার ভুবনভোলানো রূপে ভুলে আঙুল কেটে ফেলল অতিথিরা। উচ্ছল আজিজা বললেন, তাহলে দেখো আমি কার প্রেমে পড়েছি? নারীরা মাথা নিচু করল লজ্জায়। তবু জেল হলো ইউসুফের।

জেলের সঙ্গীরাও তার আচরণে বিমোহিত। ভবিষ্যৎকে চোখের সামনে দেখে এই ছেলে। একজন কয়েদি ছাড়া পেয়ে ডেকে নিলো ইউসুফকে। ফারাওয়ের স্বপ্নের জবাব দিতে হবে। ইউসুফের বর্ণনা সত্য হলো। সম্রাট পুরস্কৃত করলেন তাকে। উন্নতির ধাপে ধাপে মিসরের মুখ্যমন্ত্রী হলো ইউসুফ।

সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যে শুরু হয়েছে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। খাদ্য আছে শুধু ফারাওয়ের ভাণ্ডারে। তাই নিতে এলো ইয়াকুবের ১১ ছেলে। তারা কেউ ইউসুফকে চেনে না। ভাইদের একজনকে আটকে কৌশলে পিতা-মাতাকে ডেকে আনালেন ইউসুফ। ছেলে ফিরে পাওয়ার আনন্দে আলো ফিরে এলো তাদের চোখে।

মিসরেই থেকে গেল ইয়াকুবের বংশধররা। বাড়তে বাড়তে তারা বিরাট গোত্রে পরিণত হলো। মিসরের ফারাও তাদের দিয়ে কাজ করান, বেগার খাটান। ধীরে ধীরে দাসে পরিণত হলো বনি ইসরাইল। তাদের কণ্ঠে কেবলই হাহাকার, কবে আসবেন মুক্তিদাতা মুসা যিনি আমাদের নিয়ে যাবেন ‘হারানো মাতৃভূমিতে’!

*****
২৬টি ধারা নিয়ে গঠিত হলো জাতিপুঞ্জ ১৯২০ সালে। বাহ্যিকভাবে মনে হয় বিশ্ব শান্তিই মূল কথা। কিন্তু ভেতরে ভেতরে তুর্কি ও জার্মানির বিপক্ষে দল ভারী করাই উদ্দেশ্য। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এই ক্যামোফেজ সংস্থাটিরই নাম দেয়া হলো জাতিসঙ্ঘ। ধ্বনি শুনলে প্রাণ জুড়িয়ে যায়, কিন্তু কার্যত পরাশক্তির ভাড় ছাড়া কিছু নয়।

১৯৪৬ সালে লন্ডনে বসল সেই জাতিসঙ্ঘের প্রথম ‘প্যালেস্টাইন অধিবেশন’। শান্তি আনা হবে কেনানে! আরবি, প্যালেস্টাইনি এবং ইহুদিদের প্রতিনিধিরা যোগ দিলো। প্যালেস্টাইনের জনসংখ্যা তখন ২০ লাখ যার ৫ লাখ ইহুদি। ইংরেজ বুদ্ধিজীবী মরিসন রাষ্ট্রটিকে সমান তিন ভাগে ভাগ করার প্রস্তাব দিলেন, যেন ব্রিটিশদের অবস্থান আরো শক্ত হয়। ইহুদিরা মানল না। ১৫ মে বসল পূর্ণাঙ্গ অধিবেশন। সে মিটিংও ব্যর্থ হলো। কারণ ওয়াইজম্যান দাবিতে অনড়।

যেন দায়ে পড়ে নতুন প্ল্যান তৈরি করল ব্রিটিশ রয়্যাল কমিশন। ইহুদিরা সেটাও মানল না। মানবতাবাদী ব্রিটিশ লেখক জেফরি সকৌতুক মন্তব্য করেন ‘মানচিত্রে যার অবস্থান ‘ড্যাশ’-এর সমান, তাকে একটি রাষ্ট্র দেয়ার পাঁয়তারা করছেন আমাদের সরকার!’ অজ্ঞাত আততায়ীর হাতে নিহত হলেন জেফরি। কারো বুঝতে বাকি থাকল না, খুনি কারা।

রয়্যাল কমিশনের প্রস্তাবকে বদলে অ্যাংলো-আমেরিকান কমিশন ’৪৬-এ নতুন বিভাজন-ম্যাপ তৈরি করে। তত দিনে ব্রিটিশ আশকারা পেয়ে ইহুদিরা পাইকারিভাবে প্যালেস্টাইনিদের হত্যা করা শুরু করেছে। প্রতিবাদে শুরু হলো প্রথম আরব-ইসরাইল যুদ্ধ। মে’তে যোগ দিলো লেবানন, এপ্রিলে ইরাক, জুনে মিসর এবং জুলাইতে সিরিয়া। তবু আরবরা পারল না। পারবে কিভাবে? নামেই যুদ্ধ করে ইসরাইল কার্যত ময়দান রক্ষা করে ব্রিটিশ ও ফরাসিরা। রাতারাতি পাল্টে যেতে থাকে মানচিত্র। লোক দেখানোর জন্য জাতিসঙ্ঘ হস্তক্ষেপ করে। কিন্তু তার আগেই বিশাল এলাকা দখল করে নিয়েছে হিব্রুরা। নতুন সীমানা নির্ধারণ করে জাতিসঙ্ঘ। এবার প্রতিফলিত হয় মার্কিনি অভিলাষ।
সেই থেকেই চলছে খেলা। জাতিসঙ্ঘের নিরপেক্ষ তদন্তকারী হিসেবে ফরাসি কূটনীতিক কাউন্ট ফক বার্নাদতেকে পাঠানো হয় প্যালেস্টাইনে। জনসংখ্যা ও ইকুয়িটির ভিত্তিতে তিনি নতুন সীমানা চিহ্নিত করেন। তার সিদ্ধান্ত ইহুদিদের বিপক্ষে যায়। দুই মাসের মাথায় জেরুসালেমে খুন হন কাউন্ট ৪৮-এর ১৭ জুলাই। শেষ হয় শান্তির শেষ উদ্যোগ।

মুসার হাত ধরে মিসর থেকে বেরিয়ে আসে হিব্রুরা। গালফ অব আকাবা ডানে রেখে জর্দানের মরুভূমি পার হয়ে মৃত-সাগরের পূর্ব পাড়ে পৌঁছায় তারা। এলাকার ভৌগোলিক নাম পশ্চিম তীর বা ওয়েস্ট ব্যাংক।

কানানাইট, আমেরাইটস, আর্মেনিয়ান এবং আরবদের বসবাস ছিল তৎকালীন প্যালেস্টাইনে। সল ছিলেন প্রথম ইহুদি রাজা। তার জামাতা দাউদ (ডেভিড) দক্ষ শাসক হিসেবে সুনাম অর্জন করেন এবং রাষ্ট্রের সুনাম ছড়িয়ে দেন। দাউদের পুত্র সোলেমান প্রসিদ্ধি লাভ করেন প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতার জন্য। এদের মিলিত শাসনকাল স্থায়ী হয়েছিল খ্রিষ্টপূর্ব ১ হাজার ২০ থেকে ৯২৩ পর্যন্ত প্রায় ১০০ বছর।
সোলেমানের রাজত্বকালেই রাষ্ট্রটি দুই ভাগে বিভক্ত হয় উত্তরাংশের নাম ইসরাইল; দক্ষিণাংশের জুডিয়া। বাকি অংশে প্যালেস্টাইনিরা বসবাস করে।

সোলেমানের মৃত্যুর পর ক্রমবর্ধমান কোন্দল ও অব্যবস্থার সুযোগে খ্রিষ্টপূর্ব ২৫৩৮-এ পার্সিরা, ৩৩১ আলেক্সান্ডার এবং ৬৪-তে রোমানরা ইসরাইল আক্রমণ করে। এই তিন আক্রমণে ইহুদিরা ছত্রভঙ্গ হয়ে ছড়িয়ে পড়ে দূর-দূরান্তে।

*****
১৯৬৪ সালের ২৮ মে প্রথম যুব কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয় জেরুসালেমে। জন্ম হয় প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন বা পিএলও’র। সে বছরই আরব লিগ স্বীকৃতি দেয় পিএলওকে। ’৬৯-এ ন্যাম, ’৭৩-এ ওআইসি, ’৭৪-এ অর্গানাইজেশন অব আফ্রিকান ইউনিয়ন এবং এরপর একে একে জার্মানি, চীন, রাশিয়া, পোল্যান্ড, বুলগেরিয়া, যুগোস্লাভিয়া, রোমানিয়াসহ বহু দেশ প্যালেস্টাইনের একমাত্র বৈধ প্রতিনিধি হিসেবে মেনে নেয় পিএলওকে। ইয়াসির আরাফাত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পান ’৬৯-এ। তার নাম হয় মুকুটহীন সম্রাট। বিশ্বের সর্বাপেক্ষা অধিক ভ্রমণকারী রাষ্ট্রনেতা হিসেবে ২৪ বছর ছুটোছুটি করে শেষ পর্যন্ত স্বাধীন প্যালেস্টাইন রাষ্ট্রের পতাকা ওড়ান তিনি।

*****
সোলেমানের মৃত্যুর পর আরো অনেক নবী আসেন প্যালেস্টাইনে। দুঃখজনকভাবে ইহুদি ধর্মযাজক বা রাব্বিরা তাদের প্রায় সবাইকে হত্যা করে। সংখ্যাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, এদের সংখ্যা ২০০’রও অধিক। কারো কারো নাম কুরআনেও উল্লিখিত হয়েছে; যেমন হিজকিল, জাকারিয়া ও ইয়াহিয়া। মুসার ‘মোজাইক ল’র অনুসারীরা কিভাবে এত বিপথগামী হলো বোঝা ভার। এর চেয়েও দুর্বোধ্য যে, সর্বাপেক্ষা লাঞ্ছিত নবী-ঈসার অনুসারীরাই আজ তাদের সহযোদ্ধা! কিভাবে এই আশ্চর্য ‘মিলন’ সম্ভব হলো সে রহস্যের কিনারা করাও অসম্ভব। গৌতম বুদ্ধের বৌদ্ধ ধর্ম এবং মহাবীর তিরতিংকারের জৈন ধর্মের সাথে আজ যেমন হিন্দুদের আচারগত তফাত নেই এও বোধ হয় তেমিন ওয়াল কুফরি মিল্লাতি ওয়াহিদান!

এলিজাবেথ ও হান্না দুই বোন। সৎস্বভাবের জন্য দু’জনেই প্রসিদ্ধ। ইমরানের স্ত্রী হান্না স্বপ্নে দেখল, তার ঘরে আসছে ঈশ্বরের সেই জ্যোতি যার হাতে রয়েছে মুক্তির আলোকবর্তিকা। স্বপ্নের পর হান্না নিশ্চিত ছিল যে, তার ছেলে হবে। কিন্তু জন্মাল মেয়ে। হতাশ হান্না মেয়ের নাম রাখল মরিয়ম। মেয়েটি আট বছরে পা দিতে না দিতেই মারা গেল হান্না। বোন এলিজাবেথের স্বামী জাকারিয়া নিয়ে এলেন এতিম মেয়েটিকে। প্রতিপালন করলেন নিজের মেয়ের মতো।

ইয়াহিয়ার (জন নামে পরিচিত) যখন জন্ম হয়, তখন তার বাবা-মা জাকারিয়া এবং এলিজাবেথ অতি বৃদ্ধ। সে বয়সে তাদের সন্তান হওয়াটা স্বাভাবিক নিয়মে ছিল অসম্ভব। সে কারণে গালিলির মানুষ ইয়াহিয়ার জন্মকে ‘ঐশী-করুণা’ হিসেবে চিহ্নিত করে। ইয়াহিয়াও তার সদাচরণ এবং কল্যাণব্রতের মাধ্যমে মানুষের এই আস্থার সম্মান রাখেন। তার আহ্বানে গালিলি ছাড়াও শমরিয়া, দিকাপলি, পিরিয়া ও জুডিয়ার মানুষ সাড়া দেয়। ‘বায়াত’ গ্রহণকারীদের সংখ্যা এত বাড়ে যে, তার নামই হয়ে যায় জন-দ্য ব্যাপ্টিস্ট। ছাগলের চামড়ার আলখেল্লায় ঢাকা অতি সাধারণ এই মানুষটির জনপ্রিয়তায় ুব্ধ রাজা হেরোড এন্টিপাস ষড়যন্ত্র শুরু করেন।

ভাবীর সাথে দৈহিক সম্পর্ক ছিল হেরোডের। ভাই ফিলিপ ব্যাপারটা জেনেও প্রাণের ভয়ে মুখ বন্ধ করে ছিলেন। কিন্তু জনগণের কানাঘুষা থেমে থাকে না। এক সময় ইয়াহিয়া রাজাকে সতর্ক করেন এই ‘পাপ’ থেকে বিরত হওয়ার জন্য। সুযোগ পেয়ে যান হেরোড। রাজদ্রোহের অপরাধে কারারুদ্ধ করেন ইয়াহিয়াকে।

মনোবাসনা পূর্ণ হওয়ার আনন্দে উৎসবের ঘোষণা দিলেন হেরোড। কন্যা ‘সালোম’ নাচার অনুমতি চাইলেন। অনুমতি দেয়া হলো। সেই নাচ পরে যা ‘ওরিয়েন্টাল ড্যান্সের’ জন্ম দেয় বলে অনেকের ধারণা দেখে মুগ্ধ পিতা বললেন, সালোম যা চাইবে তাই পাবে। বাপ-কা-বেটি প্রার্থনা করেন জন-দ্য ব্যাপ্টিস্টের মস্তক চাই তার!!

ঐতিহাসিকরা প্রায় সবাই একমত যে, এটি ছিল সাজানো ঘটনা। যা-ই হোক, ইয়াহিয়ার মৃত্যুতে সবচেয়ে বিপদে পড়েন খালাতো বোন মরিয়ম। তার শেষ আশ্রয়টুকুও নিঃশেষিত হয়।

১৪ বছর বয়সে মরিয়ম মেডিটেশন শুরু করেন। জিব্রাইল এসে তাকে এমন এক আশ্চর্য পুত্রের সংবাদ দেন, যিনি জন্মাবেন পিতাবিহীন অবস্থায়। আদমের মতো তিনিও হবেন সত্যের অনুসারী। মরিয়মের দু’চোখ জলে ভরে আসে। তাহলে এই সেই আলো, যার দিন গুনছিল মা হান্না?

গুঞ্জনে অতিষ্ঠ কুমারী-মা মরিয়ম চলে গেলেন ৭১ মাইল দূরবর্তী গ্রাম বেথেলহেমে। নাজারেথের মতো এখানে কেউ তাকে ভর্ৎসনা করবে না। সেখানেই জন্ম হলো ঈসার।

কিন্তু ব্যাপারটি আর গোপন থাকল না। পথচারীরা হাসাহাসি করে। কৌতূহলী গ্রামবাসী ঘটনা জানতে চায়। মরিয়ম চুপ। ঈশ্বরের নির্দেশমাফিক তিন দিন তিনি মুখ খুললেন না। গ্রামবাসীর ঔৎসুক্য তাতে দমল না। শেষ পর্যন্ত কথা বলল সেই নবজাতক, ‘মরিয়ম হচ্ছে বাগানের ফুল বা আকাশের ওই তারার মতো পবিত্র, সিদোনের ভূমি আজ থেকে পরিচিত হবে ঈশ্বরের পবিত্র নামে। আর আমিই সে মসিহ, যিনি তোমাদের জন্য শুভ সংবাদ নিয়ে এসেছি। পৌত্তলিকতা বর্জন করে ঈশ্বরের অনুগামী হও। নইলে ভয়াবহ শাস্তি আসবে।’
রাজা হেরোডের কানেও পৌঁছল যে ‘হিব্রুদের রাজা’ জন্মগ্রহণ করেছেন। তিনি নির্দেশ দিলেন, ‘এক বছরের কম বয়সী সব শিশুকে হত্যা কর।’ ভীত মরিয়ম পথ ধরলেন মিসরের। কেউ বলে সাড়ে-তিন, কারো মতে সাড়ে ১০ বছর পর ফিরে এলেন তারা। তদ্দিনে হেরোড নিজেই বিদায় নিয়েছেন দুনিয়া থেকে।

৩০ বছর বয়সে ঈসা ধর্ম প্রচার শুরু করেন। সাধারণ খেটে খাওয়া, নির্যাতিত মানুষের আদর্শ হয়ে উঠলেন তিনি। তার স্পর্শে সুস্থ হয়ে উঠল আর্তপীড়িতজন। রাব্বিদের মাথায় হাত! তাদের কর্তৃত্ব যে যায় যায়। শুরু হলো বিরোধিতা ও ষড়যন্ত্র। শত্রু হয়ে সামনে এলো পুরোহিতরাই যাদের ধর্মগ্রন্থ তৌরাতে স্পষ্টই বলা আছে মসিহর আগমন সংবাদ।

জনগণকে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে খেপিয়ে তোলার অভিযোগে রোমান গভর্নর পিলাতের সামনে হাজির করা হলো ঈসাকে।

পুরোহিতরা বললেন, ‘তুমি তো সত্যের পতাকাবাহী। তাহলে বলো, হিব্রু একেশ্বরবাদীদের কি উচিত প্রতিমাপূজক রোমানদের ট্যাক্স দেয়া?’
শয়তানিটা বুঝতে দেরি হলো না ঈসার। এ এমন প্রশ্ন উত্তর যা-ই দেয়া হোক, রোমান গভর্নর রুষ্ট হবেই। হায়, এরাই কি সেই বনি-ইসরাইল, যাদের পূর্বপুরুষের নাম সোলেমান, দাউদ, মুসা ও ইব্রাহিম? তার চোখ বাষ্পাচ্ছন্ন। ‘প্রভু, এদের ক্ষমা করো’ মনে মনে এই প্রার্থনা করে তিনি সামনে তাকালেন।

‘আমাকে কেউ একটা মুদ্রা দাও।’
রাব্বিরা শঙ্কিত। তবু একটি মুদ্রা তুলে দেয়া হলো তার হাতে।
স্বর্ণমুদ্রাটি নিয়ে জানতে চাইলেন তিনি, ‘কার ছবি ও মোহর আছে এতে?’
‘রোমান সম্রাটের।’
‘মুদ্রাটি কিসে তৈরি?’
‘সোনায়।’

‘তাহলে তোমাদের প্রশ্নের জবাবে বলছি মুদ্রাটি দাও সম্রাটকে এবং স্বর্ণটুকু রাখো ঈশ্বরের জন্য।’
অকাট্য জবাব। কিন্তু বিচার যখন প্রহসন, সত্য তখন অকার্যকর হতে বাধ্য। বিচারে ঈসার মৃত্যুদণ্ড হলো। ৩০ স্বর্ণমুদ্রার বিনিময়ে তারই শিষ্য জিহুদা তাকে ধরিয়ে দেয়ার ভার নিলো।

তিনি ছিলেন গির্জায়। পুরোহিত ও সৈন্যদের নিয়ে জিহুদা সেখানে হাজির হলো। ঈসা প্রার্থনা করলেন গির্জায় যে আগে প্রবেশ করবে, তার মুখ যেন পরিবর্তিত হয়ে যায়। জিহুদা ঘরে ঢুকে কাউকে দেখতে পেল না। ভয় পেয়ে বেরিয়ে এলো সে। সৈন্যরা ঈসার চেহারা দেখে জিহুদাকেই ক্রুশবিদ্ধ করল।

এ ঘটনার ৪০০ বছর পরে, কুমারী-গর্ভে ঈসার জন্ম নিয়ে যুক্তিবাদী-ইউরোপ যখন মহা বিতর্কে লিপ্ত তখন রোমের এক গোপন সভায় পৃথিবীর প্রধান যাজকরা মিলিত হয়ে বাইবেলের অসঙ্গতি শুধরাবার চেষ্টা করে। পিতা-ঈশ্বর, পুত্র-ঈশ্বর এবং পবিত্র-আত্মার ব্যাখ্যা প্রবর্তিত হয় ম্যাথু, মার্ক, লুক ও জন লিখিত চারটি গসপেলের কোনোটিতেই যার অস্তিত্ব ছিল না।

‘এ কারণেই’ নৃতত্ত্বের জনক ইবনে খালদুন লিখেছেন, ‘বাইবেল পরিবর্তিত হয়েছে অসংখ্যবার। এমনকি তার বয়সের তুলনায় কমপক্ষে ১৫ গুণ বেশিবার। এটাই হচ্ছে মুসলমানদের সাথে খ্রিষ্টানদের দ্বন্দ্বের কারণ; ঈসা, মুসা এবং মহম্মদ নয়।’

*****
কেন জেরুসালেম পবিত্র নগরী? কেন এত দ্বন্দ্ব এই এলাকা নিয়ে? প্রশ্নটির জবাব খুঁজতে আমি আবারো পেছনে হাঁটি।
ইহুদিদের কাছে এই শহর পবিত্র, কারণ এখানেই রয়েছে সোলেমানের উপাসনালয় হায়কল-ই সুলাইমান; এখানেই রাজত্ব করেছেন কিং ডেভিড। খ্রিষ্টানদের কাছে এটি পবিত্র কারণ এর পাশেই বেথেলহেম অবস্থিত যেখানে যিশুর জন্ম; মা-মেরির কবর। মুসলমানরা একে পবিত্র জানে কারণ মসজিদুল আকসা এবং ‘ডোম অব দ্য রক’ বা পবিত্র পর্বতশৃঙ্গ অবস্থিত এখানে। এই মসজিদ তাদের প্রথম কিবলা। নবী মুহাম্মদ সা: এখান থেকেই তার পরলোক-দর্শনের (মিরাজ) সফর সফর শুরু করেন।

মসজিদুল আকসা তৈরি করেন নবী সোলেমান খ্রিষ্টপূর্ব ১ হাজার সালে। পারস্য সম্রাট নেবুকান্দনেজ্জারের হাতে এটি ধ্বংস হয় ৫৮৬ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে। সম্রাট এজরা এবং নেহেমিয়া একে পুনর্নির্মাণ করেন কিন্তু কিওপেট্রার পিতামহ এপিফেন্সের হাতে আবার এটি ধ্বংস হয় ১৬৭ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে। হিজকিল-জাকারিয়াদের চেষ্টায় আবার এটি গড়ে ওঠে। শেষবার একে ধ্বংস করেন হেরোড। দ্বিতীয় খলিফা ওমরের বিখ্যাত জেরুসালেম সফরের পর মসজিদটি খুলে দেয়া হয়। এর বর্তমান কাঠামোটি নির্মিত হয়েছে খলিফা আল-ওয়ালিদের দ্বারা ৬৪ হিজরিতে।

এরপর এসেছে ক্রুসেড (১০৯৬-১২০২)। ক্রুসেডে মসজিদটি কয়েকবার অবরুদ্ধ হয়েছে কিন্তু ধ্বংস হয়নি। ১১৯২ সালে সুলতান সালাদিন আইউবি একে সবার জন্য উন্মুক্ত করেন। শুক্রবার মুসলমানরা, শনিবার ইহুদিরা এবং রোববার খ্রিষ্টানরা এখানে প্রার্থনা করে। এমন আশ্চর্য ইবাদতগৃহ পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি নেই, যেখানে মিলিত হয় তিনটি প্রধান সেমেটিক ধর্মের মানুষ।

পরবর্তী ৭০০ বছর আল-আকসা ও প্যালেস্টাইন থাকে সেলজুক, মামলুক ও অটোমানদের হাতে। ১৮৮৭ সালে তুর্কিরা প্যালেস্টাইনকে তিনটি এলাকায় ভাগ করে জেরুসালেম, অককা ও নাবলুস। ১৯১৬ সালে শরিফ হোসেন তুর্কিদের থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ১৮ সেপ্টেম্বর জেনারেল অ্যালেনবাই দখল করেন প্যালেস্টাইন।

শুরু হয় বলাৎকার। ইসরাইলি সন্ত্রাসী বাহিনী ‘হোগানা’ এবং ‘ইরগন’ নিজেদের হাতে আইন তুলে নেয়। অপারেশন জাফা, অপারেশন হাইফা, জেনিন, বারাক, বেন-আমি, আক্রা, জেরুসালেম ‘ম্যাসাকার’ হয়ে ওঠে নিত্যদিনের ঘটনা। যখনই প্রতিরোধী শক্তি যেমন ‘হামাস’ গঠিত হয় তখনই জাতিসঙ্ঘের ‘যুদ্ধবিরতি’ ধ্বনি শোনা যায়। সে সুযোগে সাবরা-শাতিলা, ইয়ুন কারাই, আকসা কিংবা হেবরন নিধনযজ্ঞ চলতে থাকে। জাতিসঙ্ঘের পাওয়ারফুল চশমায় সেসব ধরাই পড়ে না। কখনো ভুলক্রমে কিছু দেখে ফেললে, নিন্দা জানিয়েই খালাস।

এভাবেই লিটানির স্রোত গড়িয়ে যায়। পাশাপাশি ক্যাম্প ডেভিড চুক্তির কৌশলগত বিজয়ে স্বীকৃতি পায় ডেভিড-শিল্ড; ইসরাইল ও ব্রিটেনের দীর্ঘ সাধনার ফসল। ষড়যন্ত্রের দুই রাজা-উজিরের নেক নজর পড়েছে এখন লেবাননের ওপর। দু’টি কারণে লেবানন তাদের দরকার। এক. মিষ্টি পানির স্রোত লিটানি নদী প্রবাহিত হচ্ছে ওখানে। দুই. পবিত্র ভূমির অংশ সেটা।

গেমায়েল পরিবারকে সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়ে ইসরাইল থেকে লেবাননে পাঠানো হয়। গড়ে ওঠে ফালাঞ্জেস পার্টি। কেউ ডাকে লেবানিজ ফ্রন্ট, কেউ খ্রিষ্টান মিলিশিয়া। প্রকাশ্যে মনে হয় তারাও ইসরাইলের শত্রু। কিন্তু কার্যত দেখা যায় পলাশীর আম্রকাননের দৃশ্য। যুদ্ধের সময় পঞ্চম বাহিনী হিসেবে ভূমিকা রাখেন গেমায়েল। ওদিকে জর্দানের বাদশা হোসেনও বেইমানির জন্য সতত প্রস্তুত। সুতরাং যুদ্ধ আর থামে না। ২৬টি দেশের বিশাল দেহতটে চুনোপুঁটির মতো ুদ্র ইসরাইল হয়ে ওঠে আরব সুন্দরীর কপালের টিপ।...

আমি তাবা হিলটনে দাঁড়িয়ে আছি। পেছনেই ইসরাইল বর্ডারের নিয়নসাইন স্বাগত জানাচ্ছে পর্যটকদের। ‘ল্যান্ড অব কিং ডেভিডে’ যাওয়ার অনুমতি নেই আমার। জানি না কী কারণে বাংলাদেশ সরকার তার নাগরিকদের ইসরাইল যাওয়ার অনুমতি দেয় না। মানুষ হিসেবে কাউকে ঘৃণা করা যায়, কিন্তু রাষ্ট্রকে লোকে কিভাবে ঘৃণা করে?

হিলটনে ফিরে দেখি লবিতে ভীষণ ভিড়। পাংশুটে মুখে দাঁড়িয়ে আছে বিদেশীরা। টিভিতে ব্রেকিং নিউজ ‘আমেরিকা আন্ডার অ্যাটাক। টুইন টাওয়ার ভেঙে পড়েছে!’
‘এটা কি সিনেমা?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম।

‘না, স্যার। এটা সিনেমা নয়।’ ড্রাইভার নির্বিকার মুখে বলল, ‘এটা ইসরাইল। অপেক্ষা করুন, যুদ্ধ আসছে।’ আমার চোখের সামনে আইলাত বন্দর ঝাপসা হয়ে যায়। তাহলে মানুষই কি মানুষের শেষ ধ্বংসের কারণ হবে? এর নামই কি কিয়ামত?
জানি, তা নয়। তবু অস্থির মনের তাড়নায় আমি বেরিয়ে পড়ি ধুলাবালির রাস্তায়। মিসরের আকাশে তখনো সূর্যের উজ্জ্বল আভা; তখনো তার আকাশের রঙ গোলাপী-নীল।


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us