আসলে কী হয়েছিল আনারকলির?

গোলাপ মুনীর | Oct 05, 2020 07:47 pm
আসলে কী হয়েছিল আনারকলির?

আসলে কী হয়েছিল আনারকলির? - ছবি : সংগৃহীত

 

নর্তকী আনারকলি ও সেলিমের (পরে যিনি সম্রাট জাহাঙ্গীর) প্রেমকাহিনী সব সময়ই আমাদের প্রলোভিত করেছে। কিন্তু সেই আনারকলি সম্পর্কে সত্য কোনটা, সে প্রশ্নও আমাদের তাড়িত করেছে। আমরা সেলিম-আনারকলির যে প্রেমকাহিনী জানি, এর সত্যতা বারবার চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে ইতিহাসবিদ আরো অনেকেই। তারা প্রশ্ন তুলেছেন, আনারকলির মৃত্যুর প্রচলিত বিবরণের সত্যতা নিয়ে। প্রশ্ন সেলিম-আনারকলির প্রেমকাহিনী কি কোনো ইতিহাসের অংশ?

এ প্রেক্ষাপটে এ লেখায় আমরা উত্তর খুঁজব দু’টি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের : আনারকলি নামে সত্যিই কি কোনো চরিত্রের অস্তিত্ব ছিল? যদি এর উত্তর হ্যাঁ হয়, তবে সম্রাটপুত্র সেলিমের বাবা সম্রাট আকবর আনারকলিকে জীবন্ত সমাধিস্থ করে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেছিলেন? এ প্রশ্নের উত্তর যাই হোক, সেলিম-আনারকলির প্রেমকাহিনী ভারতে তৈরি দু’টি চলচ্চিত্র আগ্রহীদের জন্য অবশ্যই দেখা দরকার। এর প্রথমটি হচ্ছে আনারকলি। ছবিটি নির্মিত হয় ১৯৫৩ সালে। এতে আনারকলির ভূমিকায় অভিনয় করেন বীণা রায়। আর নায়ক ছিলেন প্রদীপ কুমার। দ্বিতীয় ছবিটির নাম আমরা প্রায় সবাই জানি। মোগল-এ-আজম নামের এ ছায়াছবিতে সেলিমের ভূমিকায় অভিনয় করেন দিলীপ কুমার। আর আনারকলির ভূমিকায় মধুবালা।

আকবরনামা মতে
বাবরই প্রথম সম্রাট যিনি তার নিজের স্মৃতিকথা লিখে যান। তিনি ছিলেন বাবার দিক থেকে তৈমুরের উত্তরপুরুষ। আর মায়ের দিক থেকে চেঙ্গিস খানের উত্তরপুরুষ। দু’জনই ছিলেন দুর্ধর্ষ সাহসী। তাদের হাতে প্রচুর লোকক্ষয়ের ইতিহাস আছে। যা-ই হোক ইতিহাসের দুই সুপরিচিত দুই নায়কের উত্তরপুরুষ হিসেবে বাবর নিজেকে গর্বিতজন বলেই ভাবতেন। তিনি তার জীবনের যে স্মৃতি আলেখ্য লিখে রেখে গেছেন, তার নাম বাবরনামা। এটি তিনি লিখে গেছেন তার মাতৃভাষা Chaghatai Turkic-এ। বাবরপুত্র হুমায়ুনও লিখে গেছেন তার স্মৃতিকথা। কিন্তু হুমায়ুনপুত্র সম্রাট আকবর কোনো স্মৃতিকথা লিখে যাননি। সম্রাট আকবরের উজির আবুল ফজল ছিলেন তার সরকারি ইতিহাসবিদ। সরকারি ইতিহাসবিদ হিসেবে এই আবুল ফজল লিখে গেছেন আকবরনামা। তিন খণ্ডের এই আকবরনামা তিনি রচনা করেন ফার্সি ভাষায়। সর্বশেষ খণ্ডটি পরিচিত আইন-ই-আকবরী। এতে একান্তভাবেই বর্ণিত হয়েছে প্রশাসনিক দিকগুলো। প্রথম খণ্ডের বিষয় তৈমুর, বাবর ও হুমায়ুন। দ্বিতীয় খণ্ডে রয়েছে আকবরের ৪৬ বছরের (১৫৬০-১৬০৫) শাসনামলের বিস্তৃত বর্ণনা।

প্রশ্ন হচ্ছে, আকবর কেন তার নিজের স্মৃতিআলেখ্য লিখে যাননি? এর উত্তর হচ্ছে, তিনি ছিলেন নিরক্ষর। তিনি লিখতে ও পড়তে জানতেন না। তার সভাসদেরা তার হয়ে বিভিন্ন বিষয়ে বই লিখতেন এবং আকবরের ছিল একটি বিশাল গ্রন্থাগার। তিনি বিভিন্ন জনের কাছ থেকে বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞানের কথা শুনতেন। শুনতেন বইয়ের পাঠ। এভাবে শুনে শুনে তিনি প্রচুর জ্ঞানার্জন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। সে জন্য অনেকেই আকবরকে বড়মাপের পণ্ডিত ভাবতেন।

আকবরনামায় কি আনারকলির কথা উল্লেখ আছে? তার জীবন ও ঘটনার উল্লেখ কি আমরা আকবরনামায় পাই? বলা হয়, আকবরনামার কোথাও আনারকলি সম্পর্কে কোনো উল্লেখ নেই। সরাসরি না হোক, অপ্রত্যক্ষভাবে আভাসে-ইঙ্গিতেও কি আনারকলির কোনো ঘটনার উল্লেখ আকবরনামায় আছে?

ইন্টারনেটে পাওয়া আকবরনামাসংশ্লিষ্ট দু’টি উদ্ধৃতি এখানে প্রসঙ্গত উল্লেখ করছি :
প্রথম উদ্ধৃতি : ''The Akbarnama, the official court history of Akbar, records an incident where Akbar became angry with Salim for some reason and sent a noble to admonish him. Salim, however complained that the noble spok too harshly and Akbar ordered the tongue of the noble to be cut off, disregarding the fact that the unlucky man was acting on the orders of Akbar himself. If such could be the fate of a high-ranking noble cought in crossfire between the king and the prince, then imagine a slave girl.'

দ্বিতীয় উদ্ধৃতি : It is recorded in Akbarnama that Jahangir 'became violently enamoured of the daughter of Zain Khan Kaka, H. M. (Akbar) was displeased at the impropriety; but he saw that his heart was immoderately affected, he of necessarly, gave his consent.' The translator of Akbarnama, H. Beveridge, opens that Akbar objected to the marriage, because the prince was already married to Zain Khan's niece (actually the daughter of paternal uncle of Zain Khan, and his sister). Akbar objected to marriage near relation. But we do not know the date of deeth of either of these too wives of Janahgir.

ইন্টারনেটে পাওয়া ওপরে দু’টি উদ্ধৃতিতে উল্লিখিত কোনো তথ্যই আমরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করে সত্য কিংবা মিথ্যা বলে ধরে নিতে পারি না। তার পর মোটামুটিভাবে ধরে নেয়া আকবর ও জাহাঙ্গীরের মধ্যে বড় ধরনের এক মতপার্থক্য বিদ্যমান ছিল। আমরা প্রশ্ন তুলতে পারি, এই মতবিরোধের কারণ কী ছিল আনারকলি?

এটাও সত্য, সম্রাটপুত্র সেলিম ১৬০০ খ্রিষ্টাব্দে অনধিকার হস্তক্ষেপের মাধ্যমে সিংহাসন দখল করে বসেন, যখন আকবর ব্যস্ত ছিলেন একটি বিজয় অভিযানে। কিন্তু আকবর সাফল্যের সাথে এ বিদ্রোহের মেরুদণ্ড ভেঙে দেন।

আবুল ফজল খুন হন ১৬০২ খ্রিষ্টাব্দের ১২ আগস্ট। তাকে খুন করেন বীর সিং বুন্দেলা। সেলিমের আদেশেই তাকে হত্যা করা হয়। সেলিম আবুল ফজলকে ঘৃণা করতেন। সম্রাট আকবর মারা যান ১৬০৫ খ্রিষ্টাব্দের ২৭ অক্টোবর। সেলিম (জাহাঙ্গীর) সিংহাসনে আরোহণ করেন ১৬০৫ খ্রিষ্টাব্দের ৩ নভেম্বর, আকবরের মৃত্যুর আট দিন পর। ধরে নেয়া হয় বর্তমানে লাহোরে যে আনারকলি সমাধি রয়েছে, তা সম্রাট জাহাঙ্গীর ১৬০৫-১৬১৮ সময়-পরিধিতে নির্মাণ করেন।

লাহোরের আনারকলি সমাধি
এই সমাধি এখনো অস্তিত্বশীল লাহোরের স্টেট সেক্রেটারিয়েট অফিস কম্পাউন্ডের ভেতরে। এ সমাধির ভেতর যে কবরটি রয়েছে তাকেই ধরে নেয়া হয় আনারকলির কবর। এটি আসলে একটি অষ্টভূজী অভিজাত ভবন। এর রয়েছে আট কোণবিশিষ্ট একটি মিনার, যার ওপরে টানানো আছে একটি শামিয়ানা। এ ভবনটিকে বলা হয় রেকর্ড অফিস। কাছেই মলরোডে রয়েছে একটি বাজার। এর নাম আনারকলি বাজার। বলা হয়, বাজারটি ২০০ বছরের পুরনো। সমাধির রয়েছে ফার্সি ভাষায় কিছু শিলালিপি। এর ভাষান্তর করলে দাঁড়ায় :

‘আমি হাশরের দিনে ধন্যবাদ জানাব সৃষ্টিকর্তাকে
আহ। যদি একবার সেদিন আরেকবার দেখতে পারি প্রিয়ার সে মুখ’

শিলালিপির উত্তর পাশে যা লেখা ছিল, তার অর্থ দাঁড়ায় এমন :

‘মজনুন সেলিম আকবর’, এর সরল অর্থ দাঁড়ায় আকবরপুত্র সেলিম আনারকলিকে প্রবল ভালোবাসত।

শিলালিপি দু’টির সন লেখা ছিল : হিজরি ১০০৮ ও ১০২৫। খ্রিষ্টাব্দের হিসাবে এই স্মৃতিসমাধি নির্মাণ শুরু ও সমাপ্তি সনের উল্লেখ। তবে অনেকের কাছে মনে হয় এ ধরনের একটি সমাধি নির্মাণ করতে ১৬ বছর সময় নেয়ার কথা নয়। কারণ এর পরবর্তী সময়ে তাজমহলের বড় সমাধি নির্মাণ করতে সময় লেগেছিল ১৬ বছর (১৬৩২-৪৮)। তা সত্ত্বেও কিছুসংখ্যক ইতিহাসবিদ মনে করেন ১৫৯৯ খ্রিষ্টাব্দ ছিল আনারকলির মৃত্যু অর্থাৎ জীবন্ত-সমাধিস্থ করার বছর। এবং ১৬১৫-১৬ ছিল এই সমাধি নির্মাণ সম্পূর্ণ করার বছর। অনেকের বিশ্বাস, সেলিম ১৬০০ খ্রিষ্টাব্দে তার বাবার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন রাগে ও ক্ষোভে।

যারা আনারকলির কাহিনীতে বিশ্বাস রাখেন, তাদের অনেকের বিশ্বাস আনারকলির আসল নাম নাদিরা বেগম। তিনি বসবাস করতেন লাহোরে। তিনি আকবরের রাজসভার নর্তকী ছিলেন লাহোরে। আকবরই সর্বপ্রথম তার সৌন্দর্যে বিমোহিত হয়ে পড়ে তার নাম দেন আনারকলি। আনারকলি অর্থ ডালিম/বেদানা/দাবিম্ভ ফুলের কলি বা ফুল। এই নাম দিয়ে আকবর নাদিরা বেগমের সৌন্দর্যের প্রতি স্বীকৃতি জানান। এটি স্বীকৃত, সম্রাট আকবর আনারকলির প্রতি মোহাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলেন। আর এ কারণেই তিনি সেলিমের সাথে আনারকলির প্রেমের সম্পর্ক মেনে নিতে পারেননি।

ইন্টারনেটে আনারকলি সম্পর্কিত তথ্যানুসন্ধান করতে গেলে বিভিন্ন ইতিহাসবিদ, পণ্ডিতজন, লেখক ও অন্যদের প্রকাশিত অভিমত, আন্দাজ-অনুমাননির্ভর তথ্য, দ্বিমত ইত্যাদি দেখে যে কেউই বিভ্রান্ত হওয়ার মতো পরিস্থিতির মুখোমুখি হবেন। একটি অভিমত হচ্ছে, আনারকলিকে জীবন্ত সমাধিস্থ করার পর আকবর নিজেই আনারকলি সমাধি নির্মাণের আদেশ দিয়েছিলেন। আরেকটি অভিমত হচ্ছে, আকবর যখন লাহোরের বাইরে এক অভিযানে নিয়োজিত ছিলেন, তখন আনারকলি অসুস্থ হয়ে মারা যান। সেখান থেকে ফিরে এসে পরবর্তী সময়ে আকবর এই সমাধি নির্মাণের আদেশ দিয়েছিলেন। অন্য আরেকটি অভিমত হচ্ছে, সেলিমের এক স্ত্রীর নাম ছিল সাহেব-ই-জামাল। তিনি মারা যান। ওই সাহেব-ই-জামালই নির্মাণ করেন এই আনারকলি সমাধি। ভিন্নমতে, এই সমাধি হচ্ছে আকবরের এক স্ত্রীর, যিনি ছিলেন সম্রাটপুত্র দানিয়েলের মা।

আকবরের রাজধানী স্থানান্তর
আমরা জানি, তৈমুর লংয়ের পুত্র বাবর, তার পুত্র হুমায়ুন, তার পুত্র আকবর, আর আকবরপুত্র সেলিম। প্রথম দিকে বাবরের রাজধানী ছিল কাবুলে। ১৫৩০ সালে তার মৃত্যুর আগে তিনি রাজধানী স্থানান্তর করেন আগ্রায়। তার পুত্র হুমায়ুনের রাজধানী ছিল আগ্রায়। শেরশাহ সুরীর সাথে তার কয়েকটি যুদ্ধের পর হুমায়ুন ফিরে যান লাহোরে। সেখান থেকে ১৫৫৫ সালে দিল্লি ফিরে গিয়ে সেখানে স্থায়ী বসবাস গড়ে তোলেন। আকবর সিংহাসনে বসেন ১৫৫৬ সালে। সে বছরই তিনি মোগল রাজধানী দিল্লি থেকে আগ্রায় স্থানান্তর করেন এবং রাজধানী ১৫৭১ সালে স্থানান্তরিত হয় ফতেহপুর সিক্রিতে। এরপর আকবর কেন ১৫৮৫ সালে রাজধানী লাহোরে স্থানান্তর করেন, তার কোনো কারণ আকবরনামায় উল্লেখ নেই। তবে ধারণা করা হয় ফতেহপুরে পানির অভাব থাকায় এই স্থানান্তর ঘটে। আকবরের রাজধানী লাহোরে থাকে ১৫৯১ সাল পর্যন্ত। এরপর আবার রাজধানী স্থানান্তরিত হয় আগ্রায়। সেখানেই আকবর মারা যান ১৬০৫ খ্রিষ্টাব্দে। তার মৃত্যুর পর সিংহাসনে বসেন সেলিম (জাহাঙ্গীর)।

আনারকলির মৃত্যু ১৫৯৯ সালে। আর সে বছরই আকবর রাজধানী নিয়ে যান আগ্রায়। আগ্রা থেকেই মৃত্যু পর্যন্ত তিনি তার শাসনকাজ পরিচালনা করেন। এ থেকে একটা সন্দেহ অনেকের মনে জাগতে পারে, আনারকলির মৃত্যুতে আকবর বেশ আঘাত পেয়েছিলেন। সে জন্যই আনারকলির মৃত্যুবছরে তিনি লাহোর ছেড়ে চলে যান। এমনটি কি ভাবা যায়, তিনি যাওয়ার সময় আনারকলি সমাধি নির্মাণের আদেশ দিয়ে যান। ফলে এমনটি সম্ভাবনাই প্রবল যে, জাহাঙ্গীরই এ সমাধি নির্মাণ করেন, যার নির্মাণ শেষ হয় ১৫১৫-১৬ সালের দিকে।

ফিঞ্চ ও টেরির প্রমাণ
বলা হয়, আনারকলির সাথে সেলিমের প্রেমের বিষয়টি পাওয়া যায় দুই ব্রিটিশ পরিব্রাজক William Finch এবং Edward Terry-র বর্ণনা থেকে।

উইলিয়াম ফিঞ্চ ছিলেন লন্ডনবাসী। তিনি চাকরি করতেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে। তিনি ১৬০৮ সালের ২৪ আগস্টে বিখ্যাত ক্যাপ্টেন উইলিয়াম হকিনসকে নিয়ে সুরাটে এসে নামেন। তিনি চার বছর কাটান ইন্ডিয়ায়। তিনি তার ভারত পর্যবেক্ষণের বিস্তারিত বিবরণ লিখে গেছেন। ১৬১০ সালের ১৪ এপ্রিলে সুরাট থেকে এসে আগ্রায় হকিনসের সাথে দেখা করেন। আগ্রা থেকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জন্য নীল কেনার জন্য তিনি বিআনা (Biyana) যান। সেখান থেকে লাহোরে গিয়ে পৌঁছান ১৬১১ সালের ফেব্রুয়ারিতে। তিনি লাহোরে আনারকলির যে কাহিনী শোনেন, তা স্থান পায় তার জার্নালে। ইন্টারনেট সূত্রে পাওয়া ফিঞ্চের জার্নাল থেকে উদ্ধৃতি দেয়া যেতে পারে :

'It is now believed that Anarkali was in her forties or older when she was suspected to having an affair with the heir apparent, Prince Salim, who was then in the thirtieth year of his life and father to at least 3 sons from numerous wives. Salim's father, the otherwise enlightened Emperor Akbar, found out and ordered Anarkali to be buried alive.

Why? Because she was Akbars concubine too, and the mother of 27 year old Danial (Salim's youngest brother). তাহলে ফিঞ্চ বলতে চেয়েছেন আনারকলি ছিলেন আকবরের উপপত্নী এবং আনারকলি ছিলেন সেলিমের সবচেয়ে ছোটভাই ২৭ বছর বয়সী দানিয়েলের মা। ব্রিটিশ পরিব্রাজক লাহোর যান ১৬০৮ সালে। সম্রাট জাহাঙ্গীরের সিংহাসনে বসার তিন বছর পর। তিনি তার জার্নালে লিখে গেছেন : 'The King (Jahangir), in token of his love, commands a sumptuous tomb to be built of stone in the midst of a four-square richly walled, with a gate and diverse rooms on it.

'তার ট্রাভেলস ও তার সহপরিব্রাজকের যে ভ্রমণবৃত্তান্ত ইতিহাসবিদরা খুঁজে পান তাতে লাহোরের আনারকলি সমাধি সম্পর্কে এমনটি বর্ণিত হয়েছে।
আরেকটি বর্ণনা মতে, উইলিয়াম ফিঞ্চ বিআনা থেকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জন্য কেনা নীল বিক্রি করতে লাহোর যান ১৬১১ সালের ফেব্রুয়ারিতে, আনারকলির অনুমিত মৃত্যুর ১১ বছর পর। তার বর্ণনা তিনি লিখে গেছেন সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথমদিকের ইংরেজি ভাষায়। তাতে তিনি নিম্নরূপ তথ্য আমাদের জানান :

In the suburbs of the town, a fair monument for Prince Daniyal and his mother, one of the Akbar's wives, with whom it is said Prince Salim had liaison. Upon the notice of the affair, King Akbar caused the lady to be enclosed within a wall of his palace, where she died. The King Jahangir, in token of his love, ordered a magnificent tomb of stone to be built in the midst of a walled four-square garden provided will a gate. The body of the tomb, the Emperor killed to be wrought in work of gold...

আনারকলি ছিলেন সম্রাট আকবরের হেরেমের এক অনন্যা সুন্দরী নারী। আর তার সুন্দর চেহারায় বিমোহিত হয়েই আকবর তার নাম দিয়েছিলেন আনারকলি। বলা হয় আকবর যখন সেলিম আনারকলির সাথে প্রণয়ের ভার নিয়ে হাসি বিনিময় করতে দেখেন, তখন তিনি আনারকলিকে জীবন্ত সমাধিস্থ করার আদেশ দেন। মধ্যযুগের এ প্রণয়কাহিনী এক আকর্ষণীয় উপাদান হয়ে ওঠে সাহিত্য, লোককাহিনী ও চলচ্চিত্রের। এমনকি আজকের দিনেও ভারতীয়দের মধ্যে এ কাহিনী এক ধরনের রোমান্টিক অনুভূতি হিসেবে ধরা দেয়।

আসলেই এমনটি কি ঘটেছিল? সমূহ সম্ভাবনা যে, হ্যাঁ এমনটি ঘটেছিল। এমনটি ঘটার সবচেয়ে পুরনো রেকর্ড হচ্ছে ইংরেজ বণিক উইলিয়াম ফিঞ্চের জার্নাল, যিনি ভারতে আসেন ১৬০৮ খ্রিষ্টাব্দে। আকবরের মৃত্যুর তিন বছর পর। তিনি ভারতে ছিলেন তিন-চার বছর। এ সময়েই তিনি লাহোরে যান, যেখানে তিনি বলেছেন এই সুন্দর সমাধিটি দেখেছেন। এবং এর বর্ণনাও দিয়ে গেছেন। কিন্তু সমসাময়িক আর কোনো লেখক এ প্রণয়কাহিনীর কথা লিখে যাননি। এর তিন প্রজন্ম পর আওরঙ্গজেবের ধারাবিবরণী লেখক কাফি খান বিষয়টি রেকর্ড করেন।

কিন্তু ইতিহাসের তথ্য মতে, প্রিন্স দানিয়েলের মা মারা যান ১৫৯৬ সালে, ১৫৯৯ সালে নয়। অতএব প্রশ্ন হচ্ছে, উইলিয়াম ফিঞ্চ কি এই মহিলার সঠিক পরিচয় জানতে পেরেছিলেন? না, অন্যের কাছ থেকে তিনি শুনেছেন, তাই তিনি রেকর্ড করে গেছেন?

এবার নজর দেয়া যাক ব্রিটিশ পরিব্রাজক এডওয়ার্ড টেরির দিকে। এডওয়ার্ড টেরি এমএ পাস করেন ১৬১৪ সালে। এরপর তিনি এক গির্জার যাজক হন। তিনি ভারতে এসেছিলেন স্যার টমাস রো’র পারিবারিক যাজক হিসেবে কাজ করার জন্য। তিনি ভারত আসেন উইলিয়াম ফিঞ্চের কয়েক বছর পর। এডওয়ার্ড টেরি লিখেছেন : আনারকলির সাথে সম্পর্কের কারণে আকবর জাহাঙ্গীরকে হুমকি দেন তাকে উত্তরাধিকারী না করার জন্য। কারণ, আনারকলি ছিলেন আকবরের সবচেয়ে প্রিয় স্ত্রী। কিন্তু আকবর মৃত্যুশয্যায় সে সিদ্ধান্ত পাল্টান।

শেষ কথা
ওপরে বর্ণিত তথ্য মতে, আমরা দেখলাম লাহোরে এখনো বিদ্যমান আনারকলি সমাধি। এর পাশেই রয়েছে এশিয়ার প্রাচীনতম বাজার ‘আনারকলি বাজার’। একটা কথা আছে : আগুন ছাড়া ধোঁয়া এমনি এমনি বের হতে পারে না। অতএব বলা যায়, আনারকলি কোনো কল্পচরিত্র নন। ধরে নেয়া যায়, অনন্যা সুন্দরী আনারকলির রূপে যেমনি মজেছিলেন ডেডি আকবর, তেমনি মজেছিলেন সানি সেলিম। আবুল ফজল হয়তো সহজবোধ কারণেই তিক্ত পারিবারিক ঘটনা এড়িয়ে গেছেন আকবরনামায়। এটাও ভাবা যায় না, আকবর গোপন রাস্তা দিয়ে আনারকলিকে সুযোগ করে দিয়েছিলেন, জীবন্ত সমাধিপ্রকোষ্ঠ থেকে বের হয়ে যাওয়ার জন্য। তা ছাড়া বিদ্যমান সমাধিই প্রমাণ করে এখানেই আনারকলি জীবন্ত সমাধিস্থ হয়েছিলেন।


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us