শার্লি চিসম : যেভাবে বদলে দিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রকে

অন্য এক দিগন্ত ডেস্ক | Dec 14, 2020 08:12 am
শার্লি চিসম

শার্লি চিসম - ছবি : সংগৃহীত

 

১৯৭২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে ইতিহাস গড়েছিলেন শার্লি চিসম। সেই প্রথম যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে কোনো প্রধান রাজনৈতিক দলের মনোনয়ন জেতার লড়েছিলেন এক কৃষ্ণাঙ্গ। ১৯৯৫ সালে বিবিসির ফারহানা হায়দার কথা বলেন, কংগ্রেসম্যান চার্লস র‍্যাংগেলের সঙ্গে, যিনি কাজ করেছিলেন শার্লি চিসমের সঙ্গে। ইতিহাসের সাক্ষীর এই পর্বে থাকছে সেই কৃষ্ণাঙ্গ নারী রাজনীতিকের কাহিনী :

১৯৭২ সালে নিউ ইয়র্কের ব্রুকলিনে এক ব্যাপটিস্ট চার্চে তার সমর্থকদের সামনে এসে দাঁড়ালেন এক কৃষ্ণাঙ্গ নারী। কংগ্রেস সদস্য শার্লি চিসম ওই দিন এমন এক ঘোষণা দিলেন, যাতে চমকে গেল যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ।

সমর্থকদের তুমুল করতালিতে ঢাকা পড়ে যাচ্ছিল শার্লি চিসমের ঘোষণা :

"আজ আমি এখানে আপনাদের সামনে দাঁড়িয়েছি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট পদে ডেমোক্রেটিক পার্টির মনোনয়ন চাইতে..."

শার্লি চিসম তার ঘোষণায় বললেন, "আমি কালো আমেরিকানদের প্রার্থী হওয়ার জন্য ভোটে দাঁড়াইনি, যদিও আমি একজন কৃষ্ণাঙ্গ এবং সেজন্যে আমি গর্বিত। আমি এ দেশের নারী আন্দোলনের প্রার্থী নই, যদিও আমি একজন নারী, এবং সেটা নিয়েও আমি সমানভাবে গর্বিত। আমি কোনো রাজনৈতিক প্রভু, কিংবা ধনীদের বা বিশেষ রাজনৈতিক স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর হয়েও নির্বাচনে দাঁড়াইনি। আমি হচ্ছি আমেরিকার জনগণের প্রার্থী। আজকে আপনাদের সামনে আমার উপস্থিতি যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক নতুন যুগের প্রতীক হতে যাচ্ছে।"

এই ঐতিহাসিক ঘটনা এবং শার্লি চিসমের আরও অনেক ঘটনার সাক্ষী ছিলেন সাবেক মার্কিন কংগ্রেসম্যান চার্লস র‍্যাংগেল।

"শার্লি চিসম যেন ছিলেন একটা আগুনের গোলা, এক অসাধারণ মহিলা। তিনি ছিলেন প্রথম আফ্রিকান-আমেরিকান, যিনি বহু তাক লাগানো রাজনৈতিক সাফল্য অর্জন করেছিলেন।"

চার্লস র‍্যাংগেল প্রথম শার্লি চিসমকে দেখেছিলেন ১৯৬০-এর দশকের মাঝামাঝি। তখন চার্লস র‍্যাংগেল নিউ ইয়র্ক রাজ্যসভায় সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন।

"তার সঙ্গে একান্তে দেখা করা কঠিন ছিল। যখনই তার সঙ্গে দেখা হতো, তাকে ঘিরে থাকতো অনেক মানুষ। তিনি ছিলেন খুবই গতিশীল, খুবই বাকপটু। আমি যখন প্রথম তার সাক্ষাৎ পাই, ততদিনে তিনি জাতীয় পর্যায়ে সুপরিচিত এক ব্যক্তিত্ব।"

শার্লি চিসম ছিলেন কংগ্রেসে নির্বাচিত প্রথম আফ্রিকান-আমেরিকান নারী। ১৯৬৮ সালে তিনি কংগ্রেস সদস্য নির্বাচিত হন। রাজনীতিতে নামার আগে তিনি ছিলেন শিক্ষক। তার মা এবং বাবা- দুজনেই ছিলেন ক্যারিবিয়ান। একবার এক সাক্ষাৎকারে তিনি নিজেই জানিয়েছেন দারিদ্রের সঙ্গে লড়াই করে তার বেড়ে উঠার কাহিনী।

"আমার মা এসেছেন বারবাডোস দ্বীপ থেকে। আমার বাবা গায়ানা থেকে। আমি জন্মেছি আমেরিকায়। কিন্তু আমি আসলে বেড়ে উঠেছি ব্রিটিশ ওয়েস্ট ইন্ডিজে। আমার মা বহু বছর কেবল গৃহিনীই ছিলেন। আমার বাবা ছিলেন একটি কারখানার একজন অদক্ষ শ্রমিক। কাজেই বলতে পারেন আমি উঠে এসেছি একেবারে কঠিন দারিদ্র আর বঞ্চনার সঙ্গে লড়াই করে।"

চার্লস র‍্যাংগেল বলেন, যে অবস্থান থেকে উঠে এসে শার্লি চিসম প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হতে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামলেন তার চেয়ে প্রতিকূল অবস্থা আর কিছু হতে পারে না। কারণ একদিকে তিনি কৃষ্ণাঙ্গ, আরেকদিকে তিনি নারী।

"একজন কৃষ্ণাঙ্গ নারী হিসেবে তার ওপর যে পরিমান বোঝা, তার চেয়ে বেশি আপনি আর কারও ওপর চাপাতে পারবেন না, যদি কীনা এই বিষয়গুলো একটি চিন্তা করেন। তিনি বেড়ে উঠেছেন ভিন্ন এক দেশে, অথচ এমন এক সমাজে তিনি প্রতিযোগিতায় নামছেন, যে সমাজ নারীর জন্য সাম্য এবং ন্যায্যতায় মোটেই বিশ্বাস করে না।"

শার্লি চিসম নিজেই বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে এই বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছিলেন, প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য ডেমোক্রেটিক পার্টির মনোনয়ন চাওয়ার ঘোষণা দেয়ার পর।

"আমাকে বলতে হচ্ছে, বিশেষ করে রাজনৈতিক অঙ্গনে, একজন কৃষ্ণাঙ্গ হওয়ার চেয়ে একজন নারী হওয়ার কারণেই বরং আমাকে অনেক বেশি বৈষম্যের মুখোমুখি হতে হয়। কারণ, আমাদের উপলব্ধি করতে হবে যে, কৃষ্ণাঙ্গ পুরুষ এবং শ্বেতাঙ্গ পুরুষ, তাদের মধ্যে কোন তফাৎ নেই, কারণ তারা উভয়েই হোমো-সেপিয়েন্স এবং তারা পুরুষ জাতিরই অন্তর্ভুক্ত। আমাদের দেশের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া এবং প্রশাসনের শীর্ষ স্থানে নারীদের ব্যাপারে এদের উভয়েরই মনোভাব কিন্তু একই রকমের।"

শার্লি চিসম তার প্রচারাভিযানে দরিদ্র মানুষ, সংখ্যালঘু মানুষ, সমকামী এবং নারীদের, এবং যুক্তরাষ্ট্রের অন্যান্য প্রান্তিক মানুষদের স্বার্থকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন।

তিনি বলেছিলেন, "আমাদের সরকারকে যদি প্রকৃত গণতান্ত্রিক সরকার হতে হয়, তাহলে এই সরকারকে সমাজের প্রতিটি অংশের প্রতিনিধিত্বশীল হয়ে উঠতে হবে। আমি মনে করি এদেশের মন্ত্রিপরিষদ, বিভাগীয় প্রধানদের মধ্যে সবার প্রতিনিধিত্ব রাখতে হবে। সেখানে কৃষ্ণাঙ্গদের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, নারীদের রাখতে হবে, ভারতীয়দের রাখতে হবে, তরুণদের রাখতে হবে। সবকিছু সবসময় কেবলমাত্র শ্বেতাঙ্গ পুরুষদের নিয়ন্ত্রণে রাখলে চলবে না। বহু বিচিত্র ধরণের মানুষ নিয়ে আমেরিকা গড়ে উঠেছে। আজকে আমাদের সমাজের একটা বড় সমস্যা কিন্তু এখানেই। আমেরিকায় যে বাদামী রঙের মানুষরা আছে, কালো মানুষরা আছে, যে নারীরা আছে, তাদের মেধাকে আমেরিকা কাজে লাগাচ্ছে না। অথচ এদের মেধা দিয়ে নতুন সৃজনশীলতা, নতুন উদ্দীপনা তৈরি করা যেত, আমেরিকাকে নতুন করে উজ্জীবিত করা যেত।"

চার্লস র‍্যাংগেল বলেন, শার্লি চিসমের ব্যক্তিত্বের একটা বড় বৈশিষ্ট্য ছিল, তার অদম্য প্রাণশক্তি।

"তিনি কখনো হাল ছেড়ে দেননি। যারা মনে করতো তারা সফল হতে পারবে না, তিনি তিনি তাদের জন্য প্রজ্জ্বলিত মশাল হাতে এগিয়ে গেছেন। নিজের দুর্ভোগ নিয়ে তিনি কখনো অভিযোগ করেননি। সব প্রতিকুলতার মধ্যেও মুখের হাসি ধরে রেখেছেন। তিনি ছিলেন যে কোন মানুষের জন্য অনুপ্রেরণা। তিনি ছিলেন শারীরিকভাবে ছোটখাট এক নারী, কিন্তু তিনি তার কাঁধে আর পিঠে গর্বের সঙ্গে বহন করছিলেন বিরাট এক দায়িত্ব। তিনি দেখতে যতই ছোটখাট হোন, তিনি ছিলেন অসম্ভব শক্তিশালী, খুবই গর্বিত এক নারী।"

শার্লি চিসম ডেমোক্রেটিক পার্টির টিকেটের জন্য প্রার্থী হওয়ার কথা ঘোষণার পর শ্বেতাঙ্গ এবং কৃষ্ণাঙ্গ- উভয়ের তরফ থেকে বিরোধিতার মুখে পড়লেন। প্রচারাভিযানে নেমে শার্লি চিসম উপলব্ধি করলেন, তার পেছনে মোটেই সমর্থন নেই। তিনি এবং চার্লস র‍্যাংগেল- তারা দুজনেই ছিলেন কংগ্রেসের কৃষ্ণাঙ্গ সদস্যদের এক ককাস বা রাজনৈতিক গোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। কিন্তু এই ককাসের বেশিরভাগ সদস্য সমর্থন দিল শার্লি চিসমের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের।

চার্লস র‍্যাংগেল জানান, কংগ্রেস সদস্যদের সঙ্গে তার সমস্যা তৈরি হয়েছিল। তিনি যখন এসব কংগ্রেস সদস্যের এলাকায় যাচ্ছিলেন, তখন এরা তাকে সেভাবে স্বাগত জানাচ্ছিল না। শার্লি চিসমের মনে হয়েছিল, তাকে এরা শ্রদ্ধা করছে না।

কংগ্রেসের কৃষ্ণাঙ্গ সদস্যদের যে ককাস, তারা কেন শার্লি চিসমকে সমর্থন দেয়নি?

চার্লস র‍্যাংগেল বলেন, "আমাদের কোন ধারণাই ছিল না যে, শার্লি চিসম যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হওয়ার আকাঙ্খা পোষণ করেন। আমরা যখন বিভিন্ন প্রার্থীকে প্রকাশ্যে সমর্থন জানিয়ে ফেলেছি, তারপর আমরা শার্লি চিসমের কথা জানতে পারি। একই সঙ্গে একজন কৃষ্ণাঙ্গ এবং নারী হওয়াটা নিশ্চয়ই এক বিরাট সুবিধা, কিন্তু সব নারী বা সব কৃষ্ণাঙ্গ কিন্তু তাকে ভোট দেননি।"

শার্লি চিসম কিছু রাজ্যের প্রাইমারিতে বেশ জোরালো সমর্থনই পেয়েছিলেন। মোট ১৫১ জন ডেলিগেটের সমর্থন পান তিনি। এর ফলে তিনি ১৯৭২ সালে মায়ামিতে ডেমোক্রেটিক পার্টির জাতীয় সম্মেলনের মঞ্চ থেকে বক্তৃতা দেয়ার সুযোগ পান। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ডেমোক্রেটিক পার্টির মনোনয়ন তিনি পাননি।

চার্লস র‍্যাংগেল জানান, "তার নির্বাচনী তহবিলটিও ছিল একেবারেই সীমিত। কিন্তু তার মনোবল ছিল সীমাহীন। তার সভাগুলোতে বহু মানুষ আসছিল। এদের অনেকেই পার্টির নিবন্ধিত সদস্য নয়। তারা একধরনের গর্ব অনুভব করছিল শার্লি চিসমকে নিয়ে। কিন্তু আমি আসলেই জানি না, এদের কেউ ভেবেছিল কিনা, যে, শার্লি চিসম যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হওয়ার জন্য প্রাইমারিতে জিততে পারবে। কিন্তু তিনি যুক্তরাষ্ট্রের এমন মানুষদের হয়ে কথা বলছিলেন, যাদের কথা কেউ বলে না, যাদের এরকম একটা জায়গায় যাওয়ার সাহস নেই। সেদিক থেকে বলতে গেলে, শার্লি চিসম ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের আফ্রিকান-আমেরিকানদের জন্য, এবং আফ্রিকান-আমেরিকান নারীদের জন্য, জাতীয় পর্যায়ে একজন পথিকৃত।"

শার্লি চিসম পরে বলেছিলেন, জেতার কোনো আশা নেই, একথা জানার পরও যে, তিনি প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হতে চেয়েছিলেন, তিনি কতটা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ সেটা দেখাতে এবং বিদ্যমান ব্যবস্থা যে তিনি মানেন না, সেটা জানাতে।

চার্লস র‍্যাংগেল জানান, কংগ্রসে সদস্য হিসেবে শার্লি চিসম সবার নজর কেড়েছিলেন তার প্রাণবন্ত উপস্থিতির কারণে।

"শার্লি চিসমের চমৎকার রসবোধ ছিল। কংগ্রেসের ফ্লোরে অনেক সময় যখন একটানা একঘেঁয়ে আলোচনা চলতো, তখন সেখানে তিনি আমাদের সঙ্গে হঠাৎ কৌতুক বলে ভিন্ন রকমের পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারতেন। তিনি সব ধরনের পরিবেশে মানিয়ে নিতে পারতেন। যখন তিনি কংগ্রেস থেকে চলে গেলেন, তখন কিন্তু ডেমোক্রেট এবং রিপাবলিকান, উভয় শিবিরের লোকজনই তার অনুপস্থিতি অনুভব করছিল। কারণ তিনি ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের একজন প্রাণবন্ত সদস্য।"

চার্লস র‍্যাংগেল বলছেন, শার্লি চিসম যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হওয়ার চেষ্টা করেছিলেন, সেটি দেশটির রাজনৈতিক ইতিহাসে এক নতুন যুগের সূচনা করেছিল।

"এটি তিনি কোনো মাত্রায় করেছিলেন, সেটি আমি বলতে পারবো না। কিন্তু আমি জানি, একজন কালো মানুষ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট পদে দাঁড়াতে পারেন কিনা বলে যে প্রশ্ন, সেই প্রশ্ন তোলার সুযোগ তিনি চিরতরে অপসারণ করেছিলেন। যেসব আমেরিকান গায়ের রঙের সঙ্গে বুদ্ধিমত্তার সম্পর্ক খুঁজে পায়, তাদের জন্য তিনি এটা একদম পরিস্কার করে দিয়েছিলেন যে, তাদের এই ধারণার কোন ভিত্তি নেই। যারা তার পদাংক অনুসরণ করেছেন, সে বারাক ওবামাই হোন, বা হিলারি ক্লিনটনই হোন- তিনিই আসলে এই দরজা তাদের জন্য খুলে দিয়েছিলেন।

শার্লি চিসম মারা যান ২০০৫ সালে।
সূত্র : বিবিসি

 


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us