সৌদি সহায়তায় যেভাবে জোরাল হলো ডলার

ড. মো: মিজানুর রহমান | Apr 23, 2022 03:34 pm
পেট্রোডলার

পেট্রোডলার - প্রতীকী ছবি

 

বহু বছর ধরে পৃথিবীতে স্বর্ণের মানের ওপর নির্ধারিত হতো অর্থনীতি ও লেনদেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্র তাদের মিত্র দেশগুলোর কাছে যেসব সামরিক এবং অন্যান্য সরঞ্জাম বিক্রি করেছে সেগুলোর মূল্য পরিশোধ করা হয়েছে স্বর্ণের মাধ্যমে। এর ফলে বিশ্বের মোট রিজার্ভের ৭০ শতাংশ স্বর্ণ চলে যায় আমেরিকার হাতে। অন্যদিকে আমেরিকান ডলারের মূল্য নির্ধারিত ছিল তখন স্বর্ণের ওপর ভিত্তি করে। সে সময় ধনী রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে আমেরিকাই ছিল একমাত্র দেশ যেখানে যুদ্ধের কোনো আঁচড় লাগেনি। এ ছাড়া ইউরোপ তখন যুদ্ধবিধ্বস্ত। যেহেতু তখন পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি স্বর্ণ আমেরিকার কাছে ছিল এবং স্বর্ণের ওপর ভিত্তি করে আমেরিকান ডলার স্থিতিশীল ছিল সেহেতু বিশ্বের ৪৪টি দেশ ব্রেটন উডস এগ্রিমেন্টের মাধ্যমে ডলারকে তাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কারেন্সি হিসেবে রাখতে একমত হয়েছে। সেই থেকে ডলারের আধিপত্য শুরু।

আমেরিকার প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ডলারকে আরো শক্তিশালীভাবে প্রতিষ্ঠিত করার উদ্যোগ নেন। তিনি ১৯৭১ সালে ঘোষণা করলেন, স্বর্ণের ওপর ভিত্তি করে ডলারের মূল্য আর নির্ধারিত হবে না। বিশ্বজুড়ে আমেরিকান ডলারের কর্তৃত্ব ধরে রাখতে এবং চাহিদা বাড়ানোর জন্য ১৯৭৪ সালে সৌদি আরবের সাথে একটি চুক্তি করে আমেরিকা। বিশ্ব বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রণকারী একক মুদ্রা হিসেবে ডলারকে প্রতিষ্ঠিত করার এবং টিকিয়ে রাখার মহৌষধ ছিল ডলারকে পেট্রোডলারে রূপ দিতে পারা। পেট্রোডলার আসলে কোনো ডলার নয়; আবার পেট্রোল নামক দাহ্য পদার্থও নয়। পেট্রোডলার মূলত ডলারের বিনিময়ে পেট্রোল ক্রয়ের চুক্তি যা বাদশা ফয়সাল ও প্রেসিডেন্ট নিক্সনের মধ্যে ১৯৭৪ সালে করা হয়েছে।

এই চুক্তি অনুযায়ী সৌদি আরবকে বাধ্য করা হয়েছে ডলারকে সার্বভৌম বিশ্বমুদ্রা হিসেবে মেনে নিতে। অর্থাৎ পেট্রোল কেবলমাত্র ডলার দিয়েই কেনাবেচা করতে হবে, কোনো দেশীয় মুদ্রা দিয়ে নয়। এর বিনিময়ে আমেরিকা সৌদি বাদশাহকে গ্যারান্টি দেয় যে, যতদিন তারা পেট্রোডলার চুক্তি মেনে চলবে ততদিন সৌদি রাজ পরিবার ক্ষমতায় থাকবে। এ ছাড়াও সৌদি মুদ্রার বিনিময় হার ০১ ডলার = ৩.৭৫ সৌদি রিয়াল বেঁধে দেয়া হয়। অর্থাৎ সৌদি অর্থনীতির যে অবস্থাই থাকুক আমেরিকার হস্তক্ষেপের কারণে ডলার ও রিয়ালের এই হার উঠানামা করে না। সৌদি বাদশাহদের ক্ষমতায় থাকতে আরো একটি শর্ত দেয়, সেটা হলো, ওপেকভুক্ত সব দেশকে রাজি করানো যাতে তারা ডলার ছাড়া অন্য কোন মুদ্রা বা স্বর্ণের বিনিময়ে তেল বিক্রি না করে। উল্লেখ্য, সৌদি ছিল একক সর্বোচ্চ তেল উৎপাদনকারী দেশ। সুতরাং সৌদি আরবের চুক্তির কারণে অন্যান্য তেল উৎপাদনকারী দেশকেও এই চুক্তি মেনে নিতে হয়েছে। সে মাফিক, ১৯৭৫ সালে তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোর সংগঠন, অর্থাৎ অন্যান্য দেশগুলো সৌদি আরবের মতোই সিদ্ধান্ত নেয়। তেল হলো একটি পণ্য যা সব দেশের প্রয়োজন এবং আমদানি করতে হয় মূলত মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে ডলারের মাধ্যমে। ফলে, প্রকারান্তে এর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সব ব্যবসায়-বাণিজ্য যেন ডলার ছাড়া অন্য কোনো মুদ্রায় না চলে তার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে চেয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র; হয়েছেও তাই। আমেরিকা সবসময়ই নিশ্চিত করতে চেয়েছে যেন কোনো দেশ এই ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে না যায়।

ডলারকে পেট্রোলের সাথে সংযুক্ত করায় ডলার বিশ্বমুদ্রা হিসেবে টিকে থাকায় কতটা ভূমিকা রেখেছিল তার একটি ঘটনা এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে। আমরা জানি, একসময় ডলার স্বর্ণের সাথে যুক্ত ছিল। কিন্তু ১৯৭১ সালে মার্কিন দেশে অর্থনৈতিক মন্দা ও মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয়। অনেক দেশ তখন তাদের বাণিজ্যের পরিবর্তে জমা ডলার ভাঙিয়ে স্বর্ণে রূপান্তর করে। তখন রাষ্ট্রপতি রিচার্ড নিক্সন সোনার মান থেকে ডলারকে বিযুক্ত করে দিলেন। কিন্তু স্বর্ণ ও ডলারের বিযুক্তির পরও ডলার বিশ্বমুদ্রা হিসেবে টিকে রয়েছে তেলের দাম ডলারে পরিশোধ করার চুক্তির কারণে। অর্থাৎ ডলার স্বর্ণ থেকে বিযুক্ত হয়ে যুক্ত হলো পেট্রোলিয়ামের সাথে। এর ফলে পেট্রোডলারের জন্ম হয় এবং আন্তর্জাতিক বাজারে ডলারের চাহিদা বৃদ্ধি পেয়ে ডলার অনেক শক্তিশালী অবস্থানে চলে যায়। ডলার হয়ে উঠল মার্কিন টাকশালে ছাপা কাগজ আর পেট্রোলিয়াম মিলে এক ভুতুড়ে কারেন্সি বা আন্তর্জাতিক মুদ্রা।

এই ভুতুড়ে পেট্রোডলার নামক মুদ্রা ব্যবস্থার কারবারের ওপর বিশ্ব ব্যবস্থা দাঁড়িয়ে আছে দীর্ঘ সাত দশকের বেশি সময় ধরে। আন্তর্জাতিক রিজার্ভ কারেন্সি হিসেবে একচেটিয়া রাজত্ব করছে ডলার তথা পেট্রোডলার নামক এই দেশীয় মুদ্রাটি। জ্বালানি তেলের লেনদেনে ডলার ব্যবহারের মাধ্যমে সেই একচেটিয়াত্ব সর্বোচ্চ মাত্রায় উঠেছে। বহুকাল ডলার ছিল মুদ্রার স্থিতিশীলতার সমার্থক। এসবই বিভিন্ন দেশকে ডলারে রিজার্ভ রাখতে উৎসাহ জুগিয়েছে।

ডলারের এই অর্থনৈতিক আভিজাত্যের রাজনৈতিক ফল ভোগ করেছে কেবল যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির শাসকরা বহুবার এ সুবিধাকে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে ভিন্নমতাবলম্বী রাষ্ট্র ও সরকারের বিরুদ্ধে। ইরাক ও লিবিয়া এ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল, তাদের কী ভয়ানক দশা ঘটেছে আমরা সবই এখন জানি।


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us