ডেড সি স্ক্রল : মৃত সাগরের জীবন্ত পুঁথি

অন্য এক দিগন্ত | Apr 14, 2022 01:33 pm
ডেড সি স্ক্রল : মৃত সাগরের জীবন্ত পুঁথি

ডেড সি স্ক্রল : মৃত সাগরের জীবন্ত পুঁথি - ছবি : সংগৃহীত

 

সময়টা তখন ১৯৪৭-এর দিকে। মৃত সাগরের উত্তর-পশ্চিম তীর ঘেঁষে অবস্থিত কুমরান গুহা। এই গুহাতেই পাথর নিক্ষেপ করার খেলায় মত্ত দুই বেদুইন বালক। মেষ চড়ানোর বায়না ধরে প্রায়ই এদিকটায় চলে আসে দুই ভাই মিলে। হঠাৎ বড় একটা পাথর ছোঁড়ার পর অদ্ভুত রকমের শব্দ হলো। প্রথমদিকে তারা মনের ভুল ভেবে উড়িয়ে দিলেও, প্রতিটি পাথর নিক্ষেপের পর একই রকম শব্দ হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল মাটির তৈরি কিছু একটা ভেঙে গেছে। দুই বালক খেলা থেমে চুপ করে দাঁড়িয়ে পড়লো।

বাতাসে ভেসে আসা মৃত সাগরের লোনা গন্ধ আর পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়া বিকেলের সূর্য চারিদিক করে তুলেছিল রহস্যময়। তখনো সন্ধ্যা হতে অনেক দেরি। তাই এই অদ্ভুত শব্দের উৎস জানার জন্য দুজনে মিলে ঢুকে পড়ল গুহার ভেতর।

সেদিন ওই দুই বালকের সাহসী পদক্ষেপ উন্মোচন করে দিলো এক গুপ্ত ইতিহাস। তারা গুহার ভেতর প্রবেশ করে উদ্ধার করলো বড় বড় মাটির পাত্র। পাত্রগুলো উল্টে দিতেই মাটিতে ছড়িয়ে পড়ল অগণিত চামড়ার তৈরি স্ক্রোল। এরকম প্রায় ৭টি বড় পাত্র ভর্তি স্ক্রোল উদ্ধার করলো দুজন মিলে। তখন বাইরের আকাশে সূর্য প্রায় অস্ত যাই-যাই করছে। দুই বালক ছুটে চলে গেল বেদুইন পল্লীর দিকে। চিৎকার করতে লাগলো হাত-পা ছুঁড়ে, 'গুপ্তধন! গুপ্তধন!'

বেদুইন সর্দার সব শুনে রাতটা অপেক্ষা করলেন। পর দিন ভোর হতেই দলে দলে কুমরান গুহাতে হানা দিলেন। উদ্ধার করে নিয়ে এলেন শত শত স্ক্রল। আশেপাশের সব গুহাতে তল্লাশি চালানো যখন শেষ, তখন বেদুইনদের ঝুলিতে স্ক্রলের সংখ্যা ৯০০ ছুঁই ছুঁই করছে। জেরুসালেমে তীর্থের উদ্দেশ্যে অনেক মানুষ জড়ো হতেন। এই খবর চারদিকে ছড়িয়ে গেলে সবাই বেদুইন পল্লীতে ছুটে এলেন। এভাবেই মানবসভ্যতার চোখের আড়াল হয়ে থাকা রহস্যময় ডেড সি স্ক্রল নতুন করে ফিরে এলো আমাদের মাঝে; সাথে নিয়ে এলো এক অজানা ইতিহাস!

ডেড সি স্ক্রল কী?

‘ডেড সি স্ক্রল’ নাম শুনলেই আমাদের চোখে ভেসে উঠে বিখ্যাত মৃত সাগরের ছবি। নামকরণ থেকে মনে হওয়া স্বাভাবিক যে, স্ক্রলগুলো সম্ভবত মৃত সাগর থেকে উদ্ধারকৃত অথবা এর সাথে কোনো যোগসূত্রতা রয়েছে। কিন্তু এই স্ক্রলগুলোর নাম প্রথমদিকে ডেড সি স্ক্রল ছিল না। প্রথমে একে ‘কুমরান গুহার স্ক্রল’ নামে ডাকা হলেও এর অনুসন্ধানস্থল সকল গুহা মৃত সাগরের তীর ঘেঁষে অবস্থিত হওয়ায় এর নাম হয়ে যায় ‘ডেড সি স্ক্রল’।

কুমরান গুহা থেকে অদূরেই অবস্থিত মৃত সাগর দিগন্তের সাথে মিশে আছে।

প্যাপিরাস পাতার তৈরি শক্ত কাগজ এবং বুনো শূকরের চামড়ার উপর গাঢ় কালি দিয়ে লেখা স্ক্রলগুলো গুহার আঁধার থেকে স্থান পেল প্রত্নতাত্ত্বিকদের গবেষণাগারে। ততদিনে এতটুকু জানা হয়ে গেছে যে, স্ক্রলগুলো অতিপ্রাচীন হিব্রু-বাইবেলের পান্ডুলিপি যা হিব্রু, আরমানি আর গ্রিক ভাষায় লেখা হয়েছে। এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত বাইবেলের মধ্যে এই স্ক্রলগুলো প্রাচীনতম।

এখানে জানিয়ে রাখা ভালো, ‘হিব্রু-বাইবেল’ দ্বারা ইহুদি গ্রন্থ তানাখ এর শিপারা এবং খ্রিস্টান ওল্ড টেস্টামেন্টের আনুশাসনিক বাণী সম্বলিত পান্ডুলিপিকে বুঝায়।

তখন এর পাঠোদ্ধারের পাশাপাশি চলছিল নানা জল্পনা-কল্পনা। কে বা কারা এই স্ক্রলগুলো এই গুহাতে লুকিয়ে রেখেছে? কেন রেখেছে? স্ক্রলগুলো কি শুধু হিব্রু-বাইবেলেরই অংশ? নাকি রোমাঞ্চকর কিছু লুকিয়ে আছে এর মাঝে?

প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান

প্রথমদিকে বেদুইনরাই ছিলেন একমাত্র অনুসন্ধানকারী। ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত তারাই সকল স্ক্রল উদ্ধার করেন। বেদুইনদের কাছে স্ক্রলগুলো ছিল আয়-উপার্জনের মাধ্যম। তারা শিক্ষিত না হলেও এতটুকু নিশ্চিত ছিলেন যে, এই ধুলিমাখা ছেঁড়া পান্ডুলিপি তাদের কাছে মূল্যহীন হলেও গণ্যমান্য সাহেবরা চড়াদামে কিনে নেবেন। তাদের এই ব্যবসাতে প্রথম হস্তক্ষেপ করে জর্ডানের প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগ।

তৎকালীন বিভাগীয় প্রধান ল্যাঙ্কেস্টার হার্দিং সকল স্ক্রল জর্ডান সরকারের অধীনে আনার লক্ষ্যে অভিযান পরিচালনা করেন। সরকারি অর্থায়নে অনুসন্ধান পুরোদমে চলছিল। কিন্তু বেদুইনরাও থেমে যাননি। তারাও তাদের অনুসন্ধান অব্যাহত রাখেন।

১৯৫১ থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত জর্ডান সরকারের পক্ষ থেকে ব্যাপক অনুসন্ধান করেন ফরাসি ধর্মযাজক ফাদার রলা দ্য ভুঁ। তিনি সর্বমোট ১১টি গুহা চিহ্নিত করেন এবং এর উৎপত্তিস্থল, মালিকানা সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে গবেষণায় ভূমিকা পালন করেন। ১১টি গুহার মধ্যে ৫টি গুহার বেশিরভাগ স্ক্রলই তখন বেদুইনদের দখলে ছিল। তারা সেগুলো বিভিন্ন দেশের হিব্রু যাজক এবং ইসরাইলিদের কাছে বিক্রয় করে দেন।

এর মধ্যে সিরিয়ান বিশপ মার স্যামুয়েল তার ক্রয়কৃত চারটি স্ক্রল ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে বিক্রয়ের জন্য বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেন। এই বিজ্ঞপ্তি ইসরাইলি সামরিক বাহিনী প্রধান ইয়েগাল ইদিনের নজরে আসে। তার পিতা এল সুকেনিক ছিলেন হিব্রু বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বনামধন্য অধ্যাপক। তিনি ২৫০,০০০ ডলারের বিনিময়ে সেগুলো কিনে নেন। এর পরেই ইসরাইল এবং জর্ডান পৃথক পৃথকভাবে এই স্ক্রল নিয়ে গবেষণায় নেমে পড়ে।

প্রাথমিক প্রশ্নোত্তরের খোঁজে

গবেষকদের প্রথম লক্ষ্য ছিল অতি দ্রুত কিছু প্রাথমিক প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করা। স্বাভাবিকভাবেই তখন সকলের মনে কিছু প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল, কে বা কারা এই স্ক্রলগুলো এখানে রেখে গেল? কখন লেখা হয়েছিল এই স্ক্রলগুলো? কী লেখা আছে সেখানে?

এই সব প্রশ্নের উত্তর বের করার ক্ষেত্রে প্রথম সফলতার মুখ দেখেন ইসরাইলি অধ্যাপক সুকেনিক। তিনি এগুলোর বয়স বের করতে সক্ষম হন। তিনি বলেন, ইহুদিদের ঐতিহাসিক দ্বিতীয় মন্দির যুগে প্রথম লেখা হয় এই স্ক্রলগুলো। তবে অন্য বিজ্ঞানীরা এর সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুললেও পরে সুকেনিকের তথ্য সত্য বলে মেনে নেন সবাই। সেই অনুযায়ী সময়টা খ্রিস্টপূর্ব ২য় শতাব্দী থেকে ১০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। অবাক করা ব্যাপার হলেও সত্য, আধুনিক যুগে কার্বন ডেটিংয়ের ফলাফলও সুকেনিকের অনুমানকে সমর্থন করে।

কিন্তু কারা এই পাণ্ডুলিপিগুলো সংকলন করেছিলেন, এ নিয়ে এখন পর্যন্ত বিতর্কে লিপ্ত আছেন গবেষকরা। অনেকের মতে, রোমান বাহিনীর হাতে কুমরান এলাকা পতনের পূর্বে এখানে বসবাসরত ইহুদিদের দ্বারা এগুলো সংকলিত। তখন ইহুদিদের চারটি বড় গোত্রের মধ্যে ইসেন সম্প্রদায়ের পণ্ডিতরা এগুলো সংকলন করেন বলে ধারণা করা হয়। রোমানদের আক্রমণের পর সেগুলো এই গুহার মধ্যে লুকিয়ে রাখা হয় এবং এটাকে ‘মিনি পাঠাগার’ হিসেবে ব্যবহার করেন ইহুদি ধর্মানুসারীরা।

এছাড়া বাকি গোত্রদেরও বাদ দেয়া হয়নি সম্ভাব্য সংকলকের তালিকা থেকে। আবার অনেকের মতে, এগুলো সকলের সম্মিলিত প্রয়াস। তবে এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট প্রমাণ এখনো মেলেনি।

ইসরাইল বিতর্ক এবং স্ক্রোলের পাঠোদ্ধার

বেদুইনদের ব্যবসার সুবাদে তত দিনে স্ক্রল ছড়িয়ে গেছে বিভিন্ন দেশের গবেষকদের কাছে। যদিও সিংহভাগ স্ক্রল জর্ডান এবং ইসরাইলের হস্তগত ছিল, কিন্তু বাকিরাও হাত গুটিয়ে বসে ছিলেন না। বড় বড় গবেষকরা বিভিন্ন তথ্য উদ্ধার করতে লাগলেন স্ক্রল ঘেঁটে।

তবে সেগুলো একই তথ্য বিভিন্ন রূপে জানানো ছাড়া তেমন কোনো ঝড় তুলতে পারেনি বিশ্ব দরবারে। এক্ষেত্রে ইসরাইলের দিকে তাকিয়ে ছিলেন সবাই।

অপরদিকে ইসরাইলে তখন গবেষকদের মধ্যে প্রশাসনিক কারণে কলহ চলছিল। ড. জন স্ত্রাঙ্গলের নেতৃত্বে হাতেগোণা কয়েকজন গবেষক ছাড়া আর কেউ স্ক্রল নিয়ে কাজ করার অনুমতি পাননি। এমনকি স্ক্রল সম্পর্কিত আলোকচিত্র প্রদর্শনের ক্ষেত্রেও ছিল কড়াকড়ি। ১৯৭৭ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গেজা ভারমেস এটাকে বিশ শতাব্দীর সবচেয়ে বড় একাডেমিক কেলেঙ্কারি বলেন।

তৎকালীন শীর্ষ গবেষক হার্শেল শ্যাঙ্কস প্রায় তিন দশক ধরে এ নিয়ে আইনি লড়াই করেন। দীর্ঘদিনের লড়াই শেষে ১৯৯১ সালে ইসরাইলের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগীয় প্রধান ইমানুয়েল তভ সর্বপ্রথম স্ক্রল গবেষণার ফল এবং পাণ্ডুলিপি অন্যান্য দেশের বিজ্ঞানীদের জন্য উন্মুক্ত ঘোষণা করেন।

এরপর ঝিমিয়ে পড়া গবেষকদের মধ্যে নতুন করে উদ্দীপনা দেখা গেল। কাজে লেগে পড়লেন সবাই। অত্যাধুনিক প্রযুক্তির বদৌলতে দ্রুত বেশিরভাগ পাণ্ডুলিপির পাঠ পুনরোদ্ধার সম্ভব হলো। এক এক করে প্রকাশিত হতে থাকল সকল স্ক্রলের মার্জিত পাণ্ডুলিপি।

সমস্ত পাণ্ডুলিপিকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়- বাইবেলিক এবং নন-বাইবেলিক। এর মধ্যে ১০ কপি ঈসায়ী, ৩০ কপি শামের কিতাব এবং ২৫ কপি দ্বিতীয় বিবরণ সম্পর্কিত হিব্রু দলিল রয়েছে। গবেষকদের মতে, স্ক্রলগুলো মূলত হিব্রু বাইবেলের পান্ডুলিপি হলেও সম্পূর্ণ বাইবেলের The Book of Esther অধ্যায়ের কোনো পান্ডুলিপি এর মাঝে খুঁজে পাওয়া যায়নি।

নতুন টেস্টামেন্টের ঈসায়ী থেকে এগুলো ১০০০ বছর পুরাতন। তবে যিশুখ্রিস্টের আগমনবার্তা সম্পর্কিত জশুয়ার ভবিষ্যদ্বাণী হিব্রু শামের কিতাবে রয়েছে, যা এর আগে কোথাও দেখা যায়নি। ওল্ড টেস্টামেন্টের অনেক দূর্লভ ও হারিয়ে যাওয়া তথ্য এই স্ক্রলের মাধ্যমে জানা সম্ভব হয়েছে। এ থেকে অনেকে ধারণা করেন, খ্রিস্টধর্মের শুরু হয়েছে এই স্ক্রলগুলোর মাধ্যমে। তবে এই বিষয়ে দীর্ঘদিন যাবৎ বিতর্ক চললেও সঠিকভাবে কোনো কিছু জানা যায়নি।

আর নন-বাইবেলিক অংশে বিভিন্ন আইন-কানুন, রীতিনীতি, ব্যবসায়িক কাগজপত্র এবং কিছু ব্যক্তিগত পুঁথি রয়েছে। গবেষকদের মতে, কুমরান গুহার বিরানভূমি আগে ঠিক এরকম ছিল না। এখানে বড় সম্প্রদায় বাস করত। কুমরান নামে গোটা একটা সভ্যতার অস্তিত্বের কথা জানা যায় স্ক্রল থেকে।

এছাড়া ১৬টি সামরিক চিঠিপত্র পাওয়া যায়, যেগুলো বার কুখবা নামে পরিচিত। ‘বাবাথা’ নামক এক ইহুদির ব্যক্তিগত নথি সম্বলিত কয়েকটি পাণ্ডুলিপিও পাওয়া যায়। নব্যপ্রস্তর যুগের বিভিন্ন হাতিয়ারের অংশবিশেষও উদ্ধার করা হয় বলে জানান গবেষকরা।

প্রায় ৪০ ভাগের মতো স্ক্রল থেকে পাঠোদ্ধার করা অসম্ভব বলে জানান ইসরাইলি গবেষকরা। ১৯৯১ সালের নভেম্বর মাসে Biblical Archaeological Society প্রথমবারের মতো পাণ্ডুলিপি বিষয়ক প্রদর্শনীর আয়োজন করে। তবে ১৯৯৪ এর শেষের দিকে ইসরাইলি পুরাতত্ত্ববিদরা পরীক্ষার মাধ্যমে কিছু গ্রিক পাণ্ডুলিপি কুমরান সম্প্রদায় বহির্ভূত বলে নিশ্চিত হন। তবে সেগুলো ঠিক কোন উদ্দেশ্যে সেখানে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল, তার উত্তর এখনো বের করা সম্ভব হয়নি।

ইসরাইল প্রদত্ত ছবি নিয়ে হান্টিংটন লাইব্রেরি কর্তৃপক্ষ প্রথম কম্পিউটার অ্যানালাইসিস সম্পাদন করেন। এর মাধ্যমে দুর্বোধ্য অনেক পাণ্ডুলিপির নিখোঁজ অংশের সম্ভাব্য পাঠোদ্ধার সম্পন্ন করা হয়।

ডেড সি স্ক্রলের পাঠোদ্ধারের মাধ্যমে ওল্ড টেস্টামেন্টের অনেক অজানা তথ্য বেরিয়ে আসে, যা র‍্যাবাই তত্ত্ব এবং জুডাতত্ত্বের নতুন দিক উন্মোচন করে। যিশুখ্রিস্টের আগমন এবং প্রাথমিক খ্রিস্টান ধর্মের অনেক অজানা তথ্যও জানা যায়। প্রাচীন ইহুদি ধর্মের সাথে খ্রিস্টানদের ওল্ড টেস্টামেন্ট এর সূক্ষ যোগসূত্রতাও পাওয়া যায় এগুলো থেকে।

রহস্যময় কপার স্ক্রোল এবং গুপ্তধনের সন্ধান

ধর্মীয় স্ক্রোলগুলো ইসরাইলিদের হাতে থাকলেও সবচেয়ে রহস্যময় স্ক্রল তখন জর্ডানিদের হস্তগত ছিল। অন্যান্য স্ক্রলের মতো তা প্যাপিরাস পাতা বা চামড়ার উপর লিখিত ছিল না। সেটা লেখা হয়েছিল তামার তৈরি পাতের উপর। যাকে ইতিহাসবিদরা The Copper Scroll নামে চেনেন।

একে পাণ্ডুলিপি বললেও ভুল হবে। কারণ এর মাঝে লেখার সাথে আছে খোদাই করা কয়েকটি মানচিত্র। আসলে এটা ছিল একাধিক গুপ্তধনের নকশা। ১৯৫২ সালে অনুসন্ধান অভিযানের সময় এক জর্ডানি পুরাতত্ত্ববিদ ৩ নং গুহার ভেতর থেকে এটি উদ্ধার করেন।

জর্ডান সরকার তখন কড়া নিরাপত্তায় স্ক্রলটিকে ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অ্যালেগ্রো-এর কাছে প্রেরণ করে। অ্যালেগ্রো পরীক্ষার মাধ্যমে বুঝতে পারেন স্ক্রলটি একটি গুপ্তধনের মানচিত্র। তিনি তৎক্ষণাৎ স্ক্রলের রহস্য সমাধানে লেগে যান। পরে জর্ডান সরকারের নির্দেশে ১৯৬০ সালে অ্যালেগ্রোর গবেষণার ফলাফল জার্নাল আকারে প্রকাশ করা হয়।

অ্যালেগ্রোর জার্নালে ঢুঁ মেরে জানা যায় যে, স্ক্রলে মোট ৬৩টি স্থানের নির্দেশনা রয়েছে। স্ক্রলের ভাষ্যমতে সেগুলো সোনা আর রুপা বোঝাই করা কুঠুরি, যার সর্বমোট পরিমাণ কয়েক টনের কাছাকাছিও যেতে পারে। স্ক্রলটি যেন বছরের পর বছর টিকে থাকে সেজন্য এটা তামার পাতের উপর লেখা হয় বলে জানান অ্যালেগ্রো।

স্ক্রলের নির্দেশনায় স্পষ্টাকারে স্থানগুলোর বর্ণনা দেয়া হয়েছে। কপার স্ক্রোল থেকে হুবহু অনুবাদ করা আলোচিত একটি লাইন তুলে ধরলাম, “যেখানে লবণের স্তূপ, সেখান থেকে প্রথম সিঁড়ির নিচে চার হাত গভীরে ৪১ টালি রূপা”।

আপাতদৃষ্টিতে আমাদের কাছে সহজ মনে হলেও গুপ্তধনের সন্ধান পাওয়া এত সহজ নয়। কারণ, মানচিত্রের এসব নির্দেশনা তখনকার গুহাবাসীদের জন্য লেখা হয়েছিল। কেউ নিজের ঘরের মতো গুহাগুলোকে না চিনলে, তার পক্ষে এই অবস্থানগুলো বের করা প্রায় অসম্ভব। তাই, এখনকার কারো জন্য এত সহজ নয় এর সন্ধান করা। উপরন্তু স্ক্রল মোতাবেক গুপ্তধনের প্রথম অবস্থানের সাথে বাকিগুলোর যোগসূত্র রয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত সেই প্রথম অবস্থানই বের করা সম্ভব হয়ে উঠেনি

তবে অধিকাংশ ইতিহাসবিদের মতে, দুই হাজার বছর আগেই রোমানরা হয়তো সকল গুপ্তধন লুট করে ফেলেছেন। এর পক্ষে প্রমাণও দিয়েছেন অনেকেই। কিন্তু এই প্রমাণ কি আর অনুসন্ধান থামাতে পারে! এখনো সবধরনের সূত্র নিয়ে পরীক্ষা করে যাচ্ছেন পুরাতত্ত্ববিদরা।

আর এই মহামূল্যবান কপার স্ক্রল নিয়ে সাহিত্যকরাও মনের মাধুরী মিশিয়ে আপন কল্পনার মাধ্যমে রোমাঞ্চকর অভিযান পরিচালনা করে রচনা করেছেন বেশ কিছু উপন্যাস। এর মধ্যে Nathaniel Norsen Weinreb-এর The Copper Scroll এবং Lionel Davidson-এর A long way to Shiloh বিখ্যাত।

মালিকানা বিরোধ

প্রথমদিকে ধর্মীয় স্ক্রল মনে হলেও কপার স্ক্রলের সন্ধান আরো রোমাঞ্চকর রহস্যের হাতছানি দিচ্ছে ইতিহাসবিদদের। এরই জের ধরে ১৯৬৭ সালে আরব-ইসরাইল যুদ্ধের সময় ইসরাইল জর্ডান থেকে প্রায় ১৫০০-এর মতো স্ক্রোল নিজেদের দখলে নিয়ে নেয়। ইসরাইলের রকফেলার জাদুঘরে কড়া নিরাপত্তায় শুরু হয় গবেষণা।

সবচেয়ে বড় বিতর্ক শুরু হয় যখন ইসরাইল স্ক্রলগুলোর অনুবাদ প্রকাশ করতে দীর্ঘ ৪০ বছর বিলম্ব করে। এদিকে জর্ডান সরকারও বসে থাকেনি। তারাও বরাবরই জর্ডানকে স্ক্রলগুলোর বৈধ মালিক হিসেবে দাবি করে আসছে।

বর্তমানে জর্ডানের দখলে রয়েছে কপার স্ক্রোলসহ মাত্র ২৫টি স্ক্রোল! এছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফিলিস্তিন, কানাডা এবং সিরিয়ার বিভিন্ন গবেষণাগার এবং প্রতিষ্ঠানের নিকট বেশ কয়েকটি স্ক্রল হস্তগত আছে।

অপরদিকে সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা নীতির ২৩৩৪ অনুশাসনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র Veto প্রদান না করায়, ইসরাইল স্ক্রলগুলোর অধিকার হারাতে পারেন বলে মনে করেন টাইমস অফ ইসরাইলের বিশেষজ্ঞরা। তবে স্ক্রলের ব্যাপারে ইসরাইলের মাত্রাতিরিক্ত গোপনীয়তা ব্যাপারটিকে রহস্যময় করে তুলেছে।

২০১০ সালে জর্ডান সরকার কানাডায় ইসরাইল আয়োজিত স্ক্রল প্রদর্শনী বয়কট করে এবং সেগুলো পুনরায় দখলে নেয়ার সংকল্প জানায়। বর্তমানে জর্ডান, ইসরাইল, ফিলিস্তিন, কানাডা এবং সিরিয়া স্ক্রলগুলোর মালিকানার বিষয়ে স্নায়ুযুদ্ধে লিপ্ত আছে, যা সমাধা হওয়ার কোনো সম্ভাবনা দেখেন না বিশেষজ্ঞরা।

টাইম ম্যাগাজিনের মতে, ডেড সি স্ক্রল ইতিহাসের অন্যতম সেরা অনুসন্ধান। রাজনৈতিক বিরোধ এবং মধ্যপ্রাচ্যের বিষফোঁড়া খ্যাত ইসরাইলের অতিমাত্রায় গোপনীয়তার কারণে উন্মুক্ত বিশ্ব বঞ্চিত হচ্ছে অজানা সব রোমাঞ্চকর তথ্য থেকে।

২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইসরাইল অনুসন্ধানকারী দল ১২ নম্বর গুহার সন্ধান পান বলে দাবি করেন। এর মাধ্যমে গবেষণায় এক নতুন সম্ভাবনার দেখা দেয়। কিন্তু এ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করেননি কর্তৃপক্ষ

যতই দিন গড়াচ্ছে, ততই ঘনীভূত হয়ে পড়ছে রহস্য। তথ্যপ্রযুক্তির অবাধ বিচরণের যুগে ইসরাইলের এরূপ মনোভাব নিন্দাজনক। তবে আশা করা যায়, ভবিষ্যতে কোনো তৃতীয় পক্ষের হস্তক্ষেপে হয়তো এই সমস্যার সমাধান হবে এবং বিশ্বদরবারে উন্মোচিত হবে স্ক্রলের রহস্য।

তথ্যসূত্র : কোরা


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us