যেভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ইসরাইল

ড. এ কে এম আজহারুল ইসলাম | May 21, 2021 02:12 pm
ইসরাইলের মানচিত্র

ইসরাইলের মানচিত্র - ছবি : সংগৃহীত

 

নিউইয়র্ক টাইমসের সাংবাদিক কিংসলে ইসরাইল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে এবার রমজান মাসের প্রথম রাত ১৩ এপ্রিল শুরু হওয়া সঙ্ঘাতের কারণ জানিয়েছেন। জেরুসালেমের বিখ্যাত আল-আকসা মসজিদে ঢুকে পড়ে ইসরাইলি পুলিশের একটি দল। তারা কেটে দেয় মসজিদের লাউড স্পিকারের তারগুলো। ওই দিন ছিল ইসরাইলের ‘মেমোরিয়াল ডে’। মসজিদের কাছাকাছি ওয়েস্টার্ন ওয়ালে ইসরাইলি প্রেসিডেন্টের বক্তব্য দেয়ার কথা। আজানের কারণে ইসরাইলি প্রেসিডেন্টের বক্তব্যে বিঘ্ন ঘটতে পারে, তাই তার কেটে দেয়া হয়। জেরুসালেমের গ্র্যান্ড মুফতি শেখ একরিমা সাবরির মতে, সংঘর্ষের শুরুটা ওই ঘটনা থেকেই। ‘আগুনে ঘি’ ঢেলেছিল আল-আকসা মসজিদে পুলিশের এই অভিযান। কেবল আল-আকসা মসজিদে পুলিশের অভিযানের কারণেই নয়, ফিলিস্তিনি ছয় পরিবারকে বাড়ি থেকে উৎখাত করার পর তরুণ ফিলিস্তিনিরা বিক্ষোভ করেছিলেন।

অবরুদ্ধ ছিটমহলে ফিলিস্তিনিরা রমজান শেষে বৃহস্পতিবার সকালে জেগে উঠতে যাচ্ছে ঈদ পালনের জন্য। আর তখনই ইসরাইলি জঙ্গি বিমান গাজা উপত্যকার উঁচু টাওয়ার ভবন এবং অন্যান্য লক্ষ্যবস্তুতে প্রচণ্ড বিমান হামলা চালায়। হামাসও রকেট ছুড়ছে। শনিবার ইসরাইলি বাহিনী গাজায় ১৩ তলা একটি ভবন গুঁড়িয়ে দেয়। ওই ভবনে বার্তা সংস্থা এপি এবং কাতারভিত্তিক টেলিভিশন চ্যানেল আলজাজিরার কার্যালয় ছিল। একই দিনে গাজার পশ্চিমাঞ্চলে শরণার্থীশিবিরেও হামলা চালায় ইসরাইল। এতে এক পরিবারের ১০ সদস্য নিহত হয়েছে। গুরুতর আহত হয় পাঁচ মাসের এক শিশু। প্রায় প্রতিদিনই ঘটছে এমন ঘটনা। রয়টার্সের হিসাব অনুযায়ী, সংঘর্ষে ১৬ মে পর্যন্ত ১৪৮ জন নিহত হয়েছে। তাদের মধ্যে ৪১টি শিশুও রয়েছে। আহত আরো এক হাজারের বেশি লোক।
ইসরাইল সরকার আধিপত্য বজায় রাখতে একের পর এক হামলা চালিয়ে যাচ্ছে- বিশ্লেষকদের মন্তব্য। আর ইসরাইলের চোখে সন্ত্রাসী দল হামাস ফিলিস্তিনি আন্দোলনে নিজেদের অবস্থান পাকাপোক্ত করতে চাইছে। ইসরাইল প্রতিষ্ঠার আগে থেকেই এই উত্তেজনা ছিল। তবে প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু তার দীর্ঘ শাসনামলে এই উত্তেজনাকে জিইয়ে রেখে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পূরণ করে চলেছেন।

ইসরাইল রাষ্ট্র কিভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল দেখা যাক। ব্রিটিশ বাহিনী প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় (১৯১৪-১৯১৮) তুরস্কের অটোমান সাম্রাজ্য দখল করে নেয় এবং এটিকে কয়েকটি রাজনৈতিক অঞ্চলে বিভক্ত করে। ১৯১৭ সালে বালফোর ঘোষণার পরে উপনিবেশবাদীরা ফিলিস্তিনে রাষ্ট্রবিহীন ইউরোপীয় ইহুদিদের বসতি স্থাপন করতে সহায়তা করে। ফলে ৯০ শতাংশ মুসলিম এবং মাত্র ৩ শতাংশ ইহুদি অধ্যুষিত ফিলিস্তিনের বাস্তবতাকে নির্মমভাবে উপেক্ষা করা হয়। পশ্চিমা শক্তি দ্বারা দখলকৃত ভূমি বা অঞ্চল ইউরোপীয় ইহুদিদের দেয়া হলো। প্রকৃতপক্ষে এভাবে ফিলিস্তিনিরা বঞ্চিত হয়েছে। অধিকৃত অঞ্চলে ইউরোপীয় ইহুদিদের (পরবর্তীকালে সব ইহুদি) স্থানান্তরিত করার সময় লাখ লাখ লোককে তাদের পৈতৃক বসতভিটা এবং সম্পত্তি থেকে বিতাড়িত করা হয়। ঘোষণাপত্র এবং এর কার্যকরকরণ দ্বারা ফিলিস্তিনি জনগণকে ঠকানো মধ্যপ্রাচ্যে বর্তমান সঙ্ঘাতের কারণ, যা গত সাত-আট দশক ধরে চলছে।


ইউরোপীয় খ্রিষ্টান ক্রুসেডার এবং নাৎসিদের দ্বারা সেখানকার ইহুদিদের ওপর অত্যাচারের কারণে সৃষ্ট সহানুভূতির ফলাফল ফিলিস্তিনে ইহুদি রাষ্ট্রের জন্ম। পরবর্তীতে ১৯৬৭ সালে ইসরাইল বেশ কয়েকটি আরব দেশ, জেরুসালেম, সিরিয়ার গোলান হাইটস এবং মিসরের সিনাই উপদ্বীপসহ বেশ কয়েকটি আরব দেশের বিশাল অঞ্চল দখল করে। ফিলিস্তিনিদের সাথে ইসরাইলের আচরণ সম্পর্কিত জাতিসঙ্ঘের সুরক্ষা কাউন্সিলের ৬৯টি প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছে। ইসরাইলের জন্মের পর থেকে আমেরিকা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং শীতল যুদ্ধের পর সবচেয়ে শক্তিশালী জাতি হওয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যের নীতি রূপায়ণ করছে যেখানে ফিলিস্তিনিদের অধিকারকে অমানবিকভাবে উপেক্ষা করা হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে।

১৯৬৭ সালের যুদ্ধে ইসরাইলিরা পূর্ব জেরুসালেম দখল করে নেয়। এরপর থেকে তারা জেরুসালেমকে তাদের ‘রাজধানী’ বলে গণ্য করে। কিন্তু এর কোনো আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি নেই। ফিলিস্তিনিরা চায় ১৯৬৭ সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধের আগে যে সীমান্ত ছিল, সেই সীমানার ভিত্তিতে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠিত হবে। ইসরাইল এটা মানতে নারাজ।

১৯৬৭ সালের যুদ্ধে ইসরাইল যেসব ফিলিস্তিনি এলাকা দখল করে নিয়েছিল, সেখানে তারা অনেক ইহুদি বসতি গড়ে তুলেছে। আন্তর্র্জাতিক আইনে এসব বসতি অবৈধ। কেবল পশ্চিম তীর এবং পূর্ব জেরুসালেমেই এমন বসতি গড়েছে পাঁচ লাখের বেশি ইহুদি। ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর সেখান থেকে বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে এসেছিল লাখ লাখ ফিলিস্তিনি। তারা ইসরাইলের ভেতর তাদের বাড়িঘরে ফিরে যাওয়ার অধিকার দাবি করে আসছে। কিন্তু ইসরাইল এই অধিকারের স্বীকৃতি দিতে চায় না।

ইসরাইল রাষ্ট্রের জন্মলাভের পর চরমপন্থী ইহুদিদের সন্ত্রাস বন্ধ হয়নি। অদ্যাবধি মাতৃভূমি থেকে বিতাড়িত ফিলিস্তিনিদেরই আক্রমণের লক্ষ্য করা হচ্ছে। নিজ ভূমি থেকে বিতাড়িত ও অধিকারহীন ফিলিস্তিনিদের ওপর পৌনঃপুনিক ইসরাইলি মিসাইল আর বিমান হামলা কিংবা ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামীদের আত্মঘাতী বোমা হামলায় বেসামরিক লোকজনই বেশি হতাহত হয়েছে। এখানে প্রথমোক্তটি রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সন্ত্রাস এবং পরেরটি ব্যক্তি বা গোষ্ঠী কর্তৃক সন্ত্রাসী ঘটনা।

বিশ্ব মোড়ল আমেরিকার কারণে জাতিসঙ্ঘও বহু বছর ধরে ঘটা এসব হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ থামাতে পারেনি। আরব নিউজের মতে, বুশ প্রশাসন থেকে শুরু করে সবাই আজ অবধি ‘আত্মরক্ষার অধিকার’-এর দোহাই দিয়ে ইসরাইলের সব অপকর্মকে অন্ধভাবে সমর্থন করছে। আবার এ ধরনের কাজ অন্য কোনো দেশ করলে তাদের নিন্দা জানাতে যুক্তরাষ্ট্র খুবই উচ্চকণ্ঠ। কিন্তু ইসরাইলের জন্য বিবেচনার পরিপ্রেক্ষিত ভিন্ন। ইসরাইলের সব অপরাধের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র চরম ভণ্ডামির পরিচয় দিয়ে এসেছে নির্বিকারভাবে। ফলত পৃথিবীর অগণিত মানুষ যুক্তরাষ্ট্রকে অবিশ্বাস ও ঘৃণা করে। এতে বিস্ময়ের কিছু নেই যে, মানুষ এখন ইসরাইল ও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসকে সমার্থক মনে করে। গাজায় পরিচালিত কঠিন অত্যাচার অবশ্যই রাজনৈতিক উদ্দেশে প্রণোদিত সন্ত্রাস।


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us