নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় আদৌ ছিলো কি?

জি.মোস্তফা | May 22, 2021 06:06 pm
নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়

নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় - ছবি সংগৃহীত

 

জান্নাতুল ফেরদৌস আলিজা কী সুন্দর আবেগময় ভাষায় লিখেছেন, 'পশ্চিমারা মধ্যযুগের যে সময়টাকে অন্ধকারযুগ (৪৭৬ খ্রিস্টাব্দ-১৪৯২ খ্রিস্টাব্দ) বলে অভিহিত করে থাকেন ঠিক সেই সময় আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশের জ্ঞানের দ্যুতি ছড়ানোর সূর্য ছিল নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়। এখনকার ছাত্রদের যেমন স্বপ্ন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়, হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয়-এ পড়াশোনা করা ঠিক সেই সময়ের ছাত্রদের স্বপ্নচোখ ছিল আমাদের নালন্দা। জাপান, ইরান, ইন্দোনেশিয়া, মঙ্গোলিয়া, গ্রিস, তিব্বত, চীন, কোরিয়া, মধ্য এশিয়া হতে পণ্ডিত ও ছাত্রদের এক বিরাট সমাগম ছিল এই নালন্দা। প্রায় দুই হাজার শিক্ষক এবং দশ হাজার ছাত্রের এক বিশাল জ্ঞান চর্চার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছিল নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়। পৃথিবীর বুকে গড়ে ওঠা প্রথম আবাসিক আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয় ছিল নালন্দা যেখানে তিন হাজার ছাত্রের থাকা-খাবার এর সুব্যবস্থা ছিল।'

এখন আমার প্রশ্ন হচ্ছে সত্যিই কি নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল? উত্তর হচ্ছে, না। কখনোই নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্তিত্ব ছিলো না। তাহলে এই মিথ্যা ইতিহাস তৈরি করলো কে? ইংরেজরা তৈরি করেছে।

কেন তৈরি করেছে? তারা ভারতবর্ষ দখল করার পর আর্য আগমনের তত্ত্ব আবিষ্কার করলো,আর্যরা ভারতবর্ষে এসেছিলো ইউরোপ থেকে আর স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন, 'Only Hindus are Aryans, হিন্দু ছাড়া কেউ আর্য নয়"। কাজেই এখন ইংরেজদের ভারত শাসনের ন্যায়সঙ্গত অধিকার রয়েছে। যাতে ভারত বর্ষকে উন্নত দেশে পরিণত করতে পারে। তাদের যুক্তি ছিলো মুসলিম শাসকরা ভারতের ইতিহাস ঐতিহ্যকে বিলীন করে দিয়েছে। এখানে এই ছিলো সেই ছিল, সিন্ধু সভ্যতা ছিল , উন্নত শিক্ষাব্যবস্থা ছিলো, বিজ্ঞান চর্চার ব্যবস্থা ছিল। এমনকি এই কাল্পনিক নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংসের ব্যাপারেও ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজির বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়। এগুলোকে আবার জাগিয়ে তুলতে হবে, মানে রেনেসাঁ ঘটাতে হবে। এই যে শুরু হলো ব্রিটিশদের মিথ্যাচার। কোটি কোটি টাকা খরচ করে তারা তথাকথিত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন আবিষ্কার করল। যেখানে তারা মাটি খনন করল সেখানেই পেল, পিতলের মূর্তি, শিবলিঙ্গ, সিন্ধু সভ্যতার বিভিন্ন নিদর্শন ইত্যাদি।

ইতিহাসবিদ গোলাম আহমাদ মোর্তজা এই চিত্রটি এভাবে তুলে ধরেছেন, 'প্রত্নতাত্ত্বিকেরা কোদাল শাবল
খুরপী চালালেই ছুঁ মন্ত্রে সব হাজির হয়ে যায় কেন? ওঁরা কি জাদুমন্তর জানেন? দেখেশুনে মনে হয় প্রত্নতাত্ত্বিকেরা বুঝি সত্যিই ম্যাজিক জানেন, না হলে ঐ ঐতিহাসিক যুগের ঢিবিঢাবা খুঁজতে গেলেই রাজ্যের শিলালিপি, অফুরন্ত প্রত্নমুদ্রা, দু চারটে বিষ্ণু মূর্তি কিংবা শিবলিঙ্গ কেন বেরিয়ে আসে? কোথাও বা ধ্যানমুগ্ধ বুদ্ধ কোথাও বা হস্তমুদ্রায় কিঞ্চিত পার্থক্যযুক্ত মহাবীরের স্ট্যাচুই বা কেন বেরিয়ে পড়ে?'

এমনকি সিন্ধু সভ্যতার যে সব নিদর্শন কলকাতা মিউজিয়ামে আছে, তাতে বিন্দুমাত্র প্রাচীনত্বের ছোঁয়া নেই। বরং ওগুলো ছিলো সিরামিক শিল্পের প্রাগ্রসর আধুনিক ইউরোপের কোনো দেশে তৈরি অর্ডারি জিনিস। প্রকৃতপক্ষে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাহিনীটাও পুরোপুরি বানোয়াট। তা ছাড়া অনেক ইতিহাসবিদ লিখেছেন নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ইউনিভার্সিটির মানে মানোত্তীর্ণ ছিলো না। সেখানে একটি উপসনালয় ছিল মাত্র।

জান্নাতুল ফেরদৌস আলিজার লেখায়ও কিন্তু তারই স্পষ্ট আভাস পাওয়া যাচ্ছে। তিনি লিখেছেন, 'বর্তমান ভারতের, বিহারের রাজধানী পাটনা হতে ঠিক ৫৯ মাইল দক্ষিণ-পূর্বে বিখ্যাত মৌর্য সম্রাট অশোক খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকে নালন্দাতে প্রথম ধর্মীয় উপাসনালয় গড়ে তোলেন যা পরে বৌদ্ধ তীর্থস্থান হয়ে ওঠে। এর পরে ৪২৭ খ্রিস্টাব্দে, বৌদ্ধরাজা কুমারগুপ্তের পৃষ্ঠপোষকতায় নালন্দা মহাবিহার গড়ে ওঠে।'

আসলে নালন্দা সর্বোচ্চ এক মহাবিহারই ছিলো বটে,কখনোই তা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল না।
আলিজা পরে যা লিখেছেন তা ইতিহাসের নির্জলা মিথ্যাচার। তিনি লিখেছেন, 'ধর্মচর্চায় শুরু হলেও পরবর্তীতে ন্যায়শাস্ত্র, ইতিহাস, রাজ্যশাসনবিদ্যা, মনোবিজ্ঞান, চিকিৎসাবিদ্যা, ব্যাকরণ ও ভাষাতত্ত্ব, যুক্তিবিদ্যা, জাদুবিদ্যা, ধনুর্বিদ্যা, জ্যোতির্বিদ্যা, বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয় চর্চায় আস্তে আস্তে এটি আধুনিক উচ্চশিক্ষার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে। নালন্দাতে বিখ্যাত শিক্ষকের মধ্যে আর্যভট্ট (শূন্য সম্পর্কে সর্বপ্রথম ধারণা দেন), শীলভদ্র, নাগার্জুন, ধর্মকীর্তি, জীবক, পাণিনি, কুটিলা, বিষ্ণু শর্মা, অতীশ, ছিলেন অন্যতম। বিখ্যাত চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাং সম্পর্কে আমরা সবাই জানি। তিনি ছিলেন শীলভদ্রের ছাত্র। তিনি ভারত পর্যটন করেন ৬৩০ থেকে ৬৪৩ খ্রিস্টাব্দের মধ্যবর্তী সময়ে যখন নালন্দার পৃষ্ঠপোষক ছিল রাজা হর্ষবর্ধন। হিউয়েন সাং ও ফা-হিয়েন (খ্রিস্টীয় ৫ম শতাব্দীতে নালন্দায় আসেন) এর লেখায় নালন্দা সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য পাওয়া যায়।'

তিনি আগ বাড়িয়ে আরো তুলে ধরেছেন, 'হিউয়েন সাং ও ফা হিয়েন এর ভ্রমণকাহিনী পড়ে আর এক চীনা ভিক্ষু ইৎসিং নালন্দাতে সংস্কৃত শিখতে আসেন। ইৎসিং দশ বছর নালন্দায় অতিবাহিত করার পর প্রচুর গ্রন্থ সাথে নিয়ে ফিরেছিলেন। ইতিহাসবিদগণ তাই নিশ্চিত করেন যে, এই মহাবিহারে একটি সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার ছিল। নালন্দার গ্রন্থাগারটির নাম ছিল "ধর্মগঞ্জ" (ধর্মের হাট)। তিনটি বহুতলবিশিষ্ট ভবনে এই গ্রন্থাগারটি অবস্থিত ছিল। ভবনগুলির নাম ছিল “রত্নসাগর” যার অর্থ-রত্নের মহাসাগর, “রত্নদধি” যার অর্থ-রত্নের সমুদ্র ও “রত্নরঞ্জক” যার অর্থ-রত্নখচিত। রত্নদধি ছিল নয় তলাবিশিষ্ট ভবন। এখানেই পবিত্রতম ধর্মগ্রন্থ “প্রজ্ঞাপারমিতা সূত্র” ও “গুহ্যসমাজ” রক্ষিত ছিল। অনুমান করা হয়, সেখানে লক্ষাধিক গ্রন্থ ছিল। এই গ্রন্থাগারে ধর্মগ্রন্থের পুথির পাশাপাশি ছিল ব্যাকরণ, ন্যায়শাস্ত্র, সাহিত্য, জ্যোতিষবিদ্যা, জ্যোতির্বিজ্ঞান ও ভেষজবিদ্যা-সংক্রান্ত গ্রন্থাবলিও ছিল। ইতিহাসবিদগণের অনুমান, নালন্দা মহাবিহারের গ্রন্থাগারটির একটি শ্রেণিবিন্যাস ক্রম ছিল এবং এই ক্রমটি সংস্কৃত ভাষাবিদ পাণিনির শ্রেণিবিন্যাস ক্রমের ভিত্তিতে সাজানো ছিল। বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থগুলো ত্রিপিটকের প্রধান তিনটি বিভাগের (বিনয় পিটক, সুত্ত পিটক ও অভিধম্ম পিটক) ভিত্তিতে বিন্যস্তভাবে পাওয়া গিয়েছিল"।

নালন্দা সম্পর্কিত এই তথ্যগুলো যে মিথ্যা তা এখনি বুঝতে পারবেন। বলা হয় সেখানে নাকি কৌটিল্যের অর্থশাস্র পড়ানো হতো। তথাকথিত কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রের বইয়ের নামেই গোলমাল। অর্থশাস্ত্রের অর্থ অংশের মানে টাকা পয়সা নয়- মানে (Meaning)ও নয়।
এমনকি অভিধানেও শব্দটির যেসব অর্থ দেয়া আছে তার কোনোটাই নয়। ঐ অর্থ শব্দের মানে পৃথিবী।
বুঝতে কষ্ট হয় না খাঁটি ও আধুনিক ইংরেজি Earth-এর উচ্চারণ চুরি করেই ঐ অর্থ শব্দটি বানানো হয়েছিল। বানানো হয়েছিলো আধুনিককালেই।

অর্থশাস্ত্র মানে Economics নয়-ওর মানে পৃথিবী সম্পর্কিত জ্ঞান। আর পাণিনি নামে কোনো ব্যাকরণবিদ আদৌ ছিলো না। কাজেই তার পাণিনি ব্যকরণ রচিত হওয়া অসম্ভব।

আর হিউয়েন সাঙ এবং ফা হিয়েন দুটি বানানো কাল্পনিক চরিত্র বৈ কিছুই নয়। কাজেই তাদের নামে চালানো মিথ্যা ইতিহাসের আলোকে মিথ্যা নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাহিনী মিথ্যা ছাড়া কিছুই নয়।

এই প্রধান চরিত্রগুলোই যদি কাল্পনিক হয় তবে বাকিগুলোর কী অবস্থা! মূলত ভারতীয় ইতিহাসের অভারতীয় দলিল তৈরি করতেই চীনা পর্যটক হিউয়েন সাঙ ও ফা হিয়েন নামে দুটি চরিত্র কষ্ট করে বানানো হয়েছিল।
ঐতিহাসিক হিউয়েন সাঙ এবং ফা-হিয়েনের ইতিহাসের উপর নির্ভর করে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বর্ণোজ্জ্বল বয়ান হাজির করা হয়, অথচ এ দুজন মহান। ইতিহাসবিদই তো কল্পনা-সৃষ্ট, যাদের বানিয়েছিল ইংরেজরা।

আর্যভট্ট কস্মিনকালেও শূন্য আবিস্কার করেননি। শূন্যের আবিস্কারক গণিতবিদ আলখাওয়ারিজমি। আরবি সিফর থেকেই জেফিরো হয়ে জিরো শব্দের উৎপত্তি।

নালন্দা উপাসনালয়ের সময় তৎকালীন বিজ্ঞান এত উন্নত ছিল না। এমনকি কোনো শাখার অস্তিত্বই ছিলো না।যেমন ইউরোপে ১৬ শ' শতকের পূর্বে রসায়ন বলতে জাদুবিদ্যাকে বোঝানো হতো। সুতরাং নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় যে আদৌ ছিল না, এবং তার কাহিনী যে কল্পনাশ্রিত তা স্পষ্ট প্রমাণিত।

কিন্তু পরে এই সেদিন এই মঠ বা বিহারকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত করা হয়। নোবেল জয়ী অর্থনীতিবিদ ড. অমর্ত্য সেনের নেতৃত্বে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় চালু করা হয়। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়কে বর্তমানে পৃথিবীর সকল ছাত্র-ছাত্রীর ভর্তির জন্য উন্মুক্ত রাখা হয়েছে।

ভারতের পরলোকগত রাষ্ট্রপতি এ পি জে আব্দুল কালাম এটিকে আরো উন্নত করেন। ভারতীয় পার্লামেন্টে ২০১০ সালে একটি বিল পাশের মাধ্যমে ২০১৪ সালের ১লা সেপ্টেম্বর ২৫ জন ছাত্র-ছাত্রী নিয়ে এর শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এখানে ইতিহাস এবং বাস্তুবিদ্যা ও পরিবেশ- এ দুটি বিষয়ে পাঠদান শুরু হয়েছে।

তথ্যসূত্র :

১. বজ্রকলম : গোলাম আহমাদ মোর্তজা
২. সাম্রাজ্যবাদী রাজনীতির সদরে অন্দরে : এস এম নজরুল ইসলাম
৩. বিশ্বের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস : এইচজি ওয়েলস

 


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us