যেভাবে কনস্টান্টিনোপল জয় করেছিলেন সুলতান মুহাম্মদ

আরাফাত শাহীন | May 29, 2021 03:55 pm
যেভাবে কনস্টান্টিনোপল জয় করেছিলেন সুলতান মুহাম্মদ

যেভাবে কনস্টান্টিনোপল জয় করেছিলেন সুলতান মুহাম্মদ - ছবি সংগৃহীত

 

এক.

১৪৫৩ সালের ২৯ মে পৃথিবীর ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হলো। এদিনই মুসলিম বাহিনীর হাতে বিজিত হয় তৎকালীন পৃথিবীর সবচেয়ে নয়নাভিরাম শহর, বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের রাজধানী কনস্টান্টিনোপল।

আপনি যদি পৃথিবীর সমর-ইতিহাস পর্যালোচনা করতে যান, তাহলে উসমানি সুলতান দ্বিতীয় মুহাম্মদের কনস্টান্টিনোপল বিজয়ে অভূতপূর্ব সামরিক প্রতিভায় রীতিমতো বিস্মিত হয়ে যাবেন। আমি প্রথম যখন ঘটনাটা জানতে পারি- বিশ্বাস করতে পারছিলাম না কিছুতেই। বহু পরে বিস্তারিত ইতিহাস জানার পর তবেই নিশ্চিত হয়েছি। আজ সে গল্পই শোনাবো।

কনস্টান্টিনোপল নিয়ে রাসূলুল্লাহ সা.-এর একটি হাদিস প্রথমে জেনে নেয়া প্রয়োজন। তিনি বলেন, 'অবশ্যই কসতুনতুনিয়া (কনস্টান্টিনোপল) এক ব্যক্তির হাতে বিজিত হবে। ওই শাসক কতই না উত্তম আর সেই বাহিনী কতই না উত্তম বাহিনী!' (মুসনাদে আহমাদ)

পৃথিবীর দিকে দিকে যখন ইসলামের বিজয়গাঁথা ছড়িয়ে পড়ছিল, সে সময় প্রায় প্রত্যেক শাসকই রাসূলুল্লাহ সা. বর্ণিত ওই সৌভাগ্যবান সেনানায়ক হওয়ার চিন্তা করেছেন। এমনকি এই সেনাবাহিনীর একজন সদস্য হওয়ার আশায় ইয়াজিদের শাসনামলে আশি বছর বয়সেও হযরত আবু আইউব আল আনসারী রা. কনস্টান্টিনোপল অবরোধে অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং তিনি সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন। কনস্টান্টিনোপলের প্রাচীরের পাশেই দাফন করা হয় তাকে।

এছাড়াও কনস্টান্টিনোপল সম্পর্কে বলা হতো- যদি সারা দুনিয়া শুধুমাত্র একটি রাষ্ট্র হয়, তাহলে কনস্টান্টিনোপল তার রাজধানী হওয়ার জন্য সবচেয়ে বেশি উপযুক্ত।
যে শহরের মর্যাদা ছিল এত বেশি তা জয় করার জন্য সব শাসক যে আপ্রাণ চেষ্টা করবে সেটাই তো স্বাভাবিক!

দুই.
কনস্টান্টিনোপল এমন কোনো শহর ছিল না যা চাইলেই জয় করা সম্ভব। ওইা সময়ে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর ও উপযুক্ত এই শহরটার প্রতিরক্ষাব্যবস্থাও ছিল সবচেয়ে উন্নত। এজন্যই ইতোপূর্বে যত আক্রমণ হয়েছে, তার সবকটিই কনস্টান্টিনোপল-এর বিরাটকার দেয়ালের সামনে এসে মুখ থুবড়ে পড়েছে।
প্রাকৃতিকভাবেই কনস্টান্টিনোপল পেয়েছিল দারুণ এক প্রতিরক্ষাব্যবস্থা। শহরের তিন দিক ছিল সামুদ্রিক জলভাগ দ্বারা বেষ্টিত- বসফরাস প্রণালী, মারমারা সাগর ও গোল্ডেন হর্ন। তাছাড়া স্থলভাগের অংশটুকু দানবের মতো উঁচু এবং চওড়া দেয়াল দিয়ে সুরক্ষিত ছিল, যা ভেঙ্গে শহরে প্রবেশ করা ছিল একপ্রকার দুঃসাধ্য।

তিন.
১৪৫১ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয় মুহাম্মদ যখন উসমানি সুলতান হিসেবে সিংহাসনে বসেন তখন তার বয়স ছিল ২০ বছরের আশেপাশে। এত অল্পবয়স্ক একজনকে সুলতান হিসেবে মেনে নিতে অনেকেরই আপত্তি ছিল বেশ জোরালো। কিন্তু মুহাম্মদ ছিলেন দৃঢ়চেতা। তিনি ক্ষমতায় এসেই এক কঠিন লক্ষ্য নির্ধারণ করে ফেলেন। আর তা ছিল প্রায় আটশত বছর আগে করা রাসূলুল্লাহ সা.-এর সেই ভবিষ্যদ্বাণী; যাতে তিনি কনস্টান্টিনোপল বিজয়ের সুসংবাদ দিয়েছিলেন।

সুলতান মুহাম্মদ-এর এমন সিদ্ধান্তে অনেকেই নাখোশ ছিলেন। কারণ, এর আগেও অনেকেই এই শহর জয় করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন। আর নেহায়েত একজন সদ্য কৈশোর পেরনো তরুণ কীভাবে এই শহর জয় করতে পারে! কিন্তু মুহাম্মদ তার সিদ্ধান্তে ছিলেন কনস্টান্টিনোপলের দেয়ালের মতোই সুদৃঢ়। তাছাড়া তার সামনে দৃষ্টান্ত হিসেবে রয়েছে মুহাম্মদ বিন কাসিমের সিন্ধু বিজয়ের ঘটনা; যিনি মাত্র ১৭ বছর বয়সেই এই অসাধ্য সাধন করেছিলেন। তাহলে তার ভয় কী!

চার.
কনস্টান্টিনোপলের মতো শহর জয় করার জন্য যে ধরনের প্রস্তুতি নেয়ার দরকার ছিল, সুলতান মুহাম্মদ তার সবই অতি সতর্কতার সঙ্গে অবলম্বন করেন। সেনাবাহিনীকে প্রশিক্ষিত করেন; তাদের মধ্যে জাগ্রত করেন ধর্মীয় চেতনা। বিশাল আকারের কামান নির্মাণ করেন; যার সাহায্যে আগুনের গোলা নিক্ষেপ করা হবে। এছাড়া যাবতীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করেই ১৪৫৩ সালে শহর অবরোধ করেন।

সুলতান এটা বেশ ভালোভাবেই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে নৌপথে প্রবল অবরোধ গড়ে তোলা ছাড়া কিছুতেই বিজয়ের আশা করা যাবে না। সেজন্য নৌবাহিনীকে সুসজ্জিত করা হয় এবং নৌবহরে যুক্ত করা হয় অসংখ্য যুদ্ধজাহাজ।

সমুদ্রপথে গোল্ডেন হর্নের দখল নেয়া সম্ভব হচ্ছিল না কিছুতেই। কারণ, বাইজান্টাইনরা গোল্ডেন হর্নের প্রবেশপথে মোটা লোহার শিকল দ্বারা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে রেখেছিল। সুলতান এটা বেশ ভালোই জানতেন যে গোল্ডেন হর্নের দখল নিতে না পারলে শহর জয় করা সম্ভব হবে না।

এই সময় তার মাথায় অভূতপূর্ব এক পরিকল্পনা খেলে যায়; যা গোটা সমর-ইতিহাসেই একেবারে অভিনব। এমন চিন্তা দূরে থাক, কেউ কখনো এটা কল্পনা করেছে কিনা সন্দেহ! তিনি স্থলপথে জাহাজ নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করলেন। এবং এই পথের দূরত্বও কম নয়; মাত্র তিন কিলোমিটার!

কেউ কখনো ভাবতে পেরেছে যে পানির জাহাজ ডাঙা দিয়ে চালিয়ে নেয়া যেতে পারে! সুলতান মুহাম্মদ সেটাই চিন্তা করলেন এবং তার বাস্তবায়ন করেও দেখালেন। গোটা যুদ্ধ-ইতিহাসই তিনি নতুনভাবে লিখিয়ে ছাড়লেন যেন! বড় কোনোকিছু জয় করতে হলে যে পরিকল্পনাটাও বড় করেই সাজাতে হয়—এটাই কিন্তু এখানের সবচেয়ে বড় শিক্ষা।

এই তিন কিলোমিটার পথ মোটেও সমতল ছিল না। এবড়োথেবড়ো পথ সেনাদের দিয়ে যথাসম্ভব সমান করা হলো প্রথমে। তারপর পুরো পথের ওপর তেল দ্বারা পিচ্ছিল করা কাঠের তক্তা বসানো হয়। এর ওপর দিয়েই একে একে ৭০টিরও বেশি জাহাজ টেনে নিয়ে যাওয়া হয় গোল্ডেন হর্নে। সবচেয়ে অবাক করার মতো বিষয় হলো- এই পুরো কর্মযজ্ঞ পরিচালনা করা হয় মাত্র এক রাতের মধ্যেই! বাইজান্টাইন সেনাবাহিনী কিংবা শহরের জনগণ ঘুর্ণাক্ষরেও টের পায়নি কিছু!

পর দিন সকালে শহরবাসী ঘুম থেকে জেগেই দেখতে পেল, গোল্ডেন হর্নে উসমানিদের পতাকাবাহী জাহাজ অবরোধ আরোপ করে বসে আছে। এমন অলৌকিক কাণ্ড এর আগে কেউ কখনো দেখেনি। তারা কিছুতেই ভেবে বের করতে পারলো না কীভাবে এই জাহাজগুলো এখানে এলো!

পাঁচ.
আল্লাহ তাআ'লা অবশেষে তাঁর প্রিয় নবীর ভবিষদ্বাণীর বাস্তব প্রয়োগ দেখালেন পবিত্র মুহাম্মদ নামেরই একজন ব্যক্তির দ্বারা! তিনি কতই না উত্তম এবং সৌভাগ্যবান মানুষ; যাঁর ব্যাপারে প্রায় ৮০০ বছর আগেই বলা হয়েছিল! তাঁর মাধ্যমেই সোয়া ১১ শ' বছর আগে রোমান সম্রাট প্রথম কনসস্টাইন দ্বারা প্রতিষ্ঠিত শহরটি মুসলিমদের পদানত হলো।
যুগের পরিবর্তন হয় আর পাল্টাতে থাকে সবকিছু; নতুনভাবে রচিত হয় যুদ্ধের ইতিহাস। তবে একটা মৌলিক বিষয়ের কখনো পরিবর্তন হয় না। আর তা হলো—আপনি যদি পরাক্রমশালী শত্রুর বিরুদ্ধে বিজয়ী হতে চান, তাহলে আপনাকে তার চেয়েও অভিনব ও অধিক সক্ষমতা অর্জন করতে হবে; সেটা সরাসরি যুদ্ধের ময়দানেই হোক, আর বুদ্ধিবৃত্তিক যুদ্ধেই হোক।

সহায়ক গ্রন্থ
* ড. আলি মুহাম্মদ সাল্লাবি; উসমানি সাম্রাজ্যের ইতিহাস, অনুবাদ : কাজী আবুল কালাম সিদ্দীক, মাহদি হাসান, মুহাম্মদ পাবলিকেশন, পৃষ্ঠা : ১৫৫-১৮৫
* সাদিক ফারহান : ইসলামের ইতিহাসে যুদ্ধ, মাকতাবাতুল আসলাফ, পৃষ্ঠা : ৪৮৮-৪৯৯
* ড. আবদুর রহমান রাফাত পাশা; সাহাবীদের বিপ্লবী জীবন ১ম খণ্ড, কামিয়াব প্রকাশন লিমিটেড, পৃষ্ঠা : ১১৮
* ড. আলি মুহাম্মদ সাল্লাবি; মুহাম্মদ আল-ফাতিহ; অনুবাদ : মাহদি হাসান, মুহাম্মদ পাবলিকেশন, পৃষ্ঠা : ১৩৭-১৬৮


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us