বিভিন্ন ধর্মে বর্ষবরণ

ড. মো: আবদুল কাদের | Dec 29, 2020 03:27 pm
বিভিন্ন ধর্মে বর্ষবরণ

বিভিন্ন ধর্মে বর্ষবরণ - ছবি সংগৃহীত

 

বিভিন্ন ধর্মে ঐতিহ্যগতভাবে বছরের প্রথম দিনটি ধর্মীয় উৎসব হিসেবেই পালিত হতো। ইহুদিদের নববর্ষ ‘রোশ হাশানাহ’ ওল্ড টেস্টামেন্টে বর্ণিত ইহুদিদের ধর্মীয় পবিত্র দিন ‘সাবাত’ হিসেবে পালিত হয়। আর খ্রিষ্টানরা পালন করে ইংরেজি নববর্ষ। অপর দিকে মুসলিমদের রয়েছে হিজরি নববর্ষ। তবে বাংলাদেশের মুসলিমরা পালন করে ইংরেজি নববর্ষের পাশাপাশি বাংলা নববর্ষ। এমনিভাবে সব জাতির উৎসবের মাঝেই ধর্মীয় চিন্তা-ধারা খুঁজে পাওয়া যায়।

মহান আল্লাহ সময় গণনা করার জন্য এবং তাঁর ইবাদত করার সুবিধার্থে মানুষের জন্য বছরে ১২টি মাস নির্ধারণ করে দিয়েছেন। কোনো ধরনের আনন্দ উৎসব পালনের জন্য নয়। মুসলিমদের উৎসবের সময় স্থান সংখ্যা সবই নির্ধারিত। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তোমাদের প্রত্যেকের জন্যই আমি একটি নির্দিষ্ট বিধান এবং সুস্পষ্ট পথ নির্ধারণ করেছি।’ (সূরা মায়িদা : ৪৮) ‘প্রতিটি জাতির জন্য আমি অনুষ্ঠান (সময় ও স্থান) নির্দিষ্ট করে দিয়েছি যা তাদের পালন করতে হয়।’ (সূরা হাজ্জ : ৬৭) যেমনটি কেবলাহ্, সালাত এবং সাওম ইত্যাদি। শুধু তাই নয়, প্রিয়নবী মুহাম্মদ সা: মুসলিমদের উৎসব সংখ্যাও নির্ধারণ করে দিয়েছেন। রাসূল সা: বলেন, ‘প্রত্যেক জাতির নিজস্ব উৎসব রয়েছে আর এটা আমাদের ঈদ।’ (বুখারি : ৯৫২ মুসলিম : ৮৯২)

উল্লেখিত হাদিসে প্রতীয়মান হয় যে, উৎসব অনুষ্ঠান প্রতিটি জাতির স্বকীয় বৈশিষ্ট্য। এছাড়াও আনাস ইবনে মালিক রা: থেকে বর্ণিত আছে যে, ‘রাসূল সা: যখন মদিনায় আসলেন তখন তাদের দুটো উৎসবের দিন ছিল। তিনি বললেন, ‘এ দুটো দিনের তাৎপর্য কী? তারা বলল, ‘জাহিলি যুগে আমরা এ দুটো দিনে উৎসব করতাম।’ রাসূল সা: বললেন, ‘আল্লাহ তোমাদেরকে এ দিনগুলোর পরিবর্তে উত্তম কিছু দিন দিয়েছেন : ইয়াওমুল আযহা ও ইয়াওমুল ফিতর।’ (সুনানে আবু দাউদ : ১১৩৪)। এ হাদিসে প্রমাণিত হয়েছে যে, ইসলাম আগমনের পর জাহেলি যুগের সব উৎসবকে বাতিল করে দেয়া হয়েছে এবং নতুনভাবে উৎসবের জন্য শুধুমাত্র দুটো দিন নির্ধারণ করা হয়েছে।

প্রত্যেক জাতির উৎসবসমূহ নিজ নিজ ধর্মের আলোকে পালন করা হয়ে থাকে। ফলে মুসলিম ও অমুসলিমদের উৎসবের মাঝে বিস্তর পার্থক্য দেখা যায়। অমুসলিমদের বর্ষবরণ, বড়দিন, বিভিন্ন পূজা উৎসব মুসলিমদের দুই ঈদের আনন্দ উৎসবের চেয়ে ব্যতিক্রম। অমুসলিম, কাফির কিংবা মুশরিকদের উৎসবের দিনগুলো হচ্ছে তাদের জন্য উচ্ছৃঙ্খল আচরণের দিন, এদিনে তারা নৈতিকতার সব বাঁধ ভেঙে দিয়ে অশ্লীল কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়, আর এই কর্মকাণ্ডের অবধারিত রূপ হচ্ছে মদ্যপান ও ব্যভিচার। এমনকি খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের বহুলোক তাদের পবিত্র বড়দিনেও ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যকে জলাঞ্জলি দিয়ে মদ্যপ হয়ে ওঠে এবং পশ্চিমা বিশ্বে এই রাত্রিতে বেশ কিছু লোক নিহত হয় মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি চালানোর কারণে। অপর দিকে মুসলিমদের দুটি ঈদ ইবাদতের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত। একটি একমাস সিয়াম সাধনা এবং অপরটি আল্লাহর রাস্তায় আর্থিক কোরবানির মাধ্যমে সংঘটিত হয়ে থাকে।

জীবনের উদ্দেশ্যই হচ্ছে ইবাদত, যেমনটি মহান আল্লাহ ঘোষণা দিয়েছেন, ‘আমি জিন ও মানুষকে আমার ইবাদত করা ছাড়া অন্য কোনো কারণে সৃষ্টি করিনি।’ (সূরা যারিয়াত : ৫৬) অতএব, মুসলিমদের জীবনের আনন্দ-উৎসব আল্লাহর বিরুদ্ধাচরণ ও অশ্লীলতায় নিহিত নয়, বরং তা আল্লাহর দেয়া আদেশ পালন ও পরিপূর্ণ আনুগত্য করার মাঝেই নিহিত।

মুসলিমের ভোগবিলাসের স্থান ক্ষণস্থায়ী পৃথিবী নয়, বরং চিরস্থায়ী জান্নাত। তাই মুসলিম জীবনের প্রতিটি কাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে জড়িয়ে রয়েছে তাদের ঈমান, ধর্মীয় মূল্যবোধ, আখিরাতের প্রতি অবিচল বিশ্বাস, আল্লাহর প্রতি যথাযথ ভয় ও ভালবাসা। ইমাম ইবনে তাইমিয়া রহ:-এর মতে, ‘উৎসব অনুষ্ঠান, ধর্মীয় বিধান, সুস্পষ্ট পথনির্দেশ এবং ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানেরই একটি অংশ। আর বাহ্যিকভাবে এগুলোতে অংশ নেয়া নিঃসন্দেহে পাপ।’

নতুন বছরের সাথে মানুষের কল্যাণ, এর কোনো সম্পর্ক নেই। ইমাম আবু হানিফা রহ:-এর দাদা তার পিতাকে পারস্যের নওরোজের দিন (নববর্ষের দিন) আলী রা:-এর নিকট নিয়ে গিয়েছিলেন এবং কিছু হাদিয়াও পেশ করেছিলেন। (হাদিয়াটি ছিল নওরোজ উপলক্ষে) আলী রা: বললেন, ‘নওরোযুনা কুল্লা ইয়াওম’ মুমিনের প্রতিটি দিনই তো নববর্ষ। (আখবারু আবু হানিফা) অর্থাৎ মুমিন প্রতিদিনই তার আমলের হিসাব নিকাশ করবে এবং নবউদ্যমে আখেরাতের পাথেয় সংগ্রহ করবে। ইসলামের চতুর্থ খলিফা আলী রা:-এর এ কথা দ্বারা সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, নববর্ষ উপলক্ষে পরস্পর উপহার আদান-প্রদান এবং শুভেচ্ছা বিনিময়ের কোনো গুরুত্ব ইসলামে নেই। নতুন বছর নতুন কল্যাণ বয়ে আনে, দূরীভূত হয় পুরনো কষ্ট ও ব্যর্থতার গ্লানি- এ ধরনের কোনো তত্ত্ব ইসলামে আদৌ সমর্থিত নয়, বরং নতুন বছরের সাথে কল্যাণের শুভাগমনের ধারণা আদিযুগের প্রকৃতি-পূজারী মানুষের কুসংস্কারাচ্ছন্ন ধ্যান-ধারণার অবশিষ্টাংশ। এ ধরনের কুসংস্কারের কোনো স্থান ইসলামে নেই। বরং মুসলিমের জীবনে প্রতিটি মুহূর্তই মূল্যবান হীরকখণ্ড। এই দৃষ্টিকোণ থেকে বছরের প্রথম দিনের কোনো বিশেষ তাৎপর্য নেই। আর তাই তো ইসলামে হিজরি নববর্ষ পালনের কোনো প্রকার নির্দেশ দেয়া হয়নি।

এমনকি পয়লা মহররমকে নববর্ষের সূচনা হিসেবে গণনা করা শুরুই হয় নবী সা:-এর ওফাতের বহু পরে দ্বিতীয় খলিফা ওমর রা:-এর শাসন আমলে। এ থেকে বোঝা যায় যে, নববর্ষ উদ্যাপন ইসলামের দৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ নয়। কেউ যদি এ ধারণা পোষণ করে যে, নববর্ষের প্রারম্ভের সাথে কল্যাণের কোনো সম্পর্ক রয়েছে বা যদি সে মনে করে যে, আল্লাহ এ উপলক্ষ দ্বারা মানবজীবনে কল্যাণ বর্ষণ করেন তবে তা শিরকে পতিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
নববর্ষের অনুষ্ঠানে বিভিন্ন প্রাণীর ছবি অঙ্কন করে নতুন প্রজন্মকে আনন্দ দেয়ার যে চেষ্টা করা হয় তাও ইসলাম সমর্থিত নয়। ইসলামে প্রতিকৃতি কিংবা জীবন্ত বস্তুর ছবি তৈরি করাকে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা: থেকে বর্ণিত রাসূল সা: বলেছেন, ‘কিয়ামতের দিন সবচেয়ে কঠিন শাস্তি ভোগ করবে (জীবন্ত বস্তুর) ছবি তৈরিকারীরা।’ (বুখারি : ৫৯৫০, মুসলিম : ২১০৯) অন্য হাদিসে রাসূল সা: বলেন, ‘যে কেউই ছবি তৈরি করল, আল্লাহ তাঁকে (কিয়ামতের দিন) ততক্ষণ শাস্তি দিতে থাকবেন যতক্ষণ না সে এতে প্রাণ সঞ্চার করে, আর সে কখনোই তা করতে সমর্থ হবে না।’ (বুখারি : ২২২৫, মুসলিম : ২১১০)

তাছাড়াও নববর্ষের অনুষ্ঠানাদির মধ্যে সমাজ-বিধ্বংসী যে বিষয়গুলো পাওয়া যায় তার মধ্যে অন্যতম হলো ভিন্ন নারীকে জড়িয়ে বিভিন্ন ধরনের অশ্লীলতা। এসব অনুষ্ঠানে নারীদের আকর্ষণীয় পোশাক পরিধান করে পুরুষের সাথে অবাধ মেলামেশায় লিপ্ত হতে দেখা যায়। ইসলামে সম্পূর্ণ হারাম ও নিষিদ্ধ। রাসূল সা: বলেন, ‘আমি পুরুষের জন্য নারীর চেয়ে বড় কোনো ফিতনা রেখে যাচ্ছি না।’ (বুখারি : ৫০৯৬, মুসলিম : ২৭৪০)
নববর্ষের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের সাথে জড়িত থাকে সঙ্গীত ও বাদ্য। বাদ্যযন্ত্রকেও ইসলামে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। রাসূল সা: বলেন, ‘আমার উম্মাতের মধ্যে কিছু লোক হবে যারা ব্যভিচার, রেশমি বস্ত্র, মদ এবং বাদ্যযন্ত্রকে হালাল বলে জ্ঞান করবে।’ (বুখারি : ৫৫৯০)

মুসলিম হিসেবে আমাদের কর্তব্য : শিরক ও কুসংস্কারপূর্ণ অনুষ্ঠানাদি, নগ্নতা, অশ্লীলতা, গান ও বাদ্যপূর্ণ অনুষ্ঠান, সময় অপচয়কারী অনর্থক ও বাজে কথা এবং কাজ পরিহার করা। মহান আল্লাহর কাছে পরিপূর্ণ তাওবাকারী ও শিরকমুক্ত জীবন পালনে ব্রতী হওয়া। কুরআনে এসেছে, ‘নিশ্চয়ই যে কেউই আল্লাহর সাথে অংশীদার স্থির করবে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাতকে হারাম করে দিয়েছেন, আর তার বাসস্থান হবে জাহান্নাম এবং জালিমদের জন্য কোনো সাহায্যকারী নেই।’ (সূরা মায়িদাহ : ৭২)

অতএব, প্রত্যেকের উচিত বর্ষবরণের নামে এমন বেলেল্লাপূর্ণ অপসংস্কৃতি এবং অর্থ ও সময়ের অপচয় সর্বস্ব অনুষ্ঠান হতে বিরত থাকা এবং সর্বস্তরের মুসলিমদের এই অপসংস্কৃতি থেকে মুক্ত রাখতে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা।

লেখক : শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us