সহিংসতার নতুন অবয়ব

হাসান মাহমুদ | Feb 25, 2021 02:57 pm
সহিংসতার নতুন অবয়ব

সহিংসতার নতুন অবয়ব - ছবি সংগৃহীত

 

আজকে এক ধরণের সহিংসতার কথা বলবো, যেখানে কোনো সন্ত্রাসী অস্ত্র হাতে দুর্বল শিকারের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে না। বরং, এই সহিংসতা ঘটে আলোকোজ্জ্বল জ্ঞানের বহ্নিশিখার মাধ্যমে, বাতিঘর বা আলোকিত মানুষ হিসেবে পরিচিত গুণীজন ও তাদের গুণমুগ্ধ, ডিগ্রীধারী, বুদ্ধিজীবিদের হাতে। এর নাম Epistemic Violence, যাকে আমি বাংলায় অনুবাদ করি জ্ঞানের সহিংসতা হিসেবে। জ্ঞানের এই সহিংসতার তিনটি বৈশিষ্ট্য/দিক আছে :
(১) কর্তার স্থানে থাকে গবেষক/স্কলার/বুদ্ধিজীবি, (২) লক্ষ্যে থাকে ক্ষমতাহীন জনগোষ্ঠী (other), এবং (৩) তথ্যের ব্যাখ্যাকে উপস্থাপন করা হয় জ্ঞান হিসেবে।

'Can the Subaltern Speak? (1988)' শীর্ষক প্রবন্ধে গায়র্ত্রী স্পিভাক এই জ্ঞানের সহিংসতা নিয়ে আলাপ তোলেন। তিনি ভারতীয় নারীর প্রতি সহিংসতা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে কিভাবে আধুনিক জ্ঞান নারীকে ‘অপর (other)’ হিসেবে উপস্থাপন করে, যা নারীকে নিয়ে নানা রকম সামাজিক নিয়মকানুনকে বৈধতা দেয়। যেমন, পারিবারিক অভিভাবকত্বে, সম্পত্তির উত্তরাধিকারে, ক্ষমতা/দায়িত্বশীল পদে পুরুষের তুলনায় নারীকে কম উপযুক্ত হিসেবে উপস্থাপন।
জ্ঞানের এই সহিংসতা বুঝতে হলে আমাদেরকে দৃষ্টিপাত করতে হবে গবেষণা প্রক্রিয়ার মধ্যে তথ্য (data) ও বিশ্লেষণের (interpretation) প্রতি। কোন বিষয়ের গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য নিজে নিজেই জ্ঞান হিসেবে হাজির হয়না। বরং প্রাপ্ত তথ্যকে সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি অনুসরণ করে সংগ্রহ করতে হয়, বিশ্লেষণ করতে হয়, এবং সর্বশেষে ব্যাখ্যা করতে হয়। অর্থাৎ, বাস্তবিক কিছু ঘটনা পর্যবেক্ষণকরত কিছু তথ্য (quantitative বা qualitative বা উভয়ই) সংগ্রহ করলেই তা জ্ঞানে পরিণত হয় না। সেই তথ্যকে অনিবার্যভাবেই ব্যাখ্যা করার দরকার হয়। তারপরেই কেবল আসে জ্ঞান।

তথ্যের ব্যাখ্যা (interpretation) অর্থপূর্ণ হয় কেবলমাত্র সুনির্দিষ্ট কোনো একটা তত্ত্বীয় কাঠামোর মধ্যেই। সাধারণভাবে, গবেষণা প্রকাশনায় তথ্যের বিশ্লেষনভিত্তিক ব্যাখ্যাগুলোকে উপস্থাপন করা হয় বাস্তব (fact) বা জ্ঞান (knowledge) হিসেবে।

পরিচিত ঘটনা থেকে জ্ঞানের এই সহিংসতার উদাহরণ দেয়া যাক। বাংলাদেশের মুসলমান সমাজ নিয়ে প্রচলিত একটা ধারণা আছে 'বাঙালি মুসলমানের মন' সংক্রান্ত বয়ানে। এখানে বাঙালি মুসলমান সমাজকে মোটাদাগে পশ্চাৎপদ, প্রতিক্রিয়াশীল, জ্ঞানবিমুখ, ইত্যাদি নানারকম নেতিবাচক বিশেষণে পরিচিত করা হয়। এসব ধারণার উৎপত্তি সাহিত্য, সংস্কৃতি, রাজনীতি ইত্যাদি ক্ষেত্রে নানা গবেষণায়। গবেষকরা বাংলাদেশী মুসলমান সমাজে শিক্ষায় অনগ্রসরতা, ধর্মীয় উন্মাদনা, রাজনৈতিক সচেতনতার অভাব ইত্যাদি অনেক বিষয় চিহ্নিত করেন আরোপিত নেতিবাচক বৈশিষ্ট্যাবলীর প্রমাণ হিসেবে। অর্থাৎ, গবেষক এইসব তথ্যকে ব্যাখ্যা করার মধ্য দিয়ে মুসলমান সমাজের বৈশিষ্ট্য নির্ণয় করেন। দেখা যাক এইসব গবেষণায় তথ্য ও তার ব্যাখ্যা স্বরূপ কেমন।

ঐতিহাসিকভাবে দেখা যায় যে বাঙালি মুসলমানের মধ্যে স্কুলে ভর্তি এবং পাশের হার প্রতিবেশী হিন্দু সমাজের তুলনায় কম। এই তথ্য নিজে নিজেই কোনো প্রকার জ্ঞান হিসেবে আবির্ভুত হয় না। বরং এই তুলনামূলক তথ্যকে ব্যাখ্যা করে গবেষক এমন উপসংহারে আসে যে বাঙালি মুসলমান শিক্ষাবিমুখ। তথ্যের এই ব্যাখ্যায় আসতে গবেষককে খুব বেশি বেগ পেতে হয় না। কারণ, আগে থেকেই সমাজে এই তত্ত্বীয় অনুমান জারি আছে যে মুসলমান সমাজ আধুনিক শিক্ষায় অনাগ্রহী। কিন্তু হিন্দু সমাজকে নিয়ে একই রকম তথ্য পাওয়া গেলেও অনুরূপ ব্যাখ্যা করা হবে না। কারণ, বাঙালি হিন্দুরা আধুনিক শিক্ষায় অনাগ্রহী এমন কোনো তত্ত্বীয় কাঠামো নেই (বরং উল্টোটি আছে, তথা হিন্দুরা বিদ্যানুরাগী)। অর্থাৎ, বাঙালি মুসলমান সমাজের মধ্যে শিক্ষার তুলনামূলক কম হারকে একটা সুনির্দিষ্ট তত্ত্বীয় কাঠামোর মধ্যে ব্যাখ্যা করার মধ্য দিয়ে তাদের ওপর একটা নেতিবাচক বৈশিষ্ট্য আরোপ করা হয়, তথা অপরায়নকে প্রতিষ্ঠা করা হয়।

একই বিষয় আরেকটা সাম্প্রতিক উদাহরণ হলো হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টে সন্ত্রাসী হামলা। একই রকম সন্ত্রাসী হালমায় গ্রামের/নিম্নবিত্তের মাদ্রাসার ছাত্র জড়িত দেখা গেলে (data) তা থেকে ব্যাখ্যা (interprete) করার মাধ্যমে আমরা তাৎক্ষণিক জেনে যাই যে মাদরাসাগুলো সন্ত্রাসবাদের উৎস আর বাংলাদেশ তালেবান সমাজে পরিণত হচ্ছে। আবার একই রকম হামলায় যদি ইংরেজি-মিডিয়াম স্কুলে পড়ুয়া এলিট পরিবারের ছাত্ররা জড়িত থাকে, তাহলে সেই তথ্যকে অনুরূপভাবে ব্যাখ্যা করে বলি না যে ইংরেজি-মিডিয়াম স্কুলগুলো উগ্রবাদের আস্তানা। কারণ, ইংরেজী-মিডিয়ামের স্কুল আধুনিক, অতএব তা’ উগ্রবাদের জন্ম দেয় না। আধুনিক স্কুল থেকে সন্ত্রাসের জন্ম হয় এরূপ একটা তত্ত্বীয় কাঠামোর অভাবে মাদরাসার মতো ইংলিশ-মিডিয়াম স্কুলকে উগ্রবাদের আস্তানা হিসেবে ব্যাখ্যা/চিহ্নিত করা হয় না।

আধুনিক, মেইন ষ্ট্রিম শিক্ষায়তনে বাংলাদেশের ইসলাম ও মুসলমান সমাজবিষয়ক গবেষণা প্রধানত জ্ঞানের সহিংসতা। গবেষণার নামে ক্রমাগতভাবে অপরায়িত (othered - marginalized, racialized, persecuted) মুসলমান সমাজকে সন্ত্রাসী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করায় নিয়োজিত এই যে জ্ঞান উৎপাদন ও বিস্তারের প্রক্রিয়া, সেটি চ্যালেঞ্জ করবেন নাকি জ্ঞানের এহেন সহিংসতায় মাস্তান/লেঠেলের ভূমিকায় নেমে তথ্যের ব্যাখ্যা (আদতে, অপব্যাখ্যা) করার মাধ্যমে এই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাবেন, তা আপনার বিবেচনা।

তবে একটা কথা বলে যাই : জ্ঞানের এই সহিংসতার খোঁজ পেয়ে গেছি। কাজেই, এইখানে যে বা যারা সন্ত্রাসীর ভূমিকায় ছিলেন এবং থাকবেন, তাদের পরিচয়ও আর গোপন থাকবে না। তা সে পরিচয় যত বড় বড় পদ আর নামীদামী পুরস্কারের আড়ালেই লুকিয়ে ফেলা হোক না কেন।

মাঠ আর ফাঁকা নাই, কাহা।


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us