মাতৃভাষায় উচ্চশিক্ষা : চীন ও ভারত বিপরীতমুখী উদাহরণ

নাঈম হাসান | Apr 07, 2021 02:14 pm
মাতৃভাষায় উচ্চশিক্ষা : চীন ও ভারত বিপরীতমুখী উদাহরণ

মাতৃভাষায় উচ্চশিক্ষা : চীন ও ভারত বিপরীতমুখী উদাহরণ - ছবি সংগৃহীত

 

মাতৃভাষায় উচ্চশিক্ষা প্রসঙ্গে ভারত ও চীন হচ্ছে আমাদের সামনে দুটি বিপরীতমুখী উদাহরণ। কোনটা আমাদের জন্য বেশি অনুকরণীয় তা নিয়ে আলাপ হতে পারে। চীন উচ্চশিক্ষায় ও সভ্যতার বিকাশে ইংরেজি বা কোনো ভিনদেশী ভাষাকে অপরিহার্য করেনি, বরং নিজ ভাষাতেই নিজেদের জ্ঞান সম্ভার গড়েছে। চীনে আপনি ইংরেজিতে পারদর্শিতা ছাড়াই বড় একজন সার্জন বা মহাকাশ বিজ্ঞানী হয়ে যেতে পারেন অনায়াসে। আসলে দরকারও হয় না ওদের।

এই রূপান্তর সফল হবার নেপথ্যে অন্যতম কারণ ছিল তাদের আধুনিকায়ন প্রজেক্ট পুরোপুরি উপনিবেশিক প্রক্রিয়ায় হয়নি। মডার্নিটি যতটা না তাদের উপর আরোপ করা হয়েছে তারচেয়ে তারা এটিকে অর্গানিক্যালি আলিঙ্গন করেছে। নিজ সভ্যতার সাথে তারা আধুনিকতার সংযোগ স্থাপন করতে নিজেদের মতো করেই। ফলে জ্ঞান ও শিক্ষার এই চৈনিক রূপান্তর বা বিনির্মাণ ছিল একদম মৌলিক কাজ, যা বর্তমানে স্বনির্ভর ও স্বয়ংসম্পূর্ণতা পেয়েছে।

অন্যদিকে ভারতের উদাহরণটি ছিল পুরোপুরি এর বিপরীত। উপনিবেশিক অভিজ্ঞতার বদৌলতে ইউরোপীয় জ্ঞান ও সভ্যতার সাথে ভারতের পরিচয়ের অনিবার্য মাধ্যম ছিল ইংরেজি। ভারত আধুনিক হয়েছে ইংরেজিতে এবং এর প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ও গড়ে উঠেছে ইংরেজিতে।

আর স্বাধীনতা উত্তর ভারত বহুভাষী মানুষের বিশাল রাষ্ট্র হওয়ায় একাডেমিক ও অফিসিয়াল পরিসরে ইংরেজিকে নিজেদের অঘোষিত ল্যাঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা হিসেবে গ্রহণ করে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভারতের প্রধান ভাষা হয়ে উঠে ইংরেজি যাতে ক্লাস লেকচারগুলো তামিল কিংবা মারাঠি সবাই সমানভাবে বোঝে। শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ে নয়, স্কুল ও কলেজ স্তরেও বেশির ভাগ অঙ্গরাজ্য ইংরেজিকে সেমি-মিডিয়াম বানিয়ে ফেলেছে। এটিই মূল কারণ যে ইংরেজিতে ভারতীয় স্টুডেন্টরা এত সাবলীল এবং পারঙ্গম, যা আমরা বাংলাদেশীরা মোটা দাগে পারি না।

ফলে উচ্চশিক্ষায় ভারতকে এখন আর সেভাবে ইংরেজি প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয় না যা আমাদের ছাত্রদের হতে হয়। মাতৃভাষা নিয়ে অপ্রয়োজনীয় আদিখ্যেতা না করে ভারত একটা বৈশ্বিক ভাষার হেজিমনি বা আধিপত্যকে আলিঙ্গন করেছে এবং তারা সেটার এডভান্টেজকে পুরোদস্তুর উপভোগ করছে।

বৈশ্বিক জ্ঞান সম্ভারে ভারত নিজেদের এক্সেস/গমন সহজতর করেছে এবং নিজেরাও দুর্বার গতিতে এগিয়ে গিয়েছে। ভারতে অনেক অটো-ড্রাইভারকে সাবলীল ইংরেজি বলতে শুনেছি। মুট মম্পিটিশনে গেলে ওদের টাইমকিপারদের আমাদের মুটারদের চেয়ে ভালো ইংরেজি বলতে শুনতাম। ওখানে জাকির নায়েক বা সাধগুরুর ইংরেজি লেকচারে ১০ লাখ মানুষ জড়ো হতো। ইন্ডিয়ান টিমের অশিক্ষিত ক্রিকেটাররা আমাদের আতাহার আলীর চেয়ে ভালো ইংরেজি বলে। গোটা মধ্যপ্রাচ্যে ভারত ভালো এক্জেকিউটিভ চাকরিগুলো বাগিয়ে নিয়েছে আর আমাদের অনার্স পাশ ছেলেরা ওখানে গিয়ে ড্রাইভিং করে।

পক্ষান্তরে এই চেতনা-বিধৌত বাংলাদেশ না চীন হতে পেরেছে না ভারত হতে পেরেছে। না জ্ঞানের রূপান্তর ও উদ্ভাবন করেছে, আর না ইংরেজি আধিপত্য মেনে নিয়ে গ্লোবাল প্লাটফর্মে নিজেদের কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছে। আমার ক্ষুদ্র ও নন-এক্সপার্ট মত হচ্ছে, চীনের মতো রূপান্তর বাস্তবতায় আমরা নেই। কারণ কাজটা করতে গিয়ে অলরেডি অনেক অনেক দেরি হয়ে গেছে।

পৃথিবীর জ্ঞানসম্ভার যে ৫-জি গতিতে অগ্রসরমান সেখানে এই রূপান্তর প্রক্রিয়া যেতে চাইলে আমরা এই গতির দৌড়ে বরং কয়েক যুগ পিছিয়ে যাবো, কারণ বাংলায় আমাদের সেই নিজস্ব নলেজ বেইস নেই। আর বৈশ্বিক দৌড়ে আমরা চীনের মতো কোনো গ্লোবাল পাওয়ার নই যে আমরা নিজেরাই বাংলার নিজস্ব প্রভাব বলয় সৃষ্টি করতে পারবো। করতে পারলে আমি নিজেও সুখি হতাম, কিন্তু বাস্তবতা হল গ্রহণ করাই প্রজ্ঞা।

তাই বাংলায় সম্পূর্ণ উচ্চশিক্ষা গ্রহণ এই চেতনাবাহী স্লোগানটিকে আরেকটু ক্রিটিকালি দেখার পক্ষপাতী আমি। ইংরেজিতে মিডিওকোর ছাত্রদের পড়াতে গিয়ে নিজেও অনেক বিপত্তির সম্মুখীন হই, বাংলায় বোঝাতে বাধ্য হই... কিন্তু সমস্যাটাকে আমার ইংরেজি মাধ্যমে শেখানোর সমস্যা মনে হয়নি, এটা বরং স্কুল কলেজ লেভেলে ইংরেজির বুনিয়াদ দুর্বল হবার সমস্যা মনে হয়েছে।

তাই আমাদের চেতনাগত আদিখ্যেতা পরিমার্জন করে ইংরেজি শেখা ও চর্চার বুনিয়াদকে আরো শক্তিশালী করার পক্ষপাতী আমি। ভারত পারলে আমরাও পারবো। বিশুদ্ধ বাংলার চর্চাকে আপন জায়গায় রাখতে হবে। কিন্তু জীবনের অন্য সকল চিন্তাগত ও প্রাতিষ্ঠানিক পরিসরে পশ্চিমের কাছে আত্মসমর্পণ করে, শুধু ভাষা-চেতনার নামে একটা গ্লোবাল রেইসে পিছিয়ে পড়া নিছক হঠকারিতা ও শুষ্ক আবেগ।

২০২০-এর দশকে এসে আপনার চীন হবার ইচ্ছা আপনাকে চীন নয় উগান্ডায় পরিণত করবে। কারণ দুটি বাস্তবতা ভিন্ন।

উল্লেখ্য, ফিলসফিক্যালি আমি একজন প্রকৃতিবাদী, উপনিবেশ ও সভ্যতাবিরোধী মানুষ... আমি ইংরেজির এডভোকেসি করছি স্থিতাবস্থার স্বার্থ বিবেচনায়। অর্থাৎ নষ্ট যখন হয়েই যাচ্ছেন তাহলে সহিহ তরিকায় নষ্ট হোন। ভালো করে পুঁজিবাদী গ্লোবালিস্ট হোন।


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us