করোনা নিয়ে বাংলাদেশের শঙ্কা

এম আর রাসেল | Apr 12, 2021 03:28 pm
করোনাভাইরাস

করোনাভাইরাস - ছবি সংগৃহীত

 

গত বছর করোনার আগমন জনমানসে রকমারি ভাবনার ঢেউ বয়ে দিয়েছিল। মানবিক কর্মেরও প্রসার ঘটেছিল। একক সুরক্ষা নয় সামষ্টিক প্রতিরক্ষার মাঝেই বিশ্ব সমাধান খুঁজে পেয়েছিল।

করোনার আগমনে অনেকেই প্রত্যাশা করেছিল ধনী গরিব বৈষম্যের ব্যবধান এবার কমে আসবে। কিন্তু আমরা অপার বিস্ময়ে লক্ষ করলাম ধনীদের সম্পদের পরিমাণ আরো বেড়ে গেছে। যেখানে বলা হয় করোনার প্রথম ধাক্কায় ১০ কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে গেছে।

মার্কিন সাময়িকী ফোর্বস প্রকাশিত তথ্য বলছে করোনার সংক্রমণ চলাকালে বিশ্বব্যাপী বিলয়নিয়ারের সংখ্যা ২৭৫৫ তে উন্নীত হয়েছে। এবার একটু নিজের দেশের পরিসংখ্যান দেখা যাক। প্রাপ্ত তথ্যমতে দেশে বর্তমান ৮৭ হাজার ৫০০ জন গ্রাহকের ব্যাংক হিসাবে কোটি টাকা রয়েছে। এর মধ্যে করোনাকালীন অবস্থায় দেশে কোটিপতি ব্যাংক হিসাবধারী বেড়েছে ৪ হাজার ৮৬৫ জন।

করোনা মহামারীকে অনেকে যুদ্ধের সাথে তুলনা করছেন। সম্প্রতি উগান্ডার রাষ্ট্রপ্রধানের একটি বক্তব্য ভাইরাল হয়েছে। সেখানে তিনি যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি স্মরণ করিয়ে দিয়ে সবাইকে ঘরে থাকতে বলেছেন। তার বক্তব্য শুনে গত বছরে প্রকাশিত বাঙ্কার বিক্রি বেড়ে যাওয়ার খবর মনে পড়ে গেল।

পশ্চিমা দেশের অনেকেই আধুনিক সুযোগ সুবিধা পরিবেষ্টিত বাঙ্কার ক্রয় করেন। যুদ্ধ পরিস্থিতিতে নিজেকে সুরক্ষা প্রদানে এই ব্যবস্থা। অনেক ধনকুবের তো বিভিন্ন দ্বীপ ক্রয় করে রেখেছেন। আহা জীবন বাঁচাতে কত বর্ণিল আয়োজন? এত আয়োজন করেও এই পৃথিবীতে কি কেউ মৃত্যু এড়াতে পেরেছে?

করোনার সংক্রমণ সাময়িক সময়ের জন্য কমলেও নতুন করে আক্রান্ত ও মৃত্যুহার দুটিই বাড়ছে। এজন্য নতুন করে করোনা নিয়ে আলোচনার ডালপালা ছড়াতে শুরু করেছে।

বিগত এক বছরে করোনা মোকাবেলায় বাংলাদেশ কতটুকু প্রস্তুতি গ্রহণ করল এ নিয়েও কথার ফুলঝুরি ফুটছে। প্রায় খবর প্রকাশিত হচ্ছে আইসিইউ না পেয়ে অনেকেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছেন। মৃত্যু জীবনের স্বাভাবিক ঘটনা এরপরও বিনা চিকিৎসায় আপনজনকে হারাতে দিতে চায় এমন মানুষ কম পাওয়া যায়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২০২৫ সাল পর্যন্ত করোনার প্রকোপ থাকবে। আল জাজিরা নিউজে বলা হয়েছে করোনা পুরোপুরি নির্মূল হবে না৷ ব্লুমবার্গের গবেষকরা বলছেন, করোনার পরবর্তী সংকট তৈরি হবে ব্যাপক আত্মহত্যার মধ্য দিয়ে। এই তথ্যকে উড়িয়ে দেয়ার সুযোগ নেই।

করোনার ফলে যে হারে দারিদ্র্য ও বেকারত্ব বাড়ছে তাতে এমন ঘটনা বাংলাদেশেও ভয়াবহ হতে পারে। করোনার নতুন আফ্রিকান প্রকরণ ও যুক্তরাজ্যে ছড়িয়ে পড়া প্রকরণ দুই বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে।

আশঙ্কার বিষয় হলো এই প্রকরণের বিরুদ্ধে আবিষ্কৃত ভ্যাকসিনগুলো যথেষ্ট কার্যকরী নয়। আইসিডিডিআরবি-এর গবেষণা বলছে, সম্প্রতি আক্রান্তদের ৮১ শতাংশই সংক্রমিত হয়েছেন আফ্রিকান প্রকরণের ভাইরাসে।
অন্যদিকে পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য বলছে, বাংলাদেশে করোনা মোকাবেলায় চিকিৎসা সরঞ্জাম পর্যাপ্ত নয়। নতুন করে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের পিপিই সংকট দেখা দিয়েছে।

রোগীদের জন্য পর্যাপ্ত সিটের সংকট, অক্সিজেন সিলিণ্ডার, আইসিইউ, ভেন্টিলেটর, হাইফো ন্যাজাল ক্যানুলা প্রভৃতি সরঞ্জামের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। অথচ এবারে ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ রোগীরই অক্সিজেন প্রয়োজন হচ্ছে।
এসব তথ্য আমাদের হতাশা বাড়িয়ে দেয়৷ তারেক শামসুর রেহমানের সুরেই বলতে হচ্ছে করোনা মহামারী থেকে আমরা কি আদৌ শিক্ষা নিয়েছি? গত বছরে যেসব সংকট ছিল এখনো তাই রয়ে গেছে।

আআইসিডিডিআরবি বলছে বর্তমানে ৬৪ জেলার মধ্যে ৪৬টি জেলা সংক্রমণের উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে। বর্তমানে কোভিড রোগে বাংলাদেশে মৃত্যুহার ১৩.৪ শতাংশ। কিন্তু সাধারণভাবে কোভিড রোগে মৃত্যুহার ৪-৫ শতাংশ। এই তথ্য নিশ্চয় ভীতি জাগানিয়া।

বিশ্ব খাদ্য সংস্থার দেয়া তথ্য মতে বিশ্বব্যাপী ২৬ কোটি মানুষ ক্ষুধার কারণে মারা যাবে। আমাদের দেশে বর্তমানে খাদ্য সংকট নেই। তবে দীর্ঘমেয়াদে করোনা মোকাবিলায় আমরা কতটুকু প্রস্তুত সে বিষয়ে কথা থেকেই যায়। করোনার প্রাদুর্ভাব সহসাই শেষ হবে না এমনটাই বলছেন বিশেষজ্ঞরা।

করোনার প্রাদুর্ভাবে বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার বেড়ে গেছে। সানেম প্রকাশিত প্রতিবেদন বলছে মহামারীতে দারিদ্র্য দ্বিগুণ বেড়ে ৪২% হয়েছে। বিবিএস প্রকাশিত ২০১৬ এর চূড়ান্ত রিপোর্টে এই হার ছিল ২১.৮ শতাংশ। নতুন করে করোনার আগমন এই হারকে আরো বাড়িয়ে দিলেও অবাক হওয়া যাবে না।

করোনার নতুন সংক্রমণে বাংলাদেশের পোশাক রফতানি খাত সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বলে মত দিয়েছেন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান।

আমরা জানি আমাদের প্রধান রফতানি খাত পোশাকশিল্প। এর প্রধান বাজার ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্র।
করোনার নতুন সংক্রমণে পশ্চিমা দেশগুলো পূর্বের মতো এতটা স্থবির হয়ে পড়বে না। কারণ দেশগুলো ইতোমধ্যে তাদের অধিকাংশ নাগরিকের ভ্যাকসিন সরবরাহ নিশ্চিত করেছে। এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র তার জনগণের ৫০ শতাংশকে টিকা দিয়ে ফেলেছে। আগামী মে মাসের মধ্যে তারা ৯০ শতাংশ জনগণকে টিকার আওতায় আনার ঘোষণা দিয়েছেন বাইডেন।

ইউরোপও একই কাজ করছে। উন্নত বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশই ভ্যাকসিন সরবরাহকে জোরালো করেছে। একই সাথে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোও করোনা মোকাবেলায় অনেকটাই সফল বলা যায়। এই অঞ্চলের ভিয়েতনাম পোশাক রফতানিতে বাংলাদেশের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী। দেশটি কারখানা খোলা রেখেছে।

তাই বলা যায়, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের পোশাকের বাজার সচল থাকবে। এখন বাংলাদেশে যে হারে সংক্রমণ বাড়ছে এতে করে পোশাক শিল্পের কর্মীরা অধিক হারে আক্রান্ত হতে শুরু করলে কারখানা চালানোই মুশকিল হয়ে যাবে।
সর্বশেষ প্রকাশিত খবর সর্বাত্মক লকডাউন কার্যকর হলেও পোশাক কারখানা খোলা থাকবে। এখানে স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করা কঠিন। তাই ঝুঁকিও থেকে যাচ্ছে। একমাত্র সমধান ভ্যাকসিন নিশ্চিত করা। সেটাও এই মুহূর্তে সম্ভব নয় কারণ সেরাম ইনন্সিটিউট ভ্যাকসিন রফতানি বন্ধ রেখেছে।

বাংলাদেশের প্রধান দ্বিতীয় রফতানি খাত হল রেমিট্যান্স। গত বছর করোনা চলাকালীন রেমিট্যান্স প্রবাহ গতিশীল ছিল। এর ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ পূর্ববর্তী রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে।

সম্প্রতি প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের লেবার মাইগ্রেশন ইন এশিয়া ইমপ্যাক্ট অব দ্য কোভিড-১৯ ক্রাইসিস অ্যান্ড দ্যা পোস্ট -প্যান্ডেমিক ফিউচার শীর্ষক প্রতিবেদনে দক্ষিণ এশিয়ায় ২৫ ভাগ রেমিট্যান্স কমে যাওয়ার পূর্বাভাস দেয়া হয়েছে। করোনার কারণে অনেক প্রবাসী দেশে ফিরলেও যেতে পারেননি।

করোনার প্রকোপ শুরুর আগে থেকেই দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানি আগের বছরের তুলনায় ৫ শতাংশ কমে গিয়েছিল।

এডিবির পূর্বাভাস অনুযায়ী ২০২৫ সাল পর্যন্ত ৫ বছরে বাংলাদেশের জনশক্তি রফতানি কমে যেতে পারে এবং ভবিষ্যতে এই হার বাড়লেও ফিরে আসবে তারচেয়ে বেশি।

পুনরায় সর্বাত্মক লকডাউন কার্যকর হলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হবে অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাত। বিবিএস-এর হিসাবে এসব খাতেই ৩৫ শতাংশ কর্মসংস্থান হয়।

এমতাবস্থায় বাংলাদেশের সামনে একটাই পথ খোলা আছে তা হলো দ্রুত গণহারে ভ্যাকসিন সরবরাহ নিশ্চিত করা। এই কাজটা যে খুব সহজ হবে তা স্পষ্ট হয়ে উঠছে। ভ্যাকসিন কূটনীতির খেলায় ওই কাজেও বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়েছে।

সামাজিক দূরত্ব মেনে চলা, লকডাউন বাংলাদেশের মতো ঘনবসতিপূর্ণ দেশে বাস্তবসম্মত সমধান নয়। অর্থনীতিকে সচল রেখে করোনা মোকাবেলার নতুন কৌশল খুঁজে বের করা জরুরি হয়ে পড়েছে। পাশাপাশি দ্রুততম সময়ে ভ্যাকসিন প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে জোর প্রচেষ্টা চালাতে হবে।


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us