কুটির শিল্প : ঋণ বিতরণে সমস্যা

এম এ খালেক | May 09, 2021 02:04 pm
কুটির শিল্প : ঋণ বিতরণে সমস্যা

কুটির শিল্প : ঋণ বিতরণে সমস্যা - ছবি : সংগৃহীত

 

গত বছর সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ ব্যাংক কটেজ অ্যান্ড মাইক্রো ইন্ডাস্ট্রিকে এসএমই খাতের অন্তর্ভুক্ত করে। এই সেক্টরের নতুন নাম রাখা হয় কটেজ, মাইক্রো, স্মল অ্যান্ড মিডিয়াম এন্ট্রারপ্রাইজ (সিএমএসএমই)। এর মাধ্যমে প্রকৃতপক্ষে কুটির এবং অতিক্ষুদ্র শিল্পকে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রাতিষ্ঠানিক শিল্প খাত হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। এতদিন কুটির এবং অতি ক্ষুদ্র শিল্পখাত প্রাতিষ্ঠানিক সূত্র থেকে অর্থায়ন বা পুঁজি সংগ্রহের কোনো সুযোগ পেত না। ফলে তাদের স্থানীয় গ্রামীণ মহাজন এবং এনজিওর কাছ থেকে উচ্চসুদে কঠিন শর্তে ঋণ নিতে হতো। সরকার দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য এসএমই শিল্প খাতকে ভিত্তি হিসেবে নির্ধারণ করে এর উপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছে। তাই কুটির এবং অতিক্ষুদ্র শিল্পকে এসএমই খাতের আওতায় নিয়ে আসা হয়। এর কিছুদিন পর এই খাতের নারী উদ্যোক্তাদের জন্য জামানতবিহীন ঋণ দানের প্রস্তাব অনুমোদন করে মন্ত্রিপরিষদ।

কারণ, কুটির ও অতি ক্ষুদ্র শিল্পের উদ্যোক্তাদের বড় অংশই নারী। দেশের আর্থ-সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতে একজন নারীকে ঋণ গ্রহণের সময় জামানত দিতে গিয়ে মারাত্মক সমস্যায় পড়তে হয়। কারণ নারীরা পৈতৃক সম্পত্তি এবং স্বামীর সম্পত্তির উত্তরাধিকার পেতে নানা জটিলতায় পড়েন। কাজেই তারা ইচ্ছে করলেই ঋণের আবেদন করার সময় ব্যাংকের চাহিদামতো জামানত দিতে পারেন না। কুটির এবং অতি ক্ষুদ্র শিল্পকে এসএমই শিল্পের আওতায় নিয়ে আসা এবং মন্ত্রিপরিষদের সভায় নারী উদ্যোক্তাদের জামানতবিহীন ঋণদানের প্রস্তাব অনুমোদিত হওয়ার পর আশা করা হয়েছিল এই দু’টি শিল্পখাতের আনুষ্ঠানিক অর্থায়নের ক্ষেত্রে আর কোনো প্রতিবন্ধকতা থাকবে না। বিশেষ করে নারী উদ্যোক্তারা চেষ্টা করলেই ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ করতে পারবেন। কিন্তু বাস্তবে এই খাতে যুক্ত নারী উদ্যোক্তাদের বিদ্যমান সমস্যার কোনো সমাধান হয়নি। তাদের এখনো অর্থায়নের জন্য গ্রামীণ মহাজন এবং এনজিওর কাছেই ধর্ণা দিতে হচ্ছে।

পদ্ধতিগত জটিলতার কারণে বাংলাদেশ ব্যাংকের সেই উদ্যোগ কতটা সফল হয়েছে বা হচ্ছে তা নিয়ে এরই মধ্যে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। করোনার আর্থিক ক্ষতি মোকাবেলার জন্য সরকার বিভিন্ন খাতের জন্য প্রাথমিক পর্যায়ে এক লাখ তিন হাজার ১১৭ কোটি টাকার আর্থিক প্রণোদনা ঘোষণা করেন। এর মধ্যে সিএমএসএমই খাতের জন্য ২০ হাজার কোটি টাকার ঋণ প্রণোদনা ঘোষণা করা হয়। বৃহৎ শিল্পের জন্য ৪০ হাজার কোটি টাকারও বেশি ঋণ প্রণোদনা ঘোষণা করা হয়। বৃহৎ শিল্পের জন্য ঘোষিত ঋণ প্রণোদনার পুরোটাই এই সেক্টরের উদ্যোক্তারা ব্যাংক থেকে ছাড় করিয়ে নিয়েছেন। কিন্তু সিএমএসএমই খাতের উদ্যোক্তারা তাদের জন্য বরাদ্দকৃত প্রণোদনামূলক ঋণ ব্যাংক থেকে ছাড় করিয়ে নিতে পারেননি। গত বছর ১৩ এপ্রিল এই প্রণোদনা ঘোষণা করা হয়। গত বছর আগস্ট মাসের মধ্যে এই ঋণ বিতরণের জন্য সময় নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু ব্যাংকগুলো নির্ধারিত সময়ে এই ঋণ বিতরণ করতে পারেনি।

২০ হাজার কোটি টাকা প্রণোদনামূলক ঋণের মধ্যে ১৪ হাজার কোটি টাকা কুটির ও অতিক্ষুদ্র শিল্পের জন্য এবং অবশিষ্ট ছয় হাজার কোটি টাকা মাঝারি আকারের শিল্পের জন্য বিতরণ করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত ছিল। মাঝারি শিল্পের মালিক বা উদ্যোক্তারা এই ঋণের বৃহদাংশই নিয়ে নিলেও কুটির এবং অতিক্ষুদ্র শিল্পোদ্যোক্তারা ব্যাংক থেকে ঋণ ছাড় করাতে পারেননি। বেশ কয়েকবার সময় বাড়িয়েও কাজ হয়নি। গত ৩১ মার্চ পর্যন্ত সময়ে সিএমএসএমই খাতের জন্য বরাদ্দকৃত প্রণোদনামূলক ঋণের ৭২ দশমিক ৩১ শতাংশ বিতরণ করা সম্ভব হয়েছে। বিতরণকৃত ঋণের বেশির ভাগই পেয়েছেন মিডিয়াম বা মাঝারি শিল্প মালিকরা। যদিও এর হিসাব আলাদাভাবে প্রকাশ করা হয়নি। প্রাথমিক পর্যায়ে সিএমএসএমই খাতের জন্য বরাদ্দকৃত ২০ হাজার কোটি টাকাই সিডিউল ব্যাংকগুলোর নিজস্ব তহবিল থেকে বিতরণ করার নির্দেশনা ছিল। কিন্তু তারল্য সঙ্কট সৃষ্টি হতে পারে এই বিবেচনায় পরবর্তীতে ১০ হাজার কোটি টাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের তহবিল থেকে পুনঃঅর্থায়নের ঘোষণা দেয়া হয়। বাংলাদেশ পুঁজি সঙ্কটের দেশ। এদেশের উদ্যোক্তারা সব সময়ই পুঁজির স্বল্পতায় ভোগে। কিন্তু সিএমএসএমই খাতের উদ্যোক্তাদের জন্য বরাদ্দকৃত প্রণোদনামূলক ঋণের অর্থ অব্যবহৃত থেকে যাচ্ছে বিষয়টি নিশ্চিতভাবেই ভেবে দেখার মতো।

কুটির ও অতি ক্ষুদ্র শিল্প মালিকরা ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার চেষ্টা করেও তেমন সাড়া পাচ্ছেন না। ব্যাংকগুলো সাধারণত ‘তেলা মাথায় তেল’ দিতেই পছন্দ করে। কুটির এবং অতিক্ষুদ্র শিল্প উদ্যোক্তাদের ঋণ দিতে তাদের তেমন কোনো উৎসাহ নেই।

ব্যাংক ঋণ পেতে যে ঝামেলা পোহাতে হয় কুটির ও অতিক্ষুদ্র শিল্পের উদ্যোক্তারা তা সহ্য করতে পারেন না। ব্যাংকের সাথে তাদের আগে থেকে কোনো যোগাযোগ নেই। আর আগে থেকে যোগাযোগ নেই এমন উদ্যোক্তাদের ঋণ দানের ক্ষেত্রে ব্যাংক আগ্রহী হয় না। ঋণের জন্য আবেদনকারীদেরও অবশ্য কিছু সমস্যা থাকে। কিভাবে ঋণের আবেদন করতে হয়, কিভাবে জামানত দিতে হয় এসব ব্যাপারে তারা প্রায়ই অজ্ঞ থাকেন। ফলে এসব বিষয়ে ব্যাংক কর্মকর্তাদের প্রশ্নের জবাব দিতে পারেন না। বিশেষ করে নারী উদ্যোক্তারা ঋণের জন্য ব্যাংকে গেলেও তারা ব্যাংকের প্রচলিত আইন-কানুন সম্পর্কে প্রায়ই তেমন কিছু বোঝেন না।

কুটির এবং অতিক্ষুদ্র শিল্পের উদ্যোক্তারা সিএমএসএমই খাতের জন্য নির্ধারিত ঋণ পেতে ব্যর্থ হওয়ার পেছনে সবচেয়ে বড় যে কারণ সেটি হলোÑ এই খাতের শিল্পের সংজ্ঞা। কুটির এবং অতিক্ষুদ্র শিল্পের সাথে মাঝারি শিল্পের বিশালতায় যে পার্থক্য তা কোনোভাবেই উপেক্ষা করার মতো নয়। হাতি এবং ছাগলের মধ্যে প্রতিযোগিতা হলে যেমন অবস্থা হবে কুটির এবং অতিক্ষুদ্র শিল্পগুলো মাঝারি শিল্পের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে ঠিক একই অবস্থায় পড়ছে। সিএমএসএমই খাতের জন্য যে সব সুবিধা দেয়া হয় তার বেশির ভাগই মাঝারি শিল্পের উদ্যোক্তারা নিয়ে যান। বিভিন্ন ক্যাটাগরির শিল্পের প্রচলিত সংজ্ঞায় কেমন বৈসাদৃশ্য রয়েছে তা আমরা একটু বিশ্লেষণ করে দেখলেই অনুধাবন করতে পারবো।

২০১৬ সালে প্রণীত শিল্পনীতি

২০১৬ সালে বিভিন্ন আকারের শিল্পগুলোকে প্রধানত পাঁচটি বিশেষ শ্রেণীতে বিভক্ত করে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে- ক. বৃহৎ শিল্প। ম্যানুফ্যাকচারিংয়ের ক্ষেত্রে বৃহৎ শিল্প বলতে এমন সব শিল্পকে বুঝানো হয়েছে যেসব প্রতিষ্ঠানে জমি ও কারখানা ভবন ছাড়াই স্থায়ী সম্পদের মূল্য প্রতিস্থাপন ব্যয়সহ ৫০ কোটি টাকা বা তারও বেশি এবং কর্মরত জনবলের সংখ্যা তৈরী পোশাকের মতো শ্রমঘন শিল্প ছাড়া ৩০০ জনের বেশি। তৈরী পোশাক বা এ ধরনের শ্রমঘন শিল্পের ক্ষেত্রে কর্মরত জনবলের সংখ্যা এক হাজার জনের বেশি সেই শিল্পকে বৃহৎ শিল্প হিসেবে আখ্যায়িত করা যাবে। সেবা শিল্পের ক্ষেত্রে যেসব প্রতিষ্ঠানের স্থায়ী সম্পদের পরিমাণ ৩০ কোটি টাকা বা তারও বেশি এবং ১২০ জন বা তারও বেশি শ্রমিক কর্মরত আছেন এমন শিল্পকে বৃহৎ শিল্প বলা হবে। খ. মাঝারি শিল্প বলতে ম্যানুফ্যাকচারিংয়ের ক্ষেত্রে জমি ও কারখানা ভবন ছাড়া স্থায়ী সম্পদের মূল্য প্রতিস্থাপন ব্যয়সহ ১৫ কোটি টাকার বেশি কিন্তু ৫০ কোটি টাকার কম এবং কর্মরত লোকবলের সংখ্যা ১২১ থেকে ৩০০ জন এমন শিল্পকে মাঝারি শিল্প বলা হবে। তবে তৈরী পোশাক কারখানার ক্ষেত্রে কর্মরত শ্রমিকের সংখ্যা সর্বোচ্চ এক হাজার জন।

সেবা খাতে মাঝারি শিল্প বলতে প্রতিষ্ঠানের জমি ও কারখানা ভবন ছাড়াই স্থায়ী সম্পদের পরিমাণ প্রতিস্থাপন ব্যয়সহ দুই কোটি টাকা থেকে ৩০ কোটি টাকা এবং কর্মরত লোকবলের সংখ্যা ৫১ থেকে ১২০ জন। গ. ক্ষুদ্র শিল্প বলতে এমন শিল্প বোঝাবে যেসব প্রতিষ্ঠানের জমি ও কারখানা ভবন ছাড়া স্থায়ী সম্পদের পরিমাণ প্রতিস্থাপন ব্যয়সহ ৭৫ লাখ টাকা থেকে ১৫ কোটি টাকা এবং কর্মরত লোকবলের সংখ্যা ৩১ থেকে ১২০ জন। এই খাতের সেবা শিল্পের ক্ষেত্রে স্থায়ী সম্পদের পরিমাণ হবে ১০ লাখ টাকা থেকে দুই কোটি টাকা এবং কর্মরত লোকবলের সংখ্যা হবে ১৬ থেকে ৫০ জন। ঘ. মাইক্রো শিল্প বলতে এমন শিল্পকে বুঝাবে স্থায়ী সম্পদের পরিমাণ ১০ লাখ টাকা থেকে ৭৫ লাখ টাকা এবং কর্মরত লোকবলের সংখ্যা ১৬ থেকে ৩০ জন। সেবা খাতের ক্ষেত্রে স্থায়ী সম্পদের পরিমাণ ১০ লাখ টাকার নিচে এবং লোকবল সর্বোচ্চ ১৫ জন। ঙ. কুটির শিল্প বলতে এমন শিল্পকে বুঝাবে যেখানে স্থায়ী সম্পদের পরিমাণ ১০ লাখ টাকার কম এবং কর্মরত লোকবল ১৫ জনের বেশি নয়, যাদের অধিকাংশই পরিবারের সদস্য।

শিল্পে সংজ্ঞায়নে বেশ কিছু বৈসাদৃশ্য লক্ষ করা যাচ্ছে। ম্যানুফ্যাকচারিং খাতে স্থায়ী সম্পদের পরিমাণ ৫০ কোটি টাকার অধিক এবং কর্মরত লোকবলের সংখ্যা ৩০০ জনের বেশি হলেই সেটি বৃহৎ শিল্প হিসেবে বিবেচিত হবে। অন্যদিকে স্থায়ী সম্পদের পরিমাণ ৫০ কোটি টাকার সামান্য কম এবং কর্মরত লোকবলের সংখ্যা ৩০০ জন হলেও তা মাঝারি শিল্প হিসেবে পরিগণিত হবে। অর্থাৎ কোনো প্রতিষ্ঠানে ৫০ কোটি টাকার স্থায়ী সম্পদ এবং ৩০০ জন লোকবল থাকলে তা মাঝারি শিল্প হিসেবে বিবেচিত হবে। আবার কোনো শিল্পের স্থায়ী সম্পদের পরিমাণ ৫০ কোটি এত লাখ টাকা এবং কর্মরত লোকবলের সংখ্যা ৩০১ জন হলেই তা বৃহৎ শিল্প হিসেবে পরিগণিত হবে।

অনেক উদ্যোক্তা আছেন যারা এসএমই খাতের জন্য দেয়া বিভিন্ন সুবিধা গ্রহণের লক্ষ্যে তাদের বৃহৎ প্রতিষ্ঠানকেও মাঝারি শিল্প হিসেবে প্রদর্শন করেন। মাঝারি শিল্পের সঙ্গে বড় শিল্পের মিল রয়েছে। কাজেই মাঝারি শিল্পকে ক্ষুদ্র শিল্পের সাথে যুক্ত না করে বৃহৎ শিল্পের ক্যাটাগরিতে ফেলাই ছিল যৌক্তিক। চিতা বাঘের সাথে বিড়ালের দৌঁড় প্রতিযোগিতা হলে যেমন অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে মাঝারি শিল্পের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে ক্ষুদ্র, কুটির ও অতি ক্ষুদ্র শিল্পের অবস্থা ঠিক তেমনই হয়েছে। যারা বৃহৎ এবং মাঝারি শিল্প মালিক তারাও করোনার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। কিন্তু তুলনামূলকভাবে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ক্ষুদ্র, অতিক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প উদ্যোক্তারা। বিশ^ব্যাপী মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষের সংখ্যা করোনার কারণে হ্রাস পেতে শুরু করেছে। এটা একটি অস্বাভাবিক ঘটনা। কারণ নিকট অতীতে আর কখনোই মধ্যবিত্তর সংখ্যা কমেনি। কিন্তু করোনার কারণে মধ্যবিত্তের সংখ্যা কমছে। এর কারণ হলো, মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষই সবচেয়ে সৃজনশীল ক্ষমতার অধিকারী। ভারতীয় বংশোদ্ভূত নোবল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বন্দোপাধ্যায় তার এক গবেষণায় একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষের তিনটি অবদানের কথা উল্লেখ করেছিলেন। তিনি বলেছেন- ক. উদ্যোক্তা সাধারণত মধ্যবিত্ত শ্রেণী থেকেই আসে। তারা সমাজে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করে এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে, খ. মধ্যবিত্তের মূল্যবোধ মানব পুঁজি আহরণ ও সঞ্চয়ের উপর জোর দেয়, যা অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রধান উপকরণ এবং গ. মধ্যবিত্তরা দরিদ্র মানুষের তুলনায় বেশি ভোগ করে এবং ভোগ ব্যয় বৃদ্ধির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।

মধ্যবিত্তদের মাঝ থেকেই ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের উদ্যোক্তা সৃষ্টি হয়। তারাই এক সময় বড় শিল্পের উদ্যোক্তায় পরিণত হন। প্রাপ্ত পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১১ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত সময়ে বিশে^ মধ্যবিত্তের সংখ্যা ৮৯ কোটি ৯০ লাখ থেকে ১৩৪ কোটিতে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। অর্থাৎ প্রতি বছর মধ্যবিত্তের সংখ্যা বেড়েছে পাঁচ কোটি ৪০ লাখ। কিন্তু করোনার কারণে বিশ^ব্যাপী মধ্যবিত্তের সংখ্যা কমে যাবে উল্লেখযোগ্যভাবে। এর মধ্যে শুধু দক্ষিণ এশিয়াতেই দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বাড়বে সাত কোটি ৮০ লাখ। এরা প্রধানত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত ছিল। মধ্যবিত্ত মানুষের বেশির ভাগই ক্ষুদ্র এবং কুটির শিল্প উদ্যোক্তা। সাধারণভাবে কৃষির উপর নির্ভর করে পরিজন নিয়ে খেয়ে পরে বেঁচে থাকা যায় কিন্তু শ্রেণী মান পরিবর্তন করা যায় না। শ্রেণী মান পরিবর্তনের জন্য শিল্পের উপর জোর দিতে হয়। কারণ কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি পায় গাণিতিক হারে। আর শিল্প উৎপাদন বৃদ্ধি পায় জ্যামিতিক হারে। করোনার কারণে বিশ^ব্যাপী মধ্যবিত্ত মানুষের সংখ্যা কমেছে তার কারণ বিশ্বব্যাপী ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের উদ্যোক্তারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তারা পেশা হারিয়েছেন। ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান তাদের সঙ্কটকালে পুঁজির যোগান দিচ্ছে না। ব্যাংকগুলো মাঝারি এবং বৃহৎ শিল্পে ঋণদানের ক্ষেত্রে যতটা আগ্রহী ঠিক ততটাই অনাগ্রহী ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পে ঋণ দানের বেলায়।

ব্যাংক ব্যবস্থায় ক্ষুদ্র, অতিক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের উদ্যোক্তারা মারাত্মকভাবে বঞ্চিত হচ্ছেন। তাই তারা প্রয়োজনীয় অর্থায়নের জন্য গ্রামীণ মহাজন ও এনজিওর কাছে ধর্ণা দেন। এই দু’টি সূত্র থেকে খুব সহজেই ঋণ পাওয়া যায়। কোনো ধরনের হয়রানির শিকার হতে হয় না। তাই তারা এসব সূত্র থেকেই ঋণ গ্রহণ করেন। কিন্তু সেখানে ঋণের সুদের হার অস্বাভাবিক রকম বেশি। এনজিওর ঋণের সুদের হার ২৪ শতাংশ। অনেক প্রতিষ্ঠান নানা অজুহাতে এর চেয়ে বেশি হারে সুদ আদায় করে। গ্রামীণ মহাজনদের বেলায় তো কোনো নিয়ম-নীতি নেই। তারা যার থেকে যেমন পারেন সুদ আদায় করেন। উচ্চ সুদের কারণে পণ্যের উৎপাদন ব্যয় অনেক বেড়ে যায়। তারা বাজারে গিয়ে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারেন না। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, এনজিওর ঋণ গ্রহণকারীদের দারিদ্র্য বিমোচন হয় খুবই কম।

জামালপুর জেলা হস্তশিল্প অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও বাংলাদেশ উইমেন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ জামালপুর জেলা শাখার আহ্বায়ক ডা. সাঈদা আক্তার বলেন, ‘বর্তমান সরকার নারীর আর্থিক ক্ষমতায়নে বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু তৃণমূল পর্যায়ের এক শ্রেণীর কর্মকর্তার অসহযোগিতার কারণে সরকারের উদ্যোগ কাক্সিক্ষত মাত্রায় সুফল পাচ্ছে না। বিশেষ করে প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ প্রাপ্তির ক্ষেত্রে নারী উদ্যোক্তাদের অসুবিধায় পড়তে হয়। ব্যাংক ঋণদানের ক্ষেত্রে এমন সব ডকুমেন্ট চায় যা নারী উদ্যোক্তাদের পক্ষে প্রায়ই দেয়া সম্ভব হয় না। যেমন, তারা ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের ঋণদানের ক্ষেত্রে শোরুম দেখতে চায়। শোরুম না থাকলে ঋণ দিতে চান না। কিন্তু ক্ষুদ্র নারী উদ্যোক্তাদের সবার তো শোরুম নেই। তাই বিপুল সম্ভাবনা থাকার পরও তাদের পক্ষে ব্যাংক ঋণপ্রাপ্তি সহজ হয় না। তারা জামানত হিসেবে সম্পত্তি চায়। কিন্তু আমাদের দেশের সমাজ বাস্তবতায় নারীরা অনেক সময়ই সম্পদের মালিকানা লাভ করে না। বাবার সম্পত্তির ভাগ পেতে তাদের ঝামেলা পোহাতে হয়। ফলে নারীর একক অধিকারে সম্পদ থাকে খুবই কম। তারা ব্যাংকের চাহিদা মতো জামানত দিতে পারেন না। ব্যাংক ঋণদানের ক্ষেত্রে উপযুক্ত গ্যারান্টর চায়। কিন্তু নারীদের পক্ষে গ্যারান্টর যোগার করাও বেশ কঠিন। অনেক সময় স্বামী গ্যারান্টর হয় ঠিকই কিন্তু তারা গৃহীত ঋণের একটি বড় অংশ নিজেদের প্রয়োজনে নিয়ে নেন। ফলে সংশ্লিষ্ট নারী উদ্যোক্তার পক্ষে ব্যাংক ঋণের কিস্তি পরিশোধ করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।

করোনা সংক্রমণ চলে যাওয়ার পর অর্থনৈতিক উন্নয়নে অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প হয়তো গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। কিন্তু তাদের নার্সিং করার কোনো ব্যবস্থা নেই। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য সিএমএসএমই খাতের পুনর্বিন্যাস করা যেতে পারে। মাঝারি শিল্পকে এই খাত থেকে তুলে নিয়ে বৃহৎ শিল্পের সাথে একীভূত করা যেতে পারে। কুটির, অতিক্ষুদ্র এবং ক্ষুদ্র শিল্পকে একত্রিত করে একটি নতুন সেক্টর গঠন করা যেতে পারে। এই খাতের জন্য প্রদত্ত ঋণ হতে হবে সম্পূর্ণ জামানতমুক্ত। ব্যাংকগুলোকে তাদের ঋণের একটি নির্দিষ্ট অংশ এই খাতে বিতরণ করার জন্য বাধ্য করা প্রয়োজন। একই সাথে বৃহৎ শিল্পের ব্যাকওয়ার্ড লিঙ্কেজ হিসেবে অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র এবং কুটির শিল্পকে গড়ে তুলতে হবে। আগামীতে টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধন করতে হলে অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের উপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া ব্যতীত আর কোনো গত্যন্তর নেই।


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us