রাষ্ট্রপতির যে বক্তব্য ভাইরাল

গোলাম মাওলা রনি | Jun 25, 2021 01:32 pm
রাষ্ট্রপতি মো: আবদুল হামিদ

রাষ্ট্রপতি মো: আবদুল হামিদ - ছবি : সংগৃহীত

 

রাষ্ট্রপতি মো: আবদুল হামিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকটি সমাবর্তন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথিরূপে যে বক্তব্য দিয়েছেন তা এখন ভাইরালরূপে বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে ভাসছে। বেশির ভাগ বক্তব্যই অত্যন্ত রসালো এবং অতীব সূ² ব্যঙ্গাত্মক মন্তব্যে অলঙ্কৃত। ফলে তার সেসব বক্তব্য শুনে উপস্থিত ছাত্রছাত্রী কিংবা শিক্ষক-শিক্ষয়িত্রী যেভাবে হেসে গড়াগড়ি দিয়েছেন তদ্রুপ কোটি কোটি ইউটিউব বা ফেসবুক দর্শকও অনবরত হেসেই চলেছেন। কিন্তু খুব অল্প লোকই রাষ্ট্রপতির বক্তব্যের অন্তরালে যে বাস্তব সত্যগুলো লুকায়িত রয়েছে সেগুলো খোঁজার চেষ্টা করেন। রাষ্ট্রপতির ভাষণগুলোর মধ্যে একটি ভাষণের কিছু বক্তব্য আপনাদের শুনালে আপনারা সহজেই বুঝতে পারবেন, রাষ্ট্রপতি হাস্যরসের অন্তরালে কতবড় চাপা কান্নার ইতিকথা সন্নিবেশিত করেছেন।

রাষ্ট্রপতি তার একটি বক্তব্যে উল্লেখ করেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি হিসেবে দাওয়াত পাওয়ার পর থেকেই তার বুকের মধ্যে একধরনের ভয়ের কম্পন শুরু হয়ে যায়। কারণ তিনি ভেবে পান না- কেন তাকে এমন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে দাওয়াত করা হয় যেখানে ছাত্রজীবনে শত চেষ্টা করেও যিনি ভর্তি হতে পারেননি। অনেক পরীক্ষায় টেনেটুনে পাস করা রাষ্ট্রপতি দেশের সবচেয়ে সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে জ্ঞান-গুণী ছাত্র-শিক্ষকদের মাঝে কী বলবেন এসব চিন্তায় তার পেরেশানি বেড়ে যায়। তার সচিব তাকে যে বক্তব্য লিখে দেন তা পড়তে যেমন তার ভালো লাগে না তদ্রুপ তার বিশ্বাস- রাষ্ট্রপতির দফতরের লিখিত বক্তব্য সমাবর্তনে অংশগ্রহণকারীদেরও ভালো লাগে না। তাই তিনি তোতা পাখির মতো গড় গড় করে লিখিত বক্তব্য পাঠ করার পর নিজের জীবনের বাস্তবতা নিয়ে যখন ব্যঙ্গ কৌতুক করেন তখন উপস্থিত দর্শক শ্রোতারা আনন্দে ফেটে পড়েন।

আপনারা যদি একটু মনোযোগ দিয়ে রাষ্ট্রপতির বক্তব্য বিশ্লেষণ করেন তবে বুঝবেন, তিনি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে কটাক্ষ করে বলেছেন যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথির কেবল পদ-পদবি থাকলে হবে না, তার জ্ঞানগরিমা হতে হবে শিক্ষকদের শিক্ষক হওয়ার যোগ্যতাসম্পন্ন। অতীতকালে যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ বলা হতো তখন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ খুঁজে খুঁজে শ্রেষ্ঠতর জ্ঞানী-গুণীকে সমাবর্তন অনুষ্ঠানের প্রধান মেহমান বানাতেন। কিন্তু কালের বিবর্তনে সব কিছুতে যখন ঘুণ পোকার আক্রমণ শুরু হয় তখন সাবেক প্রাচ্যের অক্সফোর্ড এবং ক্ষমতা পদ-পদবি ও রাজনীতি দ্বারা প্রলুব্ধ ও প্রভাবিত হতে থাকে যার ইঙ্গিত রাষ্ট্রপতি তার বক্তব্যের মাঝে লুকিয়ে রেখেছেন।

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার একবার বুয়েট তথা বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রছাত্রীদের একটি সমাবর্তন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্য দিচ্ছিলেন। বক্তব্যের শুরুতেই তিনি কৌতুক করে বলতে আরম্ভ করলেন যে, বুয়েট হলো, দেশের সবচেয়ে মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের একটি প্রতিষ্ঠান। দেশসেরা ছাত্রছাত্রীরা সবার আগে চেষ্টা করে বুয়েটে ভর্তি হওয়ার জন্য। যারা পারে না তারা মেডিক্যাল ও অন্যান্য প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে চেষ্টা করে এবং সেখানেও যারা ব্যর্থ হয় তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। অন্য দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা চান্স পায় তাদের মধ্যে সবচেয়ে মেধাহীনরাই বাংলা বিভাগে ভর্তি হয়ে থাকে। আমি সেই বাংলা বিভাগের একজন ছাত্র ছিলাম এবং কর্মজীবনে অন্য কোনো কিছু করতে না পেরে সারা জীবন শুধু বাংলাই পড়িয়েছি।

স্যার এরপর বলেন, আজ বুয়েটের এই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসাবে বক্তব্য দিতে গিয়ে আমার বারবার মনে হচ্ছে- কেন আমাকে এখানে দাওয়াত করা হলো? দেশের একি অধঃপতন শুরু হলো- দেশের সবচেয়ে মেধাবী লোকদের সামনে বক্তব্য দেয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে সবচেয়ে কম মেধাবী একজন মানুষকে। দেশে কি মেধার এত অকাল পড়েছে যে, আমাকেই বক্তব্য দিতে হবে! আগেকার জমানা হলে হয়তো এমন অনুষ্ঠানে বক্তব্য দিতে সাহস পেতাম না। কিন্তু একটি কারণে ইদানীংকালে আমার স্পর্ধা বেড়ে গেছে। একদিন সচিবালয়ে গিয়েছিলাম এবং সেখানে গিয়ে সে দৃশ্য দেখলাম যার প্রভাবে আমি এখন অনেক কিছু বলার স্পর্ধা দেখাতে পারি। আমার এখন মনে হয়- ও যদি পারে তবে আমি কেনো পারব না? সচিবালয়ের যে দৃশ্যের কথা বলছি সেখানে দেখলাম, সবচেয়ে বড় চেয়ারটিতে একজন বসে আছে এবং তাকে ঘিরে অনেক লোক তটস্থ অবস্থায় দাঁড়িয়ে বসে নিবিষ্টচিত্তে হা করে বড় চেয়ারওয়ালার কথা শুনছে। সেখানে যারা সে দিন উপস্থিত ছিল আমি তাদের সবাইকে চিনতাম ও আমার জানা মতে বড় চেয়ারে বসা লোকটি ছিল উপস্থিত সবার চেয়ে মেধাহীন এবং অযোগ্য। সুতরাং এতগুলো মেধাবী লোকের সামনে একজন গর্দভ প্রকৃতির চেয়ারধারী যদি বকবক করতে পারে এবং সবাই যদি তা আবার মনোযোগসহকারে শোনে তবে আমি কেনো পারব না? আসলে সে দিনের সেই দৃশ্য দেখার পর আমার স্পর্ধা অনেক বেড়ে গেছে!

স্যারের কথা শুনে উপস্থিত লোকজন বেজায় হেসেছিলেন। কিন্তু স্যার স্যাটায়ার করতে গিয়ে তার সে দিনের বক্তব্যে যা ইঙ্গিত করেছেন তা মূলত আজকের সমাজের নির্মম বাস্তবতা। ইদানীং আমাদের পরিবার, সমাজ-সংসার এবং রাষ্ট্রে যারা উঁচু গলায় কথা বলেন এবং যারা মথা নিচু করে সেসব কোকিলরূপী কাকদের কর্কশ কথাবার্তা শোনেন এবং মান্য করতে বাধ্য হন তা যদি মনুষ্য সমাজের পরিবর্তে গহিন অরণ্য দুর্গম পাহাড় কিংবা ঊষর সাহারা মরুভ‚মিতে বসবাসরত অন্য কোনো প্রাণী বা কীট-পতঙ্গের বেলায় ঘটত তাহলে সেখানে প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটত। অর্থাৎ অরণ্যে যদি বাঘ-সিংহদেরকে জড়ো করে শুয়োর-সজারু বা শিয়াল বক্তৃতা দিত তবে পুরো অরণ্য মুহূর্তে মরুভ‚মিতে পরিণত হতো। অন্য দিকে মরুভ‚মির দুরন্ত চিতা, উট কিংবা ঘোড়ার সমাবেশে যদি ভেড়া বক্তব্য দিত তবে মরুভ‚মিতে মুহূর্তের মধ্যে বরফের রাজ্য সৃষ্টি হয়ে যেত। একইভাবে বরফের দেশের মেরু ভাল্লুকের সামনে যদি ছাগল এসে নির্দেশ জারি করত তাহলে সেখানকার সব বরফ উড়ে যেত এবং ভূ-অভ্যন্তরের গলিত লাভা বের হয়ে এসে পুরো অঞ্চলে কিয়ামত ঘটিয়ে দিত।

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য

 


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us