ভারতে মুসলিম জনসংখ্যা কত বাড়ছে?

মাসুম মুরাদাবাদী | Nov 14, 2021 02:55 pm
এপিজে আবদুল কালাম

এপিজে আবদুল কালাম - ছবি সংগৃহীত

 

ভারতে মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধির মিথ্যা প্রপাগান্ডা নতুন নয়। দেশবাসীকে মুসলমানদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়া ও তাদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়ানোর জন্য এ মিথ্যা বারবার বলা হয়। বারবার প্রকৃত সংখ্যার শক্ত প্রমাণ দিয়ে তা প্রত্যাখ্যানও করা হয়। তবে আরএসএসের লোকেরা প্রবল শক্তি দিয়ে বারবার এ মিথ্যা এ জন্য বলছেন যে, যদি কোনো মিথ্যাকে ১০০ বার বলা হয়, তাহলে সেটাকে সত্য ধরে নেয়া হয়। বিজেপির ক্ষমতায় আসার পর ‘গৃহপালিত’ মিডিয়াও এই মিথ্যা ছড়াতে আরএসএসের সহযোগী হয়ে গেছে।

নাগপুরে আরএসএস নেতা মোহন ভাগবত দশমী উপলক্ষে বক্তৃতাগুলোতে এবার যেখানেই মুসলিম জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের কথা বলেছেন, সেখানেই ধর্মান্তরকে ‘জাতীয় ঐক্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতি’ বলে অভিহিত করেছেন। এর পাশাপাশি তিনি এমন কিছু মুসলমানের নাম প্রস্তাব করেন, মুসলমানরা যাদের ‘রোল মডেল’ (অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব) হিসেবে যেন বেছে নেয়। এ বিষয়ে আমরা বলব। তার আগে ভারতে মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধি নিয়ে তাদের পেরেশানির পর্যালোচনা করি। মোহন ভাগবত মুসলমানদের জনসংখ্যা বৃদ্ধিকে এক কঠিন পরিস্থিতির সাথে তুলনা করে তাকে নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনীয়তা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, ১৯৫১ থেকে নিয়ে ২০১১ সালের মাঝে যেখানে ভারতে জন্মগ্রহণকারী হিন্দুসহ নানা ধর্মের জন্মহার ৮৮ শতাংশ থেকে হ্রাস পেয়ে ৮৩ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে, সেখানে মুসলিম জনসংখ্যার হার ৯.৮ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ১৪.২৩ শতাংশ হয়ে গেছে। তিনি এ কথাও বলেন যে, দেশের ৯টি প্রদেশে মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ৩০ শতাংশের বেশি। তিনি বলেন, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতিগুলো দ্বারা জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার হ্রাস পেয়েছে, তবে ভিন্ন ভিন্নভাবে ধর্মীয় সম্প্রদায়গুলোর জনসংখ্যার মাঝে ভারসাম্য না থাকার প্রেক্ষাপটে এ নীতি পুনর্বিবেচনা করা প্রয়োজন। তিনি বলেন, “কয়েকটি সম্প্রদায়ের জনসংখ্যার হারে বেশ পার্থক্য রয়েছে। বিদেশী হস্তক্ষেপ ও ধর্মান্তরের কারণে সীমান্ত এলাকাগুলোর জনসংখ্যার হারে ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি করছে। এটা দেশের ঐক্য, অবিচ্ছিন্নতা ও সাংস্কৃতিক পরিচিতির জন্য ‘গভীর সঙ্কট’ হতে পারে।” এর প্রমাণ উপস্থাপন করে তিনি বলেন, ‘সীমান্ত প্রদেশগুলোতে মুসলিম জনসংখ্যার হার জাতীয় গড়ের চেয়ে অনেক বেশি।’ এটা স্পষ্টভাবে বাংলাদেশের হস্তক্ষেপের প্রতি ইঙ্গিত করে। তিনি বলেন যে, উত্তর-পূর্বে শুধু এক দশকেই অরুণাচল প্রদেশে খ্রিষ্টান জনসংখ্যা ১৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।

মুসলিম জনসংখ্যার হার বৃদ্ধি সম্পর্কে মোহন ভাগবত যা কিছু বলেছেন, কয়েকটি জরিপ তা প্রত্যাখ্যান করেছে। সম্প্রতি প্রখ্যাত সাংবাদিক ও অভিজ্ঞ অর্থনীতিবিদ স্বামী নাথান আয়ারের একটি প্রবন্ধ হিন্দি দৈনিক ‘নওভারত টাইমস’ (৫ অক্টোবর, ২০২১)-এ প্রকাশ পেয়েছে। ‘মুসলমানদের সম্পর্কে মিথ্যা ছড়ানো হচ্ছে’ শিরোনামে তিনি লিখেছেন, ‘এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, স্বাধীনতা পরবর্তী প্রতিটি আদমশুমারিতে জনসংখ্যায় মুসলিমদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৯৫১ সালে মুসলমান ছিল প্রায় ১০ শতাংশ। ২০১১ সালে সেটা ১৪ শতাংশের বেশি হয়ে গেছে। পক্ষান্তরে, সেখানে হিন্দুদের সংখ্যা প্রায় ৮৪ শতাংশ থেকে হ্রাস পেয়ে ৮০ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে। ছয় দশকের এই সময়ের মাঝে মুসলমানদের সংখ্যা প্রায় চার শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এটা হঠাৎ হয়নি। এ বৃদ্ধি ধীরে ধীরে হয়েছে। যদি বৃদ্ধির এই গতি অব্যাহত থাকে, তবুও এই শতাব্দীর শেষে গিয়ে মোট জনসংখ্যায় মুসলমানদের অংশ ২০ শতাংশের বেশি হবে না। বরং বৃদ্ধির হার কমই থাকবে। কেননা, মুসলমান ও হিন্দুদের জন্মহারে ব্যবধান দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে। হতে পারে, উভয়ের জন্মহার একই রকম হয়ে যাবে।’ স্বামী নাথান আয়ার তার প্রবন্ধে দীর্ঘ যুক্তি উপস্থাপনের পর লিখেছেন, ‘মুসলমানদের জনসংখ্যা নিয়ে বিজেপি যতই হইচই করুক, তাদের অভিযোগে কোনো বাস্তবতা নেই। মুসলমানদের জনসংখ্যা বৃদ্ধির শঙ্কা দেখিয়ে হিন্দুদের ভয় দেখানোর চেষ্টা করা হচ্ছে, যাতে তাদের ভোট পাওয়া যায়।’

এখন আসুন, মোহন ভাগবতের ওই বক্তৃতার দিকে যাই, যেখানে তিনি মুসলমানদের ‘রোল মডেল’-এর নাম প্রস্তাব করেছেন। তিনি তার পছন্দের যে সব মুসলমানের নাম প্রস্তাব করেছেন, তাদের মধ্যে প্রথম নামটি হচ্ছে মোগল শাহজাদা দারাশিকোর। দ্বিতীয় নামটি হচ্ছে সাবেক প্রেসিডেন্ট এপিজে আবদুল কালামের। সবাই জানেন, আজকাল সঙ্ঘ পরিবারের লোকেরা দারাশিকো ও ড. কালামের প্রতি বিশেষভাবে আগ্রহ দেখাচ্ছে। দারাশিকোর ব্যাপারে নতুন নতুন গবেষণা করা হচ্ছে। তার আসল কবরের সন্ধানেরও চেষ্টা করা হচ্ছে। অনুরূপভাবে ড. আবদুল কালামকে মুসলিম যুবসমাজে গ্রহণযোগ্য ও জনপ্রিয় করার জন্য নিত্যনতুন কৌশল ব্যবহার করা হচ্ছে।

দারাশিকো মোগল সম্রাট শাহজাহানের বড় পুত্র। তিনি তাকে নিজের উত্তরাধিকারী শাসক বানাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু দারাশিকোর ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে আওরঙ্গজেব তাকে মারাত্মক অপছন্দ করতেন। তিনি তাকে ‘কাফের’ ঘোষণা করেন। দারাশিকো ফারসি ভাষার একজন বড় পণ্ডিত ব্যক্তি ছিলেন। তিনি ওই ভাষায় কয়েকটি গ্রন্থও রচনা করেন। কিন্তু ধর্মীয় বিশ্বাসের বিষয়ে সেগুলো বেশ স্পর্শকাতর হয়ে ওঠে। ১৬৫৭ সালে দারাশিকো বেনারসের কয়েকজন পণ্ডিতের সহায়তায় ফারসিতে উপনিষদ অনুবাদ করেন। তিনি বলেন, তিনি বিভিন্ন ধর্মীয় বিশ্বাস এই জন্য অধ্যয়ন করেন, যাতে তিনি ধর্ম ও দর্শনের চিন্তাধারাগুলোকে পরিপূর্ণ অনুধাবন করতে পারেন। দারাশিকো আরো বলেন, ‘আমি বেদগুলোর মাঝে একত্ববাদের মূল রহস্য অনুসন্ধান করেছি।’ তিনি এও জানান, তিনি উপনিষদগুলোকে ঐশ্বরিক গোপন রহস্যাবলির রক্ষক মনে করতেন। তিনি এটাও দাবি করেন যে, তিনি উপনিষদগুলোর অনুবাদ স্বয়ং তার আত্মিক উপকারিতা এবং নিজের বংশধর, বন্ধুবান্ধব ও সত্যান্বেষীদের উপকারিতার জন্য করেছেন।

উল্লেখ্য, এটাই সেই অনুবাদ, যা বার্নিয়ার ইউরোপ নিয়ে যান। যেখানে প্রায় এক শতাব্দী পর ফ্রেঞ্চ ও ল্যাটিন ভাষায় এর অনুবাদ হয়। এটি এক কঠিন বাস্তবতা যে, দারাশিকোর ফারসি অনুবাদের মাধ্যমেই ইউরোপ হিন্দু ধর্মের দর্শন সম্পর্কে পরিচিত হয় এবং ওই অনুবাদের কারণে আওরঙ্গজেব দারাশিকোর বিরুদ্ধে কুফর ও ধর্মত্যাগের অভিযোগ আরোপ করে তাকে হত্যা করা আবশ্যক বলে ফতোয়া অর্জন করেন, যা বাস্তবায়ন করা হয়। এ বিষয়ে কেরালার গভর্নর আরিফ মুহাম্মদ খাঁ তার সাম্প্রতিক এক প্রবন্ধে বিশদ আলোচনা করেছেন। এ প্রবন্ধটিও সেই ধারাবাহিকতার একটি অংশবিশেষ, যা দারাশিকোর মাথা উঁচু করার জন্য লিখিয়ে নেয়া হচ্ছে। কিছু দিন আগে এ ধরনের একটি প্রবন্ধ আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর প্রফেসর তারেক মনসুরও ‘ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’-এ লিখেছেন, যা নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় বেশ হইচই হয়েছে।

এখন আসুন, সাবেক প্রেসিডেন্ট এপিজে আবদুল কালামের দিকে, যার নাম মোহন ভাগবত মুসলমানদের দ্বিতীয় রোল মডেল হিসেবে প্রস্তাব করেছেন। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, ড. কালাম একজন বিজ্ঞানী ও যোগ্য ব্যক্তি ছিলেন। তিনি প্রতিরক্ষা বিজ্ঞানের ময়দানে দেশকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। বিশেষ করে মিসাইল তৈরিতে তার কোনো বিকল্প নেই। এ জন্য তাকে ‘মিসাইল ম্যান’ও বলা হয়ে থাকে। তার অবদানের স্বীকৃতি উচ্চ পরিমাপে করা হয়েছে। তিনি একজন দরিদ্র মুসলমান মাঝির সন্তান। তিনি তার কঠোর সাধনার মাধ্যমে এই স্থান অর্জন করেন। একজন মুসলমান হিসেবে তার ধর্মীয় বিশ্বাস সম্পর্কিত বিষয়গুলো নিয়ে যখন প্রশ্ন ওঠে, তখন দেখা যায়, তিনি আপসকামিতা, নমনীয়তার পক্ষে ছিলেন। তিনি দুই ঈদের নামাজ পড়তেন বটে, তবে দক্ষিণ ভারতের মন্দির ও শঙ্কর আচার্যদের প্রতিও তিনি বেশ অনুরাগী ও ভক্ত ছিলেন। যখন তিনি ওই মন্দিরগুলোতে যেতেন, তখন সাষ্টাঙ্গ প্রণাম দিয়ে যেতেন। তার এ কর্মটাই সঙ্ঘ পরিবারের বেশ পছন্দের ছিল। আর এ জন্যই তার মৃত্যুতে সঙ্ঘ পরিবার সবচেয়ে বেশি শোক পালন করেছিল।

সঙ্ঘ পরিবারের লোকেরা কোনো মুসলমানকে পছন্দ করবে বা করবে না, এটি তাদের নিজস্ব চিন্তাধারার মধ্যে সীমাবদ্ধ। কিন্তু তারা মুসলমানদের এ ব্যাপারে বাধ্য করতে পারে না যে, আরএসএসের পছন্দের যে মুসলমান, তিনিই মুসলমানদের ‘রোল মডেল’ হবেন। যে মুসলমান তার ধর্ম ও বিশ্বাসের অনুসারী, তিনি সঙ্ঘ পরিবারের লোকদের দৃষ্টিতে ‘কট্টর মুসলমান’। বাহ্যত মুসলমানরা এমন কোনো ব্যক্তিকে নিজেদের রোল মডেল মেনে নেয় না বা নেবে না, যার বিশ্বাস একত্ববাদের বিরোধী। বিশ্বে মুসলমানদের একমাত্র রোল মডেল মানবদরদী নবী করিম হজরত মুহাম্মদ সা:-এর পবিত্র ব্যক্তিত্ব, যাকে সারা বিশ্বের মুসলমান গভীর শ্রদ্ধা ও সম্মানের দৃষ্টিতে দেখে।

মুম্বাই থেকে প্রকাশিত দৈনিক মুম্বাই উর্দু নিউজ ২৪ অক্টোবর,
২০২১ হতে উর্দু থেকে ভাষান্তর
ইমতিয়াজ বিন মাহতাব
ahmadimtiajdr@gmail.com
লেখক: ভারতের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us