একটি রেড ইন্ডিয়ান উপাখ্যান

ভাষান্তর : মো: আজিজুর রহমান লসকর | May 19, 2019 01:41 pm
একটি রেড ইন্ডিয়ান উপাখ্যান

একটি রেড ইন্ডিয়ান উপাখ্যান - ছবি : সংগ্রহ

 

নিকোলা নদীর তীরে অবস্থিত সুলাম নামক রেড ইন্ডিয়ান গ্রামে অনেক বছর আগে কেলোরা নামে এক অন্ধ বৃদ্ধ কবিরাজ বাস করত। অন্ধত্বের কারণে সে ছিল নিঃস্ব দরিদ্র। তাই কদাচিৎ সে নিজের ও স্ত্রীর ভরণ-পোষণ করতে পারত।

যদিও সে নিজকে একজন কবিরাজ বলে পরিচয় দিত, আসলে কিন্তু স্বপ্ন ব্যতীত সে অল্পই চিকিৎসা করত। গ্রীষ্মের দীর্ঘ দিনে সে গাছের ছায়ায় বসে কাটাত এবং শীতের দিনে কনকনে ঠাণ্ডার মোকাবেলায় গ্রাউন্ডহোগের এক প্রস্থ ছিন্ন চামড়া গায়ে জড়িয়ে ঘরের বাইরে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে রোদ পোহাত। তার এ অলসতার জন্য স্ত্রী তাকে কখনো কখনো ভর্ৎসনা করত।
স্ত্রী তাকে স্মরণ করিয়ে দিত, ‘তুমিই একমাত্র অন্ধ মানুষ নও। কুইলচেনার ইন্টামিনের কথা মনে করো। সে অনেক কিছু করে থাকে। সে ¯প্রুস বৃক্ষের মূল ঝুড়ি তৈরির উপযোগী করে দেয় এবং তার স্ত্রী তা দিয়ে ঝুড়ি তৈরি করে থাকে। সে হাড় দিয়ে সুন্দর পুঁতি বানায়। এমনকি সুতা পাকানোর কাজও করতে পারে। আর তুমি কেবল বসে থেকে সূর্যের দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে হাসো এবং মূল্যহীন জীর্ণ চামড়ায় নখ দিয়ে আঁচড়াতে থাকো।’
অথচ নিরীহ কেলোরা কেবলমাত্র একবার নিজের জন্য ক্ষমা চেয়েছিল এবং তার স্ত্রীকে স্মরণ করিয়ে দিতে চেয়েছিল যে, যাই হোক সে একজন কবিরাজ এবং বলতে চেয়েছিল যে, তাকে কিছু সম্মান দেখানো উচিত। কবিরাজরা কি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি নন?
‘একজন কবিরাজ! তুমি একজন কবিরাজ? কেউ তোমার কাছে আসে না, যদি না সে অন্য সব কবিরাজের দ্বারস্থ হয়ে বিফল হয়! প্রথম চার দিন, একই কথা তুমি প্রত্যেককে বলে থাকো। মিষ্টি পানিতে চারবার গোসল করো, কঠোর উপবাস করো, চারটি জুনিপার বেরি চিবিয়ে খাও এবং সব রস খেয়াল করে গিলে খেও। তা হচ্ছে এ চারটি এবং ওই চারটি! রাবিশ! যেকোনো নির্বোধ একই উপদেশ দিতে পারে এবং বিনিময়ে পেতে পারে আরো বেশি।’

মনে হলো এতে বৃদ্ধ কেলোরা কিছুই মনে করল না। সে ঠায় সূর্যের দিক তাকিয়ে রইল যেন স্ত্রীর কোনো বাক্য তার কর্ণকুহরে প্রবেশ করেনি। সেখানে একটি মাত্র শব্দ ছিল যা নিশ্চিত তাকে জাগরিত করতে পারত এবং তা হচ্ছে লুন নামক বিরাট আকারের একটি পাখির কণ্ঠ নিঃসৃত ধ্বনি, যা সবচেয়ে অদ্ভুত এবং সমগ্র বনভূমির মধ্যে সম্ভবত সবচেয়ে শ্রুতিমধুর। যখনই সে তা শুনত এক অস্থির চঞ্চলতা যেন তাকে আবিষ্ট করে ফেলত। তখন অন্ধ বৃদ্ধ হাতড়িয়ে তার লাঠিটি খুঁজে নিত এবং বেরিয়ে পড়ত পায়ে চলা পথ দিয়ে ম্যামট হৃদ থেকে উৎপন্ন ছোট নদীটির বাঁক ধরে। হাতের লাঠির সাহায্যে পথ অনুভব করে এবং উত্তোলিত কনুই ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে গাছের ঝুলন্ত শাখা-প্রশাখা থেকে চোখ বাঁচিয়ে বৃদ্ধ অন্ধ অতি কষ্টে ধীরে ধীরে এগিয়ে যেত।
মাঝে মাঝে কেলোরা কয়েক দিনের জন্য নিরুদ্দেশ হয়ে যেত। তারপর ভ্রমণে ক্লান্ত, অর্ধাহারে ক্লিষ্ট, হোঁচট খেয়ে পড়ে গায়ে কাদামাটি মেখে বাড়ি ফিরত। কিন্তু এতদিন কোথায় ছিল কিছু বলত না। তবে খুব ধৈর্য সহকারে ব্যাখ্যা দিত, ‘আমি আমার পিতা লুন-এর সাথে কথা বলতে গিয়েছিলাম।’ শুধু এতটুকুই।

বৃষ্টিভেজা এক দীর্ঘ শরতের পর এ অঞ্চলে বেরি ফসলের উৎপাদন খুব কম হয়েছিল। আদিবাসিরা বেরি শুকিয়ে রাখত শীতের খাদ্য হিসেবে। পরে এখানে খুব ঠাণ্ডা ও কঠিন সময়ের আগমন ঘটে। প্রতিদিন গ্রামের লোকেরা শিকার থেকে প্রায় খালি হাতে ঘরে ফিরত। তখন মনে হলো হরিণ, বন্য কুক্কুট, খরগোশ ইত্যাদি উধাও হয়ে গেছে। কিন্তু সর্বত্র বরফের ওপর নেকড়ে বাঘের পদচিহ্ন দেখে বোঝা যেত এদের সংখ্যা বেড়ে গেছে। শিকার না থাকায় টাটকা মাংসের স্বল্পতায় লোকজন তাদের লুকিয়ে রাখা সঞ্চিত খাদ্যগ্রহণে বাধ্য হয়েছিল। গ্রীষ্মে ধৃত ও ধূম প্রয়োগে সংরক্ষিত হাজার হাজার স্যামন মাছ তারা খেয়ে উজাড় করে ফেলেছিল।

উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বয়স্করা আলোচনায় বসল। কিছু লোক উৎসুক হয়ে জানতে চাইল তারা কি ক’জন তরুণকে পার্শ্ববর্তী গ্রামে, এমনকি দূরবর্তী ক্যামলুপ ও লিটন, আরো দূরে টুলামিন, এমনকি লিলোয়ে খাদ্য ক্রয়ের জন্য পাঠাবে।
একদিন শিকারিরা পুনরায় খালি হাতে বাড়ি ফিরলে পর বৃদ্ধ কেলোরা স্থানীয় মোড়লকে বলল, ‘তোমার তরুণ শিকারিদেরকে বল, প্রহরীর দায়িত্ব পালনে এগিয়ে আসতে।’ তারপর বিজ্ঞের মতো বলল, ‘আমাদের মতো নেকড়েগুলোও ক্ষুধার্ত। উপত্যকার সব শিকার ইতোমধ্যে তারা মেরে খেয়ে ফেলেছে। শীঘ্রই তারা সোজা চলে আসবে গ্রামে এবং চেষ্টা করবে শিশুদের চুরি করতে।’

শুনে মোড়ল উদ্বিগ্ন হলেও অন্ধ বৃদ্ধ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে অবজ্ঞার স্বরে বলল, ‘তুমি ফিরে যাও স্বপ্ন জগতে।’ তারপর হেসে বলল, ‘বৃথা কথা বলার সময় নেই আমার। ফিরে যাও তুমি ঔষধ বানাতে ও লুন-এর ডাক শুনতে।’
অতঃপর পুরো এক দিনও পার হয়নি; একটি মানবশিশুর তীব্র আর্তনাদ শুনে মহিলারা বিস্ময়ে চমকে উঠল। লোকজন দৌড়ে নদী তীরে গিয়ে দেখতে পেল, দূরে ছাই রঙের একটি বিরাট নেকড়ে দুলকি তালে সহজভাবে উষ্ণ প্রস্রবনের দিকে চলে গেল। সেখানে তারা বরফের ওপর দেখতে পেল রক্তের কিছু দাগ, কাঠবিড়ালের চামড়ায় তৈরি একটি ছোট টুপি, একটি খেলনা ধনুক, বরফের ওপর একটি শিশু ও নেকড়ের চলার চিহ্ন।
-‘বৃদ্ধ কেলোরার কথাই ঠিক ছিল’, বলল মোড়ল, ‘এমনকি নেকড়েরাও এখন ক্ষুধায় উন্মাদ!’

নেকড়েগুলো বৃহৎ থেকে বৃহত্তর আকার লাভ করেছিল। তাদের সামনে বয়স্ক মানুষও একা নিরাপদ ছিল না। তাই জোড় বেঁধে শিকারে বেরুতে হতো। নেকড়ের জন্য ফাঁদ ও মৃত্যুখাদ নির্মাণ করা হয়েছিল। অনেক নেকড়ে মারা গেল। কিন্তু এদের সংখ্যা কমল বলে মনে হলো না। লোকজন খুব ভীত হয়ে পড়ল। এমনকি সুলাম গ্রাম পরিত্যাগ করে অন্য কোথাও চলে যাওয়ার কথা উঠল, যা ছিল প্রায় অশ্রুতপূর্ব কথা, বিশেষ করে প্রচণ্ড শীতকালে।
তা শুনে বৃদ্ধ কেলোরা বলল যে, তা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। এবার বৃদ্ধের অভিমত মোড়ল মনোযোগের সাথে শুনল।

Ñ ‘নেকড়েগুলো পিছু নিলে তোমরা কি মনে করো, আমরা তাদের চেয়ে দ্রুত দৌড়াতে পারব?’ প্রশ্ন করেছিল বৃদ্ধ। তার বক্তব্য যুক্তিপূর্ণ ছিল।
Ñ ‘অবশ্যই সত্য’, লোকজন বলল, ‘কিন্তু এখন আমরা কী করব? আমরা অনাহারে আছি। আমাদের শিশুরাও অনাহারে রয়েছে।’
কেলোরা জানত যে ক্ষণটির জন্য সে দুদীর্ঘকাল যাবৎ অপেক্ষা করে আসছিল, অবশেষে তা উপস্থিত হয়েছে। গ্রামটিকে যদি কোনোক্রমে বাঁচানো সম্ভব হয়, তাহলে তা হবে কেলোরার একান্ত নিজের ঐন্দ্রজালিক শক্তির বদৌলতে। কেলোরা যখন ছোট বালক ছিল, তখন সে সম্পূর্ণ একাকী সুদূর পাহাড়ের চূড়াগুলোয় অনেক দিন কাটিয়েছে, হ্রদের পানিতে সে গোসল করেছে, হেমলকের রুক্ষ শাখা দিয়ে নিজের দেহে বারবার আঘাত করে রক্ত পর্যন্ত ঝরিয়েছে, দিনের পর দিন সে উপবাস করেছে, যাতে একজন কবিরাজ হতে পারে।
এত ক্লেশ সে সহ্য করেনি অনর্থক। ঘটনাগুলোর প্রত্যেকটিতে লুন এসে উপস্থিত হতো এবং তাকে শক্তি দান করত, যা অন্য কেউ জানে না। বাস্তবিক পক্ষে কেলোরার যে ঐন্দ্রজালিক ক্ষমতা রয়েছে তা কেউ অনুমান করতে পারেনি, কারণ কারো কাছে কখনো সে এর প্রমাণ তুলে ধরেনি, এমনকি বহুল ক্ষমতার অধিকারী মোড়ল বা গুরুত্বপূর্ণ কবিরাজদের কাছেও। কেবল মাত্র কিছু গুরুতর বিপদে তার অভিভাবক স্পিরিটের অনুমতিতে সে পবিত্র গান গাইত, উজ্জ্বল শুভ্র ডেন্ট্যালিয়াম শামুকের তৈরি গলাবন্ধ ব্যবহার করত, প্রত্যেকটির আকৃতি ছিল হাতির ক্ষুদ্র দাঁতের মতো, অথবা ব্যবহার করত ঐন্দ্রজালিক ধনুক। কিন্তু আজ সে উপলব্ধি করতে পারল তাকে যে জাদুর ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে তা প্রয়োগ করার এখনই উপযুক্ত সময়।

হাতের লাঠির সাহায্যে পথ আন্দাজ করে কেলোরা সাবধানে বরফ শীতল পানিপূর্ণ নদীর বালুময় তীরে অবস্থিত গ্রামের ঘর্ম-ঘরে উপস্থিত হলো। এটি একটি বদ্ধ কুঠরি। ঘর্ম-ঘরে উত্তপ্ত পানি থেকে উৎপন্ন বাষ্পের দ্বারা অনেক কষ্ট সয়ে শরীরে ঘাম ঝরানো হয়।
বৃদ্ধ কবিরাজ বদ্ধগৃহে চারবার উত্তপ্ত বাষ্প দ্বারা ঘাম ঝরাল এবং প্রতিবার নদীর বরফ শীতল পানিতে ডুব দিলো। তারপর সে বাড়ি ফিরে এলো, ডেন্ট্যালিয়াম শামুকের তৈরি গলাবন্ধ গলায় জড়াল এবং উচ্চস্বরে দৈব সঙ্গীত গেয়ে চলল। অতঃপর তার ঐন্দ্রজালিক ধনুক বেঁধে নিলো এবং শীর্ষে তীক্ষè প্রস্তরযুক্ত চারটি তীর সঙ্গে নিল।
প্রস্তুতিপর্ব শেষ হতে না হতেই সে জনতার চিৎকার শুনতে পেল। আবার নেকড়েগুলো অরক্ষিত শিশুদের ধরে নিতে গ্রামের ভেতর ঢুকে পড়েছে। নেকড়েগুলোর দিকে তাকে নিয়ে যেতে বৃদ্ধ কেলোরা সুস্পষ্ট ও দৃঢ়কণ্ঠে তার স্ত্রীকে আহ্বান করল। তার কঠোর কণ্ঠ শুনে স্ত্রী এতই বিস্মিত হলো যে, সে কোনো কিছু চিন্তা না করেই সাথে সাথে বৃদ্ধের আদেশ পালন করতে উদ্যত হলো। যথাশীঘ্র তারা গ্রামের রাস্তায় উপস্থিত হলে জনতা উচ্চস্বরে হেসে উঠল।

Ñ ‘তুমি কি তাকে নেকড়েগুলোর মুখে নিক্ষেপ করতে যাচ্ছ? তাকে নিয়ে ফিরে যাও ঘরে। সে নেকড়ে শিকারের কী জানে?’ একযোগে সবাই বলল বৃদ্ধের স্ত্রীকে লক্ষ্য করে।
Ñ ‘এদের কথায় তুমি কান দিও না।’ স্ত্রীর প্রতি হুকুম দিলো কেলোরা, ‘আমার তীরটি সবচেয়ে বড় নেকড়ের প্রতি তাক করো। খুব সাবধানে, যেন তুমি নিজেই তীর ছুড়তে যাচ্ছ।’
Ñ ‘ঠিক আছে। একটু উপরে।’ তাক করতে করতে স্ত্রী বলল, ‘আরো একটু এদিকে। এই। এবার তীর ছোড়ো।’ স্ত্রী নির্দেশ দিলো।
সাথে সাথে বৃদ্ধ কেলোরা তীর ছুড়ল। ছোট্ট ঝোপের মধ্যে লুকিয়ে থাকা বিরাট নেকড়ের দেহের পার্শ্বভাগে বেগবান অভ্রান্ত তীর সোজা বিদ্ধ হলো।
Ñ ‘দেখো! দেখো!’ বলে চিৎকারে ফেটে পড়ল মানুষগুলো, যারা এতক্ষণ মনোযোগ সহকারে লক্ষ্য করছিল, ‘কি অদ্ভুত শট! চোখে স্পষ্টভাবে দেখেও কোনো সাধারণ মানুষ তা পারবে না। কেলোরা নিশ্চয় একজন জাদুকর। একজন মহান জাদুকর। আমরা রক্ষা পেলাম। জাদুকর কেলোরাকে ধন্যবাদ।’
বৃদ্ধ কিন্তু কিছু বলল না। সে নীরবে বাড়ি চলে গেল।

শীতের বাকি দিনগুলোয় যখনই নেকড়েগুলোকে দেখা যেত, সে বাড়ি থেকে বের হয়ে গ্রামের প্রান্তে উপস্থিত হতো। তীর তাক করতে সবসময় সে স্ত্রীর সাহায্য পেত এবং সর্বদা তার ছোড়া তীরে নেকড়ে মারা যেত। অবশেষে গ্রামবাসী নিরাপদ শিকারের স্থানের খোঁজ ত্যাগ করল; এবং আবার শিকারিরা গ্রামেই শিকার ফিরে পেতে সক্ষম হলো।
পরবর্তী গ্রীষ্মে বৃদ্ধ কেলোরা তার অভিভাবক স্পিরিট লুন-এর সাথে আবার দেখা করার সিদ্ধান্ত নিলো। দূরবর্তী পাহাড়গুলোর মধ্য দিয়ে সে মাইলের পর মাইল হেঁটে গেল দিনের শেষ পর্যন্ত। চলতে চলতে কেলোরা ভাবনায় বিরতি দিলো। তখন অস্তায়মান সূর্যের উষ্ণতা সে তার বাম গালে অনুভব করল। সে বিড় বিড় করে স্বগতোক্তি করল, ‘অতএব, যে ছোট হ্রদ একদা আমি ভালোভাবেই চিনতাম, তা আমার সম্মুখে ডান দিকেই থাকা উচিত, এই একটু পথের পর ঢালু জায়গাটির ওপর।’

হঠাৎ যেন তার সত্যতা প্রমাণের লক্ষ্যে সে শুনতে পেল দীর্ঘ লয়ে ও কম্পিত স্বরে লুন-এর দিকে ধীরে ও সাবধানে সে সামনের দিকে অগ্রসর হলো। গাছের মূলে পা লেগে সে হোঁচট খেল, বনের পত্র-পল্লব তার মুখমণ্ডলে আঁচড় কেটে দিলো। অবশেষে দিনের সূর্য আরো নিচে নেমে গেল, হ্রদ থেকে উৎপন্ন ঘন ঘাসের গন্ধ তীব্র হয়ে উঠল এবং সে শুনতে পেল একটি ব্যাঙের লাফ দিয়ে পানিতে পতনের শব্দ। শিগগিরই সে অনুভব করল তার পায়ের মোকাসিন নামক পাদুকার নিচে ভেজা মাটি একটু যেন দেবে গেল। সামনের দিকে মাথা নত করে হাতের আঙ্গুলের শীর্ষ ভাগ দিয়ে সে শান্ত, ঠাণ্ডা পানি স্পর্শ করল।
সম্মুখে হ্রদ, যাকে সে নিজের হ্রদ বলে জানে, এর দিকে মুখ করে সোজা দাঁড়িয়ে কেলোরা নিজের দৈহিক উচ্চতা যেন টেনে পরিপূর্ণ করল। তার হাত গলার কাছে নিয়ে নিশ্চিত হতে চাইল যে ডেন্ট্যালিয়াম শামুকের তৈরি পবিত্র গলাবন্ধটি যথাস্থানে আছে কিনা। আরো একবার সে পবিত্র গানগুলো গাইল, যা সে বহুদিন আগে এখানেই শিখেছিল। তারপর সে উচ্চস্বরে আহ্বান করতে লাগল, ‘ওহে! আমার পিতা, লুন, আমার কাছে এসো। আমাকে সাহায্য করো, আমার পিতা!’ সে কেঁদে ফেলল।

- ‘হে বৎস! কি চাই তোমার?’ তার পায়ের কাছ থেকে একটি কণ্ঠস্বর শোনা গেল।
Ñ ‘আমি অন্ধ, পিতা আমার, আমি দেখতে চাই।’
Ñ ‘তাহলে আমার পিঠে উঠে বসো’, বলল লুন। বিসদৃশ ও কষ্টকর হলেও কেলোরা পাখিটির পিঠে চড়ে বসল।
Ñ ‘এবার তুমি আমাকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরো এবং দম বন্ধ রাখো’, চিৎকার দিয়ে বলল লুন। তারপর সে হ্রদের গভীর পানিতে ডুব দিলো এবং দ্রুত ও বলিষ্ঠভাবে ডুবসাঁতার দিয়ে ওপারে পৌঁছে গেল।
Ñ ‘বৎস! তুমি কি এখন চোখ দিয়ে দেখতে পাচ্ছ?’ জিজ্ঞেস করল লুন।
Ñ ‘আমি দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু একজন মানুষ যেভাবে দেখতে পায়, সেভাবে নয়; কারণ এখনো আমার চোখের ওপর কুয়াশার পুরু স্তর রয়ে গেছে।’
Ñ ‘শক্ত করে আঁকড়ে ধরো আরো একবার,’ উচ্চস্বরে বলল লুন; এবং আবার তারা পানির গভীরে নিমজ্জিত হয়ে গেল। হ্রদের পানির নিচে এপাশ থেকে ওপাশে পুরো চারবার তারা ডুবসাঁতার সম্পন্ন করল।

Ñ ‘এখন আমি দেখতে পাচ্ছি! দেখতে পাচ্ছি! মনে হচ্ছে যেন আমি কখনো অন্ধ ছিলাম না!’ উচ্চকণ্ঠে বলল কেলোরা।
লুন তাকে চোখে দেখার ক্ষমতা পাইয়ে দিলো। তাকে ধন্যবাদ জানাবার জন্য কেলোরা ঘুরে দাঁড়াল। কিন্তু সেখানে কাউকে দেখতে পেল না। কেবল দেখা গেল দূরে, একটি বৃহদাকার লুন পাখি হ্রদের স্থির পানিতে শান্তভাবে সাঁতার কেটে চলেছে।

কোনো কিছু নয় বৃদ্ধ কেলোরার সঞ্চিত সব ধনের মধ্যে সবচেয়ে প্রিয়টিই ছিল উৎকৃষ্ট। ছোট সাদা শামুকের তৈরি তার প্রিয় গলাবন্ধটি সে খুলে ফেলল। অতঃপর হাত উপরে তুলে প্রসারিত করে ঘুরিয়ে শামুকের গলাবন্ধটি লুনের দিকে শান্তভাবে নিক্ষেপ করল। বাতাসের মধ্য দিয়ে ধীরে ঘুরতে ঘুরতে গলাবন্ধটি গিয়ে পাখির কণ্ঠে জড়িয়ে গেল এবং তা সাদা উজ্জ্বল হাররূপে দৃষ্ট হলো; যা আমরা আজকাল পাখিটির গলায় দেখতে পাই। গলাবন্ধ থেকে খোলে অল্প সংখ্যক শামুক লুনের পিঠে ছড়িয়ে পড়েছিল। তা-ও তুমি যে কোনো লুনের পিঠে দেখতে পাবে।

 


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us