অভিবাসীদের প্রতি আমেরিকার দায় নৈতিক ও ঐতিহাসিক

আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু | May 22, 2019 01:56 pm

-

 

অবৈধ অভিবাসন ঠেকাতে ট্রাম্পের প্রস্তাবিত সীমানাপ্রাচীর তার দ্বিতীয় মেয়াদে নির্বাচনী প্রচারণার প্রধান প্রতিপাদ্য হয়ে উঠতে যাচ্ছে। তার প্রতিপক্ষ ডেমোক্রেট এবং ইমিগ্রেশন অধিকার প্রবক্তারা শুরু থেকেই বলে আসছেন ট্রাম্প যা কিছুই বলছেন, করছেন বা ইতোমধ্যে করেছেন সবকিছুর ভিত্তি মিথ্যাচার। প্রাচীরের জন্য অর্থ জোগাতে তিনি শুধু ডেমোক্রেটদেরই নয়, বরং পুরো আমেরিকান জাতির সাথে প্রতারণা করছেন। কংগ্রেসকে তার প্রস্তাবিত প্রাচীর নির্মাণে অর্থ বরাদ্দে অনুমোদন দেয়ার জন্য ফেডারেল শাটডাউনের আশ্রয় নিয়েছেন। এতে ক্ষতি হয়েছে আমেরিকার এবং আমেরিকানদের। কিন্তু তাতেও কংগ্রেস পুরো অর্থ বরাদ্দ দিতে সম্মত হয়নি। কিন্তু ট্রাম্প হাল ছাড়েননি। তিনি বকেই চলেছেন যে অভিবাসীরা আমেরিকাকে ফোকলা করে ফেলছে; সন্ত্রাস আমদানি করছে এবং আমেরিকানদের কাজ ও ব্যবসা হাতিয়ে নিচ্ছে। কোনোভাবেই তিনি আমেরিকা বিনির্মাণে অভিবাসীদের অবদান স্বীকার করতে চান না। হোয়াইট হাউজে তার গত দুই বছরের অবস্থান প্রথাগত মিথ্যাচারের ওপর দিয়ে চালিয়ে এসেছেন, অর্থাৎ তিনি বলেছেন, সীমানাপ্রাচীর তো আছেই, এটিকে পুরো বাস্তবায়িত করলেই অভিবাসীদের স্রোত রোধ করা সম্ভব। প্রাচীর নির্মাণ যে অবৈধ অভিবাসী রোধের একমাত্র সমাধান নয় তা তিনি নিজেও স্বীকার করেন এবং সেজন্য অতিরিক্ত সীমান্ত রক্ষী ও নজরদারি সরঞ্জাম মোতায়েনের জন্যও বরাদ্দ চান, যাতে সীমান্ত রক্ষা ব্যবস্থা নিশ্ছিদ্র করা সম্ভব হয়। তিনি বলতে চান যে, অভিবাসীরা যে আমেরিকার অর্থনীতির একটি বড় অংশ শুষে নিচ্ছে শুধু তাই নয়, তারা আমেরিকায় রোগব্যাধির বিস্তার ঘটাচ্ছে, যা সত্য নয়। গত বছর সেন্ট্রাল আমেরিকার কয়েকটি দেশ এল সালভেদর, গুয়েতেমালা, হন্ডুরাস ও নিকারাগুয়ার থেকে মেক্সিকো হয়ে হাজার হাজার অভিবাসী আমেরিকার দক্ষিণ সীমান্তে পৌঁছায়। অভিবাসীদের মধ্যে সন্ত্রাসীরা রয়েছে এবং অল্প সময়ের মধ্যে অনেক সন্ত্রাসীকে গ্রেফতার করা হয়েছে মর্মে ট্রাম্পের দাবিও ছিল মিথ্যা, বরং অভিবাসীদের বিপুল প্রবাহ সত্ত্বেও গত দুই বছরে যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসী প্রবেশ বৃদ্ধির পরিবর্তে তাৎপর্যপূর্ণভাবে হ্রাস পেয়েছে বলে সরকারি পরিসংখ্যানেও দেখা যায়। অতএব অভিবাসন প্রশ্নে ট্রাম্প যা কিছু বলেছেন তা আমেরিকার জন্য কোনো সঙ্কট নয়, বরং ভীতি ও বিভাজন সৃষ্টির উদ্দেশ্যে এটি তার রাজনৈতিক অপকৌশল মাত্র।

সেন্ট্রাল আমেরিকার উপরোল্লিখিত দেশগুলো থেকে হাজার হাজার অভিবাসী জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আমেরিকা-মেক্সিকো সীমান্তে উপনীত হয়ে ট্রাম্পের অভিবাসন নীতির কঠোরতার কারণে মেক্সিকোতে আটকা পড়ে দেশটির জন্য সঙ্কটের সৃষ্টি করেছে। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, সেন্ট্রাল আমেরিকা থেকে অভিবাসীপ্রবাহ সেখানকার চরম দারিদ্র্য, গ্যাং ভায়োলেন্স এবং জনগণের ওপর সেসব দেশের কর্তৃত্ববাদী সরকারের নিষ্ঠুর আচরণের পেছনেও বহুলাংশে আমেরিকার ভূমিকা দায়ী। বিগত দেড় শ’ বছরে আমেরিকা ওই দেশগুলোর প্রতিটিতে তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য ছলে বলে ও কৌশলে অভিযান চালিয়েছে যখন তারা আমেরিকার অর্থনৈতিক ও সামরিক অভিলাষ পূরণের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে অথবা সহযোগিতার হাত প্রসারিত করেনি। সেন্ট্রাল আমেরিকান দেশগুলোর জন্য যুক্তরাষ্ট্র হয়ে উঠেছিল এক মূর্তিমান আতঙ্ক, যে ক্ষত এখনো শুকিয়ে যায়নি। উনিশ শতকে যুক্তরাষ্ট্র যখন ল্যাটিন আমেরিকার ওপর ঔপনিবেশিক সম্পর্ক চাপিয়ে দেয়ার উদ্যোগ নেয় তখন থেকে একের পর এক সামরিক অভ্যুত্থান ঘটতে থাকে এবং ১৯৫০ এর দশক থেকে সেসব দেশে ডেথ স্কোয়াড গড়ে উঠতে থাকে, যা যুক্তরাষ্ট্রের জন্যই বিপজ্জনক হয়ে ওঠে এবং দেশগুলোর জনগণ এর শোচনীয় মূল্য দিতে থাকে এবং আজ যে যুক্তরাষ্ট্রমুখী সেন্ট্রাল আমেরিকান অভিবাসী প্রবাহের কথা বলা হচ্ছে, তার শেকড় খুঁজলেই দেখা যাবে এ শেকড় পুঁতেছে স্বয়ং আমেরিকা।

১৯৫২ সালে গুয়েতেমালার তদানীন্তন প্রেসিডেন্ট জ্যাকোবো আরবেনজ যুক্তরাষ্ট্রের ইউনাইটেড ফ্রুট কোম্পানির (ইউএফসি) মালিকানাধীন জমি এক লাখ দরিদ্র ও ভূমিহীন পরিবারের মধ্যে বণ্টন করে দেন। প্রেসিডেন্ট আরবেনজ ইউএফসিকে ক্ষতিপূরণ দেয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করা সত্ত্বেও ইউএফসি বিলম্ব সহ্য করতে রাজি ছিল না। তারা আইসেনহাওয়ারের প্রশাসনের ওপর ব্যাপক চাপ সৃষ্টি করে আরবেনজকে উৎখাত করার জন্য। তাদের চাপে কাজ হয়। তখনকার সেক্রেটারি অব স্টেট জন ফস্টার ডালেস এবং তার ভাই সিআইএ’র ডাইরেক্টর অ্যালেন ডালেস ইতিপূর্বে ইউএফসির আইনজীবী ছিলেন এবং ওই কোম্পানির যথেষ্ট পরিমাণে শেয়ারও ছিল তাদের। দুই বছর পর সিআইএ কমিউনিজম ঠেকানোর নামে প্রেসিডেন্ট আরবেনজকে উৎখাত করে এবং তাদের পছন্দনীয় ব্যক্তিকে ক্ষমতায় বসায়। সিআইএ’র হাতের পুতুল হিসেবে কাজ করেন গুয়েতেমালার ইতিহাসে নিষ্ঠুর দুই একনায়ক এফ্রেইন রিওস মন্ট এবং লুকাস গর্সিয়া। চল্লিশ বছর ধরে গুয়েতেমালায় গৃহযুদ্ধ চলতে থাকে এবং যুক্তরাষ্ট্রের মদদপুষ্ট সামরিক একনায়করা মায়া আদিবাসীদের ওপর ব্যাপক গণহত্যা চালায়। শুধু প্রেসিডেন্ট এফ্রেইন রিওস মন্টের মেয়াদেই দুই লক্ষাধিক লোক নিহত হয়। যুক্তরাষ্ট্র গুয়েতেমালার জনগোষ্ঠীর ওপর নির্যাতন চালাতে সেখানকার সামরিক জান্তাদের সহায়তা করার পরিণামের খেসারত দিতে বা ক্ষতিপূরণ দিতে আগ্রহী না হলেও প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন গুয়েতেমালায় তার দেশের বাড়াবাড়ির কারণে দুঃখপ্রকাশ করেছেন। কিন্তু সমস্যার যে বীজ তার পূর্বসূরি বপন ও লালন করেছিলেন তার রেশ এখনো কাটেনি।

সেন্ট্রাল আমেরিকার আরেক দেশ এল সালভেদরও একই সময়ে গৃহযুদ্ধের অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে। ১৯৮০ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত বামপন্থী ফারাবুন্দো মারতি ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট (এফএমএলএন) সালভেদরের সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। রিগ্যান প্রশাসন সালভেদরের বিশেষ বাহিনীকে অস্ত্র সহায়তা ও প্রশিক্ষণদানের প্রস্তাব দেয়। সালভেদরের কুখ্যাত অ্যাটলাকাটল ব্যাটালিয়নের প্রশিক্ষণ দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। এই বাহিনী এল মজোতে গ্রামের ওপর হামলা চালিয়ে এক হাজার লোককে হত্যা করে, যাদের মধ্যে নারী এবং শিশুও ছিল। সালভেদরের গৃহযুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের মদদপুষ্ট সালভেদরের ডেথ স্কোয়াড খ্যাত বাহিনী নির্মমভাবে ৮০ হাজার লোককে হত্যা করে। গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটার পর যুক্তরাষ্ট্র এল সালভেদরে সহায়তা পাঠানো বন্ধ করে দেয় এবং এর ফলে দারিদ্র্য ও গৃহযুদ্ধপীড়িত দেশটি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যায়। কংগ্রেস সালভেদরের শরণার্থীদের যুক্তরাষ্ট্রে ‘টেম্পরারি প্রটেকটেড স্ট্যাটাস’ (টিপিএস) অনুমোদন করে নব্বই-এর দশকে। এ অনুমোদনের পর সালভেদর থেকে হাজার হাজার তরুণ এসে যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান প্রধান সিটিগুলোতে ভিড় করে। অন্যান্য ল্যাটিন আমেরিকানদের থেকে বৈষম্যের শিকার হয়ে সালভেদরের তরুণ শরণার্থীরা নিজেদের রক্ষা করতে ‘মারা সালভাট্রুচা’ গ্যাং গঠন করে, যা একপর্যায়ে ‘এমএস-১৩’ গ্যাং নামে কুখ্যাতি লাভ করে। ক্যালিফোর্নিয়ার কারা ব্যবস্থার সহযোগিতা পেয়ে এই গ্যাং সংখ্যাগত ও অপরাধ কর্মের ব্যাপককতার কারণে কুখ্যাত হয়ে ওঠে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে আশঙ্কায় যুক্তরাষ্ট্র বিশ হাজারের অধিক সাজাপ্রাপ্ত এল সালভেদরের অপরাধীকে ডিপোর্ট করে। কিন্তু এ ব্যাপারে এল সালভেদরের সরকারকে কোনো তথ্য দেয়নি যে, যাদের ডিপোর্ট করা হয়েছে তাদের পরিচয় কি অথবা ডিপোর্ট করার পেছনে কী কারণ। ফলে এমএস-১৩ ‘নর্দার্ন ট্রায়াঙ্গেল’ অর্থাৎ এল সালভেদর, গুয়েতেমালা ও হন্ডুরাসজুড়ে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে আছে এবং তাদের সৃষ্ট সন্ত্রাসের কারণেই বহু লোক শুধু নিজের ও পরিবারের নিরাপত্তার সন্ধানেই দেশ ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্রমুখী হয়।

হন্ডুরাসের চিত্রও প্রায় অভিন্ন। আশির দশকে রিগ্যান প্রশাসন ডানপন্থী ডেথ স্কোয়াডকে সহায়তা ও প্রশিক্ষণ দেয় হন্ডুরাসের বামপন্থী সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য। কন্ট্রা নামে পরিচিত সরকারবিরোধী এই বর্বর বাহিনী নিরীহ জনগণের ওপর অত্যাচার নিপীড়ন চালিয়ে কুখ্যাতি অর্জন করে। তা সত্ত্বেও রিগ্যান প্রশাসন তাদের সহায়তা দানে বিরত হননি। তার পূর্বাপর আমেরিকান প্রশাসনও ডানপন্থীদের সহায়তা দিয়েছে সরকার সমর্থকদের ওপর নিপীড়ন চালাতে। এরপর ২০০৯ সালে প্রেসিডেন্ট ওবামার শাসনামলে স্টেট ডিপার্টমেন্ট বামপন্থী প্রেসিডেন্ট ম্যানুয়েল জেলায়াকে উৎখাত করেন। যে জেনারেল তাকে উৎখাত করায় নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট স্কুল অফ দ্য আমেরিকাস এ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। ওবামা প্রশাসন অবিলম্বে নতুন হন্ডুরান সরকারকে স্বীকৃতি দান করে এবং প্রেসিডেন্ট জেলেয়ার সরকারের প্রত্যাবর্তনের জন্য কোন ধরনের আলোচনা করতে অস্বীকৃতি জানায়।

যুক্তরাষ্ট্র সেন্ট্রাল আমেরিকান দেশগুলোর ওপর সামরিক হস্তক্ষেপ শেষ করে আইএমএফ ও ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের সহায়তায় সেখানকার দেশগুলোর উপর কৃচ্ছ্রতা বা ব্যয় সংকোচননীতি আরোপ করে। ২০০৫ ও ২০০৬ সালে এল সালভেদর, গুয়েতেমালা ও হন্ডুরাস অবাধ বাণিজ্য চুক্তিতে উপনীত হয়। এই চুক্তির শর্ত অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্র ওই দেশসমূহে অবাধে শিল্প ও কৃষিজাত পণ্য রফতানি করতে পারে। এ কারণে ওই দেশগুলো কৃষিপণ্য রফতানি করা থেকে আর মুনাফা লাভ করতে পারছে না। উৎপাদন ব্যয় তুলতে না পারার ফলে বহু কৃষি পরিবার নিঃস্ব হয়ে গেছে এবং জীবন বাঁচাতে যুক্তরাষ্ট্রমুখী হয়েছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করার পরও বহু হন্ডুরান তরুণ সুবিধাজনক চাকরি পেতে ব্যর্থ হয়ে অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে এমন দৃষ্টান্ত কম নয়। ফলে যুক্তরাষ্ট্র সাজাপ্রাপ্ত বহু হন্ডুরান তরুণকে ডিপোর্ট করেছে। ভয়ঙ্কর ধরনের এসব অপরাধীকে ডিপোর্ট করায় সে দেশে সহিংসতা যে ব্যাপক হয়েছে তাতে বিস্ময়ের কিছু নেই।

এমএস-১৩ গ্যাং-এর আর্থিক উৎস প্রধানত মাদক পাচার। ধারণা করা হয় যে, আমেরিকানদের মাদক সেবন বৃদ্ধি পেয়েছে মূলত সেন্ট্রাল আমেরিকান উৎসের কারণে এবং আমেরিকান ভূখণ্ডে তরুণদের মধ্যে সহিংসতার বিস্তারও একই কারণে ঘটেছে। প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ১৯৭১ সালে মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করার পর মাদক পাচারের রুট পরিবর্তিত হয়েছে এবং নতুন রুট হয় বিশেষত কলম্বিয়া। যুক্তরাষ্ট্র ‘প্ল্যান কলম্বিয়া’র অধীনে ৭.৫ বিলিয়ন ডলারের অভিযানের উদ্যোগ নেয় কলম্বিয়ার সরকারকে অন্যান্য সহযোগিতার পাশাপাশি সামরিক সহায়তা বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে। এর ফলে মাদক পাচারের রুট আরেকবার পরিবর্তিত হয় এবং এবার আরো উত্তরে মেক্সিকো হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে মাদকের প্রবেশ অব্যাহত থাকে। যুক্তরাষ্ট্র আবারও মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধের উদ্যোগ নেয় ২০০৬ সালে এবং মেক্সিকোর সহায়তায় কথিত সহস্রাধিক মাদক পাচারকারী নিহত হয় অথবা চিরদিনের মত গুম হয়ে যায়। মাদকবিরোধী অভিযানকে সর্বোচ্চ সামরিকীকরণের কারণে মেক্সিকো এবং সেন্ট্রাল আমেরিকান দেশগুলোতে মাদক পাচারকারীদের আন্তঃসংঘর্ষে বহু নিরীহ মানুষের জীবন ক্ষয় হয় এবং বহু পরিবার অভিভাবকহীন হয়ে পড়ে। কিন্তু সামরিক অভিযানের পরও যুক্তরাষ্ট্রে মাদকের অনুপ্রবেশ বন্ধ করা যায়নি।
বিশেষজ্ঞদের মতে, গ্যাং ভায়োলেন্স এবং দারিদ্র্য দূর করার ক্ষেত্রে কোনো উদ্যোগ কার্যকর হলেই যে যুক্তরাষ্ট্রে মাদকপাচার এবং সেন্ট্রাল আমেরিকান ইমিগ্রান্ট প্রবাহ বন্ধ হয়ে যাবে সে সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায় না। কারণ, ‘নর্দার্ন ট্রায়াঙ্গেল’ খ্যাত অঞ্চলের দেশগুলো সেন্ট্রাল আমেরিকার শুষ্কতম (ড্রাই করিডোর) এলাকায় অবস্থিত এবং জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে সেসব এলাকার জনগোষ্ঠী তাদের আদি বাসস্থান ছাড়তে বাধ্য হবেই। বিগত এক দশকে সেখানে প্রচণ্ড খরা হয়েছে এবং এর পরিণতি ছিল ফসল না ফলা এবং জমি নিয়ে বিরোধ। বিশ্বখাদ্য কর্মসূচির পরিসংখ্যান অনুসারে এ মুহূর্তে সেন্ট্রাল আমেরিকার বিশ লক্ষের অধিক মানুষ চরম খাদ্য সঙ্কটের মধ্যে রয়েছে। ১৮৫০ সাল থেকে বিশ্বে কার্বন নির্গমনের জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী (২৭ শতাংশ) দেশ হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র এবং এর সরাসরি শিকার সেন্ট্রাল আমেরিকা। গত বছর যুক্তরাষ্ট্রের সীমান্তে এসে জড়ো হওয়া ইমিগ্রান্টদের দেশগুলোতে যে পরিমাণ কার্বনডাই-অক্সাইড নির্গমণ হয়েছে তার চেয়ে ৬৭৮ গুণ বেশি কার্বনডাই-অক্সাইড একাই নির্গমন করেছে যুক্তরাষ্ট্র।

যুক্তরাষ্ট্র দশকের পর দশক ধরে নিজেদের স্বার্থে সেন্ট্রাল আমেরিকান দেশগুলোকে ব্যবহার করেছে; কিন্ত ওই অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিতে পারেনি। পরিবেশ বিপর্যয় এবং মাদকপাচার চক্র থেকে সেখানকার জনগোষ্ঠীকে মুক্ত করতে পারেনি, বরং যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিটি উদ্যোগ সেন্ট্রাল আমেরিকান দেশগুলোর জনগণের দারিদ্র্য বৃদ্ধি করেছে, অপরাধীদের হাতে তাদের অবাধ মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে। তারা যে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে দেশ ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্রমুখী হচ্ছে তা এককভাবে যুক্তরাষ্ট্রের সৃষ্ট বলে আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক এবং ইমিগ্রেশনবিষয়ক বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। অতএব যুক্তরাষ্ট্রের নৈতিক দায়িত্ব সেন্ট্রাল আমেরিকান উদ্বাস্তুদের পালিয়ে আসার পথ বন্ধ করতে হয় তাদের নিজ নিজ দেশে অবস্থানের উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করা অথবা তাদের আইনানুগভাবে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানের সুযোগ দেয়া। যুক্তরাষ্ট্রের হাতে যে রক্তের দাগ, সেই দায় তারা অস্বীকার করতে পারে না এবং এ দাগ মুছেও ফেলতে পারে না।

কিন্তু ট্রাম্প অভিবাসীদের সঙ্গে যে আচরণ করছেন তা অমানবিক ও মানবাধিকার পরিপন্থী। অভিবাসীদের মধ্যে ভীতি সঞ্চারের জন্য তিনি গত বছর অভিবাসী পরিবারের শিশুদের মা-বাবার কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে বিচ্ছিন্ন করে রাখার কর্মসূচি নেন। মা-বাবাকে তাদের নিজ নিজ দেশে ডিপোর্ট করে সন্তানদের আটকে রাখেন। আদালতের নির্দেশে এ প্রক্রিয়া বন্ধ হলেও এখন পর্যন্ত প্রায় দেড় হাজার শিশু পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন এবং আশঙ্কা করা হচ্ছে যে, অনেক শিশুকে আর কখনোই তাদের মা-বাবার সঙ্গে মিলিত করা সম্ভব হবে না। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বাস্তবে অভিবাসন সঙ্কটের সমাধান চান না। সঙ্কট জিইয়ে রাখতে চান তিনি- কারণ তিনি বিশ্বাস করেন এই বিভাজনের নীতিই তাকে পরবর্তী নির্বাচনে জয়ী করতে সহায়ক হবে।

 


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us