নেতাজীকে নিয়ে বিপাকে বিজেপি

সুবীর ভৌমিক | Nov 14, 2019 09:36 pm
নেতাজীকে নিয়ে বিপাকে বিজেপি

নেতাজীকে নিয়ে বিপাকে বিজেপি - ছবি : সংগৃহীত

 

ভারতের ক্ষমতাসীন হিন্দু জাতীয়তাবাদী বিজেপি অব্যাহতভাবে দেশের স্বাধীন সংগ্রামের কৃতিত্ব মূল্যায়ন করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। অবশ্য এই সংগ্রামে হিন্দু ডানদের অর্থপূর্ণ কোনো ভূমিকাই নেই।
প্রধানমন্ত্রী মোদি মহাত্ম্যা গান্ধী, সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল এবং এমনকি উগ্র ডানপন্থী স্বাধীনতা যুদ্ধের নায়ক নেতাজী সুভাস চন্দ্র বসুর প্রতি প্রকাশ্যে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছে।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, এটা হলো আসলে ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহেরলাল নেহরু ও তার কংগ্রেস পার্টিকে (জাতীয় রাজনীতিতে বিজেপির প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী) ছোট করার একটি চতুর চাল।
তবে ভারতের সবচেয়ে শ্রদ্ধাভাজন স্বাধীনতা যুদ্ধের নায়ক নেতাজী সুভাস চন্দ্র বসুর ভাতিজার ছেলে এই পরামর্শ দিয়ে বিজেপিকে অস্বস্তিতে ফেলেছেন যে দলটির উচিত হবে দেশকে ঐক্যবদ্ধ রাখার জন্য নেতাজির সেক্যুলারবাদকে দৃঢ়ভাবে ধরে রাখা।

নেতাজীর ভাতিজার ছেলে চন্দ্র কুমার বসু গত পার্লামেন্ট নির্বাচনে বিজেপির টিকেটে দক্ষিণ কোলকাতা থেকে পার্লামেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন।

গত বছর আজাদ হিন্দ ফৌজ দিবস উদযাপনের সময় প্রধানমন্ত্রী মোদি যখন নেতাজীর আইএনএ-এর টুপি পরেছিলেন, তখন বসু পরিবারের এই বংশধর তার পাশেই ছিলেন। নেতাজীর গোপন করে রাখা হাজার হাজার ফাইল উন্মুক্ত করে দিলে তিনি মোদির প্রশংসা করেছিলেন। উল্লেখ্য, বিজেপির সমালোচকেরা নেহরুর কৃতিত্ব খর্ব করার জন্য উগ্র জাতীয়তাবাদের বসু ধারার প্রশংসা করার প্রয়াসকে বিরোধী কংগ্রেসকে অস্বস্তি ফেলা হিসেবে অভিহিত করেছেন।
বসু পরিবারের অন্যান্য সদস্য এখনো সেক্যুলার দলগুলোর সাথে থেকে বিজেপির বিষাক্ত হিন্দুত্ববাদের প্রবল বিরোধিতা করে গেলেও চন্দ্র বসু গেরুয়াদের সাথে যোগ দিয়েছেন। তার কাজিন ও হার্ভার্ডের ইতিহাসের অধ্যাপক সুগতা বসু (তিনি বিয়ে করেছেন তার সহকর্মী ইতিহাসবিদ পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত আয়েশা জালালকে) পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেসের প্রতিনিধিত্ত্ব করেছিলেন ২০১৪-১৯ পর্যন্ত।

তবে ভারত যখন রুদ্ধশ্বাসে অযোধ্যা (হিন্দু উগ্রপন্থীরা ১৯৯২ একটি মসজিদ ধ্বংস করে দেয় হিন্দুদের পৌরানিক নায়ক রামের স্মৃতিতে একটি মন্দির নির্মাণের জন্য) প্রশ্নে আদালতের রায় শোনার অপেক্ষা করছিল, তখন চন্দ্র কুমার বসু চলতি সপ্তাহে গেরুয়া দলকে লক্ষ্য করে বড় ধরনের একটি আঘাত হেনেছেন।
বসু হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন যে তার দল যদি ঐক্যবদ্ধ ভারতের নেতাজির সেক্যুলার মতাদর্শ অনুসরণ না করে, তবে দেশ টুকরা টুকরা হয়ে যাবে।

চন্দ্র বসু মিডিয়ার লোকদেরকে বলেন, ঐক্যবদ্ধ ভারতের জন্য দলকে অবশ্যই নেতাজির আদর্শ অনুসরণ করতে হবে। এখানে ধর্মের কোনো স্থান থাকতে পারে না। তা না হলে পুরো ভারত টুকরা টুকরা হয়ে যাবে। সুভাস চন্দ্র বসু তার আজাদ হিন্দ ফৌজে হিন্দু, মুসলিম, শিখ ও খ্রিস্টানদেরকে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন।... আমিও বিজেপিতে আছি। আমি বিশ্বাস করি, ধর্ম একটি ব্যক্তিগত বিষয়। যারা এতে বিশ্বাস করে না, তারা বিভেদকারী শক্তি।
‘ধর্মের কোনো স্থান নেই’ বক্তব্যটি বিজেপির জন্য হজম করা খুবই কঠিন। বিজেপি হিন্দু ধর্মের সাথেই তার জাতীয়তাবাদকে বেঁধেছে।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, যারা ধর্মকে ব্যক্তিগত বিষয় মনে করে না, তাদেরকে তিন বিভেদকারী শক্তি হিসেবে উল্লেখ করে হিন্দু ডানদেরই লক্ষ্য করেছেন।
দিল্লি ও কলকাতায় বিজেপি নেতারা চন্দ্র বসুর প্রকাশ্যে দেয়া বিবৃতির ওপর মন্তব্য করতে আগ্রহ প্রকাশ করেননি। তবে স্পষ্টভাবেই দেখা যাচ্ছে যে তারা অস্বস্তিতেই রয়েছেন। সহিংসতার আশঙ্কায় প্রধানমন্ত্রী মোদি ও বিজেপি-আরএসএস নেতারা শান্ত ও সংযত থাকার আহ্বান জানালেও তারা অযোধ্যার রাম জন্মভূমি বিতর্ক নিয়ে হিন্দু ভাবাবেগ নিয়ে খেলার সুযোগটি হাতছাড়া করেননি।

চন্দ্র বসু স্বাধীনতা যুদ্ধের নায়কের প্রতি ‘যথার্থ’ শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করার জন্য দিল্লিতে নেতাজীর একটি ভাস্কর্য ও স্মৃতিসৌধ নির্মাণের জন্য প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আহ্বান জানান।

মোদি সরকার নেতাজীর মতোই আরেক মহান নেতা সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের একটি মূর্তি নির্মাণ করেছে ৪০০০ কোটি রুপি ব্যায় করে। তারা উদার নেহরুর বিরুদ্ধে প্যাটেলকেই ‘আসল নায়ক’ হিসেবে উপস্থাপন করতে চাচ্ছে। তবে প্যাটেলের প্রভাবে থাকা কংগ্রেসের ডানপন্থী অংশ দেশকে বিভক্তির দিকে ঠেলে দিয়েছিল। কিন্তু নেতাজীর বামপন্থী অংশটি প্রবলভাবে এর বিরোধিতা করেছিল।

চন্দ্র কুমার টুইটে বলেছেন, ভারত সরকারের উচিত ভারতের মুক্তিদাতা ও আজাদ হিন্দ ফৌজের প্রতি যথাযথ শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা। ইন্ডিয়া গেটে নেতাজীর একটি ভাস্কর্য, দিল্লির রাজপথে স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা এবং সব ভারতীয়কে ঐক্যবদ্ধ করার নেতাজীর আদর্শকে বাস্তবায়ন করা।

তিনি তার টুইটে প্রধানমন্ত্রীর অফিসকে ট্যাগ করে বলেন যে তিনি এই ইস্যুতে প্রধানমন্ত্রীর অফিসে চিঠি লিখবেন।
তিনি বলেন, আমরা (বিজেপি) গান্ধী সংকল্প যাত্রা করেছি। আমি ছয় দিন হেঁটেছি। কিন্তু তেমন সাড়া পাইনি। আমি গান্ধীকে খাটো করতে চাই না। তবরং আমি প্রধানমন্ত্রীকে বলব, আমরা দেশজুড়ে নেতাজী সংকল্প যাত্রার আয়োজন করতে পারি। তা হতে পারে পুরো জানুয়ারিজুড়ে।

সুভাস চন্দ্র বসু জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৮৯৭ সালের ২৩ জানুয়ারি।

তিনি তার উগ্র জাতীয়তাবাদের জন্য অনেকবার ব্রিটিশদের কারাগারে ছিলেন। গান্ধীর অসহযোগিতার আগে তিনি দুবার কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। কংগ্রেসের ডানপন্থীরা তাকে দল ত্যাগ করতে এবং ১৯৩৯ সালের ৩ মে অল ইন্ডিয়া ফরোয়ার্ড ব্লক গঠন করতে বাধ্য করেছিল।

তিনি ব্রিটিশ যুদ্ধ প্রয়াসে কংগ্রেসের সমর্থন প্রদানের বিরোধিতা করেছিলেন। তিনি ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে জাপানিদের পাশাপাশি লড়াই করার জন্য ভারত থেকে পালিয়ে গিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি গঠন করেছিরেন। আইএনআইয়ে তার ঘনিষ্ঠ সহকর্মীদেরমধ্যে ছিলেন মুসলিমও শিখ বা প্রবলভাবে সেক্যুলার হিন্দুরা।
নেতাজীর মৃত্যু বা অন্তর্ধান রহস্য উদঘাটনের জন্য ভারত সরকার পর্যায়ক্রমে তিনটি তদন্ত কমিশন গঠন করলেও এখন পর্যন্ত সমাধান আসেনি। কমিশনগুলো হলো ১৯৫৬ সালে শাহ নওয়াজ কমিটি, ১৯৭০ সালে খোসলা কমিশন ও ২০০৫ সালে মুখার্জি কমিশন।

ইতিহাসবিদেরা বলছেন, সুভাস চন্দ্র বসু ব্যক্তিগতভাবে শাস্ত্র অনুসারী হিন্দু হলেও তিনি তার সময়ে প্রচণ্ডভাবে বিরোধিতা করতেন হিন্দু সভা ও উগ্র ডানপন্থী গ্রুপগুলোর। তিনি তার দেশাবাসীকে এদের থেকে দূরে থাকতে সাবধান করে দিয়েছিলেন।

বসুর ফরোয়ার্ড ব্লকের শীর্ষ নেতা শ্যামল রায় বলেন, বিজেপি হয়তো নেতাজীর কৃতিত্বের প্রশংসা করার চেষ্টা করবে। কিন্তু তাতে কাজ হবে না। নেতাজী ও বিজেপি তেল আর জলের মতো আলাদাই থাকবে। গেরুয়ারা অপরিহার্যভাবেই বদহজমে ভুগবে।


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us