আফগানিস্তানেও ভারতকে মূল্য দিতে হবে!

এম কে ভদ্রকুমার | Dec 12, 2019 08:24 pm
আফগানিস্তানেও ভারতকে মূল্য দিতে হবে!

আফগানিস্তানেও ভারতকে মূল্য দিতে হবে! - ছবি : সংগৃহীত

 

এমনটাও ঘটল : স্বাধীনতার পর থেকে ভারতের সবচেয়ে বন্ধুভাবাপন্ন ও সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী আফগানিস্তান কূটনৈতিক শিষ্টাচার দূর করে এবং দ্ব্যর্থহীন ভাষায় তার দেশে সংখ্যালঘুদের ওপর কথিত ধর্মীয়/বর্ণবাদী নির্যাতন হচ্ছে বলে ভারতীয় নেতৃত্বের রূঢ় দোষারোপ প্রশ্নে তার ক্ষোভ ও আহত হওয়ার অনুভূতি প্রকাশ করেছে। ইন্ডিয়া টুডে টিভিতে আফগান দূত তাহির কাদিরির দেয়া সাক্ষাতকারটি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এবং এমনকি পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের জন্য বোধদয় ঘটানো উচিত, অর্থাৎ তাদের বোঝা উচিত, তিনটি বড় মুসলিম প্রতিবেশীর সাথে ভারতের রাজনৈতিক সম্পর্ক বিপরীত স্রোতের মুখে পড়েছে।

আফগানিস্তানে সংখ্যারঘু শিখ সম্প্রদায়ের ওপর রাষ্ট্রীয় নির্যাতন হচ্ছে বলে অভিযোগে তীব্র সমালোচনা করেছেন আফগান দূত। তিনি বলেছেন, তালেবান আফগান লোকজন ও সরকারের পতনের পর থেকে, বিশেষ করে এই সরকারের আমল থেকে গত কয়েক বছরে শিখ সম্প্রদায়সহ সংখ্যালঘুদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা হচ্ছে, আফগানিস্তানে তারা আমাদের মহান ভাই ও বোন হিসেবে মর্যাদা ভোগ করছে। তাদের প্রতি আমাদের বিপুল শ্রদ্ধা আছে, আমরা পার্লামেন্টে তাদের জন্য আসনের ব্যবস্থা করেছি, নিম্নকক্ষেও তাদের আসন দিয়েছি। আমরা প্রেসিডেন্ট প্রাসাদেও তাদের প্রতিনিধি রেখেছি।

কাদিরির মন্তব্যে বস্তুনিষ্ঠতা রয়েছে। তালেবান শাসনামালের ৫ বছরের (১৯৯৬-২০০১) অস্বাভাবিক সময়টি বাদ দিলে আফগান রাষ্ট্র সবসময়ই বিভিন্ন ধর্ম ও সম্প্রদায়কে বিকাশিত হওয়ার সুযোগ দিয়েছে, বহুত্ববাদ অনুসরণ করেছে। আফগানিস্তানে শিখ সম্প্রদায় কখনো নির্যাতিত হয়ীন। বস্তুত, আফগান সমাজের সুগভীরে প্রোথিত (এমনকি ১৯৯২-১৯৯৬ মুজাহিদিনদের বিশৃঙ্খল সময়েও) থাকা কাবুলের শিখ গুরুদুয়ারা শান্তি ও সৌম্যতার উদ্যান ছিল। আর ’৯০-এর দশকে নিরাপত্তা পরিস্থিতির অবনতি ঘটার সময় অনেক শিখ পরিবার ভারতে চলে এসে গোলযোগ অবসানের অপেক্ষা করেছে। তবে পরিবারগুলোর পুরুষ সদস্যরা কাবুলেই থেকে তাদের জীবিকা (মূলত ব্যবসা) অনুসন্ধান করে গেছে। আফগান ব্যবস্থায় তারা তুলনামূলকভাবে ভালোই আছে, বিশেষ করে ভারতের সাথে ব্যবসার ক্ষেত্রে। অবশ্য সন্ত্রাসবাদের ডাকিনি আফগানিস্তানে এখন নিরাপত্তাহীনতার সৃষ্টি করেছে এবং শিখ সম্প্রদায়ও মারাত্মকভাবে দুর্ভোগে রয়েছে। কিন্তু তা কি রাষ্ট্রীয় নির্যাতন? ঈশ্বরের দোহাই দিয়ে বলা যায়, তা নয়।

বর্তমান বিজেপি সরকারের দৃষ্টিভঙ্গির বিপরীতে উপর্যুপরি কংগ্রেস সরকারগুলো ভারতে আশ্রয়প্রার্থী আফগান নাগরিকদের জন্য খোলা দরজা নীতি অনুসরণ করেছে। আমরা কখনো ধর্ম বা জাতীয়তার ভিত্তিতে আফগানদের মধ্যে পার্থক্য করিনি। ভারতীয় নীতি ছিল জনগণের মধ্যে সম্পর্ক জোরদার করা, আর ওই দৃষ্টিকোণ সাধারণভাবে আফগান জনসাধারণের মধ্যে আমাদের দেশের জন্য ব্যাপক সুনাম বয়ে এনেছে।

যৌক্তিকভাবেই ওই দৃষ্টিকোণ ছিল ভারত-আফগানিস্তান সম্পর্কের মূল বিষয়। এমনকি ভারতীয় গোয়েন্দারাও অনেক দশক ধরে ওই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থেকে সুবিধা পেয়েছে। এ ধরনের রুক্ষ্ম পদক্ষে গ্রহণ থেকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকে বিরত রাখার জন্য ভারতের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো কতটুকু চেষ্টা করেছে তা আমরা জানি না। তবে কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, আমাদের দেশে এ ধরনের পেশাদারিত্বের অস্তিত্ব আমাদের দেশে আর বিরাজ করছে না। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ব্যাপারে যত কম বলা হয়, ততই ভালো। ভারতীয় নেতৃত্বের মুসলিমবিরোধী অবস্থানের কারণে আফগানিস্তান ও বাংলাদেশের সাথে ভারতের সম্পর্ক খারাপ হওয়ার বিষয়টি ভারতের পররাষ্ট্র দফতরের বোঝানোর সময় এখনই। কিন্তু খোদ রাজার চেয়েও বেশি আনুগত্য থাকা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যে নীরব দর্শকই হয়ে থাকবে, তা বলাই বাহুল্য।

আপনি চিন্তা করে দেখছেন কি, আপনার প্রতিবেশীদেরকে অসহিষ্ণু ও বর্ণবাদী ও নির্যাতনকারী হিসেবে অভিযুক্ত করছেন? আর এর মাধ্যমে কি আপনি কাচের ঘরে পাথর নিক্ষেপ করছেন না? মনে রাখতে হবে, এমনকি ছোট ছোট দেশও আত্মমর্যাদা ও জাতীয় গর্বের অধিকারী। আমরা আফগান ও বাংলাদেশী জাতীয় মনন, আত্মমর্যাদায় আঘাত দিয়েছি। এ জন্য অবশ্যই মূল্য দিতে হবে। বর্তমান ক্ষমতাসীনেরা যত দিন ক্ষমতায় থাকবে, তত দিন ভারতের মুসলিম প্রতিবেশীদের সাথে খোলা মনে আন্তরিকতার সাথে বৈঠক করা অসম্ভব। কারণ তারা আমাদের দেশকে গোঁড়ামির ভূমি মনে করবে।

ভারত তার ‘উদ্বাস্তু সমস্যা’ সমাধানে ভিন্ন পথ অবলম্বন করতে পারত। মোদি সরকার যদি অভিবাসীদের সুরক্ষা করার ব্যাপারে আন্তরিক হতো, তবে সে স্বাধীনতা না থাকা বা হুমকির মধ্যে থাকা উদ্বাস্তুদের ফেরত না দেয়ার জাতিসঙ্ঘের ১৯৫১ সালের উদ্বাস্তু কনভেনশন সই করতে পারত। ভারত যদি বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে তার নৈতিক দাবিটি অব্যাহত রাখতে চায়, তবে কোনোভাবেই উচিত হবে না ধর্মের ভিত্তিতে কোটি কোটি লোককে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত করা।

কোনো ভুল ছাড়াই চানক্যপুরিতে বাংলাদেশি ও আফগান মিশনগুলো তাদের দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও জাতীয় সম্মনের প্রতি আঘাত দিয়ে ভারতীয় নেতৃত্ব যেসব কথা বলছে, সেগুলোই মূল ভাবে নিজ নিজ রাজধানীতে পাঠাবে। যে অঞ্চলে ভারত ইতোমধ্যেই নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছে, সেখানে কেন দুই ব্যতিক্রমী প্রতিবেশীকে রাগাতে গেলাম? অবশ্য কূটনীতির সহানুভূতির দুনিয়ায় আমরা হয়তো হিসাব করতে পারি যে আফগানিস্তানের মতো ছোট দেশগুলোর সামনে ভারতের মতো বড় দাতাদের সাথে সহযোগিতা করা ছাড়া আর কোনো গত্যন্তর থাকবে না। কিন্তু এ ধরনের অহঙ্কার আজকের দুনিয়ায় আমাদের বেশি দূর নিয়ে যাবে না। আমরা যদি শ্রদ্ধার ভিত্তিতে সমান মর্যাদায় সম্পর্ক রক্ষা করতে না পারি, তবে আমাদের ছোট প্রতিবেশীরা অর্থপূর্ণ মিত্রতার জন্য অন্যত্র তাকাবে। আর বর্তমান পরিস্থিতিতে তাদেরকে এ জন্য খুব বেশি দূরে তাকাতে হবে না। আর তা যখন ঘটবে, রাতের পর যখন দিন আসেই, তখন আমাদেরকে মাটিতে বসে রাজার মৃত্যুর করুণ কাহিনী বলা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না।

ইন্ডিয়ান পাঞ্চলাইন


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us