মার্কিন কোম্পানিগুলো কেন ফেসবুকে বিজ্ঞাপন বয়কট করছে?

অন্য এক দিগন্ত ডেস্ক | Jun 28, 2020 09:20 pm
ফেসবুক

ফেসবুক - ছবি : সংগৃহীত

 

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে বিজ্ঞাপন দেয়া বয়কট করেছে বেশ কিছু নামজাদা কর্পোরেট সংস্থা। এর প্রেক্ষাপটে সংস্থার সিইও মার্ক জাকারবার্গ ঘোষণা করেছেন, এই প্ল্যাটফর্মে হেট-স্পিচ ও ভুয়া খবর মোকাবিলায় কনটেন্ট মডারেশন নীতি আরো কঠোর করা হবে।

শুক্রবার বিকেলে ফেসবুক লাইভে জাকারবার্গ এই ঘোষণা করেন। এর ঘন্টাখানেক আগে, গত এক সপ্তাহ সময় ধরে প্রায় ১০০ সংস্থা ফেসবুকের বিজ্ঞাপনে তাদের বিনিয়োগ প্রত্যাহারের যে সিদ্ধান্ত ঘোষণা করছিল, তাতে যোগ দেয় ইউনিলিভারের মতো বড় সংস্থা।

ফেসবুকের সাম্প্রতিক নীতি পরিবর্তনে অবশ্য বিশ্বজোড়া বিজ্ঞাপনদাতাদের মধ্যের বিদ্রোহ কমাতে পারেনি। এই সংস্থাগুলোর অভিযোগ, ভুয়া তথ্য ও উত্তেজনা ছড়ানোর মতো কনটেন্টের প্রাবল্য রুখতে ফেসবুক প্রায় ব্যর্থ।

এ বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে যখন ওই দিনই পরের দিকে জাপানি গাড়ি প্রস্তুতকারক সংস্থা হোন্ডা মোটর কোম্পানি ও মার্কিন চকোলেট উৎপাদক সংস্থা হারশেল স্টপ হেট ফর প্রফিট প্রচারে যোগ দেয়। এ মাসে এই বয়কট আন্দোলন শুরু করেছিল বেশ কয়েকটি মার্কিন মানবাধিকার গোষ্ঠী।

কোকাকোলাও ঘোষণা করেছে তারা ফেসবুকসহ সমস্ত সোশাল মিডিয়ায় বিজ্ঞাপন দেয়া অন্তত ৩০ দিনের জন্য বন্ধ রাখছে। তবে তারা অ্যাডউইককে বলেছে, চলমান বয়কটি আন্দোলন নিরপেক্ষভাবেই তাদের এই সিদ্ধান্ত।

সংস্থার সিইও জেমস কুইয়েন্সি বলেছেন, “আমরা আমাদের বিজ্ঞাপনের মান ও নীতি ফের খতিয়ে দেখছি যে, আমাদের সংস্থায় আভ্যন্তরীণভাবে কোনো সংস্কার প্রয়োজন রয়েছে কিনা। সোশাল প্ল্যাটফর্মগুলিকে ঘৃণা, হিংসা ও অনুপযুক্ত বিষয়মুক্ত রাখার ব্যাপারে আমাদের সোশাল মিডিয়া পার্টনারদের কাছ থেকে কী প্রত্যাশিত তাও খতিয়ে দেখছি। আমরা তাদের জানাতে চাই যে আমরা তাদের থেকে আরো বেশি পরিমাণ দায়িত্ব, স্বচ্ছতা ও ব্যবস্থাগ্রহণ প্রত্যাশা করছি।”

ফেসবুকের বিজ্ঞাপন বয়কট আন্দোলন গতি পেল কীভাবে

মিনিয়াপোলিসে নিরস্ত্র জর্জ ফ্লয়েডের হেফাজত মৃত্যু নিয়ে সারা আমেরিকায় বর্ণবাদবিরোধী বিদ্রোহ মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অগ্রণী মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলো এই আন্দোলনে যোগ দেয়। বিভিন্ন বড়-ছোট সংস্থার কাছে তারা আবেদন করে ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রাম থেকে বিজ্ঞাপন বন্ধ করার ব্যবস্থা করে। এই আন্দোলন স্টপ হেট ফর প্রফিট নামে পরিচিত হয়।

কোয়ালিশনে যোগ দিয়েছে কালার অফ চেঞ্জ, ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন ফর দি অ্যাডভান্সমেন্ট অফ কালার্ড পিপল, স্লিপিং জায়েন্ট, ফ্রি প্রেস, অ্যান্টি ডিফ্যামেশন লিগ, কমন সেন্স মিডিয়া। এদের অভিযোগ অনলাইনে বর্ণবাদী কনটেন্ট প্রচার রোধ করতে প্রায় কোনও পদক্ষেপ করছে না।

এই আন্দোলনের ওয়েবসাইটে বলা হচ্ছে, “আমেরিকায় জর্জ ফ্লয়েড, ব্রেরোনা টেলর, টনি ম্যাকডেড, আহমেদ আরবেরি, রেশার্ড ব্রুকস এবং আরো অনেকের ঘটনায় বর্ণ সম্পর্কিত ন্যায় বিচারের যে লড়াই সামনে এসেছে সে সংক্রান্ত প্রতিবাদীদের বিরুদ্ধে হিংসা প্রণোদনা অনুমোদন করেছে ফেসবুক।”

এই প্ল্যাটফর্ম থেকে বিজ্ঞাপন তুলে নেয়ার জন্য ব্যবসায়ীদের কাছে আবেদন জানিয়ে বলা হয়েছে,”ফেসবুকের ৭০ বিলিয়নের ৯৯ শতাংশ আসে বিজ্ঞাপন থেকে। চলুন আমরা ফেসবুককে একটি শক্তিশালী বার্তা পাঠাই যে, ঘৃণা, ধর্মান্ধতা, বর্ণবাদ, আপনাদের লাভ কখনোই সেমেটিসজমবিরোধিতা ও হিংসার প্রচারের মাধ্যমে আপনাদের লাভ করতে দেয়া হবে না।”

২০২০ সালের মার্কিন নির্বাচনের প্রচারের দায়িত্বে থাকা সংগঠকরা আশঙ্কা করছেন, সোশাল মিডিয়া বিভাজিত অডিয়েন্স ভুয়া খবর ও বিভেদমূলক বিষয় প্রচারের কারণ হয়ে উঠতে পারে। এই প্রচারে ব্যাপকতা এসেছিল মার্কিন আইসক্রিম নির্মাতা সংস্থা বেন অ্যান্ড জেরিস, ফিল্ম পরিবেশক ম্যাগনোলিয়া পিকচার্স ও আউটডোর অ্যাপারেল ব্র্যান্ড নর্থফেসের যোগদানে। তারা ফেসবুকে বিজ্ঞাপন বয়কটিদের দলে যোগ দিয়েছে।

তবে ফেসবুকের মডারেশন নীতি নিয়ে আলোচনা কেন্দ্রে চলে এসেছে টেলিকম সংস্থা ভেরিজোনের বিজ্ঞাপন বয়কটের সিদ্ধান্তে।

ভেরিজোনের সিদ্ধান্তের পিছনে রয়েছে একটি খোলা চিঠি। ওই চিঠিতে দেখানো হয়েছে একটি ঘৃণাপূর্ণ অ্যান্টিসেমেটিক পোস্টের পাশেই একটি বিজ্ঞাপন।

ইউনিলিভার, ভেরিজোন এবং লিভাইসের মত সংস্থা এই সোশাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক ফের খতিয়ে দেখার সিদ্ধান্ত নেয়ার সঙ্গেই বড় বিজ্ঞাপন সংস্থাগুলো তার গ্রাহকদের এই বিক্ষোভে যোগ দিতে বলেছে, ক্যাম্পেনের তরফ আশা করা হচ্ছে ফেসবুক তাদের নীতি বদলের মাধ্যমে একটি সুরক্ষিত ও পক্ষপাতহীন অনলাইন অভিজ্ঞতা তার লাখ লাখ ব্যবহারকারীর কাছে তুলে ধরবে।

এই ক্যাম্পেনের সংগঠকরা ফেসবুকের কাছে সুপারিশের একটি তালিকা প্রকাশ করেছেন। এতে যেসব সুপারিশ করা হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে যেসব মানুষ বর্ণবাদ ও বিদ্বেষের শিকার তাদের যেন আরো সমর্থন দেয়া হয়, ভুয়ো তথ্য ও বিদ্বেষমূলক কনটেন্ট থেকে আয়দায়ী বিজ্ঞাপন বন্ধ করা, এবং প্রাইভেট গ্রুপে নিরাপত্তা বৃদ্ধি।

ফেসবুকের প্রতিক্রিয়া

ফেসবুকে জাকারবার্গের শুক্রবারের ভাষণের আগে ফেসবুক ২০০-র বেশি বিজ্ঞাপনদাতার সঙ্গে কনফারেন্স কলের মাধ্যমে জানিয়েছে, তারা বিশ্বাসের ঘাটতি পূরণের চেষ্টা চালাচ্ছে।

শুক্রবার ১১ মিনিটের লাইভস্ট্রিমিংয়ে জাকারবার্গ ঘোষণা করেন, তার সংস্থা হেট-স্পিচ নিয়ে ক্রমবর্ধমান উদ্বেগের বিষয়টি মেটাতে দ্রুত ব্যবস্থা নেবেন। জাকারবার্গ বলেন, “আমি ফেসবুককে মানুষের নিজের কথা বলার ও গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার মাধ্যম করে তোলার ব্যাপারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, কিন্তু একই সঙ্গে ঘৃণা বা হিংসা ছড়ানোর বিরুদ্ধে বা ভোট দমনের বিরুদ্ধেও আমার অবস্থান, আমরা এ ধরনের কনটেন্ট সরিয়ে দেব তা যার কাছ থেকেই আসুক না কেন।”

তিনি বলেন, “ইনস্টাগ্রাম ও ফেসবুক প্রান্তিক গোষ্ঠী ও সংখ্যালঘু – অভিবাসী, পরিযায়ী, উদ্বাস্তু ও অন্যদের সুরক্ষায় সচেষ্ট। একইসঙ্গে তিনি বলেন, সংস্থা এ ধরনের নীতিবিরোধী পোস্ট সরিয়ে না দিয়ে সেগুলোকে লেবেল দিতে পারে।”

দেশজোড়া বর্ণবিদ্বেষবাদ বিরোধী আন্দোলনের মধ্যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিতর্কিত পোস্ট না সরানোর পর থেকেই ফেসবুক জনরোষের মুখে পড়েছে। ফ্লয়েডের মৃত্যুর পর মিনিয়াপোলিসে বিক্ষোভরতদের বিরুদ্ধে শক্তিপ্রয়োগের হুমকি দিয়েছিলেন ট্রাম্প। সংস্থার এই সিদ্ধান্তের জেরে ফেসবুকের কয়েক শ' কর্মী তাদের অসন্তোষ ব্যক্ত করতে ভার্চুয়াল ওয়াকআউট করেন।

ক্যাম্পেনর প্রভাব, ফেসবুকে

৭০ বিলিয়ন ডলার বার্ষিক আয়ের এই সংস্থা থেকে বিজ্ঞাপনদাতারা মুখ ফেরানোয় এদের ব্যবসার বড়সড় ক্ষতি হতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

ইউনিলিভার তাদের বিজ্ঞাপন বন্ধের ঘোষণা করার পরেই ফেসবুকের শেয়ারের দাম পড়ে যায় ৮.৩ শতাংশ- গত তিন মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশ হ্রাস। সিএনএন-এর এক রিপোর্ট অনুসারে গত বছর এই সংস্থা ৪২ মিলিয়ন ডলার ঢেলেছিল ফেসবুকে। ভেরিজোনও গত মাসে ২ মিলিয়ন ডলার বিজ্ঞাপন দিয়েছিল ফেসবুকে, জানিয়েছে সিএনবিসি।

এই বয়কট ক্যাম্পেনের উদ্দেশ্য ফেসবুকের আর্থিক ক্ষতি করা নয়, মনে করিয়ে দিয়ে মানবাধিকার সংগঠন স্লিপিং জায়েন্টস শুক্রবার এক টুইট করে বলেছে এই প্রচারের উদ্দেশ্যে ফেসবুকের গেট ও ভুয়ো তথ্য সম্পর্কিত মডারেশনের যে ঘাটতি তা তুলে ধরা।

অনেকেই এর সঙ্গে ২০১৭ সালের ইউটিউবের বিরুদ্ধে চলা বয়কট আন্দোলনের সাদৃশ্যের কথা বলেছেন। তখনও বড় সংস্থাগুলি ইউটিউব থেকে বিজ্ঞাপন তুলে নিয়েছিল। তবে কিছুদিন পরেই তারা আবার ফেরত আসে বলে জানিয়েছে ফোর্বস।

সূত্র : ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস

 


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us