ফেরাউনের শাসন ও হজরত মুসা

গোলাম মাওলা রনি | Aug 13, 2020 07:21 pm
দ্বিতীয় রামাসিসের মমি

দ্বিতীয় রামাসিসের মমি - ছবি : সংগৃহীত

 

মিসরীয় ফেরাউনদের মধ্যে যিনি অন্যতম শ্রেষ্ঠ শাসক হিসেবে পরিচিত তার নাম ছিল প্রথম সেটি। তার স্ত্রী তুইয়াও অত্যন্ত মহীয়সী রমণী ছিলেন। ধারণা করা হয়, এই মহান শাসকের জমানাতেই শিশু হজরত মুসা আ: মিসরের রাজপ্রাসাদে অলৌকিকভাবে আশ্রয় লাভ করেন এবং একজন রাজপুত্ররূপে লালিত পালিত হতে থাকেন। পরে তিনি যৌবনপ্রাপ্ত হলে তার নেতৃত্বগুণ, প্রজাদের প্রতি মমত্ব, সাহস শক্তি এবং বুদ্ধিমত্তা দেখে ফেরাউন প্রথম সেটি এতটাই মুগ্ধ হয়ে পড়েন যে, তাকে ভবিষ্যৎ শাসকরূপে মনোনীত করার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু একটি দুর্ঘটনার কারণে মুসা আ: ফেরারি আসামিরূপে রাজপ্রাসাদ থেকে পালিয়ে মাদায়েনের দিকে চলে যান। ফলে তার বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি হয়। এই ঘটনার কয়েক বছর পর সম্রাট সেটির মৃত্যু হয় এবং তার একমাত্র পুত্রসন্তানরূপে রামসিস দ্য সেকেন্ড অর্থাৎ দ্বিতীয় রামসিস সিংহাসনে আসীন হন।

বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ, লৌকিক উপকথা এবং সাহিত্য উপন্যাসে যে অভিশপ্ত ফেরাউনের কথা বলা হয় তিনি যে দ্বিতীয় রামসিস তা বেশির ভাগ ঐতিহাসিক বিশ্বাস করেন। দ্বিতীয় রামসিসের রাজত্বকাল, তার জ্ঞান গরিমা এবং সমসাময়িক দুনিয়াতে তার ইতিবাচক প্রভাব প্রতিপত্তির যে ইতিহাস লিখিত রয়েছে সেগুলোর সাথে তার পতনের কাহিনী মেলানো সত্যিকার অর্থেই কঠিন একটি বিষয়। মিসরের হাজার বছরের রাজনৈতিক ইতিহাসে তিনিই হলেন সর্বকালের সেরা জনপ্রিয় শাসক এবং কিংবদন্তির সম্রাট। তার রাজত্বকালকে বলা হয় উনিশতম ডাইনেস্টি। তিনি ক্ষমতায় ছিলেন ১২৭৯ খ্রিষ্ট পূর্বাঙ্গ থেকে ১২১৩ খ্রিষ্ট পূর্বাঙ্গ পর্যন্ত। অন্য দিকে তার জীবৎকাল ছিল নব্বই বছর। অর্থাৎ নব্বই বছর জীবৎকালের ৪২ বছরই তিনি মিসর শাসন করেছেন। ১৮৮১ সালে যখন তার মৃতদেহ আবিষ্কৃত হয় তখন তা রাজকীয় মর্যাদায় প্রাচীন রাজধানী লুক্সরের রয়্যাল ফ্যাসি থেকে কায়রোতে আনা হয়। একটি ঐতিহ্যবাহী ইঞ্জিনবিহীন ফেরাউন জমানার ধাঁচে তৈরি জাহাজে করে দ্বিতীয় রামসিসের মৃতদেহ যখন নীল নদ দিয়ে আনা হচ্ছিল তখন লাখ লাখ মিসরবাসী বন্দুকের গুলি ছুড়ে, আতশবাজি ফুটিয়ে এবং নেচেগেয়ে তাদের সম্রাটকে স্বাগত জানাতে থাকে।

তাবৎ দুনিয়ার ইতিহাসবিদেরা গবেষণা করে রীতিমতো গলদঘর্ম হচ্ছেন দ্বিতীয় রামসিস জমানার রাজনৈতিক সফলতা, রাজ্য বিস্তার, সমগ্র সাম্রাজ্যে সরকারি কাজকর্ম, রাজকীয় স্থাপনা, জনস্বার্থে নির্মিত রাস্তাঘাট, সরাইখানা, সেচব্যবস্থা, খাল খনন, প্রাচীন সুয়েজ খাল পুনঃখনন, জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন, মিসরকে সামরিক এবং অর্থনৈতিক দিক থেকে পৃথিবীর একনম্বর পরাশক্তিতে পরিণত করা ইত্যাদি শুভ কর্মের সাথে তার জমানার শেষের দিকে সাত সাতটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা মহামারী যা কিনা গ্রেট প্লেগ হিসেবে চিহ্নত সেগুলোর ভয়াবহ পরিণতির সমন্বয় ঘটাতে গিয়ে তারা ভেবে পাচ্ছেন না কেন মিসরীয় জনগণ তাকে এত ভালোবাসে। অন্য দিকে বাইরের দুনিয়ার অনাদিকালের লোকজন তাকে অভিশাপ দেয়। অথবা কেনো মহাকালের সবচেয়ে ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ যা কিনা অল্প কয়েক মাসের ব্যবধানে পরপর সাতবার সাতটিরূপে তার রাজধানীকে আক্রমণ করেছিল, কেন তার রাজধানী সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়েছিল, পরবর্তীতে বিরানভূমিতে পরিণত হয়েছিল এবং কালের গর্ভে সেটি কেন প্রায় ১৫ মিটার মাটির নিচে চাপা পড়ল।

আধুনিককালের বিজ্ঞানীরা দ্বিতীয় রামসিসের রাজধানীর সন্ধান পেয়েছেন। প্রযুক্তির কল্যাণে তারা মাটির নিচে চাপা পড়া রাজধানীর মানচিত্রটি পর্যন্ত বানিয়ে ফেলেছেন। সেখানে দেখা যাচ্ছে, রামসিসের রাজধানী যা কিনা সিটি অব রামসিস নামে পরিচিত ছিল তা লম্বায় ছিল ১৫ কিলোমিটার এবং প্রস্থেও ১৫ কিলোমিটার। অর্থাৎ ২২৫ বর্গকিলোমিটারের প্রাচীন সেই মহানগরীর মতো সৌন্দর্যমণ্ডিত, আধুনিক, পরিকল্পিত, নিরাপদ এবং সুখসম্পদে পরিপূর্ণ কোনো রাজধানীর জন্ম পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি হয়নি। তার জমানায় পরিচিত দুনিয়ার জ্ঞানী গুণী, ব্যবসায়ী, কবি-সাহিত্যিক থেকে শুরু করে শান্তিপ্রিয় সচেতন নাগরিকদের স্বপ্নময় সাধ ছিল দ্বিতীয় রামসিসের রাজধানীর নাগরিক হওয়ার বাসনা। নীল নদের চমৎকার একটি বাঁকে গড়ে ওঠা রাজধানীটি তার মৃত্যুর পরে যখন বিরানভূমিতে পরিণত হচ্ছিল, তখন অলৌকিকভাবে নীল নদ তার গতিপথ পরিবর্তন করে সংশ্লিষ্ট এলাকা থেকে বহু যোজন দূরে চলে আসে। ফলে পানির অভাবে সেখানে কোনো পাখ-পাখালিও টিকতে পারেনি।

দ্বিতীয় রামসিসের পতন নিয়ে প্রাচীন তাওরাত-ওল্ড টেস্টামেন্ট এবং পবিত্র কালামে রব্বানী আল কুরআনে যে কাহিনী বর্ণনা করা হয়েছে তা প্রায় একই রকমের। ফলে ঐতিহাসিকরা তার পতনের কার্যকারণের সমীকরণ করতে না পারলেও ধর্মবেত্তারা ঠিকই গাণিতিক হিসাবে অনেক কিছু বের করে ফেলেছেন। তাদের মতে, ফেরাউন রামসিসের পতনের প্রধান কারণ হলো তিনি নিজের প্রতি মস্তবড় জুলুম করেছেন। তার রাষ্ট্রক্ষমতা লাভ, রাজ্য জয় এবং সর্বক্ষেত্রের সফলতায় তিনি নিজের প্রকৃতি গঠন এবং পরিণতি সম্পর্কে উদাসীন হয়ে পড়েছিলেন। তার মেধা, মননশীলতা, ঐতিহ্যবাহী রাজকীয় পারিবারিক শিক্ষা ইত্যাদি সব কিছু ভুলে গিয়ে তিনি ফটকাবাজ দালাল, চাটুকার কবি, ধড়িবাজ অসৎ ব্যবসায়ী এবং ফুর্তিবাজ মেধাবী চরিত্রহীন লোকদের সংস্পর্শে এসে নিজেকে প্রথমে মহামানব, তারপর অতি মানব, তারপর দেবতাদের প্রতিনিধি ভাবতে শুরু করেন। পরে তিনি নিজেকে দেবতা বলে ঘোষণা করেন এবং সর্বশেষে দেবতাদের প্রধান অর্থাৎ ঈশ্বর বলে ঘোষণা করতে থাকেন।

তার রাজনৈতিক সফলতা ও ক্ষমতা, সামরিক প্রতিভা, জনকল্যাণ, গণমুখী আচরণ তথা রাজনৈতিক চরিত্র এবং অঢেল অর্থের সাথে সাথে চরিত্রহীন মেধাবী আমির ওমরা, সেনাপতি, পুলিশ, বেসামরিক আমলা, ধড়িবাজ পুরোহিত কবি এবং জাদুকরদের সম্মিলিত প্রচার প্রপাগান্ডার কারণে তার জমানার বেশির ভাগ লোকজন বিশ্বাস করতে শুরু করে যে, তিনি সত্যিকার অর্থেই ঈশ্বর, যা কিনা আসমানের মালিককে বিক্ষুব্ধ করে তোলে।

দ্বিতীয়ত, তিনি জনগণের মধ্যে স্পষ্টত তিনটি পরস্পরবিরোধী সম্প্রদায় তৈরি করে সমাজে মারাত্মক ফ্যাতনা জুলুম নির্যাতন শোষণ বঞ্চনার এক নবতর অধ্যায় রচনা করেন, যা তার পূর্বসূরিরা কোনো দিন করেনি। তিনি তার বংশীয় বা দলীয় লোক, যারা পরিচিত ছিল কিবতি নামে, তাদের নাগরিকদের মর্যাদা দান করেন এবং রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক সুযোগ-সুবিধায় তাদের ঈশ্বরের প্রতিনিধিরূপে সব অপকর্ম করার লাইসেন্স দেন। তিনি বনি ইসরাইল নামক সুবিখ্যাত জাতিগোষ্ঠী যাদের প্রায় কারো লাখ লোক তার রাজধানী এবং তৎসংলগ্ন এলাকায় বসবাস করতেন, তাদের সব নাগরিক অধিকার হরণ করেন। ফলে এসব হতভাগ্য লোকজন সহায় সম্পতি হারিয়ে ক্রীতদাসে পরিণত হন। যারা স্বাধীন থাকতে পেরেছিলেন তারাও কিবতিদের দ্বারা নানাভাবে নির্যাতনের শিকার হতে থাকেন।

রামসিসের ঈশ্বর হওয়ার বাসনা যারা সৃষ্টি করেছিল, তারা সারা সাম্রাজ্যে বিরাট এক শক্তিশালী সিন্ডিকেট তৈরি করে ফেলেছিল। এই সিন্ডিকেট সব ব্যবসা-বাণিজ্য, নিয়োগ-বদলি ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণ করে রাষ্ট্রের মধ্যে আলাদা একটি রাষ্ট্র গড়ে তুলেছিল। রামসিস যখন বুঝতে পারলেন তিনি ঈশ্বর নন বা কোনো মানুষের পক্ষে ঈশ্বর হওয়া অসম্ভব তখন তিনি আল্লাহর নবী হজরত মুসা আ:-এর প্রস্তাব মতো বনি ইসরাইলিদের মুক্তি দিতে রাজি হলেন। কিন্তু তার তৈরি বশংবদ কুখ্যাত সিন্ডিকেটটি বারবার তাকে প্ররোচিত করে তার দেয়া প্রতিশ্রুতি থেকে তাকে পাপের পথে ফিরিয়ে আনতে থাকে। এমন একটা সময় আসে যখন তিনি রীতিমতো অসহায় হয়ে পড়েন। কিন্তু দাম্ভিকতা, লোকলজ্জা এবং তাকে ঘিরে থাকা স্বার্থান্বেষী পাপিষ্ঠের দলের প্ররোচনায় তিনি বারবার অপরাধ করতে থাকেন।


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us