উমর খালিদদের প্রতি অমর্ত্য সেনের আহ্বান

অমর্ত্য সেন | Oct 27, 2020 05:50 pm
উমর খালিদদের প্রতি অমর্ত্য সেনের আহ্বান

উমর খালিদদের প্রতি অমর্ত্য সেনের আহ্বান - ছবি সংগৃহীত

 

দার্শনিক ইমামুয়েল কান্টে ‘কারো যুক্তি সব ব্যাপারে ঢালাও ব্যবহারের স্বাধীনতা’র যে দাবি করেছিলেন, তার মতো কোনো কিছুই গুরুত্বপূর্ণ নয়।দুর্ভাগ্যজনকভাবে কান্ট আরো উল্লেখ করেছেন, যুক্তি প্রদর্শন করার সুযোগ প্রায়ই সমাজ অত্যন্ত ভয়াবহভাবে সঙ্কোচিত করে ফেলে।বর্তমান বিশ্বের অন্যতম একটি ঝামেলাপূর্ণ বিষয় হলো এই যে এশিয়া, ইউরোপ, ল্যাতিন আমেরিকা, আফ্রিকা, যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক দেশে স্বৈরতান্ত্রিক প্রবণাত ব্যাপকভাবে বাড়ছে। আমার আশঙ্কা, আমাকে আমার দেশকেও এই দুর্ভাগ্যজনক ঝুড়িতে ফেলতে হতে পারে।

ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসন থেকে স্বাধীনতা লাভের পর অনেক ব্যক্তিগত স্বাধীনতাসহ একটি সেক্যুলার গণতন্ত্র হওয়ার সুন্দর ইতিহাস কয়েক দশক পর্যন্ত ছিল ভারতের।জনসাধারণ স্বাধীনতার প্রতি তাদের দায়বদ্ধতা ও সিদ্ধান্তসূচক গণপদক্ষেপের মাধ্যমে স্বৈরতান্ত্রিক শাসনকে অপসারণের দৃঢ়প্রতিজ্ঞতা প্রদর্শন করেছিল।এর একটি উদাহরণ হলো ১৯৭৭ সালের সাধারণ নির্বাচন। ওই সময় জরুরি অবস্থার পোশাকে থাকা স্বৈরতান্ত্রিক বিধিনিষেধকে জনগণ দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করেছিল। সরকার সাথে সাথে তা মেনে নিয়েছিল।
অবশ্য, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অনেকেরে কাছেই স্বাধীনতার অগ্রাধিকার কিছুটা হলেও ঔজ্জ্বল্য হারিয়েছে এবং বর্তমান সরকার বর্তমান সরকার ভিন্ন ধরনের সমাজ বিকাশে প্রবল ধরনের ঝোঁক প্রদর্শন করছে।অবশ্য সরকারবিরোধী ব্যাপক বিক্ষোভও হয়েছে। তবে অবাক করা ব্যাপার হলো, সরকার এগুলোকে প্রায়ই রাষ্ট্রদ্রোহ হিসেবে বর্ণনা করেছে। আর এর জের ধরে গ্রেফতার ও বিরোধী নেতাদের আটক করার সুযোগ পাচ্ছে।এই অবস্থানে স্বৈরতান্ত্রিক প্রবণতা ছাড়াও চিন্তার মারাত্মক বিভ্রান্তি দেখা যাচ্ছে।কারণ সরকারের সাথে ভিন্ন মত প্রকাশ মানে এই নয় যে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা বা অন্তর্ঘাত চালানো।

ব্রিটিশ উপনিবেশিক ভারতে আমি যখন স্কুলে ছিলাম, আমার অনেক স্বজন মহাত্মা গান্ধী ও অন্যদের অনুপ্রেরণায় ভারতের স্বাধীনতার জন্য অহিংস আন্দোলন করেছিলেন। তাদেরকে সহিংস কোনো কিছু থেকে বিরত রাখার জন্য ব্রিটিশ ভারতীয় কারাগারে রাখা হতো। এটাকে বলা হতো ‘প্রিভেন্টিভ ডিটেনশন’ হিসেবে। ভারতের স্বাধীনতার পর ‘প্রিভেন্টিভ ডিটেনশন’ বন্ধ করা হলেও পরে আরেকটু নমনীয় অবয়বে আবার চালু করা হয়।কাজটি ভালো হয়নি। কিন্তু হিন্দুত্ববাদমুখী বিজেপি সরকার এখন দায়িত্বে থাকার সময় ‘প্রিভেন্টিভ ডিটেনশন’ বিশাল ভূমিকা পেয়েছে,কোনো ধরনের বিচার ছাড়াই সহজে গ্রেফতার ও আটক রাখছে বিরোধী রাজনীতিবিদদেরকে।
বস্তুত, গত বছর থেকে নতুনভাবে প্রণীত আনলফুল অ্যাক্টিভিটিজ (প্রিভেনশন) অ্যাক্ট (ইউএপিএ)-এর আলোকে রাজ্য একতরফাভাবে যে কাউকে সন্ত্রাসী ঘোষণা দিয়ে গ্রেফতার করতে পারবে। আর তাকে কোনো ধরনের বিচার ছাড়াই আটক রাখতে পারবে। বেশ কয়েকজন মানবাধিকারকর্মীকে সন্ত্রাসী আখ্যা দিয়ে এর মধ্যেই আটক করা হয়েছে।

যখন কাউকে দেশবিরোধী আখ্যা দেয়া হয়, সেটাকে বিশ্বের যেকোনো স্থানে বড় ধরনের দার্শনিক অভিযুক্তকরণ হিসেবেও বিবেচনা করা হয়। কিন্তু আজকের ভারতে তা সরকারের কোনো দায়িত্বে থাকা ব্যক্তির কোনো সমালোচনামূলক বক্তব্য ছাড়া আর কিছুই বোঝায় না।সরকারবিরোধী ও দেশবিরোধীর মধ্যে পার্থক্যে বিভ্রান্তিই স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের বৈশিষ্ট্য। আদালত অনেক সময় এ ধরনের অপব্যবহারমূলক অনুশীলন বন্ধ করতে সক্ষম হয়। কিন্তু ভারতীয় আদালতগুলোর মন্থর গতি এবং ভারতের বিশাল সুপ্রিম কোর্টে মতামতের পার্থক্যের কারণে সবসময় তা কার্যকর প্রতিকার হয় না। বিশ্বে মানবাধিখার অন্যতম প্রসিদ্ধ রকষক অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল সরকারি হস্তক্ষেপের কারণে ভারত ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছে।

সাধারণভাবে স্বৈরতন্ত্রের সাথে জাতির বিশেষ কোনো অংশের ওপর নির্যাতনের সাথে হাত ধরে আসে। ভারতে তা হয়ে থাকে বর্ণ বা ধর্মের সাথে। স্বাধীনতার পরপরই প্রবর্তিত কিছু সুবিধা (চাকরি ও শিক্ষায়) অচ্ছ্যুত বা দলিতরা এখনো পেয়ে আসছে। তবে তাদের সাথে প্রায়ই খুবই কঠিন আচরণ করা হয়ে থাকে। উচ্চবর্ণের হাতে দলিতদের ধর্ষণ বা খুন প্রায়ই ঘটে এবং সরকার তা অগ্রাহ্য বা আড়াল করে রাখে।

ভারতীয় কর্তৃপক্ষ মুসলিমদের অধিকার ব্যাপকভাবে হ্রাস করেছে। এমনকি তাদের নাগরিকত্ব অধিকারেরও বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। হিন্দু ও মুসলিমদের মধ্যে শত শত বছরের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান সত্ত্বেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রাজনৈতিকভাবে চরমপন্থী হিন্দু সংস্থাগুলো স্থানীয় মুসলিমদেরকে অনেকটা বিদেশী হিসেবে চিহ্নিত করছে, তারা দেশের ক্ষতি করছে বলে প্রচার করছে।

ভারতীয় সংস্কৃতি বিভিন্ন ধর্ম, বিশ্বাসী জনসাধারণের যৌথ ফল। এটি সঙ্গী, সাহিত্য, চিত্রকলা ও স্থাপত্যসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেখা যায়। এমনকি হিন্দু দর্শনগত গ্রন্থ উপনিষদ ভারতের বাইরে ব্যবহারের জন্য প্রথম অনুবাদ করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন মোগল শাহজাদা দারা শিকোহ। তিনি ছিলেন তাজমহল নির্মাতা সম্রাট শাহ জাহান ও মমতাজমহলের বড় ছেলে।সরকারের বর্তমান মতাদর্শকে অগ্রাধিকার দিয়ে ভারতের অনেক পাঠ্যপুস্তক এখন পুরোপুরি পরিবর্তন করা হয়েছে। এসব বইতে মুসলিম জনগোষ্ঠীর ইতিহাস হয় সংশোধন করা হচ্ছে বা হ্রাস করা হচ্ছে।

ইউএপিএ নিয়ে ক্ষমতায় থাকা সরকার গান্ধীর পরামর্শের আলোকে অহিংস প্রতিবাদে নামা লোকদেরও সন্ত্রাসী হিসেবে অভিহিত করছে। এটি বিশেষ করে ছাত্রনেতাদের নেতৃত্বে ভারতে উদীয়মান সেক্যুলার প্রতিরোধের ক্ষেত্রে বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে জওহেরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের মুসলিম স্কুলার উমর খালিদের কথা বলা যেতে পারে। তাকে ইউএপিএ আইনের আওতায় সন্ত্রাসী অভিহিত করে গ্রেফতার করা হয়েছে।

ভারতের স্বৈরতন্ত্রের বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে দরকার দৃঢ়প্রতিজ্ঞ প্রতিরোধ। তবে বিশ্বও এখন স্বৈরতন্ত্রের মহামারিতে আক্রান্ত হয়েছে। নানা দেশে নানাভাবে স্বৈরতান্ত্রিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে। ফিলিপাইনে মাদক পাচার হ্রাসে, হাঙ্গেরিতে অভিবাসনের ঢল থামাতে, পোল্যান্ডে সমকামীদের দমাতে, ব্রাজিলে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে একই বিষয় দেখা যাচ্ছে। স্বাধীনতা রক্ষার জন্য বিশ্বের প্রয়োজন বিভিন্ন ধরনের পন্থা।

ড. মার্টি লুথার কিং জুনিয়র ১৯৬৩ সালে বার্মিংহাম কারাগার থেকে এক চিঠি লিখেছিলেন : যেকোনো স্থানের অবিচার সব জায়গার ন্যায়বিচারের প্রতি হুমকি।

তিনি জোর দিয়ে আরো বলেছিলেন, সব প্রতিরোধই হওয়া উচিত অহিংস। আজকের ভারতের তরুণ ছাত্রনেতাদের জন্যও কথাটি প্রযোজ্য। স্বৈরতন্ত্রের বৈশিষ্ট প্রকাশে কিছু অভিন্নতা যেমন আছে, প্রতিরোধকে যৌক্তিক করার কাজেও অভিন্নতা আছে।

সূত্র : গার্ডিয়ান


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us