বলকানের হৃদয় ছুঁয়ে

মীর সালমান শামিল | Jun 24, 2021 05:14 pm
বলকানের হৃদয় ছুঁয়ে

বলকানের হৃদয় ছুঁয়ে - ছবি সংগৃহীত

 

ওপর থেকে দেখতে অদ্ভুত সুন্দর লাগছে স্কোপিয়া শহরকে।

বিমানটা স্কোপিয়ার আকাশে চক্কর দিচ্ছে। চারদিকে বলকান পাহাড়ে ঘেরা, মাঝেখানে সবুজের সমুদ্র, এই সবুজ কানন চিরে ঠিক মাঝখান দিয়ে বয়ে গেছে পাহাড়ি নদী বারগের। এই নদী শহরকে দুই ভাগ করেছে, পূর্ব পাশে পুরোন অংশ, পশ্চিমে নতুন।

স্কোপিয়া, মেসিডোনিয়ার রাজধানী, পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন শহর। খ্রিস্টপূর্ব ৪০০০ সালে এই শহরের গোরাপত্তন। উর্বর ভূমি, সুমিষ্ট ফল, পশুসম্পদের প্রাচুর্যতার কারণে স্কোপিয়া সব সময়ই পরাশক্তিরগুলোর আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল। এ পর্যন্ত ২৩টি সাম্রাজ্য বিভিন্ন সময় শাসন করেছে স্কোপিয়া। কখনো রোমান এম্পায়ার, কখনো বারজেন্টাইন, কখনো বুলগেরিয়ান, কখনো বা হলি রোমান এম্পায়ার। কোনো সাম্রাজ্যই স্থায়ী হতে পারেনি। পরাশক্তিগুলোর এই দ্বন্দ্বের বলি হয়েছে স্কোপিয়ার সাধারণ মানুষ। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার জন্য সেভাবে বাড়েনি স্কোপিয়ার পরিধি।

১৩৮৯ সালে মেসিডোনিয়া উসমানিয়া সালতানাতের অধীভুক্ত হয়। মুসলিমরা একাধারে ৬০০ বছর স্কোপিয়া শাসন করে। এর আগে স্কোপিয়া টানা দু শ' বছরও শাসন করেনি কোনো সাম্রাজ্য। উসমানিয়া সালতানাতের সময় স্কোপিয়াতে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আসে। এর আকার বেড়ে কয়েকগুণ হয়। মাত্র কয়েক হাজার মানুষের শহর প্রায় ৭ লাখ মানুষের একটা বিশাল মহানগরীতে পরিণত হয় (ইউরোপের প্রেক্ষিতে ৭ লাখ বড় সংখ্যা। মিউনিখের মতো আধুনিক মাল্টিন্যাশনাল শহরের জনসংখ্যা মাত্র ১০ লাখ)। স্কোপিয়া শহরের কাঠামো, রাস্তাঘাট সব কিছুইতেই মুসলিম প্রভাব স্পষ্ট। স্পেন, সিসলি, ভারতের মতো মুসলিমরা মেসিডোনিয়াতেও ধর্ম চাপিয়ে দেয়নি। যারা মুসলিম হয়, তারা ইসলামকে ভালোবেসেই মুসলিম হয়। তাই ৬০০ বছরের শাসনের পরও মেসিডোনিয়াতে মুসলিমের সংখ্যা মাত্র ৩৩ ভাগ।

অষ্টাদশ শতকের একদম শেষের এবং উনিশ শতকের শুরুর দিকে উসমানিয়া সালতানাতে তরুণ তুর্কি আমলাতন্ত্রের জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির প্রভাব বৃদ্ধির জন্য অনান্য এলাকার মতো মেসিডোনিয়ার মানুষও ক্ষুব্ধ হয়। ১৯১২ সালে হাঙ্গেরি, সার্বিয়ার সহায়তায় মেসিডোনিয়া উসমানিয়া সালতানাত থেকে আলাদা হয়ে যায়। ১৯৩০-এর দশকে কমিউনিস্টরা ক্ষমতায় আসে। এরপর ১৯৯০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর থেকে আমেরিকা প্রভাবাধীন তথাকথিত 'গণতান্ত্রিক সরকার' মেসিডোনিয়ার ক্ষমতায়।

এয়ারপোর্টে ঝামেলা হয়নি তবে চুঙ্গিঘরের সামনে বিশাল লাইনে ঘণ্টাখানেক অপেক্ষা করতে হয়। চুঙ্গিঘরের ঝক্কি মিটিয়ে কিছু ইউরো ভাঙ্গিয়ে নিলাম। এয়ারপোর্ট থেকে মূল শহর প্রায় আধা-ঘন্টার রাস্তা। সোজা প্রশস্ত রাস্তা আর মার্সিডিজ বেঞ্চের বেশ আরামদায়ক বাস। রাস্তার পাশের মনোরম দৃশ্য দেখতে দেখতে মূল শহরে পৌঁছে গেলাম। স্কোপিয়াতে নামার পরেই কেন যেন ভালোলাগা শুরু করল। জার্মানির শীত আর ঠাণ্ডা বাতাসে হাঁপিয়ে উঠেছিলাম। স্কোপিয়ার উষ্ণ আবহাওয়া, পিচ ঢালা রাস্তা, বারান্দা বিশিষ্ট বহুতল আবাসিক ভবন; উত্তরাকে মনে করিয়ে দিচ্ছিলো( বারান্দা মুসলিম স্থাপত্যের বৈশিষ্ট্য। ইউরোপে ডুপ্লেক্স বাড়িই বেশি, বহুতল বিশিষ্ট আবাসিক ভবন অনেক কম)।

ব্রেমেন থেকে ফ্লাইট ছিল ৯ টায়। খুব সকাল বেলায় বাসা থেকে বের হয়েছিলাম। ক্ষুধা লেগেছে, হালাল রেস্টুরেন্টের খোঁজ করতে হবে। ৩৩ ভাগ মুসলিম, রেস্টুরেন্ট পাবো- সেটা নিয়ে খুব একটা চিন্তা ছিল না। একটু হাঁটার পরেই সিটি সেন্ট সেন্টার পার্কে পৌঁছালাম। চমৎকার পার্ক। সারি সারি গাছ। লাল ফুল। হলুদ ফুল। নীল ফুল। সাদা ফুল। আরো নানান রঙের ফুল আর বসার জন্য বেঞ্চ। কমিউনিস্ট শাসনের চিহ্ন চোখে পড়া শুরু করল। এর আগে কখনো কমিউনিস্ট প্রভাবাধীন দেশে যায়নি। অভিজ্ঞতা একদমই নতুন। লেলিন, কাল মার্কস, জোসেফ স্ট্যালিনসহ কমিউনিস্টদের সব রথি-মহারথির ভাস্কর্যে ভরা সিটি পার্কসহ স্কোপির পশ্চিম অংশ। পার্ক পার হলেই মেসিডোনিয়া গেট। মেসিডোনিয়া গেট হুবহু বার্লিন গেটের মতো। গেটের দুই পাশে লেলিন এবং নরেয়া ভেটার (নামের উচ্চারণ নিয়ে আমি নিশ্চিত না) দুটি প্রকাণ্ড ভাস্কর্য। কমিউনিস্ট মেসিডোনিয়াতে গির্জা এবং মসজিদ অনেকটা নিষিদ্ধ ছিল। ভাস্কর্যের এই বাহুল্য দেখে মনে হলো গির্জা তারা বন্ধ করে দিয়েছিল, কিন্তু গির্জা বন্ধ করে লেলিনকে জিসাস ক্রাইস্ট বানানোর চেষ্টা করেছিল।

খাবারের দিকে স্কোপিয়া ইউরোপের অন্য শহরগুলোর চেয়ে সমৃদ্ধ। কাবাব, জুস, আইসক্রিম, বাদাম, চা, নানান পদের মিষ্টি। দামও খুব একটা বেশি না। মুসলিম তুর্কি ও মেসিডোনিয়ার স্থানীয় সাংস্কৃতির মিশেলের জন্য খাবারের এই বৈচিত্রতা। দুপুরের খাবার শেষে এয়ার বিএনবিতে বুক দেয়া বাসায় গেলাম। পাহাড়ের উপরে বাসা। বারান্দায় এসে মন ভালো হয়ে গেল। পুরো শহরের একটা ভিউ দেখা যাচ্ছিল বারান্দা থেকে। পাহাড়ি রাস্তা পেরিয়ে বাড়িটা। রাস্তার দুইপাশে সারি সারি বাড়ি। প্রতিটা বাড়ির সামনে বাগান। বাগানে চেরি, আঙ্গুরসহ নাম না জানা বিভিন্ন ফলের গাছ। একদম আদর্শ বাড়ি বলতে যা বোঝায়। দুপুরের পর কিছুটা বিশ্রাম নিয়ে বের হয়ে গেলাম সিটি সেন্টারের দিকে। স্কয়ারের পাশে আলেক্সান্ডার দ্য গ্রেটের একটা বিশাল মূর্তি। মূর্তির পাশে প্রায় ছয়শ বছরের পুরনো ব্রোঞ্জ ব্রিজ। এই ব্রিজ পেরিয়েই ওল্ড টাউন আর স্কোপিয়া দূর্গ। রক্ষী জানিয়ে দিলো আজ দুর্গে প্রবেশ সম্ভব নয়; দ্বার রুদ্ধ, সুতরাং অগত্যা...

এই স্কোপিয়াতে জন্ম নিয়েছিলেন মাদার তেরেজা, যার মহানুভবতার আলো মানুষের মনকে আলোকিত করছে যুগের পর যুগ। মাদার তেরেজা যাদুঘর শহরের কেন্দ্রের পাশেই। স্কোপিতে এসে এই যাদুঘর না গেলে সেটা হবে অপরাধ। মাদার তেরেজার ব্যবহার করা কিছু তৈজসপত্র, পোশাক, লেখা চিঠি সংরক্ষিত আছে এই যাদুঘরে। বের হবার সময় মনে মনে বললাম, আপনার মতো বিশাল হৃদয়ের মানুষ প্রতি ঘরে ঘরে জন্ম নিক। আমাদের পৃথিবীটা হোক আরো সুন্দর...

স্কোপিয়ার ওল্ড সিটিতে হাঁটতে হাঁটতে মাটির একটা গন্ধ পাবেন। পরিবেশ অনেকটা আমাদের পুরান ঢাকার মত। রাস্তার পাশে কাবাব, চা, কফির দোকান, সুভিনিয়রের দোকান। কাবাবের দোকানগুলোতে অনেকটা ধাবার মতো চেয়ার-টেবিল সাজানো। কাবাবের স্বাদ ভিন্ন, একদম ফ্রেস সেটা অনুভব করতে পারছিলাম! শহর দেখতে দেখতে সন্ধ্যা হয়ে এলো, হঠাৎ যেন কত কাল পরে শুনতে পেলাম... হাইয়া আলাস সালাহ, হাইয়া আলাল ফালাহ... নামাজের দিকে আসো, কল্যাণের দিকে আসো। আজান! জার্মানিতে মাইকে আজান দেবার অনুমতি নেই। অনেক দিন হয়ে গেছে আজান শুনি না।

মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনলাম। কী মোহময় সুরধ্বনি... যেন কলবের ভেতর ভরে পবিত্র বারুদ ছুড়ে দেয় অন্তহীন সীমানায়...

মসজিদ দেখে মুগ্ধতা বেড়ে গেল। সুন্দর মিনার, চমৎকার স্থাপত্য শৈলী। এই মসজিদের নাম মোস্তফা পাশা মসজিদ। ১৪৯২ সালে, উসমানিয়া মন্ত্রী মোস্তফা পাশা এই মসজিদ নির্মাণ করেন। ছেলে-মেয়ে উভয়েরই নামাজের ব্যবস্থা আছে। ছেলেদের পাশাপাশি অনেক মেয়েও মসজিদে যাচ্ছে। নামাজ শেষে এক মেসিডোনিয়ান ভাই নিজে থেকে এসেই সালাম দিলো। কোথায় থাকি, কত দিন হলো এসেছি, অনেক কথা!

মেসিডোনিয়াতে মুসলিমদের অবস্থা কেমন জানতে চাইলাম,

...মেসিডোনিয়াতে মুসলিমের সংখ্যা প্রায় ৫০ ভাগ। কিন্তু সরকার সেটা প্রকাশ করে না। স্কোপিয়ার এই অংশ মুসলিমপ্রধান৷ পুরো মেসিডোনিয়াতে যেখানেই যান মিনার দেখতে পাবেন। আমরা ইসলামকে মন থেকে ধারণ করি!

মনটা ভালো হয়ে গেল। ভিন্ন রঙ, ভিন্ন জাতিসত্তা, ভিন্ন ভাষা, জীবনে প্রথমবার দেখা কিন্তু কী আন্তরিকতা! মনে পরে গেল আল মাহমুদকে-

আমরা আমাদের সঙ্গীদের চেহারের ভিন্নতাকে গ্রাহ্যের মধ্যে আনি না,
কারন আমাদের আত্মার গুন্জন হু হু করে বলে
আমরা একাত্মা, এক প্রাণ।
কেউ পাথরে, কেউ তাঁবুর ছায়ায়, কেই মরুভূমির উষার বালু কিংবা সবুজ কোন ঘাসের দেশে চলছি।
আমরা আজন্ম মিছিলেই আছি...

নামাজ শেষে আবার যাত্রা শুরু। শহরের পথে পথে। বারগের নদীটা একদম আদর্শ পাহাড়ি নদী। খুব একটা গভীর না তবে স্রোত প্রচণ্ড। নদীর পাশেই বেশ কয়েকটা জাহাজ আকৃতির রেস্টুরেন্ট, একটু পর পরই বসার জায়গা, খোলা জায়গা। ছুটির দিনে প্রচন্ড ভিড় ছিল। সবাই পরিবারসহ এসেছে সময় কাটাতে। গভীর রাত কিন্তু মনে হলো তাদের কোনো তাড়া নেই। কিন্তু আমার আছে। আগামীকাল সকাল সকাল বের হতে হবে গন্তব্য বলকানের আরো গভীরে, কসোভোর রাজধানী প্রিস্টিনা।

এয়ার বিএনবির বাসায় ফিরতে ট্যাক্সি নিলাম। ভাড়া আমাদের ঢাকার চেয়েও কম। ল্যাম্পপোস্টের নিয়ন আলো, নাগরিক কোলাহল ভেঙে গাড়ি এগিয়ে চলছে পাহাড়ের উপরের দিকে। ড্রাইভার জন ডেনভারের গান চালু করলো : Almost old there, older than the tree, younger than the mountain blowing like a breeze.


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us