বলকানের হৃদয়ে

মীর সালমান শামিল | Jun 26, 2021 03:06 pm
বলকানের হৃদয়ে

বলকানের হৃদয়ে - ছবি সংগৃহীত

 

খুব সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠলাম। স্কোপিয়া ঘোরা শেষ। এবারের গন্তব্য কসোভো; ধ্রুপদি বলকানের অর্থনৈতিক রাজধানী প্রিস্টিনা। ইউরোপে মুসলিমপ্রধান দেশ মাত্র চারটি; কসোভো এর মধ্যে অন্যতম। (বাকী তিনটি আলবেনিয়া, আজারবাইজান ও বসনিয়া-হার্জগোভিনা। মেসিডোনিয়াতে প্রায় সমান, তুরস্ককে ইউরোপে বিবেচনা করলে পাঁচ)। ভৌগোলিকভাবে প্রিস্টিনা বলকান এলাকার ঠিক মাঝামাঝি অবস্থিত। এই অবস্থানের কারণে প্রিস্টিনা বাণিজ্যিক কাজের কেন্দ্রবিন্দু ছিল সব সময়। প্রিস্টিনা পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীনতম জীবন্ত শহর। প্রায় ১০ হাজার বছর ধরে মানুষ অব্যাহতভাবে এ শহরে বসবাস করছে। গত ১০ হাজার বছরে কসভোর মানুষ ২৭টা সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল। সব আঞ্চলিক এবং বৈশ্বিক পরাশক্তি-ই প্রিস্টিনা শাসন করেছে কোনো না কোনো সময়। তাহলে কিভাবে ইউরোপের এই অংশে ইসলাম ছড়ালো এই প্রশ্নটা মাথায় এলো, সাথে সাথেই মস্তিষ্কের অন্য অংশ জবাব দিল উসমানিয়া সালতানাত! আসলেই তাই। উসমানিয়া সালতানাত ৫০০ বছরেরও বেশি সময় প্রিস্টিনা শাসন করে। তবে এই বলকান অঞ্চলে ইসলাম প্রসারের গল্পটা বেশ চমকপ্রদ। সার্ভিয়ার রাজা স্টিফেন উসমানিয়া সম্রাট বায়েজিদের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করেন। স্টিফেনের বোন লেডি ডেসপিনার সাথে বায়েজিদের বিয়ে হয়। সম্রাজ্ঞী ডেসপিনাকে এই অঞ্চলের মানুষ খুবই ভালোবাসত। তার প্রভাবেই সার্ভিয়া, বসনিয়া, কসোভো, আলবেনিয়া, মেসিডোনিয়া অঞ্চলে ইসলাম ছড়িয়ে পরে।

এর আগে, ১৩৮৯ খ্রিষ্টাব্দে কসভোর যুদ্ধে মধ্য ও পুর্ব ইউরোপের মিলিত শক্তি উসমানিয়া সুলতান মুরাদের কাছে পরাভূত ও পর্যুদস্ত হলে সার্ভিয়ার রাজা স্টিফেনের মত আনেকেই উসমানিয়া সুলতানের আনুগত্য স্বীকার করে মিত্র হয়। সুলতান বায়েজিদ ছিলেন সুলতান মুরাদের পুত্র। তবে স্টিফেন ছাড়া সকলেই বিশ্বাস ঘাতকতা করে। স্টিফেন যত দিন জীবিত ছিলেন তত দিন শত প্রতিকূলতা, সমগ্র খ্রিস্টান ইউরোপের ক্রোধের শিকার হয়েও নিজের ওয়াদা রক্ষা করেছেন। ১৩৯৪ পোপ নবম বেনিফেসের নির্দেশে সমগ্র ইউরোপ যখন সুলতান বায়েজিদের বিরুদ্ধে ক্রুসেড ঘোষণা করে, খ্রিস্টান হওয়া সত্ত্বেও স্টিফেন 'ক্রুসেডে যোগ দেননি। ক্রুসেডে যোগ না করায় ইউরোপের মিলিত শক্তি আক্রমণ করে স্টিফেনকে হত্যা করে এবং রাজ্য ধ্বংস করে। পরে উসমানিয়ারাও মিত্র এবং আত্মীয় স্টিফেনকে হত্যার প্রতিশোধ নিয়েছিল।

***
স্কোপিয়া থেকে প্রিস্টিনা ৩/৪ ঘণ্টার রাস্তা তবে আসলে ঠিক কত সময় লাগবে তা নির্ভর করবে চুঙ্গিওয়ালার উপর। মাইক্রোর বড় ভাই আর মিনি বাসের ছোট ভাই জাতীয় একটা বাহন আমাদের প্রিস্টিনা নিয়ে যাবে। বাহনটি শহর ছেড়ে গ্রামের দিকে যাত্রা শুরু করল। আমাদের দেশের মতোই দোকানের সামনের ফুটপাতে নানা পণ্যের পসরা সাজানো। শহর ছাড়াতেই রাস্তার পাশে পাহাড়, খামার আর বাগান দৃশ্যমান হলো। রাস্তাটিও বেশ চমৎকার। লম্বা-প্রসস্ত, অনেকটা জার্মানির অটোবানের মতো। ভালই লাগছিলো ভ্রমণ। কখন সীমান্তে পৌঁছে গেছি টের পাইনি। হঠাৎ বাধ সাধলো বেরসিক চুঙ্গিওয়ালা। আমাদের সবার পাসপোর্ট আর রেসিডেন্ট পারমিট নিয়ে গেল। মিনিট বিশেক কী যে করলো আল্লাহ মালুম। আমরা রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলাম। আমি হাসনাইন ভাইকে বললাম, চলেন আমরা স্থিরচিত্র ধারণ করি। যে কথা সেই কাজ। মুঠোদূরালপনীর ক্যামেরার সদ্ব্যবহার শুরু করলাম। এখানেও বাধ সাধলো চুঙ্গিওয়ালী আপু৷ শুধু বাধ সাধা না, আপু মনে হলো কিঞ্চিৎ ভয় পেয়ে গেছেন৷ নো- পিকচার! তার এই ভয়ের কারণ হাসনাইন ভাইয়ের ভুড়ি নাকি আতিফ ভাইয়ের দাড়ি আমি সেই রহস্য ভেদ করতে পারলাম না।

আরো মিনিট পাঁচেক অপেক্ষার পর চুঙ্গি আপু সদয় হলেন, আমাদের পাসপোর্টে একটা ছাপ লাগিয়ে দিলেন। যাত্রা আবার শুরু হলো। তাপমাত্রা ধীরে ধীরে বাড়ছে, কসোভোতে বাতাসের সাথে জলীয়বাষ্পের উপস্থিতিও অনুভব করতে পারলাম। ঘামতে শুরু করলাম।

***
জার্মানিতে মুসলিম ৬ থেকে ৭%। প্রচুর টার্কিশ কাবাবের দোকান। তবে কোনো ফাস্টফুড শপ নেই। কত দিন হয়ে গেছে চিকেন ফ্রাই, পিজ্জা, পাস্তা কিংবা বার্গার খাই না...

কসোভো আসার আগেই বলে রেখেছি সবাইকে বলে রেখেছি গিয়ে প্রথমেই একটা ফাস্টফুড শপে ঢুকে এই খাবারগুলো অর্ডার করবো। গাড়ি প্রিস্টিনা ঢুকতেই জানালা দিয়ে খুঁজতে শুরু করলাম। ১০ হাজার বছরের শহর কিন্তু দেখে মনে হচ্ছে না। সব স্থাপনা একদমই নতুন তবে পরিকল্পিত না। বাস থেকে নামার পরে গরমের ঝাঁজটা আরো ভালোভাবে বুঝলাম। বাস নামিয়ে দিয়েছে শহরের কেন্দ্র থেকে একটু দূরে। কেন যেন ট্যাক্সি না বহু বছরের বিশ্বস্ত ওপরওয়ালা প্রদত্ত পদযুগলের উপর ভরসা করে হাঁটা শুরু করলাম। অগোছালো শহর, বাস-ট্যাক্সির ভেঁপু, হাঁটতে ভালো লাগছিল না তবে নতুন শহরের প্রতি মানুষের স্বাভাবিক আকর্ষণের কারণে অতটা খারাপও লাগছিল না। আমার গুরু প্রফেসর আব্দুর রাজ্জাক স্যার অনেক আগে বলে গেছেন,
'মৌলবি! একটা কথা খেয়াল রাখন খুব দরকার। যখন কোন নতুন জায়গায় যাইবেন, দুইটা বিষয় পয়লা জাননের চেষ্টা করবেন। ওই জায়গার মানুষ কী খায়। আর পড়ালেখা কি করে। কাঁচাবাজারে যাইবেন, কী খায় এইডা দেখনের লাইগ্যা। আর বইয়ের দোকানে যাইবেন পড়াশোনা কী করে হেইডা জাননের লাইগ্যা।'

কিন্তু সমস্যা হলো কাঁচাবাজার বা বইয়ের দোকান কোনোটাই খুঁজে পেলাম না। আপতত গন্তব্য নতুন প্রিস্টিনার প্রতীক, নিউ বর্ন নামে কিছু একটার দিকে। গাইড আসাদ ভাইয়ের ফোনের ম্যাপ। তবে গুগল আপনাকে সব কিছু জানাবে না, আমাদেরও জানালো না। এক স্থানীয়ের সাহায্য নিতে হলো। এরা ইংরেজি বেশ ভালো পারে। সব বুঝিয়ে দিলো। যা বুঝলাম তা হলো দূরের পথ পায়ের উপর আর ভরসা করা যাচ্ছে না। ট্যাক্সি নিতে হবে। ওই ছেলেটাই ফোন দিয়ে ট্যাক্সি নিয়ে এলো। এত অকৃত্রিম আন্তরিকতা, মন ভালো হয়ে গেল। আমি নাম মনে রাখতে পারি না, ওর নামটাও ভুলে গেছি।

ট্যাক্সিতে উঠে শান্তি লাগল। মার্সিডিজ বেঞ্চের নতুন কার। তবে তার চেয়েও অসাধারণ হলো ভাড়া একদমই কম। ট্যাক্সি ড্রাইভারও ভালো ইংরেজি পারে। এখানে একটা পরামর্শ দেই, কখনো বেজোড় সংখ্যক মানুষ নিয়ে ভ্রমণে বের হবেন না। সংখ্যা রাখবেন ৪ অথবা ৮। আমরা ছয়জন। দুটি ট্যাক্সি নিতে হয়েছে। বেশি খরচ হয়েছে।

আমরা যাচ্ছি এই নিউ বর্নে। কিন্তু বস্তু সম্পর্কে কিছুই জানতাম না, তাই আগ্রহী ছিলাম। কিন্তু এরপরে আমি যা দেখলাম! তার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না..।

একটা ভবনের সামনে রোমান হরফে লেখা 'NEW BORN', কিন্তু এর মাজেজা কী বুঝলাম না। দেখি সবাই তাদের যন্ত্র দিয়ে ছবি তুলছে, আমরাও তুললাম। মুস্তাফিজ ভাইকে বললাম, ভাই! আমি ক্লান্ত, শ্লান্ত ও ক্ষুধার্ত। মধ্যাহ্ন ভোজের একটা যোগাড় করেন! শুরু হলো কসোভোর স্থানীয় খাবারের দোকান খোঁজা। একদম গরু খোঁজা খুঁজলাম। কিন্তু ভাগ্যে নেই, অগত্যা যেতে হলো ইস্তামবুল; ইস্তামবুল কাবাব শপে।

খাবার শেষে গেলাম পাশের মসজিদে গেলাম নামাজ পড়তে, পাহাড়ের বরফ গলার পানির মত ঠাণ্ডা পানি দিয়ে অজু করার পর শরীরের সাথে মনেও যেন একটা শান্তির পরশ বয়ে গেল। মসজিদে যাবার পথে কয়েকজনকে সালাম দিয়েছিলাম, সবাই খুবই অবাক এবং তার চেয়েও বেশি খুশি হচ্ছিল। আমারাও বেশ মজা পাচ্ছিলাম সালাম দিয়ে। কমিউনিস্ট প্রভাব এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি কসোভো। ধর্ম এখনো সেভাবে জীবনে স্থান করে নিতে পারেনি সম্ভবত। এরপর একটা অদ্ভুত দর্শন মূর্তি দেখলাম, স্ট্যাচু অব লির্বাটির দুঃসম্পর্কের খালাতো বোনের মতো লাগল। এটা প্রিস্টিনার দর্শনীয় স্থান! আমি বিমোহিত!

বিল ক্লিনটন প্রসিডেন্ট থাকা অবস্থায় আমেরিকা কসোভোকে বড় ধরনের সাহায্য করেছিল, তা স্মরণ রাখতে কসোভো বিল ক্লিনটনের নামে একটা রাস্তা এবং বিশাল মূর্তি বানিয়েছে। ওই রাস্তাতেই ছিলাম তবে কেন যেন সেই মূর্তি দেখার ইচ্ছা হল না। আমাদের সেলফি মাস্টার আতিফ ভাইও সেলফি তোলার জোস পাচ্ছিলেন না। পরিকল্পনা ছিল রাত পর্যন্ত প্রিস্টিনা থেকে রাতে আলবেনিয়া যাত্রা করবো। সেটা বাদ দিয়ে বিকালেই যাওয়া ঠিক হলো। আবার ফিরলাম টারমিনালে। আমার পাস্তা খাওয়াও হলো না। আলবেনিয়াও মুসলিম দেশ, মনকে সান্ত্বনা দিলাম।

টিকেট নিয়ে আবার বসে পড়লাম সেই অদ্ভুত বাহনে। আমার সিংগেল সিট। পেছনে ডাবল সিটে মুস্তাফিজ ভাই আর আসাদ ভাই। পাশের ডাবল সিটে শান্ত ভাই আর হাসনাইন ভাই। আতিফ ভাই এক ম্লেচ্ছকে দোস্ত বানিয়ে ফেলেছে তাই সামনের দিকে সিটে তার সাথে বসেছে।
একটা কথা আছে তিনজন ব্রিটিশ এক হলে একটা ক্লাব বানায়, তিনজন জাপানি এক হলে একটা যন্ত্র বানায় আর তিন বাঙালি এক হলে করে দলাদলি। সেখানে পাঁচজন বাঙালি আড্ডা দেবার মতো অবস্থানে বসে আছি।

দেশ থেকে হাজার মাইল দূরে থাকলেও শতভাগ বাঙালি রক্ত শরীরে প্রবাহমান! আমরাও শুরু করলাম আড্ডা। রাজনীতির দলাদলি, ইতিহাসের অলি-গলি এবং সাম্প্রতিক বিশ্ব সবই এলো একে একে। আমাদের আড্ডা চলছে, পৃথিবীও চলছে তার আহ্নিক গতিতে, এই কারণে পশ্চিমে ঢোলে পড়ছে সূর্য, দিন পেরিয়ে আসছে সন্ধ্যা, রাত। গাড়িও ছুটে চলছে আমাদের নিয়ে তীব্র গতিতে, নাসির উদ্দীন আলবানির দেশ আলবেনিয়ার দিকে।


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us