বলকানের হৃদয়, তিরানার ছোঁয়ায়

মীর সালমান শামিল | Jun 27, 2021 02:00 pm
বলকানের হৃদয়, তিরানার ছোঁয়ায়

বলকানের হৃদয়, তিরানার ছোঁয়ায় - ছবি সংগৃহীত

 

বলকান ভ্রমণে পরের গন্তব্য আলবেনিয়ার রাজধানী তিরানা। এই তিরানা সম্পর্কে তেমন কিছুই জানি না। শুধু জানি আলবেনিয়া ইউরোপের পাঁচটি মুসলিম দেশের অন্যতম (বাকি চারটা- তুরস্ক, কসেভো, আজারবাইজান, বসনিয়া)। এরা অনেক দিন সোভিয়েত বলয়ের মধ্যে ছিল। প্রিস্টিনা থেকে তিরানা মাইক্রোবাস যায়। বেশ দ্রুতগামী, কিন্তু মাইক্রোর চেয়ে বাসই আমার বেশি প্রিয়। কিন্তু বাস অনেক পরে অগত্যা মাইক্রোতেই চেপে বসতে হলো। মারসিডিজ ব্রান্ডের নতুন মাইক্রো, ফাঁকা রাস্তা। মাইক্রো তীরের বেগে চলতে শুরু করল। তিরানা যাবার রাস্তাটা অদ্ভূত সুন্দর। সারি সারি বাগান, লেক আর পাহাড়। একটার পর একটা, ছবির মতো করে সাজানো- আম গাছ, জাম গাছ, লিচু গাছ হেন, মিলেমিশে আছে ওরা আত্মীয় যেন।

তিরানা পৌঁছাতে রাত ১০টা বেজে গেল। শহরে নেমেই মনটা ভালো হয়ে গেল কোলাহল এবং ঠাণ্ডা বাতাসে। শহরটা রাতের বেলার নিকেতন বা বারিধারার মতো। তবে অনেক মানুষ, আমাদের টিএসসির মতো না তবে প্রাণবন্ত শহর। জার্মানির বেশিরভাগ শহরই নীরব। কয়েক দিন দিন হয়ে গেছে ভাত খাওয়া হয় না। ভাত না খেতে পারলে বাঙালির তৃপ্তি হয় না, আমাদেরও হয়নি। আমাদের শেফ মুস্তাফিজ ভাইয়ের নেতৃত্বে বাজার করলাম। এবার গুরুর কথা মানার সুযোগ পেলাম, যেটা কসোভোতে পাইনি।

আমার গুরু বলেছিলেন, 'মৌলবি! একটা কথা খেয়াল রাখন খুব দরকার। যখন কোন নতুন জায়গায় যাইবেন, দুইটা বিষয় পয়লা জানার চেষ্টা করবেন। ওই জায়গার মানুষ কী খায়। আর পড়ালেখা কি করে। কাঁচাবাজারে যাইবেন, কী খায় এইডা দেখনের লাইগ্যা। আর বইয়ের দোকানে যাইবেন পড়াশোনা কী করে হেইডা জাননের লাইগ্যা।'

আলবেনিয়ার বাজার দেখলাম। এদের খাবার, খাবারের দোকান অন্য ইউরোপীয় দেশের মতোই। খাবারের ভিন্নতা নেই। অর্থাৎ গুরুর কথানুসারে মুসলিম দেশ হলেও এরা মোটামুটি ইউরোপীয় বৈশিষ্ট্যই হবে, অন্তত তিরানাতে। দেখি গুরুর কথা কতটা মেলে!

জিনিসপত্রের দাম মেসিডোনিয়ার তুলনায় বেশি। এয়ার বিএনবির বাসায় ঢুকেই এক গ্রুপ গেল গোসল করতে, আর আমরা এক গ্রুপ রান্নায়। এরপর কাজ অদল-বদল। তবে মুস্তাফিজ ভাই মহান মানুষ, একাই ৬০/৭০ ভাগ করছেন! আমরা দোয়া করলাম, আল্লাহ উনাকে জান্নাতে এর চেয়ে নিযুতগুণ সুস্বাদু খাবারের ব্যবস্থা করে দেন।

রাত ১২টার দিকে বের হলাম। রাত সিটি ট্যুরের জন্য আদর্শ সময়। যদিও তাবৎ কবি-সাহিত্যিক রাতকে ভিলেন হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন সবসময়। আমার কাছ রাতই প্রিয়। রাতের আছে ভাষা, গভীর ভাব বিনিময়ের ক্ষমতা। রাতকে বোঝা কঠিন; উপলব্ধি করা কঠিনতর। প্রকৃতির রহস্যময়তা দু-হাত ভরে ঢেলে দেয় রাতে। তিরানার রাত আমাকে মনে করিয়ে দিলো জাদুর শহরকে... টিএসসি, পলাশী, বুয়েট, পুরান ঢাকা, উত্তরা।

শুক্রবার রাত ইউরোপীয়দের জন্য সাপ্তাহিক উৎসবের দিন। শনি-রোববার ছুটি, শুক্রবার রাতে সবাই যায় ক্লাবে। তিরানাতেও একই অবস্থা। দলে দলে সবাই ক্লাবে যাচ্ছে। আমরা আছি তিরানার গুলশানে, একটু পর পরই ক্লাব। কিশোর থেকে শুরু করে থেকে বৃদ্ধ- সবাই যাচ্ছে বা আসছে ক্লাব থেকে। গুরুর কথা তিন ঘণ্টার মধ্যেই ফলে গেল!

এরাও ভালো ইংরেজি জানে। তবে ইউরোপের অন্য দেশ থেকে একটা পার্থক্য চোখে পড়লো, কসোভোতেও লক্ষ্য করেছিলাম। প্রচুর কিশোর/তরুণ। ইউরোপের অন্য দেশগুলোতে বয়স্ক মানুষের সংখ্যা বেশি। তিরানার রাস্তাগুলো খুব একটা প্রসস্ত না। ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে রাস্তার একটা নির্দিষ্ট ছাঁচ আছে, সাইকেল চলার রাস্তা, হাঁটার রাস্তা মিলিয়ে। এরা ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য হবার পরে এদের রাস্তা ঠিক করতেই অবস্থা খারাপ হয়ে যাবে। সুন্দর শহর, সোডিয়াম লাইট, রাস্তার পাশে সারি সারি গাছ এবং একটা নদী। তবে নদীটা দেখে ভিমড়ি খাবার যোগার। এইটা নদী! আক্ষরিকভাবেই একটা ড্রেন। নদী দেখে হতাশ হয়ে ফেরার পথ ধরলাম। বেশি সময় নেই। সকালে যাবো পাশের শহর দুরুজে। আবার সন্ধ্যাতেই যাবো মেসিডোনিয়া। খুবই ব্যস্ত দিন অপেক্ষা করছে। গুগল সাহেবের কথা অনুসারে দুরুজে চমৎকার একটা বিচ আছে। অনেক দিন সমুদ্রে নামি না...

সকালে রাস্তার ধুলা-বালি পেরিয়ে গেলাম বাস স্ট্যান্ডে। তবে ট্যাক্সিতে ছিলাম, ধুলা শরীর স্পর্শ করেনি। এখানেও ট্যাক্সি ভাড়া খুবই কম। প্রায় ৪০/৫০ মিনিট ট্যাক্সিতে গিয়ে ভাড়া এলো ৫/৬ ইউরো। চেপে বসলাম দুরুজগামী বাসে। দুরুজ পৌঁছাতে ১.৫/২ ঘন্টা লাগবে। বেশ আরামদায়ক বাস, ভাড়া ১ ইউরো। ভাড়া দেখেই মনটা ভালো হয়ে গেল। যাত্রাপথে ঘুমাতে পারে একটা বড় ধরনের যোগ্যতা। আমার এক বিচারক বন্ধুর এই বিষয়ে পিএইচডি ডিগ্রি আছে৷ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসে উঠে বসেই ২/৩ মিনিটের মধ্যে ঘুমিয়ে যেত। আমার এই প্রতিভা সামান্য আছে। কাজে লাগানোর চেষ্টা করলাম। অপেক্ষা সমুদ্রের। তবে সমুদ্র দেখে হতাশ হলাম... এর থেকে আমাদের বাঁশ বাড়িয়া ঘাট অনেক ভালো। তবে এতেই দেখি অনেক মানুষ। সবাই বেশ খুশি প্রাণবন্ত!! এরা কক্সবাজার চেনে না...

বিচের কিনারে অনেকগুলো রেস্টুরেন্ট। খুবই ক্ষুধার্ত ছিলাম। একটা রেস্টুরেন্ট দেখে বসে পরলাম। এবার শুরু হলো আরো বড় বিপত্তি। এরা ইউরো গ্রহণ করে তবে মাস্টার কার্ডে বিল নেয় না। শুধু এরা না আশেপাশের কোনো রেস্টুরেন্টই মাস্টার কার্ডে বিল নেয় না। কাছে আলবেনিয়ার টাকা নেই। অনেক খোঁজাখুঁজি করে সব মিলিয়ে ৩৬ ইউরো হলো। রেস্টুরেন্টের ম্যানেজারকে বললাম সমস্যার কথা। ম্যানেজার খুবই সজ্জন ব্যক্তি। আমাদের ৩৩ ইউরোর একটা মেনু বানিয়ে দিলো। পাউরুটি, সালাদ, পানি, পনির আর সামুদ্রিক মাছ৷ পরিমাণ প্রয়োজনের চেয়ে বেশি। প্রথমে পাউরুটি নিলাম। আলতো করে সেঁকে উপরে গুড়া গুড়া মাখনের দানা ছড়ানো। স্বাদ একদম অন্যরকম। এরপর নিলাম সালাদ আর পনির। সালাদটা একদম ফ্রেস। মুখে দিতেই তৃপ্তির ভাব চলে এলো। এ ধরনের খাবারে আমি একদমই অভ্যস্ত না। তবে মনে হলো এই পাউরুটি আর পনির অনায়াসে আমাদের মসুরের ডাল আর আলুভাজির সাথে টেক্কা দিতে পারবে। এরপর মাছ। বঙ্গ সন্তান হবার পরেও আমি মাছ খুব একটা পছন্দ করি না। ছোট মাছ, চিংড়ি আর ইলিশ- আমার দৌড় এ পর্যন্তই। কিন্তু এই মাছ মুখে দিতেই। মচমচে ভাজা, একটুও আঁশটে ভাব নেই, আর স্বাদ? অতুলনীয়! এখনো মুখে লেগে আছে!! দুপুরের খাবারটা হলো আলবেনিয়ার সবচেয়ে অসাধারণ অভিজ্ঞতা! যদিও মাত্র এক ঘন্টা আগেই আদেও খাওয়া হবে কিনা সেটা নিয়ে দুঃচিন্তায় ছিলাম ক্রেডিট কার্ড কাজ করছিলো না বিধায়। অথচ এটাই হল ট্যুরের ভোজনবিলাস!

ফাবি আইয়ে আলা ইয়ে রব্বি কুমা তুজায্ যিবান
'অতঃপর তোমরা তোমাদের রবের কোন কোন নিয়ামতকে অস্বীকার করবে?'

খাবার খেয়ে নামলাম সমুদ্রে। কক্সবাজার এবং সেন্টমার্টিন গুলে খেয়ে ফেলা আমার কাছে এই সৈকত তেমন কিছু হবার কথা না, তবে অনেক দিন পর সমুদ্রে নামা তাই মনটা প্রফুল্ল হয়ে গেল। প্রথমবারের মতো পানির নিচে সেলফি তুললাম এবং জেলিফিশ দেখলাম। এই জেলিফিশ জিনিসটা বেশ ভয়ংকর। বেশি গভীরে গেলাম না তাই। ঘণ্টাখানিক দাপাদাপি করে, আশেপাশে হাঁটাহাঁটি করলাম কিছুক্ষণ। জার্মানির ঠাণ্ডায় আধমরা ছিলাম এবার আলবেনিয়ার গরমে অবস্থা কাহিল। রোদটা গায়ে লাগছিলো বেশ। দেখতে দেখতে বিকাল হয়ে গেল। আলবেনিয়ারকে বিদায় জড়ানোর সময় এসেছে৷ এবার গন্তব্য মেসিডোনিয়ার ছোট্ট পর্যটন শহর অহরিদ৷ সেখানে আছে বিখ্যাত অহরিদ লেক, পাহাড় আর পাহাড়ি বন....

ট্যুরটা বেশি রাস হয়ে যাচ্ছে। আমি প্রচণ্ড অলস মানুষ। শান্তি হচ্ছে না এত তাড়াহুড়োতে। কিন্তু কিছুই করার নেই, সবকিছু আগে থেকেই ঠিক করা। বিকাল ৫টায় বাস ছাড়ার কথা, কিন্তু ঘড়ির কাঁটা ৬-এর কাছাকাছি, বাসের পাত্তা নেই। শুধু বাংলাদেশ না, ইউরোপেও বাস দেরি করে। সাড়ে ৬টার দিকে অবশেষে বাস এলো। বাস প্রায় ফাঁকা, মনটা ভালো হয়ে গেল। তবে উঠেই বুঝতে পারলাম ঝামেলা অন্য জায়গায়। এসি কাজ করছে না ভালো। বাসের মধ্যে ভ্যাবসা গরম। একটা জ্বালাময়ী বাস ভ্রমণের জন্য মনকে প্রস্তুত হতে বললাম...


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us